॥কিস্তি-পাঁচ॥
আমি ঘরে ফিরে আসি। কিছুক্ষণ পরই ছাত্ররা আসতে শুরু করবে। তার আগে বাচ্চাদের নাস্তা খাইয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে ওদের বাবার সঙ্গে। চুলায় দুপুরের রান্না চাপাতে হবে। মেয়েরা বাড়ি ফিরে খাবে। তার আগে গোসলটাও সেরে নিতে হবে। গোসল করতে করতে ভিজিয়ে রাখা এক বোল কাপড় ধুতে হবে। কাজের বুয়াটাকে বাদ দিয়ে দিয়েছি এ মাস থেকে। টানতে পারছি না আর। ২০ ছাত্রের ব্যাচ পড়িয়ে বেলা সাড়ে দশটা বাজে হাজিরা দিতে হবে স্কুলে। মাস শেষে বেতন ১৭০০ টাকা। এখানে গরু-গাধার মতো ক্লাস নিতে হয়। কোনো সাবজেক্টের বালাই নেই। বাংলা-অংক-ইংরেজি-সমাজ-বিজ্ঞান-ধর্ম—সব বিষয়ে ক্লাস নিতে হয়। কে কোন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছে, তার থোড়াই কেয়ার করে প্রশাসন। দিনে ১২/১৬ টা ক্লাস নিতে হয়। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত। তখন ঘোর আকালের সময় আমার। পাড়ার কমিউনিটির স্কুল। ৮ বছরের চাকরি বিরতির পর কে কাকে চাকরি দেয়? এটুকু যে আমার মিলেছে, তা-ই অনেক। মেয়েদের বাবা চাকরিবিহীন ছয় মাস। ব্যাংকে জমা রাখা সব টাকা তোলা শেষ। সব এফডিআর ভাঙা হয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছে ছয় মাসের। মেয়েদের স্কুলের বেতনও ছয় মাসের বাকি। হঠাৎ একদিন দেখি, ঘরে আর কোথাও কোনো টাকা নেই। আঁৎকে উঠি
—হায় হায়। মেয়েরা ঘরে ফিরে খাবে কী?
আঁতিপাতি করে খুঁজি এখানে সেখানে। আলমারিতে রেখে দেওয়া পার্সগুলোতে। কোথাও কি কিছু টাকা রয়েছে। অন্তত আজকের চালটা কেনা যায়। নাহ্। কোথাও কোনো টাকা নেই। আমি এখন কী করবো, কোথায় যাবো? কার কাছে টাকা ধার করবো? কে দেবে আমাকে টাকা?
—জয়ের বাবা। জয়ের বাবা।
দুই তিনবার ডাকার পর টিভি থেকে কান সরায় জয়ের বাবা। কিন্তু চোখ সরায় না। সে খুব মনোযোগে একটা ইংরেজি সিনেমার শট দেখছে।
—কী হয়েছে? বলো।
—এদিকে তাকাও।
খুব বিরক্তি হয়ে মারাত্মক অপরাধ করেছি এমন করে টিভি থেকে চোখ সরিয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় আমার দিকে।
—বলো
—ঘরে কোনো টাকা নেই।
—কী করা? এমন তো ছ মাস ধরেই চলছে।
—না না তেমন নয়। আজ আর কোথাও কোনো টাকা নেই।
—দেখোনা, কোথাও থাকতে পারে।
তার দৃঢ় বিশ্বাস আমার কাছে টাকা আছে। কিন্তু ছ’টা মাস ঢাকা শহরে চাকরিবিহীন সংসারটা টানতে যে গুনেবেছে রাখা কয়টি মাত্র টাকা শেষ হয়ে যায়, তা যেন সে জানেই না। তার ভাব আমি বুঝি। তাই আমার কণ্ঠ রূঢ় হতে শুরু করে।
—ছ’মাস ধরে ঘরে বসে আছো। চাকরি নেই। ঘরে বসে বসে টিভি দেখছো। বাচ্চাদের খাবার ভাতটা, রান্না করার চাল নেই ঘরে। তুমি জানো?
নির্বিকার জয়শ্রীর বাবা। বলে—আমি কী করবো?
—তুমি কী করবে মানে? লজ্জা নেই তোমার? ছোট ছোট দুটো মেয়ে তোমার। তুমি জওয়ান পুরুষ। ওদের মুখে খাবার দেবার দায়িত্ব কার? আমার একার? জমানো যা ছিল টাকা পয়সা সব শেষ। ঘরে ব্যাংকে কোথাও আর একটি টাকাও নেই।
আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
—আমার মেয়েরা ঘরে এসে কী খাবে? তুমি কী মানুষ?
একথা বলার পর হনুমানের মতো একলাফ দেয়। আমি ভয় পেয়ে যাই। এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ঘাড়ে। লাগিয়ে দেবে কয়েক ঘা। তা না করে সে টিভি বন্ধ করে। কপালের কুঁচকানো ভাঁজটা কন্সটেন্ট লেগে থাকে কপালেই।
—বলো কী করতে হবে?
—চালের ব্যবস্থা করো। মেয়েদের মুখে অন্তত সাদা ভাত দিতে পারবো।
খুব কঠিন স্বরে কথাগুলো বলার পর আমার বেশ খানিকটা স্বস্তি ফিরে আসে। রাগ আর দুঃখটা খানিক কাটে। আর মনে হয় এবার তার সম্বিত ফিরে পাবে। কিন্তু নাহ্, ঘণ্টা দেড় চলে যায়। বাজারে যাওয়ার নাম নেই। ওদিকে বেলা বাড়ছে। মেয়েদের স্কুল থেকে ফিরে আসারও সময় হয়ে গেছে। আমি একা বেডরুমে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করি। হয়তো কারও কাছ থেকে ধার টার করবে। কিংবা বাবার বাড়িতেও যোগাযোগ করতে পারে। অবুঝ দুধের বাচ্চার খাবার নেই শুনলে দাদা-দাদি নিশ্চয়ই খাবারের কোনো না কোনো ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু না। তার কোনো বিকার কিংবা বোধ নেই। বেলা ১০টা বেজে গেলো। আমি উঠে পড়ি—কই? কী করলে?
এই প্রথমবারের মতো মাথা নিচু করে সে। কিন্তু কণ্ঠস্বরে উদ্ধতভঙ্গি আমার কান এড়ায় না।
—আমি কী করবো?
রাগে আর দুঃখে আমার সমস্ত শরীর বিদ্রোহ করে ওঠে। পুরো দস্তুর সুস্থ এক যুবক ঘরে বসে বসে টিভি দেখে। ছয় মাস চাকরি নেই তার। কারও কাছে বলে না তার চাকরির দরকার। নাক ডেকে ঘুমায়। তিন আর ছয় বছরের দুটি বাচ্চার মুখে ভাত নেই। বাড়-বাড়ন্ত শরীর ওদের। দুধওয়ালাটাকে দুই লিটার থেকে এক লিটার, এক থেকে আধা, আধা থেকে এক পোয়া করে দুধ দিতে দিতে বিদায় করেছি। দুধের টাকা দিতে পারি না। বাড়িওয়ালাকে ছয় মাস বাড়িভাড়া দিতে পারি না। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারি না। মেয়েদের স্কুলে বেতন বাকি পড়েছে ছয় মাসের। অথচ তার কোনোই ভাবান্তর নেই। চাকরির চেষ্টা নেই। তার বাড়ি থেকে কোনো সাহায্য নেই। ঘরে চাল তরকারিও নেই। ডিম মুরগী তো পরের কথা।
—তুমি কী করবে মানে? তোমার বাচ্চাদের খাবার কে জোগাড় করবে?
আমার কথার ভঙ্গি তার পছন্দ হয় না। চিৎকার করে ওঠে।
—আমি কি ইচ্ছে করে চাকরি ছেড়েছি না কি?
এ কথা শুনে আমার গায়ে আগুন ধরে যায়। আমিও র্ধৈয রাখতে পারি না আর চিৎকার করে উঠি।
—কেন? আমি কি বলিনি তোমাকে তুমি চাকরি করতে গিয়ে কোনো রাজনীতিতে জড়িয়ো না? ওই নেশাখোর মেয়েটাকে তুমি হেল্প করতে পারবে না। ওর কাউন্সেলিং দরকার। তোমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তুমি জানাও যে, ও নেশাখোর । তুমি ওর এসিটেন্সি ঠিকমতো পাচ্ছ না? বলিনি?
—হুম বলেছো। এটা করলে ওর চাকরি চলে যেতো। আমি চাইনি এটা।
—কিন্তু চাকরি তো ও নিজেই ছেড়েছে। সাথে তোমারটাও গেছে। নোংরা আর কলঙ্কিতভাবে গেছে। অন্য মেয়ের চাকরি বাঁচাতে গিয়ে নিজের মেয়েদের মুখের খাবারটাও কেড়ে নিয়েছ।
—বাজে কথা বলোনাতো।
—বাজে কথা মানে? তোমাকে আমি বলেছিলাম কি না, ওই মেয়ের চাকরি রাখতে গিয়ে তোমার মেয়েদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলো না। বলেছিলাম?
—তুমি বললেই হলো?
—তাহলে এখন মেয়েদের খাবার স্কুলের বেতন বাড়িভাড়া এসব নিয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছে কেন?
—ভেবো না। কে বলেছে তোমাকে ভাবতে?
—বাহ! আমি তো মা। তোমার মতো বাবাও আমি কখনো দেখিনি। আরও দুই ঘণ্টা বাদে মেয়েরা বাড়ি আসবে। এখনো ভাত রান্না হয়নি। চালের ব্যবস্থা তুমি করতে পারলে না। বলছ তুমি কী করবে? আমাকে বলছো ভাবতে না। তাহলে বাচ্চাগুলো যাবে কোথায়?
—খায়নি ওরা? যখন চাকরি করেছি খায়নি?
—খেয়েছে। কিন্তু এখন? এইবেলা খাবে না? তাহলে? এখন কি এতদিন খেয়েছে বলে না খেয়ে থাকবে? কতদিন না খেয়ে থাকবে? এইটুকু ছোট্ট বাচ্চাদের কথা এভাবে বলতেও তোমার লজ্জা লাগলো না?
—লজ্জা লাগার কী আছে? চাকরি হলে আবার খাবে।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে রই কয়েক সেকেন্ড। তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠি।
—আর কী বলবে মানে? বলবে চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে। এই মাসের মধ্যেই কিছু একটা করবো। বাচ্চাদের আজকের খাবারের ব্যবস্থা আমি করছি। তুমি একদম চিন্তা করো না। এসব বলবে…
—অত ন্যাকা ন্যাকা কথা আমার আসে না।
আমি স্তম্ভিত হয়ে থাকি।
—সন্তানের খাবার ব্যবস্থা করা, তোমারই দোষে ভুক্তভোগী তিনটি মানুষকে আশ্বাস দেওয়া মানে ন্যাকামি? কী বলতে চাও তুমি?
আমার কথাটা শেষ হয় না। হাতের টিভির রিমোটটা ছুড়ে ফেলে দেয়। জিরাফের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে বেড রুমে ঢোকে। ঠাস ঠুস দাম দুম শব্দে ওয়ারড্রোব খোলে। তারপর শার্ট পরে দড়াম শব্দে আমার মুখের ওপর দরজাটা খুলে বের হয়ে যায়। কোথায় যাচ্ছে কে জানে। গায়ে বডিস্প্রে ছড়াতে ভোলে না। বাতাসে তুমুল ঘ্রাণ ছড়িয়ে চারপাশ ধোঁয়াশা করে বের হয়ে যায়। বডি স্প্রের ঘ্রাণে আমার মাথায় দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন।
কোনোমতে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি। কোনোভাবেই ভেবে উঠতে পারি না কিভাবে কী করবো। স্কুল ছুটির সময় হলো। মেয়েদের কি সে নিয়ে আসবে? না কি আমারই বের হতে হবে। কিচ্ছু বলে যায়নি। ফোন করে জানতে চাইলেও ফোন ধরবে না। আমি তো তাকে চিনি। কাঁথাটা গায়ে টেনে সিলিংয়ের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকি। মনে মনে ভাবি একটা চাকরি করবো। কিভাবে সম্ভব? বড় মেয়েটা হওয়ার পর আট বছরের গ্যাপ। কোথাও কিছু করিনি। কে দেবে এই বয়সে এতদিন কাজ থেকে দূরে থাকা আমাকে চাকরি? মেয়েদের কে দেখাশোনা করবে—এসব ভেবে আমাকেও কিছু করতে দেয়নি। কতবার বলেছি ডে কেয়ার সেন্টারে মেয়েদের রেখে চাকরি করবো। তুমি একটু সাহায্য করলেই চলবে।
—না, লাগবে না। মেয়েদের দেখো।
একসময় মনকে মানিয়ে নিয়েছি। থাক, না হলো আমার ক্যারিয়ার। ওর ক্যারিয়ার ঠিক থাকলেই সব ঠিক। আমার জীবন তো শেষ। আমার আর কী চাইবার আছে? মেয়েরা ঠিকঠাক মতো বড় হতে পারলেই বেশ। ওতে যদি পরিবারে শান্তি থাকে, তাই সই। কিন্তু এখন? এই ছোট বাচ্চা রেখে আমি কিভাবে চাকরি করবো? দেবেই বা কে? ভাই বোন সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এখন তো মেয়েদের খাবার জোগাড় করতে আমাকেই পথে নামতে হবে দেখতে পাচ্ছি। এসব ভাবতে ভাবতে সময় কখন পার হয়ে যায়। কলিং বেলের শব্দে ঘোর কাটে। দরজা খুলে দেখি মেয়েদের নিয়ে ফিরে এসেছে সে। হাত খালি। আমি ভাবছিলাম পাড়ার দোকান থেকে হয়তো দুই-এক কেজি চাল অন্তত আনবে। নাহ। তাও আনেনি দেখে আমি আর রাগ সামলাতে পারি না।
—কী খাওয়াবো ওদের এখন আমি?
আমার চেয়ে দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে ওঠে।
—ব বেশি চড়েছ বলছি। চিৎকার করো না।
—কী বলছ তুমি। বাচ্চাগুলো আমার না খাওয়া। আমি এখন ওদের কী খাওয়াবো? তুমি ওদের বাবা। জবাব দাও।
কথার কোনো জবাব না দিয়ে হন হন করে বের হয়ে যায় আবার। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি সোফায়। বীভৎস লাগে এই মানবচরিত্র। নিজের সন্তানের প্রতি কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ! আমি হতবাক। কিংকতব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকি। বুকে ভয়। কখন মেয়ে ডেকে বলে, মা খেতে দাও। খিদে লেগেছে। হে আল্লাহ পৃথিবীতে কোনো মানুষকে তুমি ধৈর্যের এমন চরম পরীক্ষায় কোনোদিন ফেলো না। এমন নিষ্ঠুরতা তুমি কোনো মাকে দেখিয়ো না। বরং সেই নারীকে তুমি নিঃসন্তান রেখে দিও। এমন সময় দরজায় টোকা। জয়শ্রীর বাবা এসেছে কি! বোধ করি কারও থেকে ধার টার করেছে। মেয়েদের খাবার না দিয়ে কি সে আর চলে যেতে পারবে? শুধু শুধু ভয় পেলাম আমি। নিশ্চয়ই মেয়েদের খাবার নিয়ে এসেছে। মুহূর্তে ক্ষমা করে দেই তাকে। উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলি।
—আন্টি। মা এসব রান্না করেছে । আজ তো পাপিয়ার জন্মদিন, জয়শ্রী আর রাজষির জন্য—বলেই হাত বাড়িয়ে খাবার ভর্তি যে বোলটা এগিয়ে দেয়, তাতে প্রায় চারজন লোকের খাবার।
আমি চোখের জল লুকাতে চেষ্টা করি। পিউ বুঝতে পেরে কোনোদিকে না তাকিয়ে চলে যায়। আমার বুঝতে বাকি থাকে না আমাদের কথাবার্তার কিছু না কিছু পাশের বাসার ভাবির কানে গেছে। আর তারই ফল খাবার পাঠানো। লজ্জায় নিজের কাছে নিজেই মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হওয়ার কথা তখন। কিন্তু না। সত্যি আমি সেদিন একটুও লজ্জিত হইনি। চিরকালের শিক্ষা সংস্কার লজ্জা মান অপমান বোধ সেদিন আমার লুপ্ত হয়ে গেছিল এক মুহূর্তের জন্য। খুব আনন্দ হলো আমার। হেসে উঠলাম নিজের মনেই।
—যাক। মেয়েদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে তবে।
চলবে…