ভাষান্তর ॥ অজিত দাশ
জ্ঞানের সঙ্গে সুফিবাদ সংশ্লিষ্ট নয়। সুফিবাদ সম্পূর্ণভাবে নিবিড় প্রেমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিভাবে সমগ্রের সঙ্গে প্রেমে পড়তে হয়, কিভাবে সমগ্রের সঙ্গে লীন হয়ে যেতে হয়, কিভাবে সৃষ্টি ও স্রষ্টার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে হয়, এসবেরই দীক্ষা দেয় সুফিবাদ। প্রচলিত ধর্ম আমাদের দ্বৈততার শিক্ষা দেয়—স্রষ্টা তার সৃষ্টি থেকে আলাদা, অনেক ঊর্ধ্বে। এসব ধর্মে স্রষ্টাকে ঊর্ধ্বে তুলে দিয়ে তাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। সুফিবাদে স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করা হয়নি। সুফিরা স্রষ্টাকে সব কিছুর মধ্যে অনুভব করে আনন্দে মেতে থাকেন। আর আমিও সেই শিক্ষা দেই।
আমার সন্ন্যাস হচ্ছে আনন্দের সন্ন্যাস। পুনর্জন্মের নয়। রুমি বলেছেন, ‘যতক্ষণ তোমার প্রিয়ার সঙ্গে মিলন না হচ্ছে, ততক্ষণ মরিয়া হয়ে থেকো আর যখন প্রিয়ার সঙ্গে মিলন হবে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠো।’ আর এটাই হচ্ছে সুফিবাদের মূল লক্ষ্য। প্রিয়ার মিলনের অপেক্ষায় কাতর হয়ে থাকা। আমি তোমাদের একটি ভালোবাসাময় পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি । আমি তোমাদের ভালোবাসার পথে ব্রতী করার চেষ্টা করছি। তোমরা ভালোবাসা বলতে তথাকথিত ভালোবাসাই বোঝো—যা আবেগ, অনুভূতি, ছলনায় পর্যবসিত। একদিন ভালোবাসো তো পরদিন ঘৃণা করো। প্রথমে প্রেমে পড়ে প্রিয়তমার জন্য মরতেও প্রস্তুত হও, পরে তাকে ঘৃণা করে মারার জন্যও প্রস্তুত হও। প্রগাঢ় ভালোবাসায় লীন হতে হলে একজনকে তার সর্বস্ব দিয়ে ঝুঁকি নিতে হবে। তথাকথিত ভালোবাসায় একমুহূর্তে তুমি ভালোবেসে জীবন দিতে প্রস্তুত হও, আবার অন্য মুহূর্তে প্রিয়তমার প্রতি এমন ক্ষোভ জন্ম নেয় যে, তাকে হত্যা করতেও প্রস্তুত হও। এটা প্রেম নয়, এটা ‘ব্যক্তিত্ব’। প্রেমের একটা গভীরতা থাকে। পরম সত্য কিংবা পরমসত্তার প্রতি তীব্র প্রেম সহজে জন্ম নেয় না। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমস্ত সত্তার কেন্দ্রবিন্দু থেকে জন্ম নেয়। তুমি সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। সে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। হ্যাঁ, এই প্রেমসুধা পান করে তুমি নৃত্য করবে। উন্মত্ত হবে। এই ভালোবাসা তৈরি করার জন্য সুফি সাধকরা একটা পথ খুঁজে নেয়—কিভাবে তুমি নিজের সত্তায় প্রেম সৃষ্টি করে সেই তরঙ্গে নৃত্যরত হয়ে পরমসত্তার নিকটবর্তী হবে। খাজা ইসমত বোখারি বলেছেন—
সুফিবাদ নির্বোধের প্রদক্ষিণের জন্য কোনো কাবা নয়
নয় ধর্মভীরুদের জন্য কোনো মসজিদ,
এটা ধ্বংসযজ্ঞের এমন মন্দির
যেখানে রয়েছে প্রেমের উন্মাদনা…
সুফিবাদ নির্বোধের প্রদক্ষিণের জন্য কোনো কাবা নয়, না ধর্মভীরুদের জন্য কোনো মসজিদ। এটি এমন একটি বৈজ্ঞানিক শক্তিক্ষেত্র, যেখানে ব্যক্তির সমগ্র শক্তি সম্ভাব্য মাত্রায় প্রকাশিত হতে পারে। আর যখনই ব্যক্তি প্রেমের দিপ্তি দ্বারা পূর্ণ হবে, তখনই পরম সত্যের সাক্ষাৎ পাবে। আর এ সাক্ষাতের মাধ্যমে কেউ বোধিজ্ঞান প্রাপ্ত হবে, আলোকপ্রাপ্ত হবে। সত্তার সব দুর্দশা দূর হবে। আর আমি যখন বলছি এটা হচ্ছে সুফিদের পথ, তখন বলবো—এই নীরবতা ও আশীর্বাদের বর্ষণকে তোমার নিজের দিকে প্রবাহিত হতে দাও। দেখবে তোমার মধ্যে ‘অহং’ বলে কিছু নেই। একটা শুদ্ধ নীরবতা আছে। তোমার ব্যক্তিত্ব অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু বর্তমান আছে আর সেখান থেকে ক্রমাগত আলো অনন্তের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে।
আমি তোমাকে স্রষ্টা সম্পর্কে বলছি। আমি ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো জ্ঞান দিতে আগ্রহী নই। আমি আমার স্রষ্টাকে তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। আমি তোমাদের স্রষ্টাকে আহ্বান করছি জেগে উঠতে। আর এটাই সুফিরা করে আসছে হাজার বছর ধরে। ব্যক্তির সম্ভাবনাকে সত্যের দিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীতে নানা ধর্ম আছে। কিন্তু সুফিবাদ হচ্ছে প্রাণের ধর্ম। মানবসত্তার কেন্দ্রবিন্দু হতে উৎসারিত ধর্ম। সুফিবাদ ইসলাম ধর্মের কোনো অংশ নয়। বরং ইসলাম হচ্ছে সুফিবাদের অংশ। সুফিবাদ মোহাম্মদের জন্ম নেওয়ার অনেক অনেক আগে থেকেই ছিল। ধর্ম জন্ম নিয়েছে আবার ধ্বংসও হয়ে গেছে কিন্তু সুফিবাদ রয়েই গেছে। কারণ, এটি কোনো ধর্মমত নয়। এটি হচ্ছে ধার্মিক হওয়ার উপায়। তুমি হয়তো সুফিবাদের কথা শুনোনি, কিন্তু তুমি যদি ধার্মিক হও, তাহলেই তুমি একজন সুফি। কৃষ্ণ একজন সুফি, জিশু খ্রিস্ট, মহাভীর ও বুদ্ধ—সবাই সুফি। তারা কেউ হয়তো এই শব্দটি শুনেনওনি। তারা জানেনও না সুফিবাদ বলে কিছু একটা আছে।
যখনই কোনো ধর্মের সারমর্ম টিকে থাকবে, বুঝতে হবে তার মধ্যে সুফিবাদের অবস্থান রয়েছে। সুফিবাদ না থাকলে ধর্মের মৃত্যু হয়ে যায়। আর এটাই ঘটছে সারা পৃথিবীতে। সবাইকে এই বিষয়ে নজর দিতে হবে। না হলে এই মৃত্যু কোনো অর্থহীন ধারণাকে নিয়েই আটকে থাকবে।