ক.
মাস্টার, শরীর খারাপ?
না।
অনেক চিন্তিত?
একটু।
কী বিষয়ে?
আছে। তাইলে ক্লাসে যা ঘটেছিল, শোনো।
খ.
আজ আমরা কী বিষয়ে আলোচনা করতে পারি, বলো?
স্যার, খোয়াবনামা নিয়ে।
তারপর…
গোরা নিয়ে।
তারপর…
চাঁদের অমাবস্যা।
তারপর…
সে রাতে পূর্ণিমা ছিল।
তারপর…
পুতুল নাচের ইতিকথা।
তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। এবার বলো, তোমরা কেন সেশনজটে?
ক্লাস ঠিকমতো হয়নি।
কী কারণে?
অবরোধ-হরতাল, সেজন্য।
আচ্ছা! আজ আমরা কথা বলবো এ টপিকেই। কে কোন ধরনের সমস্যায় ছিলে বা আছ অবরোধ-হরতালের জন্য? বলো, নিজের গল্প।
জি, স্যার।
শাফিন হাত তুলেছ। বলো।
স্যার, গল্প ম্যালা কষ্টের।
বলো। আমরা শুনবো।
স্যার, গৃহস্থের ঘরে জন্ম। বাবা বেঁচে না থাকায় বড় ভাই সংসার চালান। তিনি আবার পড়ালেখা করেছেন খুবই কম। চাকরিতে যেতে পারেননি। চাষাবাদ করেন। আবাদ-সুবাদ থেকে যা আয় হয়, খরচ মিটে যেতো। কিন্তু হরতাল-অবরোধ আমাদের সব উলট-পালট করে দিয়েছে। সবজির দাম কমে যাওয়ায় ভাই লোকসানে পড়ে যান। সেই লোকসানের আঁচ পড়েছে আমার ওপরেও। দাম কম হওয়ায় সময়মতো টাকা পাঠাতে পারছেন না। এছাড়া জিনিসও বেশি বেচতে হচ্ছে। আমাদের এলাকার সব গৃহস্থই এমন ফ্যাসাদে আছে। আট নয় টাকা দামের ফুলকপি বেচতেছে দুই টাকা করে। বাঁধাকপিরও দাম এমন। সবার মুখ বেজার। দাম না পেলে কি আর শরীল-মনে ফুর্তি থাকে? ফুর্তিতে আসমান সমান হতাশা আর যন্ত্রণা পিলার গাড়ছে। ঋণের চিন্তায় সবার মুখ কালো হয়ে গেছে। অবরোধ না থাকলে ঢাকায়, চট্টগ্রামে সবজি পাঠানো পারতো। দ্যাশ-দ্যাশান্তর থেকে পাইকার আসতো। এখন কিছুই হচ্ছে না। এক ট্রাক জিনিস শহরে পাঠালে খরচ হতো দশ হাজার টাকা। হরতালের বাজারে লাগে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার। সবজির দামের চেয়ে যাতায়াত খরচই বেশি। সেই জিনিস যে ঠিক সময়ে পৌঁছবে, তারও গ্যারান্টি নেই। কাঁচামাল তো পরেরদিন বাজার ধরতে না পারলে পচে যাবে। স্যার, অনেক যন্ত্রণায় কাটছে সময়।
ইউসুফ, কিছু বলতে চাও?
জি।
বলো।
স্যার, আমার বাবা টমেটো আবাদ করেছিলেন। বেচা-বিক্রি নাই। তাই টমেটো গরু, মুরগি, কুকুরকে খাওয়াতে হয়েছে। স্যার, একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, রাজনৈতিকরা আন্দোলনে সক্রিয় হয় তখনই, যখন চাষির ঘরে আবাদ তোলার সময়। তারা ভাবে, আমার ভাইটা, বোনটা, ছেলেটা, মেয়েটা বাইরে থেকে পড়ালেখা করছে, তাকে বেশি করে টাকা পাঠাবে এই সময়ে। বছরের বাকি সময় তো হাতে টাকা-পয়সা থাকে কম। সেই সময়ও টাকা পাঠায়, কিন্তু পরিমাণে অল্প। আবাদ ঘরে আসা মানে হাতে টাকা থাকা। পাঠাবে বেশি করে। সংসার সাজাবে। টিনের দোচালাকে চারচালা করবে। কত পরিকল্পনা থাকে। অথচ এখন তারা সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। গত বছরের লস পুষাইতে না পুষাইতে আবারও লসে। ধবধবে সাদা ফুলকপির সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে কাঁদছে দেখেছি। গ্রামের অনেকেই বাবার মতো কেঁদেছে আবাদের সামনে দাঁড়িয়ে। গৃহস্থের ক্ষেতভর্তি পেঁয়াজ অথচ বাজারে গিয়ে দেখবেন পেঁয়াজ নাই। এর মূল কারণ হরতাল-অবরোধ। চাতালে ধান সিদ্ধ আর নাড়ানাড়ি দেখবেন না। চালের দাম নাই এসব করে কী করবে? তারাও হতাশ। আমার এক চাচাকে বলতে শুনেছি, ‘লেতারা তো হরতাল ডাকতি পারলিই হলো। হরতালে তারকেরে তো কোনো ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় খালি হামাকেরে মতো গরিব কৃষকের। খেতের সবজি কি হরতাল মানবি? খেত থ্যাকি সবজি না তুললি পচে লষ্ট হবি। হরতালে পাইকার আসতে পারিচ্চে না। কষ্ট করে আবাদ করা খেতের সবজি এক্কেবারে সস্তা দামে বেচা লাগিচ্চে।’ বাবারা তো নিজের গাটের টাকা থেকে আবাদ করতে পারে না। তারা ঋণ করে এনজিও থেকে। সেখানে আবার মাসে মাসে কিস্তি দিতে হয়। তারা তো হরতাল-অবরোধ মানবে না। আবাদে লস হয়েছে একথাও তাদের কাছে বিবেচ্য না। তাদের কিস্তি চাই। সেই কিস্তি দেওয়ার জন্য এক আবাদ থেকে আরেক আবাদের অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু প্রত্যেক আবাদেই লস। গরু-ছাগল বেচে বাবা কিস্তি দিয়েছে। লোন শোধ করেছেন। একটা মজার ব্যাপার কি জানেন স্যার?
বলো।
আমরা আবাদ করা সবজির দাম পাই না। অথচ তেল, চিনি, ডাল ঠিকই বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে।
পিয়াস বলো, হাত উঠাইছো।
স্যার, আমার বাপ সিএনজি চালাইতো। আর এই দেশে অবরোধ, হরতাল যাই ডাকা হোক না কেন, আন্দোলনকারীরা সব রাগ ঝাড়ে সিএনজির ওপরেই। সিএনজিতে আগুন জ্বালিয়ে বোঝায়, তারাও রাস্তায় আছে। বাপের সিএনজিটা পুড়ে যাবার পর বাস চালানির কাজ নেই। কিন্তু এ কাজও বেশি দিন করতে পারেন না। মালিক একদিন বাপকে ডেকে বলে চাকরি ছেড়ে দিতে। বাপ প্রথমে না করলেও পরে মেনে নেন। হরতাল-অবরোধ থাকলে কি আর গাড়ি চলতে পারে? আয় না থাকলে মালিক টাকা পাবে কোথায়? বাপ এমন অনেক কথা চিন্তা করে মালিককে কিছু বলেননি। বাপের কাছ থেকে শুনেছি মালিকের দুঃখও অনেক। ডিসেম্বর-জানুয়ারি এই দুই মাসে দুই লাখ টাকা আয় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস রাস্তায় নামাতে পারেনি বলে আয় হয়নি। তারও ঋণ বেড়েছে। কর্মচারীর বেতন দিতে পারে না। ঘর ভাড়া দিতে পারে না। বিরক্ত হয়ে একদিন ড্রাইভারকে গাড়ি নামাতে বলেন, রাস্তায়। কিছুদূর আগানির পর পিকেটাররা গাড়ির কাচ ভাঙে। লসের ওপরে লস। বাপ যেদিন চাকরি ছাড়েন, সেদিন মালিকের ব্যথাক্রান্ত স্বর শুনতে পেয়েছিলেন, ‘একটা গাড়ি চালাইলে হারাদিনে লাভ অয় সাত আট আজার ট্যাহা। একটা গ্লাসের দাম অইলো পয়ষট্টি আজার ট্যাহা। পিকেটাররা যদি জানতো এই দামের কতা, তাইলে আর বাঙতো না এই গ্লাস। তার বাবা দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীও জানে না গাড়িডার দাম কত। একটা চাহার দাম কত। দুই নেত্রিও যদি জানতো এমন ক্ষতির কতা তাইলে আর তারা হরতাল অবরোধ ডাকতো না।’ বাপ পরে চিন্তা করলেন, বসে না থেকে একটা কিছু করা দরকার। হরতাল-অবরোধে তো রিকশা চলতে পারে। তাই তিনি রিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতে থাকেন। ক্ষ্যাপ যে বেশি পেতেন, তা না। মানুষ রাস্তায় বেরুতে ভয় পেত বলে সারাদিনে দশ-বারোটা ক্ষ্যাপ দিতে পারতেন। এই টাকায় মালিককে দিবেন কী? চাল-ডাল-তেল কিনবেন কী? আর আমাকেই পাঠাবেন কী? বাপের দুঃখ আমাকেও স্পর্শ করে। একদিন ফোন করে বলেন, ‘বাপ বুঝলি, সরহারে সরহারে কাইজ্জা হরে আর রাগ ঢালে গাড়ির উরপে। গাড়ি বাঙে আর পোড়ায় বাড়াইট্টা গুণ্ডারা। হ্যারা পাঁচ তালা থাইক্কা কেবল চায়া চায়া দেহে। তারা কইছে হরতাল। হরতাল। পাবলিক যে মরবার বইছে ওইডা দেখবার সময় নাই। গরিব মানুষ আর বেশিদিন টিইক্কা থাকপার পাইতো না, সব মইরা যাইবো।’ স্যার, অবস্থা এমন।
রিয়াজ কিছু বলতে চাচ্ছো?
জিী স্যার।
বলো।
স্যার, আমি কয়দিন আগে প্যান্ট-শার্ট কিনতে গিয়েছিলাম, দেখি দোকানদার বড় বড় হাই তুলছে। কর্মচারীদের মধ্যে দুই-একজন ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সঙ্গে ভাব না জমিয়েই বা কী করবে। কাস্টমার আসে না। বেচা-বিক্রিও নাই। হরতাল-অবরোধ না থাকলে মানুষ আসত, পছন্দ করতো, দশজন না হলেও পাঁচজন হয়তো কিনতো।
সমীর, তুমিও বলতে চাও?
জি, স্যার।
আচ্ছা, বলো।
স্যার, কয়েকদিন আগে পিজি হাসপাতালে যাওয়া দরকার ছিল। মা হাসপাতালে ভর্তি। রিকশাচালককে বলি, যাবেন? বলে, না। সিএনজি চালককে যাওয়া কথা বলি, বলে পাঁচশ টাকা লাগবে। দিতে চাইলাম ওই পরিমাণ টাকা। পরে বলে না ভাই যাবো না। আপনেরে হয়রানি করলাম, মাপ কইরা দেন। গাড়ি চালাইতে ভয় লাগে। কখন আগুন দেয়। আপনি অন্য কিছুতে যান। বাস তো আগেই বন্ধ। ওইদিকে মা অসুস্থ। ট্রিটমেন্টও যে ভালোভাবে হচ্ছে, তাও না। হরতালে ডাক্তার আসে নাই। ওষুধ নাই। আমরা দলের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেই না। অথচ দলীয় সিদ্ধান্তের যন্ত্রণা আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে।
তোমাদের প্রত্যেকের গল্পই বেদনাদায়ক। শুনে অনেক কষ্ট পেলাম। আজ ক্লাস এ পর্যন্তই থাকুক। আগামীদিন দেখা হবে। ভালো থেকো তোমরা।
গ.
এমন অবস্থায় চিন্তা না করে থাকতে পারি, অবন্তি? বলো?
তা অবশ্য ঠিক। কিছু শুনতে পাচ্ছো?
কী?
স্লোগানের মতো কিছু কানে আসছে।
চলো, বারান্দায় যাই।
সংলাপ চাই, সংলাপ চাই…
মাস্টার, কিসের সংলাপ চাচ্ছে?
শোনো অবন্তি, এরা দেশের নুন খেয়ে গুণ গাচ্ছে। তারা দেশের টালমাটাল অবস্থা বন্ধের জন্য প্রধান দুইদলের নেত্রীদের সংলাপে বসার কথা বলছে। এত সংলাপে হবেটা কী? বলো? প্রত্যেকে নিজের জন্য লড়ছে। কেউ গদীতে থাকতে চাচ্ছে, কেউ গদীতে বসতে চাচ্ছে। এজন্য দেশ হরতাল-অবরোধ আর মানুষের কান্নাকাটিতে ভরে গেছে। যারা আন্দোলন করছে, তাদের একটা বড় পোস্ট দিয়ে দাও, দেখবে মুখে ফেবিকলের আটা লাগিয়ে বসে আছে। আর একটি কথাও বলবে না।
আমাকে একটা ব্যাপার বোঝাও তো। আন্দোলনে যে কয়জন নারী দেখলাম, সবাই কালো। সুন্দরীরা কি আন্দোলনে আসে না?
বাইরে বেরুলে তাদের ত্বক কালো হয়ে যাবে না। তুমিও তো কম সুন্দরী নও। কিন্তু ঘরে বসে আসো আমার বউ হয়ে। স্টুডেন্ট থাকাকালীন হয়তো বন্ধুদের বাইকে ঘুরে বেড়িয়েছ আন্দোলনে না গিয়ে?
ফাজলামি রেখে যা জানতে চাইছি, বলো।
সুন্দরীদের রূপের তাপ বেশি হওয়ায় সুরক্ষা ছাড়া বেরুতে চায় না। তোমাকে একটা কবিতার কিছু অংশ শোনাই:
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।
প্রেমিকরা তাদের সুরক্ষিত রাখতে রাখতে এমন অবস্থা করেছে যে প্রেমিকের হাত ধরে না হাঁটলে হাইহিলের পা পিছলে পড়ে, মচকে যাওয়ার দশা।
আবার মজা নিচ্ছো?
তোমাকে একটা গল্প বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমাদের রুম থেকে খালি মোবাইল হারাতো। স্ক্রিনটার্চ মোবাইল। আমরা চোরকে ধরতে যত সতর্ক হই, সে তত কম সময় নিয়ে চুরি করে। রুমে মোবাইল রেখে ওয়াশরুমে যাওয়া, আর আসা। এসেই দেখা গেলো মোবাইল নাই। তিন-চাইর মিনিটের মধ্যেই মোবাইল উধাও। আমরা তো বেশ বিরক্ত। একদিন অবশ্য ধরা তাকে পড়তে হয়। আমাদের পাশের রুমে একজন লাভার বয় ছিল। সেই এ কাজ করত। পাঁচমিনিটের মধ্যে কোন দেশ থেকে চোর আসবে বলো, সে কেবল আমাদের মোবাইলই নিয়ে যাবে, অন্য জিনিস নয়। তাকে যখন পিটানি দেওয়া হলো তখন সে বলে কেন মোবাইল চুরি করে। প্রেমিকার প্রত্যেকদিনের বায়না মেটাতেই সে এ কাজ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলে তো একজনের কম টাকা লাগে না। সঙ্গে সুন্দরী প্রেমিকা পোষো। ডাবল খরচ। খরচের চাপে চ্যাপ্টা হয়েই সে বাধ্য হয়েছে এসব করতে।
বুঝলাম। চলো আজ ঘুমাতে যাই।
ঘ.
প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা কেমন আছ তোমরা?
ভালো নয়।
কেন? কী হয়েছে?
স্যার, দেশে যে অবস্থা চলছে তাতে কি আর ভালো থাকা যায়?
মিজান, খুলে বলো।
স্যার, মানুষ তো আর বাঁচার জায়গায় নাই। গাড়ি পোড়ানোর সঙ্গে মানুষও পোড়াচ্ছে। গতকাল প্রেসক্লাব মোড়ে গিয়ে দেখি মাইকে বলছে, ‘ভাত দে, কাজ দে’, ‘পেটে লাথি মেরো না, তুলে নাও অবরোধ,’ ‘আমার বাবাকে পুড়িয়ে মারা হলো কেন?’ ‘অবরোধ মানি না, মানবো না’। হরতাল-অবরোধে আক্রান্ত মানুষেরা মিছিল বের করছে। তারা অনেকদিন কাজ করতে পায় না। সংসারে শান্তি নাই। হরতাল ডাকনেওয়ালারা এ বছরের জানুয়ারিতে এসে গত বছরের জানুয়ারিতে হওয়া নির্বাচন বাতিল করে মধ্যবর্তী নির্বাচন, বাক্ স্বাধীনতা প্রদান, গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীদের মুক্তিসহ এমন অনেক দাবি নিয়ে হরতাল-অবরোধ চালাচ্ছে, বিরোধীরা। মুক্তির বদলে তো চব্বিশ ঘণ্টায় আরও পঁচিশ শ’ রে জেলে ঢুকাইছে। নির্বাচনের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তাহলে লাভটা কী হলো?
স্যার, আমি মিজানের কথার সঙ্গে আরো কিছু কথা যোগ করতে চাই। সেটা হলো, ট্রাক ভর্তি বালু বাড়ির সামনে রেখে রোধ করছে বিশৃঙ্খলা। আবার কেউ বালুর বস্তায় লোহার ত্রিফলা রেখে পথ অবরোধ করার কৌশল আয়ত্ত করছে। এখন রাজনীতির প্রধান অস্ত্রই যেন হয়ে গেছে পেট্টোল বোম। জনগণ ভোট দেবে না, গায়ে ছুড়ো পেট্টোল বোম। অবরোধ-হরতাল ডাকবে, গাড়িতে ছুড়ো পেট্রোল বোম। সংসদে আসন পাবো না, পুরা ঘর জ্বালাবে পেট্রোল বোমে। মিছিলে আসবে না পোলাপাইন, ছুড়বে পেট্রোল বোম। মিডিয়া কথা শুনবে না, ছুড়বে পেট্রোল বোম। মানুষের মুখে রাম নাম আসবে না, ছুড়বে পেট্রোল বোম। কূটনীতিকেরা বিরুদ্ধ মত দিবে, ছুড়বে পেট্রোল বোম। বাইরের দেশ আমদানি-রপ্তানি করবে না, মারবে পেট্রোল বোম।
আমিও কিছু বলতে চাই।
বলো, শিউলি।
স্যার, সংসারে অনেক মানুষ থাকে, কিন্তু টাকা-পয়সা কামাই করে দুই-একজন। আর কাম-কাজ পারনেওয়ালা মানুষটিই যদি আগুনে পুড়ে মারা যায়, তাহলে ওই পরিবারের কথা চিন্তা করে দেখেন, কত বিপদ। গতদিন পত্রিকায় পড়লাম পেট্রোল বোমে পুড়ে আকলিমার স্বামী মারা গেছে। কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার সোনার মানিকটারে স্কুলে বর্তি হরাইবো ক্যাডা? ছ্যারাডারে খাওয়াইবো ক্যাডা? কারে লইয়া বাঁইচা থাহাম আমি? ও আল্লাহ! তুমি ক্যান এত বড় শাস্তি দিলা আমারে?’ আল্লাহর নিকট এভাবে প্রশ্ন রেখে তার কিন্তু খুব বেশি লাভ হলো না। আকলিমারা কাঁদবে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারবে না। খেতে পারবে না। সন্তানরা একসময় পাবে টোকাইয়ের স্বীকৃতি। তাদের হাতেও উঠবে হাত বোমা। পেট্রোল বোমা। যা ব্লাস্ট করে মারবে অনেককেই। একটা মৃত্যু আরও অনেক মৃত্যুর আশঙ্কাকে জিইয়ে রাখলো।
দেখ, হরতাল-অবরোধ তো থামছে না। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা চাটনির মতো চেটে চেটে দেখছে হরতাল-অবরোধের স্বাদ কেমন। গতদিন আমিও রাস্তায় বেরিয়েছিলাম। দেখি, একদল নবীন সাহিত্যপ্রেমী তাদের আলাপ চালাচ্ছে। চা খাচ্ছে, সিগারেট টানছে আর বিষণ্ন মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে:
অবরুদ্ধ স্বদেশ, কী করে বলি তুমি গান শোনাও!
অবরুদ্ধ স্বদেশ, কী করে বলি চলো শীতের সন্ধ্যায় হাঁটি!
অবরুদ্ধ স্বদেশ, কী করে বলি আসো জ্যোৎস্না পোহাই!
অবরুদ্ধ স্বদেশ, কী করে বলি উৎসবে মাতো!
অবরুদ্ধ স্বদেশ, কী করে বলি আমায় ভালোবাসো!’
ব্যথাহত মন তাদের কাব্য ঝরাচ্ছে। এরপরও তাদের আলাপ চলছিল। আজ, ক্লাস শেষ করতে চাচ্ছি। কী বলো?
ঠিক আছে স্যার। সুস্থ থাকবেন।
ঙ.
অবন্তি, ব্যস্ত না কি?
না। কেন?
এদিকে আসো।
আসলাম।
তোমাকে একটা সাক্ষাৎকার শোনাতে চাই, শুনবে?
হুম।
বিরোধী দলের প্রধানের সঙ্গে আলাপচারিতা। আমার এক ছাত্র তৈরি করেছে এই কাল্পনিক আলাপ:
আপনি কি জানেন, আপনি যে কাজ করছেন এ নিয়ে প্রতিদিন শত শত পঙ্ক্তি রচিত হচ্ছে, যেখানে আপনার কাজের প্রশংসাই বেশি? যার ভিড়ে আপনি হারিয়ে যেতে পারেন?
লেখুক, তাতে আমার কোনো যায় বা আসে না। লেখে কী করতে পারে দেখা যাক? হারিয়ে যাওয়া কি এত সোজা। আমি তো আরও জেগে উঠছি।
একজন শিশু সমান এক শ’ কবিতা, একজন নারী সমান পঞ্চাশ কবিতা। এক হাজার কবি সমান শিশুদের জন্য লিখিত হচ্ছে এক লাখ কবিতা। নারীর জন্য পঞ্চাশ হাজার। শিশু আর নারীরা আপনার কী ক্ষতি করেছে যে, তাদের মারতে হবে?
কোনো উত্তর নেই, মুখ ফ্যাকাশে।
আপনি বয়স্কদের বাদ দিয়ে শিশুদের হত্যা করার মতো যে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন, এই শক্তি পেলেন কোথা থেকে?
সে কী বলতে? এর পেছনে আমার শক্তিই বেশি, তার সাথে যোগ হয়েছে বড় বড় দেশ। আপনাদেরও তো আমি লাভবান করেছি তাই না? নইলে এত সাহিত্য, এত লেখা পেতেন কেমন করে?
হুম, তা তো করেছেন। নইলে আজ আপনার মুখোমখি হওয়ার সৌভাগ্য হতো না। আপনি এই হত্যা চালাবেন, না থামবেন?
চলছে, চলবে। সবাই তো সমর্থন দিচ্ছে। বড় বড় মানুষরা সমর্থন দিচ্ছে, আমি থামব কেন?
আর কতদিন এভাবে পেট্রোল বোমে পোড়ায়া মারবেন মানুষের জীবন?
যতদিন ক্ষমতায় আসতে না পারছি, ততদিন।
এভাবে কি ক্ষমতায় আসা যায়? আপনি তো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন?
কিভাবে বুঝলেন? একটা মানুষ পোড়াই আর তারে নিয়া মেতে থাকে পুরা দেশ। তারা ভাবে, নড়েচড়ে উঠে। বিচ্ছিন্নের বদলে তো আরও আচ্ছন্ন হচ্ছি।
সিএনজির ওপর আপনাদের হরতাল-অবরোধের রাগ ঝাড়েন কেন?
নিরীহকে আরও মারতে হবে। বড় বাসের নাগাল পাওয়া তো মুশকিল। এজন্য ছোট সিএনজিকে ধরে রাগের প্রকাশ করি। দেখাই যে, আমরাও আছি, রাস্তায়। বের হবা তো মরবা।
মানে ঝিকে মেরে বৌকে বোঝানোর মতো?
আমি আর কথা বলতে চাচ্ছি না। আপনারা বিদায় নিলে ভালো হয়।
আর কতকাল দেশকে অবরুদ্ধ রাখতে চান?
যতদিন প্রতিপক্ষ অবরুদ্ধ না হচ্ছে, ততদিন।
আপনি তো প্রতিপক্ষ নয়, জনগণকেই ’রুদ্ধ করেছেন?
আমি উঠছি। আপনারা আসুন।
কুত্তার লেজ চৌদ্দ বছর চোঙায় রাখলেও তার যেমন পরিবর্তন নাই। বাঁকা লেজ বাঁকাই। ক্ষমতায় থাকা, আসার প্রচেষ্টায় মেতে থাকা ব্যক্তিদের অবস্থাও তেমন। তাদের বলে, কয়ে কোনো লাভ নেই। যারা এসব করছে, তাদের একদিন টিনের ঘরে থাকতে দেওয়া দরকার ছিল। বৈশাখী বাতাসে যে ঘরের চাল উড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্ষাকালে বৃষ্টি পড়ে। টিনের ফুঁটা দিয়ে রোদ আসে। বোমা, গুলির ভয়ে সবসময় অস্থির থাকতে হয়। তাহলেই তারা বুঝতে পারত জীবন কী।
মাস্টার, সাক্ষাৎকারটা কাল্পনিক হলেও সত্যকথন। আমার ছোট ভাইও পোড়াপুড়ি নিয়ে কী জানি লিখছে ফেসবুকে।
কী লিখছে?
মন দিয়ে পড়ি নাই। তুমি পড়ে দেখো।
দাও দেখি।
পড়ো:
বহির্বিশ্বের রাজনীতির সংবাদ আমাকে টানে না। দেশের হরতাল-অবরোধই বেশি ভাবায়। প্রতিদিন কত জন মারা পড়লো, এ শুনতে পেয়ে বারবার শিহরিত হই। নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুর সংবাদ আমাকে শোকাহত করে। কিন্তু সেই শোক দীর্ঘায়িত নয়। থাইল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রির মৃত্যুদণ্ডের সংবাদে খেয়াল নেই। দক্ষিণ সুদানে যুদ্ধের আশঙ্কাতেও ভাবান্তর নেই। দেশের যুদ্ধই আমাকে পোড়ায়। সুস্থ দেহ নিয়ে ঘর ছাড়লেও ফেরা আর সুস্থ থাকে না। হতে হয় বিকলাঙ্গ অথবা হারাতেই হয় জীবনটাকে। তরতাজা মৃত্যু দেখতে হয় চোখের সামনে। আগুন আর কান্না। গাড়ি পোড়াও। বাড়ি পোড়াও। হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। বাচ্চারা কাঁদছে। মাকে বলছে,
মা ভোগ নাগছে, খাবার দে?
খাবার পাইম কোটে? যে ঘরত খাবার থুচনু ওইয়ার চিহ্নও খুঁজি পাবার নাগাল না। সোগে জ্বালে দিছে!
তোক কি খাবার দেইম?
পাঁচ বছরের জোনাকির ক্ষুধা মেটাতে মা বাসন্তীর কোনো উপায় জানা নেই। তার ঘর জ্বলছে। তার স্বামী বাতাসুর রোজগারের শেষ ভরসা মাছ ধরার জালটিও পুড়ছে। কিভাবে পুড়ছে তা দেখার সুযোগ বাতাসু পায়নি। কেবল জানটা নিয়ে দৌঁড়াচ্ছে। পেছনে ফেরে দেখার সাহসও সে করতে পাচ্ছে না। আগুন তো সাহস যেখানে লুকিয়ে থাকে সেই বুকেই লাগতে ধরেছিল। হাত দিয়ে সরিয়ে কেবল দৌঁড়াবার সার্টিফিকেট পায়। জিরাবার জন্য থামে। দেখতে পায় সে একা নয় শত শত মানুষ দৌড়াচ্ছে। জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ সে এসবের কিছুই খেয়াল করেনি। খেয়ালে আসলে ‘থ’ হয়ে যায়। সে পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে মন্দিরে। কেউ কেউ নদী পার হয়ে ওপারে যাচ্ছে। অনেকেই মাথায় দু-একদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের এক আনা নিয়ে হাঁটছে। চোখের জল ঝরাচ্ছে। চোখের জল না ঝরিয়ে কী করবে? বাতাসুর বউ বিন্দি সরকারের লোকদের ফোন দিয়েছে, কেউ আসেনি। অন্যধর্মীরা ক্ষতি করছে। কষ্ট বড় হচ্ছে। ভাষা খোঁজে। অস্পষ্ট হলেও বেরুতে চাচ্ছে, ‘একাত্তর তো ওই দেশত গেছনু, দেশ স্বাধীন হইলে আবার আচছং। এ্যালা স্বাধীন দেশত থাকি আবার মাইনষের দেশত যাওয়া নাগবে? ইয়ার চায়া গাওত পেট্টোল ঢালি পুড়ি মরার মাঝতও শান্তি আছে। মনত মোর আগ থাকিল না হয়। নিজের দেশত থাকনু হয়। মাইনষের দেশত ক্যা যাইম। তাও যাওয়া নাগবে।’ তার মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিবে, একথা বলেছে। ওদের জোর কি এতই বেড়ে গেছে? সে নিজেকে প্রশ্ন করে, উত্তর মেলে না। কেবল কপাল ঠোকায় মাটিতে। মাটি তো কথা বলতে পারে না, উত্তর করবে কেমন করে? দেহ-ই উত্তর দেয় কেঁদে কেঁদে। কান্নার রং লাল। পানির মতো তরল নয়, গাঢ়। বিন্দির কপাল থেকে রক্ত বের হয়। আশ্রয়হীন হয়ে জীবনের সব স্বপ্ন এবং আশার রং বিবর্ণ। বাতাসুরা গাছতলায় দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে, মাথায় চাপড় কেটে কান্নার রায়টুকু সঙ্গে রাখে। কিন্তু তাদের কান্নার শব্দ কারো কাছে পৌঁছায় না। সহায়হীন মানুষের লাইন বড় হচ্ছে।
অবন্তি, এমন জ্বালাও, পোড়াও, রেললাইন উপড়ে ফেলা, গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার দৃশ্য আমরা সিনেমায় দেখেছি। এখন এমন ঘটনা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। আমরা হচ্ছি প্র্যাকটিক্যাল এলিমেন্ট। বাপ-দাদাদের কাছে গল্প শুনেছি ’৭১-এর যুদ্ধের সময় এসব ঘটেছিল। এমন যদি হয়, তাহলে কি স্বাধীন দেশকে স্বাধীন করতে আবার যুদ্ধে নামতে হবে?
পরিস্থিতি তো বিদঘুটে।