॥ পর্ব-১১॥
মশিকে বোর্ডিংয়ে রেখে বাড়িতে চলে গেল গোলাম মোর্শেদ। মন একটু খারাপ মশির। গোলাম মোর্শেদ ম্যাজিস্ট্রেটকে চাপ দিয়ে স্বীকারোক্তি বের করতে চেয়েছে। বলেছে, ব্যাপারটা পেপারে পত্রিকায় জানাজানি হয়ে গেলে ম্যাজিস্ট্রেটের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
কিন্তু গোলাম মোর্শেদের এ কথার মানে কী? সে একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকের কাজ হলো ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিয়ে যাওয়া। দুই পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করা। পাঠক নিজেই বিচার করবে, কে দোষী আর কে নির্দোষ। সাংবাদিক কেন এক পক্ষকে কবুল করানোর জন্যে পীড়াপীড়ি করবে? সে থাকবে পক্ষপাতহীন।
এর মানে বুঝতে পারে মশি। গোলাম মোর্শেদ চাইছে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে নগদ টাকা উসুল করা। মশি এটাকে সাংবাদিকতা মনে করে না। তার কাছে এটা হলো ধান্দাবাজি। কাঁচা টাকা কামানোর মতলব।
নিজের সিটে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল সে। সকাল থেকে রীতিমতো উত্তেজনায় সময় কেটেছে ওর। জীবনে এ প্রথম একজন থানার দারোগা, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আর ম্যাজিস্ট্রেটের মুখোমুখি হয়েছে সে। শুধু মুখোমুখি হওয়া নয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছে। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর ক্ষমতাশালীও মনে হয়েছে। ওর সাথে সমীহ করে কথা বলেছে থানার বড় অফিসার, আপ্যায়ন করে চা-বিস্কুট খাইয়েছে। ইউএনও ইংরেজিতে বলেছে, মশি সাহেব, লুক। ইটস আ ম্যাটার অভ প্রেসটিজ। আফটার অল হি ইজ আ গভর্নমেন্ট সার্ভিস হোল্ডার।
এর মানেও বুঝতে পারে মশি। গোলাম মোর্শেদ যা-ই চাক, দারোগা আর ইউএনও চান না উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বদনাম হোক। তারা চান ব্যাপারটা পেপারে না গিয়ে স্থানীয়ভাবে মিটমাট হয়ে যাক। গোলাম মোর্শেদও তাই চায়। তবে তার চাওয়ার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বীকারোক্তি এবং সাংবাদিকের মুখ বন্ধ রাখার নজরানার ব্যাপারটাও আছে। উপুড় থেকে চিত হয়ে শুয়ে পা মেলে দিল। খিদে পেয়েছে। গোলাম মোর্শেদ কখন খেতে ডাকতে আসে কে জানে?
চালাক লোক গোলাম মোর্শেদ। মশি তা বুঝতে পারে। ফরিদপুর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে কোনো চাকরি বাকরি না করেও দিব্যি করে কম্মে খাচ্ছে, এটা সোজা ব্যাপার নয়। পয়সাপাতি কামাইয়ের সুলুক সন্ধান ভালই জানে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে খাতির করে নিজের সম্পাদনায় পত্রিকা বের করছে। এটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। এ পত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম এবং শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাস মোকাবেলার কথা তুলে ধরা হচ্ছে সবিস্তারে। অবশ্য হিল লিটারেচার ফোরাম নামের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং বাঙালি অভিবাসীদের বিষোদ্গারের জবাবও দেওয়া হয় পাহাড়ের কথা পত্রিকায়। জবাব দেয়ার কাজটা মশিই করে থাকে। দশবছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৃণমূলে থাকার কারণে সে উপজাতিদের জীবনধারার সঙ্গে পরিচিত এবং শান্তিবাহিনীর দুর্বৃত্তপনাও তার ভাল করে জানা।
ভাবছিল গোলাম মোর্শেদের কথা। চালাক লোকটা। জানে কীভাবে টাকা উপার্জন করতে হয়। সুযোগ চিনতে ভুল করে না। আর মশির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সে সুযোগটা কীভাবে চিনতে হয়, সেটাই বুঝতে পারে না।
অবশ্য কেবল চালাক হলেই হয় না। কিছু যোগাযোগও থাকতে হয়। মশির ধারণা, গোলাম মোর্শেদের সে যোগাযোগ আছে। সেনাবাহিনীর উঁচু লেবেলের কারো সাথে খাতির না থাকলে এরকম কাটতিবিহীন পত্রিকা চালানোর খরচ সে কোত্থেকে পেত? বিজ্ঞাপনও তো নেই। তবে মশি আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবর নিয়ে তার তত মাথাব্যথা নেই। এই মুহূর্তে তার দরকার একজোড়া শু। গোলাম মোর্শেদ বলেছে কিনে দেবে। এখনও দেয়নি। আজ থানায় এবং ইউএনও অফিসে আধা পুরনো স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিতে গিয়ে প্রবল অস্বস্তি আর লজ্জায় ভুগেছে সে। নাহ, আজ আবার বলতে হবে জুতো কেনার কথা। চট্টগ্রাম থেকে আসার সময় সেরকমই তো কথা ছিল।
সিগারেট ধরাল মশি। আচমকা মেয়েটার কথা মনে এল। রানী নিহার দেবী হাই স্কুলের প্রাথমিক শাখার শিক্ষক ইয়াসমিন বেগম। মেয়েটা সেটলার। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা সেটলার হিসেবে আসছে, তাদের সবাই অশিক্ষিত, দরিদ্র শ্রেণির মানুষ্। তাদের মধ্য থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার মতো মেয়ে দূরের কথা, ছেলে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। এই ইয়াসমিন নামটা মশিকে একজনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিন। কিন্তু কোথায় সে বিলাইছড়ির ধানগোদা পাড়া আর কোথায় খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি! সে রিলিফের গমের জন্যে মিছিল করা পল্লবী শতরূপা ইয়াসমিন আর রানী নিহারদেবী হাই স্কুলের শিক্ষিকা ইয়াসমিন বেগমকে মেলাতে যাওয়াটা কষ্ট কল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে?
কিন্তু কোথাও একটা কীসের একটা মিল আছে মনে হচ্ছে যেন। সেটা কী বুঝতে পারছে না মশি। মনে হচ্ছে গলার স্বর। কিন্তু ১০ বছর আগে শোনা একটা মানুষের গলার স্বর কি মনে থাকে? থাকে হয়তো। তবে একজন মানুষের সঙ্গে আরেক জনের মানুষের চেহারার মিল থাকার বিরল ব্যাপারের মতো গলার স্বরেরও কি মিল থাকে? এখন পর্যন্ত এমন কিছু দেখেনি সে।
পেটে খিদে জানান দিচ্ছে। গোলাম মোর্শেদ এখনো খেতে ডাকতে আসেনি। তার আগে গোসলটা সেরে আসা যায়। বোর্ডিংয়ের সামনে চাপা কল। তবে শীতকালটাকে গোসলের উপযোগী সময় বলে মনে করে না মশি। হাসল মনে মনে। শীতের ভয়ে গোসল না করলে দু‘দিন পরে `খাচ্চর’ আর `পেরেত’ ডাকতে শুরু করবে মানুষ। অতএব লুঙ্গি আর গামছা কাঁধে বালতি নিয়ে বেরোল।
ঠিক এ সময় হন্তদন্ত হয়ে প্রায় ছুটে আসতে দেখা গেল গোলাম মোর্শেদকে। থামল মশি। কাছে এসে গোলাম মোর্শেদ বলল, চলে খাবেন।
গোসল করব তো!
সময় নেই। খেয়েই বেরোতে হবে। সময় নেই একদম। একদিন গোসল না করলে কিছু হবে না।
ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলবেন তো?
গোলাম মোর্শেদ হাসল। আরে ভাই, আপনার কপাল খুলে গেছে। ক্যাপ্টেন সাহেব আপনার সাথে কথা বলতে চান। আপনাকে নিয়ে যেতে খবর পাঠিয়েছেন।
ভয় পেয়ে গেল মশি। আমার সাথে ক্যাপ্টেন সাহেবের কী কথা! উনি আমাকে চেনেনই বা কী করে? কী উল্টোপাল্টা কথা বলছেন?
গোলাম মোর্শেদ তেলতেলে গলায় বলল, আরে ভাই, আপনাকে কেন চিনবে। আপনার লেখাকে চিনেছে। লেখেন তো ক্ষুরের মতো ধারালো। লোগাং হত্যাকাণ্ড নিয়ে শান্তি বাহিনী আর আমাদের বামদের সব মিথ্যে কথার জবর জবাব দিয়েছেন আপনি। ক্যাপ্টেন সাহেব সেটা পড়েছেন। তাই আপনাকে দেখতে চান।
হ্যাঁ, লোগাং হত্যাকাণ্ড নিয়ে শান্তি বাহিনী পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ আর হিল লিটারেচার ফোরাম নামের পত্রিকাটির মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছে সে। একই সঙ্গে ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু বাম বুদ্ধিজীবীর আন্দাজে বলা কথা কাহিনীরও অসারতা প্রমাণ করেছে। মন্তব্য করেছে, ঢাকায় বসে ভূতের গান না গেয়ে লোগাংয়ে আসুন। দেখবেন ঘটনা কী এবং কেন? বাঙালি সেটলাররা হিলট্রাক্টসে এসে অন্যায় করে ফেলেনি। দেশের যে কোনো জায়গায় তাদের বাঁচার অধিকার আছে। ১৯০০ সালের সিএইচটি রেগুলেশন আইন বর্তমানের বাস্তবতায় অচল।
মশি লিখেছে, লোগাং হত্যাকাণ্ডের দায়ভাগ সবার। শুধু অশিক্ষিত সেটলার আর উপজাতিদের কাঁধে দোষ চাপিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না।
মশি এটাও লিখেছে, কোনো কোনো মহল এতে ক্ষুদ্রতর জাতিসত্তার সঙ্গে বাঙালিদের বিরোধ জিইয়ে রাখার মাধ্যমে তাদের ভাষায় ‘ধনিক-বণিক’ শ্রেণির স্বার্থরক্ষার গন্ধও খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারা প্রথম থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে এক দুর্বোধ্য মনোভাবের পরিচয় দিয়ে আসছে। এরা প্রকারান্তরে, নীতিগতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদেরই সমর্থন দিচ্ছে। খাগড়াছড়ি থেকে যারা ‘বৈসাবি’ মেলায় আমন্ত্রিত হিসেবে ঘুরে এসেছেন, তারা সরাসরি পাহাড়ীদের পক্ষেই কথা বলেছেন। মনে হয়, তারা বিশেষ কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছেন। এরা আসলে বাম।
বামের প্রতি মশির একধরনের অবজ্ঞা। পাকিস্তানে এরা কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি কেবল তত্ত্ব কপচানোর কারণে, পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন তাদের কথিত ডানের হাতে এবং বাংলাদেশে তারা শতধাবিভক্ত হয়ে এখনো তত্ত্ব আউড়ে চলেছে।
গোলাম মোর্শেদের বউয়ের রান্নার হাত ভালো। কই মাছের ঝোল, বাঁধা কপি ভাজি আর মুগের ডাল। দুপুরের খাবারটা মনোযোগ সহকারেই খেল মশি। হালকা একটু ঠাট্টাও করলো। বললো, ভাবির হাতটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। আমার টাকা নেই। থাকলে তা-ই করতাম।
ঠাট্টা শুনে গলা ছেড়ে হাসলো গোলাম মোর্শেদ-ঠিক আছে। আমিই বাঁধিয়ে দেব। সোনা না পারি, পিতল দিয়ে হলেও দেব।
মশিও হাসলো। কিন্তু ভাই, একটা সমস্যা যে হয়ে গেলো?
কী সমস্যা?
আপনার ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করতে যাব, ঠিক আছে। কিন্তু কী পরে যাব? ছেঁড়া তালিমারা স্যান্ডেল পায়ে দেখলে যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়?
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল গোলাম মোর্শেদ। তারপর বলল, ঠিক আছে, চলেন। আগে আপনার জুতো কিনে নেই।
চলবে…