॥তিন॥
গঞ্জে রহমালীর দোকান আছে। চা-পান-বিড়ি সিগারেট বেচে সে। অনেক বেলা হয়ে গেছে। রোদটা কেমন চড়চড়িয়ে উঠছে। মা তাগাদা দেয়—কী হইলো বাছা তোর? আজ অমন পইরে পইরে ঘুমাইতেসছ ক্যারে রহম? কাছে এসে ফুলমন বেওয়া ছেলের কপালে হাত রাখে। শঙ্কা কেটে গেলে ঠেলা দেয়—রহম বাপারে, কত বেলা হইলো! অইজ তো হাঁডবার। হাডে যাবি না? রহমালী ধড়মড় করে উঠে বসে। দুহাতে চোখ রগড়ে নেমে পরে বিছানা থেকে। বিছানা বলতে চারটা বাঁশের খুঁটির ওপর বাঁশের মাচা। তার ওপর একটা ছেঁড়া তোষক, একটা তেল চিটচিটে বালিশ আর সবুজ রঙের ময়লা কাঁথা। কাল সারারাত ঘুম হয়নি। থেকে থেকে খুশনির কথাই মনে পড়ছিল। অমন পাড়ভাঙা হাসি, সচকিত চাউনি—ভাবতেই নিস্তেজ হয়ে আসে রহমালীর সমস্ত ইন্দ্রিয়। আর কি চাইছে বেদেনী তার কাছে? ভেবে পায় না রহমালী। বর্ষাকাল এলে রহমালী রাতের বেলায় বের হয় মাছ মারতে। ঝুপিহাতে টর্চলাইট নিয়ে তার বাপও মাছ মারতো। তার পিছে পিছে খালুই হাতে হাঁটতো রহমালী। বাপের কাছ থেকেই সে জেনেছিল শান্দর বাইদ্যার মাছ মারা ঝুপি বানাইয়া দিলে তাতে বেশি মাছ মারণ যায়। এই বিশ্বাসেই সে বাইদ্যানীর কথায় গেছিল তার বাপের কাছে। ঝুপি আনার পর মাছ মারা বিশেষ হয়ে ওঠেনি। চন্দনার জল সামাল দিতে রহমালীকে বাড়িতেই কাজ করতে হয়েছে। কালই সে মাছ মারতে গেছ দুটো শোল আর চার-পাঁচটা লাউয়ো টাকি মেরে ঘরে ফিরছে।
রহমালী আইতনায় ঝোলানো পলিথিন থেকে একটুকরো কয়লা নিয়ে মুখে পুরে নদীর ঘাটে যায়। এ ঘাট থেকে বেদের বহর দেখা যায় না। তবু সে বারকয়েক উঁকি মারে। তারপর ঘাটে বসে মুখ ধোয়। কিন্তু কী আশ্চর্য! নদীর ঘোলা জলের মধ্যে সে কুশনির মুখ দেখামাত্রই মুখের কুলকুচি করা পানি আর নদীতে ফেলতে পারে না। উজান ঠেলে চন্দনার জল বেদের ঘাট থেকে কুশনির ছবি মনা মাঝির ঘাটে নিয়ে আসে। রহমালী উবু হয়ে চন্দনার ঘোলাপানির ভেতর তাকিয়ে থাকে। এই সময় ঘাটে এঁটো বাসন ধুতে আসে সালমা ভাবী। রহমালীকে জলে ধ্যানী হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলে—মাছের নেশা কাটে নাই ভাই! ঘাটলা ছাড়ো কাম করতে দাও। রহমালীর কানে সেই কথা যায় না। সে যেমনি ছিল তেমনিই থাকে। ভাবী বলে, কী রে রহম, টলা ছাড়বি।অবচেতন মনে রহমালরি মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে—চুপ রাও ভাবী, কুশনি বাইদ্যা। চালমা ভাবীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে কুশনি বাইদ্যা-জলের তলে? সে আবার কী কাণ্ড। দ্রুত সে নিচে নেমে আসে। একেবারে রহমালীর গা ঘেঁষে বসে পড়ে। ঘোলা জলের মধ্যে দেখতে পায় না সালমা ভাবী। সে ধাক্কা দেয় রহমালীকে। কিরে মাছ মারতে মারতে তুর মাথাখানও গেছে। রহমালী কামনামদির দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সালমার দিকে। সেই ভাষা বুঝতে কষ্ট হয় না সালমার। এক সন্তানের জননী সে স্বামী থাকে দুবাই। বছর পাঁচেক হলো আসার নাম নেই। বিয়ে করে রেখে গেছে। মেয়ের জন্ম হলো। মুখ পর্যন্ত দেখেনি কাশেম। আসছি আসব করেও আসছে না।
সালমা একটু সরে যায়। চন্দনার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা বাতাস দুজনকেই ছুঁয়ে যয় এক ঝটকায়। রহমালী তড়াক করে উঠে যায়। সালমার স্বাভাবিক হতে ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে। তারপর সে অভ্যস্ত হাতে এঁটো বাসন মাজতে থাকে। তবু তার মগজের মধ্যে রহমালী আর কুশনি বাইদ্যার প্রসঙ্গ ঘুরপাক খেতে থাকে। দুপুর গড়ানোর আগেই কুশনি বাইদ্যার বিষয় মাঝিপাড়ায় রসালো গল্পের গাছ হয়ে ওঠে। ফুলমন বেওয়া সালমাকে ডেকে ছেলেকে বোঝানোর দায়িত্ব দেয়। খুশি হয়ে ওঠে সালমা ভাবী।
চলবে…