॥পর্ব-পাঁচ॥
আবির নতুন এলাকায় এসে গরুর চনা-গোবর থেকে উঠে গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠার মতো অনুভব করেছিল। গ্রামে তাকে ‘শাহা’ এবং ‘শাহু’ ‘পাগলার পুত’ বলা হতো। এখানকার কেউ সেই গ্রাম্য খেতাবিটা জানতে পারলো না। এ শব্দটা শেওলার নিচে পড়ে যাবে। কিন্তু চর অঞ্চলের বাসিন্দা বলে এখানকার সবাই তাদের চৌরা বলে ডাকে। এমনকি আশেপাশের বাড়ির ছোট ছোট বাচ্চারাও আবিরের মাকে ‘চৌরা মাতারি’বলে উল্লখ করে। আপত্তিকর এ শব্দটি দিনের মধ্যে অজস্রবার উচ্চারিত হয়। কেউ একবার তাকে চৌরা বললে তার কাছে মনে হতো এ শব্দটি হলুদ কফ মেশানো এক দলা থুতু।
এখন গা সহা হয়ে যাচ্ছে। অনেক কিছুই সইতে হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে তিনটা ঘর ছিল। একটা দোচালা টিনের ঘরে পাটখড়ির বেড়া ছিল। অন্য দুটির মধ্যে একটি ছিল গরুর একচালা ঘর, আরেকটা ছোট রান্নাঘর। চৈত-বৈশাখ মাসে বান-তুফানের সময় সারা রাত ঘুমানো যেতো না। চালের এখান দিয়ে, সেখান দিয়ে পানি পড়তো। গরুর ঘর ভিজে গেলে পানি সেচতে হতো। তুফান থেমে যাওয়ার পরে থাকার ঘরের মেঝের পানি কাচানোর পরে ভিজা মেঝেতে ছালা বিছিয়ে তার ওপর আধা ভিজা হোগলা পেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হতো। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের তুফানে সারা রাতে ঘুম হতো না। জেগে বসে থাকতে হতো।
এখন ভাড়া বাড়িতেও প্রায় একই অবস্থা। পুরানো টিনের ফাঁক দিয়ে পানি পড়ে। মুলির ক্যাঁচার বেড়া ভিজে যায়। কাঁচা ভিটি, ভিজে যায়। বেড়া বেয়ে কেঁচো ওঠে। রাতের অন্ধকারে আলো হয়ে জ্বলে। শীতের সময় ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস ঢোকে। মোকসেদা কার কাছ থেকে শিখে এসে বেড়ায় আঠা দিয়ে কাগজ লাগিয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির সময় ভিজে যায়। রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। হাড়ি-পাতিল সব যেখানে যেখানে পানি পড়ে সেখানে পেতে দিতে হয়।
নতুন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার পরে আবিরের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি বেপারিদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভালো। এখানে বেতন তুলতে গেলে সবাইকে স্বাক্ষর করতে হয়। টিপসই করার কেউ নাই এখানে। বরিশাল থেকে আসা কয়েকজন মেশিনচালক আছে তারা মেট্রিক পাস। একজন আইএ পাসও আছে। এখানে নাইট ডিউটি করলে রাত আড়াইটার দিকে বিস্কুট দেওয়া হয়। আগে নাকি চায়ের ব্যবস্থাও ছিল। প্রতিটি নাইট ডিউটির জন্য অতিরিক্ত এলাউন্স সাত টাকা করে দেওয়া হয়। বছরে বারো দিন বন্ধ থাকে। দুই ঈদে ছয় দিন, শবে বরাত, শবে কদর, মহরম আর ঈদে মিলাদুন্নবিতে বন্ধ থাকে। এ ছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, মে দিবস এবং ষোলো ডিসেম্বর বন্ধ থাকে। হিন্দু কেউ থাকলে দুর্গাপূজার জন্য তিন দিন ছুটি পায়। কিছু দিন আগে প্রতি মাসে এক দিনের করে মাসিক ছুটি চালু ছিল। দরখাস্ত করে নিয়ে হতো এই ছুটি। কারো মা-বাবা বা ঘরের কেউ মারা গেলে চারদিন পর্যন্ত ছুটি দেওয়া হয়। এই চার দিনের হাজিরা দেওয়া হয়। বছরে একবার করে পিকনিকে নেওয়া হয়। দুই ঈদে বেতনের অর্ধেক বোনাস দেওয়া হয়। কুরবানির ঈদে মালিকের বাড়িতে এক গরু কুরবানি হয়, আর মেইলের ভিতরে আরেক গরু কোরবানি করা হয়। এটির মাংস শুধু ওয়ার্কারদের জন্য। মহরমে খিচুড়ি হয় আর ঈদে মিলাদুন্নবির দিন বিরিয়ানি রান্না হয় ওয়ার্কারদের জন্য। রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারের আয়োজন করা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। হিন্দু-মুসলমান সবাই একত্রে বসে ইফতারি করে।
অনেক সুযোগ সুবিধা আগে চালু ছিল, এখনো কিছু কিছু চালু আছে। তবে এখানে বেতন কম দেওয়া হয়। অন্যান্য সুবিধা দিয়ে মালিক সাহেব এদিক দিয়ে ঠকিয়ে দেন। এখানে বেশিরভাগ শিক্ষিত বলে আবিরের কাছে বেতন কম হলেও ভালো লাগে। এ প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় অপারেটরদের দাপট আছে কথা সত্য, তবে অন্য ডিস্ট্রিক্ট থেকে আসা শ্রমিকরাও যথেষ্ট সুযোগ পায়। মেশিন থেকে জাল বের করে গজ মেপে কেটে নিয়ে ধোওয়া, শুকাতে দেওয়া, ইস্ত্রি করা এবং ইস্ত্রি করা জাল বস্তায় ভরে মুখ সেলাই করার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন লেবার আছে চর অঞ্চলের। তাদের বেতনও ভালো। সম্ভবত বয়সের সাথে সাথে তাদের বেতন বেড়েছে। তারা সবাই বয়স্ক। কয়েকজন আছে মানিকগঞ্জের। তারা নাকি মেট্রিক পাস। তাদেরও বেতন ভালো। বরিশাল অঞ্চলের কয়েকজন আছে মেট্রিক পাস এবং আইএ পাস, তাদেরও বেতন ভালো। ময়মনসিংহের কয়েকজন আছে শিক্ষিত মানুষ। তারা অবশ্য শ্রমিক না, স্টাফ। দুই জন ইলেকট্রিশিয়ান এবং একজন স্টোর কিপার।
একদিন আবির কোম্পানির মালিক মাস্টার সাহেবকে দেখেছে। এক সময় নাকি কোন স্কুলের মাস্টার ছিলেন, পরে শিল্প উদ্যোক্তা হন। আবিরকে নতুন দেখে কাছে এসে তিনি দাঁড়ান। আবির গত কয়েক মাসের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে নিষ্প্রাণ মেশিনগুলো যেন এখানে মাঝে মাঝে জীবন্ত হয়ে ওঠে। যার মেশিন তার সাথে ভালো আচরণ করে, অন্য কেউ চালাতে গেলে ডিস্টাব দেখা দেয়। সুতা কাটে, জাল ছিঁড়ে যায়, শাটেল লাফিয়ে ওঠে। আরো কত রকমের সমস্যা করে। এ যেন পোষা ঘোড়া। আসল মালিকের সাথে ভালো আচরণ করে আর অপরিচিত কাউকে সহ্য করতে পারে না, লাফিয়ে পিঠ থেকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে। আরেকটা বিষয় আবির লক্ষ্য করেছে, মালিক, ম্যানেজার আর ফোরম্যানের সামনে মেশিন বিগড়ে যায়। এই অবস্থা হয়। সুতা কাটে, ববিন খালি হয় ঘন ঘন, জাল ফাঁড়া বের হয়। সেদিনও মাস্টার সাহেব আবিরের সামনে এসে দাঁড়ানোর পরেই মেশিনে সুতা কাটতে শুরু করে। মালিকের সামনে আবির সুতা লাগাতে লাগাতে ঘেমে ওঠে। মালিক সাহেব ভুরু কপালে তুলে বিরক্তি প্রকাশ করেন। আবিরকে জিজ্ঞাসা করেন, আগে কোথায় কাম করছোস?
সুতা লাগিয়ে অন বাটনে চাপ দিয়ে মেশিন চালু করে মালিকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে আবির উত্তরে বলে, বেপারি সাহেবের ফ্যাটকারিতে।
মেশিন ভালোভাবে চালাইতে পারোস না? আমি তো দেখতাছি খালি সুতা কাটতাছে। বিষয়ডা কী?
আবির বলে, এতক্ষণ তো ভালোই চলছে। এখন সমস্যা করতাছে। চক মারলে ঠিক হইয়া যাইব মনে হয়।
মেশিনের কোনো কোনো অংশে চক খড়ি ঘষে দিতে হয়। এতে পার্টসটা ঘোরে পরিমাণ মতো। সেখানে বেশি টাইট হয় না, আবার ঢিলাও হয় না। প্রথম দিন ফ্যাক্টরিতে ঢুকে এখানে-সেখানে ভাঙ্গা চক আর মেশিনের সামনে চকের বাকসো দেখে আবির অবাক হয়েছিল। এখানে চক কেন? স্কুলে ব্লাকবোর্ডে যে চক দিয়ে লেখা হয় সে চক। চকের একটা বাকসের গায়ে লেখা পড়ে জানতে পারে চক শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না শিল্প প্রতিষ্ঠানেও কাজে লাগে।
সে মালিকে সামনে একটি চক হাতে তুলে নেয়। শাটেল বক্সের নিচের বড় রোলারের কন্ট্রোল ব্রেকের কাছে পুলিতে চক ঘষতে শুরু করে।
প্রোডাকশন তোর কত হইছে?—বলে মালিক সাহেব মেশিনের পাশের ডিজিটাল মিটারের দিকে তাকান। সন্তোষজনক প্রোডাকশন দেখে মনে মনে খুশি হন কিন্তু তা ভেতরে চেপে রাখেন। আবিরকে জিজ্ঞাসা করেন, নাম-টাম লেখতে পারোস?
আবির তার শিক্ষার কথাটা বলতে চায় নাই, সবার কাছে লুকিয়ে রেখেছিল। এবার সে না বলে পারে না। সে জানায়, পারি। আমি এই বছরে ক্লাস টেইনে উঠছি।
কস কী? কোন স্কুলে?
আবির তার স্কুলের নাম বলে। এর পরে আর মালিক সাহেব বেশি দেরি করেন নাই। অন্য মেশিনের দিকে চলে গেছেন।
এর পরে অনেকদিন আর মালিকের দেখা পায় নাই আবির। হয়তো অন্য শিফটের সময় আসা-যাওয়া করেন আবিরের তাই দেখা হয় না। আবির লক্ষ্য করে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক, ম্যানেজার, সুপারভাইজার সবাই তাকে স্নেহ করে। তার প্রতি স্নেহ যেন দিন দিন বাড়ছে। সে বুঝতে পারে এটা হচ্ছে তার লেখাপড়া করার কথাটা মালিকের জানার পরে। হয়তো তিনিই সবাইকে জানিয়েছেন।
তখনো প্রতিষ্ঠানে জেনারেটর ছিল না। বিদ্যুৎ চলে গেলে সবাই বসে গল্প করে। স্থানে স্থানে চক্রাকারে বসে গল্প করে সবাই। আবিরের কোনো চক্র নাই। তার বয়সী ছেলেরা তাকে এড়িয়ে চলে। কিছুদিন পরে দেখা যায় তার স্থান হয় টুইস্টিং মেশিনের শিক্ষিত কয়েকজন লোকের সাথে। সেখানে আছে জসিম, চুন্নু, ইউসুফরা। তারা সবাই নাকি ইন্টার পাস।
তবে আবিরের হাতের লেখা সবার চেয়ে ভালো। প্রতিদিনের হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। অনেকে তাকে দিয়ে ছুটির দরখাস্ত লেখায়। একদিন একজনকে লিখে দিয়েছিল, এর পর থেকে সবাই তাকে দিয়েই লেখানো শুরু করেছে।
এর থেকে আড্ডায় আসরে যেখানেই আবির বসে সবাই তাকে ঘিরে বসে। আবিরের কথাবার্তায় সবাই বুঝতে পারে এ ছেলেটা জেলার সবচেয়ে ভালো স্কুলের ছাত্র। সে এবার মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। তার পড়াশোনা অনেক। নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়ে। প্রতিদিন ডিউটির একটু আগে এসে সুপারভাইজারের টেবিলে প্রতিদিনের পেপার পায়। দশ-পনেরো মিনিট ধরে সব খবরে চোখ বুলিয়ে যায়। মনে চাইলে কোনো কোনো সংবাদ পুরোটাই পড়ে। রাজনৈতিক কলাম, আন্তর্জাতিক সংবাদ, খেলাধূলার পাতা সবই সে মনোযোগ দিয়ে পড়ে।
মুদি দোকানে কাজ ছেড়ে দিলেও আবির মিরকাদিমের সেই কাগজের দোকানে যাওয়া অব্যাহত রেখেছে। সেখানে গিয়ে এখনো পুরানো নোট বই, গাইড বই কিনে আনে। এর মধ্যে সে আরেকটি অজানা খনির সন্ধান লাভ করেছে। সে হলো বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা এবং শারদীয়া সংখ্যা। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, আনন্দবিচিত্রা, সাপ্তাহিক রোববার, সাপ্তাহিক পূর্ণিমা, পূর্বাণী, চিত্রালী, চিত্রালী উপহার, সন্ধানী আরো কত পত্রিকার ঈদসংখ্যা! আর কলকাতারগুলো মনে হয় বেশ উন্নত। কাগজ ভালো, বাঁধাই ভালো, রঙিন ছবিও আকর্ষণীয়। সেখান থেকে আসে আনন্দবাজার, আনন্দমেলা, আনন্দলোক সানন্দা, দেশ, প্রতিক্ষণ, মনোরমাসহ আরো পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা। এসব পত্রিকা আসে সদাইয়ের পোটলা বাঁধার জন্য। দোকানদার প্রথমে মনে করতেন ছেলেটা দোকানের জন্যই কিনে নিচ্ছে এসব। পরে আবির জানায় সে পড়ার জন্য নেয়। এসব মোটা পত্রিকায় অনেকগুলো করে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, ফিচার, নাটক, রম্য রচনাসহ বিশেষ কোনো লেখা থাকে।
এগুলো কেজি দরে কিনে আনে আবির। দশ টাকা কেজি পাঁচ-দশ কেজি বাছাই করে কিনে আনে। বাড়িতে অবসরে পড়ে। সব ধরনের লেখাই সে পড়ে। সমকালীন বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিকসহ সব ধরনের লেখকের লেখার সাথে সে এখন পরিচিত। ছোটবেলা স্কুলে থাকতে সে মনে করতো বাংলা সাহিত্যে কোনো জীবিত কবি নাই। একদিন দৈনিক পত্রিকায় শামসুর রাহমানের একটা কবিতা দেখে সে মনে করে এই কবির নাম শামসুর রাহমান, আর স্কুলে পড়তো শামসুর রহমান নামের কোনো কবির কবিতা। পরে বুঝতে পারে স্কুলে শিক্ষকেরা ভুল নাম শিখিয়েছেন, আসলে তার নাম শামসুর রাহমান।
এর মধ্যে একদিন মিরকাদিমের পাশের এনায়েত নগর গ্রামের এক স্কুলে কয়েকজন কবি সাহিত্যিক আসেন কোনো এক অনুষ্ঠানে। সেদিন আবিরের সকালে ডিউটি ছিলো। সে দুপুর দুইটায় বাড়ি ফিরেই পুকুরে গোসল করে চারটা ভাত খেয়ে দৌড়ে গেছে এনায়েত নগর। গিয়ে দেখে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেখানে সুফিয়া কামালকে দেখে অবাক হয়। তিনি এখনো হাঁটাচলা করতে পারেন! অনুষ্ঠানে আরো এসেছিলেন এমআর আখতার মুকুল, ইমদাদুল হক মিলন, হাসনাত আবদুল হাই আর কে কে যেন! সেদিন রাতে আবিরের ঘুম হয় নাই। তার গোপন ইচ্ছাগুলো মাথায় কিলবিল করছিল। অনেকে লেখকদের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করার জন্য খাতা নিয়ে গিয়েছিল। সে যদি নিতে পারতো তাহলে তার কাছেও এতজন লেখকের স্বাক্ষর থাকতো। সে যদি দোকান থেকে ছোট একটা নোটবুক কিনে নিতো তাহলেও পারতো। এসব ভাবনা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছিল।
ফ্যাক্টরির এক পাশে জাল বানানোর নেট মেশিন, অন্য পাশে সুতা পাকানোর টুইস্টিং মেশিন। সে সব মেশিন মূলত মেয়েরা চালায়। স্থানীয় মেয়ে আছে, বরিশালের মেয়েও আছে। মধ্য বয়সের মহিলাও আছে। তাদের মধ্যে আবির সম্পর্কে একটা কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। এ শিফটের ডিউটির সময় বাসা থেকে সকালের খাবার যেতে দেরি হলে অনেক মেয়েই আবিরকে নাস্তা করার আহবান করে। “কি আবির ভাই, খাইছেননি? না খাইলে আহেন একত্রে খাই।”
আবির হাসি মুখে ফিরিয়ে দেয়। একদিন আবিরের ভাত যেতে দেরি হয়েছিল, বেলা এগারোটা বেজে যাওয়ার পরেও আাজিম বা মোরশেদা কেউ তার খাবার নিয়ে যায়নি। বরিশালের ইভা বলে, “আবির ভাই, আইজ তো আ¤েœর খাওন আহে নাই। আমার ভাত খাইবেন? ভাত না খাইলে টেকা দেই, দোকান থিকা নাস্তা আইন্না খান। না খাইয়া কাজ করতে পারবেন?”
আবির প্রচ- ক্ষুধায় তখন কাতর ছিল। নাশতা কিনে খাওয়ার মতো টাকা তার পকেটে ছিল না। সে না করতে পারে নাই। ইভা দারোয়ানকে দিয়ে দোকান থেকে নাশতা আনিয়ে দিয়েছিল। এর পর থেকে ইভা একটু আবিরঘেঁষা হয়ে পড়ে। এটা অনেকের চোখে পড়ে। ইভা একদিন বলে, আমগো দেশের বাড়ি বেড়াইতে যাইবেন?
কোন থানায়?
খেপু পাড়া। যেইটারে সবাই কলাপাড়া বলে।
আবির জানে খেপু পাড়া ওরফে কলা পাড়া একেবারে সাগরের পারে। সেখানেই আছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। সম্ভবত বরগুনা জেলায়। সে বলে, অনেক দূর তো! ঠিক না?
ইভা হাসে, বলে, আমনেরে কি হাঁটাইয়া নিমু? লঞ্চে যাইবেন। মোগো বরিশাইল্লা লঞ্চে কোনোদিন উডছেননি?
না উডি নাই। ইচ্ছা আছে। যামুনে।
কথা ঐ পর্যন্তই। কিছুদিন পরে টুইস্টিং মেশিন সাইডের ফোরম্যান ইভাকে অন্য শিফটে ঘুরিয়ে দেয়। সেই শিফটের কে যেন চলে গেছে বলে মেশিন চালানোর লোক কমে গেছে। এখন আবির যখন ফ্যাক্টরিতে ঢোকে তখন ইভারা বেরিয়ে যায়। দেখা হয় গেটের কাছে। ইভাই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, কেমুন আছেন আবির ভাই?
ভালো। তুমি?
আমিও ভালা আছি। কতদিন ধইরা আমনেরে দেহি না, মোনে অয় কয় বচ্ছর!
আবির হাসে। এভাবে প্রায়ই যাওয়ার সময় ইভা দেখা করে আবিরের সাথে। অন্যরাও আবিরকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে। তবে ইভার সাক্ষাৎ যেন আকাক্সিক্ষত। দেখা হওয়াটা যেন অনিবার্য। দেখা না হলে যেন কেমন ফাঁকা লাগে।
একদিন স্থানীয় এক মহিলা নাইট ডিউটিতে আবিরের মেশিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে, আবির তুমি দেখি এখন কেমুন গানটান করো, বিষয়ডা কী?
আবির বলে, নাইট ডিউটিতে থাকলে গান না গাইলে ঝিমানি আহে।
মহিলা আরেকটু কাছে এসে বলে, বরিশাইল্লা মাগিগো লগে তোমার এত খাতির ক্যান কও দেহি।
মহিলাদের মুখে নোংরা কথা আবির অনেক শুনেছে। তার মাও মঝে মাঝে বলেন। কিন্তু আবিরকে সরাসরি কোনো মেয়েকে জড়িয়ে এভাবে কেউ প্রশ্ন করতে পারে তা সে কখনো ভাবতে পারে নাই। তার কান গরম হয়ে যায়। সে কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। চুপ করে থাকে। মহিলা আবার বলে, বেশি খাতির বালা না বুঝলা? বেশি খাতিরে পেট অয়।
এবার আর শুধু কান না, আবিরের সারা শরীরই গরম হয়ে যায়। সে আত্মরক্ষার জন্য বলে, আরে না, তেমুন খাতির আমি করি না।
না হইলেই বালা। কিছু মোনে কইরো না। আমি এমনিতেই কতাডা কইলাম। তুমি লেহাপড়া করা পোলা। তোমার সামনে ভবিষ্যৎ আছে।—বলে মহিলা আবিরের সামনে থেকে চলে যায়।
এর পরে আবির বুঝতে পারে এখানে সতর্কতার বিষয় আছে। সে দেখতে তার সমবয়সী ছেলেদের একটু বেশি লম্বা। বই-পুস্তক পড়া, আর কর্মস্থলে নানা বয়সী মানুষের সাথে মেলামেশার কারণে আবির তার বয়সের তুলনায় একটু বেশি বালেগ হয়ে গিয়েছে। সে যদি শুধু স্কুলে যাতায়াত করতো তাহলে বই আর পরীক্ষা নিয়ে থাকতো। আর হয়তো বন্ধুদের সাথে খেলাধূলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, কিন্তু এখানে নানান দেশের নানান বয়সের মানুষের সাথে কাজ করে সে অনেক কিছু আগেই জানতে পারছে। এটা আবির নিজেও অনুমান করতে পারে।
একদিন মালিকের বউ, মেয়ে ও ছেলে কারখানায় আসে। বোধ হয় কোথাও গিয়েছিল দাওয়াত খেতে। তারা বাড়ি যাওয়ার সময় ফ্যাক্টরিটা দেখে গেল। সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েকে দেখছিল। মেয়েটা পনেরো- ষোলে বছরের। ছেলেটা আট-দশ বছরের। আবির মেশিন চালু রেখে একা একা গান গাইছিল। সে নানা ধরনের গানই শোনে। সিনেমার, কলকাতার পুরনো বাংলা গান, দেশের আবদুল জব্বার, আবদুল হাদি, সুবীর নন্দী, কুমার বিশ্বজিৎ, এন্ড্রু কিশোর, রবি চৌধুরী, মনি কিশোর, ডলি সায়ন্তনী, শাকিলা জাফরসহ সমকালের অনেকের। মেশিন চালানোর সময় সে জোরকণ্ঠে গায়ও। তার কণ্ঠ ফ্যাসফ্যাঁসে, তাই কাউকে শোনানোর জন্য গায় না, নিজের আনন্দেই গায়।
অটোমেটিক মেশিন, অন বাটনে চাপ দিলেই মেশিন চলতে থাকে। মেশিনটা সেদিন বেশ ভালোই চলছিল। হঠাৎ সে দেখে মালিকের মেয়ে তার মেশিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আবির মেয়েটিকে সালাম দিয়েই ভাবে, কাজটা কি ঠিক হলো! মেয়েটা কি বয়সে তার চেয়ে বড় হবে? মনে হয় না। ছোটই হবে। তাহলে সালাম দিয়েছে কেন? ওদের অনেক টাকা-পয়সা আছে শুধু এই যোগ্যতায়?
এ সময় মালিকের পরিবারের অন্যরাও কাছে আসে। সাথে ছিলেন ম্যানেজার সাহেব। হঠাৎ মালিকের বউকে ম্যানেজার বলেন, এই ছেলেটা স্কুলে পড়ে, এইবার মেট্রিক দিবো। আমরা ওরে নানারকম সুযোগ দেই, গরিব মানুষ পড়তে চায় পড়–ক।
এ কথা শুনে মালিকের পরিবারের সবার আগ্রহ বেড়ে যায় আবিরের ব্যাপারে। তারা কেমন কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকায়। কিন্তু এমন ডাহা মিথ্যা কথা বলার পর থেকে আবির মালিক-ম্যানেজার কারো ওপরেই আর শ্রদ্ধা রাখতে পারে না। এর পর থেকে সে লেখাপড়া সংক্রান্ত সব কথা চেপে যেতে শুরু করে।
চলবে…
প্রাচীন স্রোতের কণা-৪॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ