॥পর্ব–২৯॥
ভাইজান—যার আদরের বোন ছিলাম। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, যখন ভাইজান চলে যায় রাশিয়ার প্যাট্রিস লুমুম্বা ইউনিভার্সিটিতে—স্কলারশিপ নিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। যখন ফিরে আসে, তখন কেমন করে যেন বদলে যায় তার সব। অথচ লালমাই পাহাড়ের পথে পথে এই ভাইয়ের হাত ধরে এত হেঁটেছি। তার অসাধারণ রেজাল্ট আর এক্সট্রা কারিকুলামের কারণে ‘আপনি শামীমের আম্মা’ বলে আমার মায়ের দিকে স্কুলের স্যারদের বিস্মিত চোখে তাকাতে দেখেছি। সন্তানের কারণে মায়ের মুখ কতটা উজ্জ্বল হতে পারে, এই ভায়ের কারণেই তা দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। এক রত্তি বয়সে পুকুরের জলে উপুড় করে শুইয়ে দিয়েছে এই ভাই-ই আমাকে। জলের বর্ণ আর গন্ধ শিখিয়েছে নিজের হাতে ধরে ধরে। পেটের নিচে হাত রেখে রেখে হঠাৎ কখন আবার জলের নিচে সরিয়ে নিয়েছে, টেরই পাইনি। তার কাছেই শিখেছি কী করে অবলম্বনহীন জলের ওপর ভেসে থাকতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর ক’বার এপার ওপার করতে পারি পুরোটা পুকুর—তার পরীক্ষা নিয়ে সুযোগ্য করে তৈরি করে তুলেছিল প্রিয় ছোট বোনকে সুইমিং কম্পিটিশনে অংশগ্রহণের জন্য। এই ভাই-ই শিখিয়েছে উঁচু বাঁধানো পাড় থেকে কী করে লাফিয়ে পড়তে হয় জলের গভীরে। শিখিয়েছে কী করে ভেসে উঠতে হয়, জলের অতলেই অদূরে আবার। আজ সেই ভাই ফিরে এসেছে আমার। আর সঙ্গে নিয়ে এসেছে খানিক অন্ধকার।
এত কাছে ইউনিভার্সিটির হল। সেটা রেখে কেন আমার অত দূরে রামপুরায় গিয়ে থাকতে হবে? কেনই বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চড়ে এত ঝক্কি সামলে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতে হবে? আমার মাথায় আসে না। ভাইয়ে বিবেচনাবোধ দেখেও আমি অবাক হই। শুধু তার অপছন্দের ছেলেটির সঙ্গে চলি বলে এই ডিসিশন! আমাকে রামপুরায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে প্রতিদিন! সারাদিনের প্রায় বেশিরভাগ সময়ই আমার কলাভবন আর টিএসসিতে থাকতে হয়। সকাল আটটায় থাকে নরেন বিশ্বাসের ছন্দের ক্লাস। মাঝ দুপুরে রফিকুল্লাহ খান পড়ান মেঘনাদ বধ। বিকেল আড়াইটায় থাকে সৈয়দ আকরাম হোসেনের ক্লাস। আহা কী অসাধারণ সব শিক্ষক আমার! কী অসাধারণ তাদের পড়ানো! আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। ক্লাস থেকে ফিরে আসি। অনেক্ষণ আমার দিনযাপনে লেগে থাকে নরেন স্যারের সেই নেচে নেচে বলা ছন্দের রেশ। বক্রোক্তি আর কাকু বক্রোক্তির উদাহরণে ছন্দ বিহ্বল পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তির অণুরনন। নরেন বিশ্বাসের ভরাট ছন্দোবদ্ধ নির্ভুল উচ্চারণে চর্যাচর্য বিনিশ্চয় থেকে বলা শ্লোক:
উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহিঁ সবই সবরী বালী
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সরবী গীবত গুঞ্জরী
আহা! আমার যাপিত জীবনের সূর্য সকাল। কোনো কোনোদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত স্রোতের সঙ্গে আবৃত্তির কাজ। গ্রুপওয়ার্ক। প্রোডাকশনের রিহার্সেল। একে তো আমার বাসে উঠলেই বমিটিং ট্যান্ডেন্সি হয়, তার ওপর এভাবে রামপুরা থেকে যাতায়াত করে পড়ালেখা আর আবৃত্তি চর্চা কোনোটাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। আমি বলি, ‘না’; রামপুরায় থাকব না। ভাই নিশ্চিত হয়ে পড়ে, ওই ছেলের জন্যই আমি আসলে এতটা বেপরোয়া। এতটা সাহস করে ভাইজানের মুখের ওপর বলি, ‘না’। ভাইজানের মুখের মেঘের ছায়া আর মেলাতে পারে না।দিন দিন প্রগাঢ় হতে থাকে।
তারপর একদিন গভীর জমাট আইস হয়ে বসে থাকে আমার মাথার ভেতর—তার মুখের ওপর। আজও তার ব্যাপক ঘনত্ব বড় বেশি নির্বাক করে তোলে আমার সময়। সে চলে গেছে হলে। কামালউদ্দীন হল তার জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও সে কেন যেন মাওলানা ভাসানী হলে থাকতো। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। কিন্তু না। কাজের কাজ কিছুই হয় না। প্রথম বছরটা এভাবেই চলে। ক্লাস শুরু হয়নি। তেমন করে ক্লাস হয় না। ছাত্রছাত্রী এখনো সবাই আসেনি। এই করে করে প্রায়ই সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকায় চলে আসে। মাঝে মাঝে প্রায়ই ফিরে যায় না নিজের ক্যাম্পাসে। আবার দিনের বেলা আমার ক্লাস চলার সময় কলাভবনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রায়ই আমাকে ক্লাস করতে দেয় না। রিহার্সেল পণ্ড করে দেয়। আস্তে আস্তে বিরক্তির কারণ হতে থাকে। শর্বরী, রূপা, লুবনা, রীতা ও ডেইজী আমার এইসব হলের বন্ধুদের সঙ্গে তার খুব গাঢ় বন্ধুত্ব হতে থাকে দিনে দিনে। ধীরে ধীরে এমন শুরু হয়—প্রায়ই তার হাত শূন্য। টাকা নেই। আমার কাছে চাইলে আমি একশ কী দুইশ টাকা হাতে ধরিয়ে দেই। বিডিআর তিন নম্বর গেটের ভাজা পোড়ার দোকানে বিকেলের নাস্তা করি। ঘুরতে বের হই। আমাকেই বেয়ার করতে হয়। ময়মনসিংহের ভাড়া বাড়িতে বাবা, মা, আপা, মুকুল—ওরা সবাই থাকে। আমাকে মাসে এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। সরকারি চাকরিজীবী বাবা তখন রিটায়ার করেছেন। পেনশনের টাকায় চলছে সংসার। আপা তখন ইকোনমিক্সে অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। মুকুল এসএসসি পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে। পুরো মাস আমার তাই হিসাব করে এই টাকাতেই চলতে হয়। আমার চলেও যায়। কোনোকালেই আমার বাবা-মায়ের কাছেও তেমন করে চেয়ে নেওয়ার অভ্যেস নেই। আসলে দরকারি জিনিসগুলো না চাইতেই মা গুছিয়ে দিয়েছেন, সেটা বই খাতা কলম কাগজ হোক কী জামা জুতো ক্লিপ সেপটিপিন হোক। দিনে দিনে তার চাওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকে। আমি ওই মা-হারা বাবার উদাসীনতায় এলেবেলে বড় হয়ে ওঠা অসাধারণ জ্ঞানী আর কবিতা লিখতে পারা ছেলেটার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। আমি তাকে নিষেধ করতে পারি না। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বাসায় আমাকে টাকা বাড়িয়ে দিতে বলি।
আরও বেশি করে দিতে হবে!
ভাইজান বাদ সাধে।
এই টাকায় দিব্যি চলে যায়। ওকে জিজ্ঞেস করুন, এত টাকা কী করে ও। নতুন জামা কাপড়ও তো কিনতে দেখি না।
সত্যিই। যখন বন্ধুরা প্রতিমাসে টাকা জমিয়ে নতুন জামা কেনে। জুতো কেনে। কোথাও বেড়াতে যায় তখন আমি শূন্য। ওরা কোথাও বেড়াতে যাবে। আমাকে যেতে বললে আমি বলি ‘যেতে পারছি না রে’। তাতে ওরা রাগ করে। একটা সময়ের পর থেকে আমাকে আর ওরা ডাকে না। আমি আইসোলেটেড হতে শুরু করি। আবৃত্তির গ্রুপ ‘স্রোত আবৃত্তি সংসদে’ তখন নিয়মিত সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেছি। প্রায়ই রিহার্সেলে আমি যাই না। ওর সঙ্গে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই। তখন ১৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবিত আত্মীয় স্বজনদের ঘটনার বর্ণনা করা চিঠিগুলো নিয়ে স্রোত আবৃত্তি সংসদ শুরু করেছে নতুন প্রোডাকশন ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’। তার শুরুর একটি পিস ছিল আমার। বেশ কয়েক বছর ১৩ ডিসেম্বর রাত ১২টা এক মিনিটে শাহবাগের মোড়ে পিজির সামনে আমরা এই প্রযোজনাটি মঞ্চায়ন করতাম। বেশ কিছুদিন রিহার্সেল আর প্র্যাকটিস করে দুই আড়াই পাতার পিসটি আমার মুখস্থ। পড়িও দারুন। আমার নিজেরই ভালো লাগে। প্রতিটি চরিত্রের জন্য তখন দুজনকে রেডি রাখা হতো। কিন্তু ওই পিসের জন্য কোনো অপশন ছিল না। আমি একাই। ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না’র ওই শুরুর অংশটি ছিল অসাধারণ। আর আমার হাস্কি কণ্ঠে মানিয়েছিলও বেশ। কখনো কোনো কারণে কোনো একটা মঞ্চায়নের সময় যদি আমি এই মঞ্চায়নটা করতে পারবো না বলতাম, পরীক্ষা বা টিউটোরিয়াল বা অন্য কারণে, তখন সোহেল ভাই খুব মজা করে বলতেন, এই প্রোডাকশনের এই অংশটিই একমাত্র ক্যারেকটার লেস আর তুমি হলে অনলি ওয়ান পারফর্মার। অতএব শাপলা, এটা তোমাকে ছাড়া চলবে না।
অর্থাৎ এই প্রোডাকশনে প্রত্যেকেই এক একটা চরিত্র করছে। রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি একাত্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই প্রযোজনাটি গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করেছিলেন তৎকালীন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। এই প্রযোজনাটি এতটাই ব্যক্তিঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল যে, আমাদের সবার যে একটা চরিত্র যেন হয়ে উঠেছিলাম আমরাই প্রত্যেকে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি এরোমা গুণের চিঠিটি কিংবা শহীদ মেহেরুন্নেসার বন্ধু মকবুলা মঞ্জুরের লেখাটি যখন পড়তেন শিলাদি, শহীদ আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর লেখাটি পড়তেন বিজু আপা, শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদের লেখাটি পড়তেন তন্দ্রা আপা, তখন চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়তো আমাদের। আবৃত্তিকাররাও ছিলেন এক একজন দুর্ধর্ষ। তাদের প্রাণ দিয়ে খেটে খেটে দিনরাতের পরিশ্রমে নির্মাণ করা অসাধারণ সব পড়া। মাহফুজ মাসুম, যে দুষ্টুমীতে ভরপুর তুচ্ছ বাক্যে জীবনের সব কষ্ট আর যাতনাকে বরাবর হাসি আর উল্লাসের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে, সেই মাসুম যখন স্টেজে উঠতো করের হাটের খণ্ডযুদ্ধের বর্ণনায়, কিংবা সাদি মোহাম্মদের লেখাটি যখন পড়তেন মাহিদুল ইসলাম, কিংবা মাসুদুজ্জামান পড়তেন জহুরুল হক হলের চিশতী হেলালের বন্ধুর সেই বেদনাঘন লেখাটি কিংবা তার উদাত্ত স্বগর্ভ কণ্ঠে যখন শুরু হতো আসাদ চৌধুরীর সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘তোমাদের যা বলার ছিল বলেছে কি তা বাংলাদেশ, কিংবা মাহিদুল ইসলাম শুরু করতেন রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর সেই চিরচেনা কবিতা, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরানো শকুন’; তখন একেকজনের রক্তে স্নায়ুতে ঝরে পড়তো রুদ্ররোষ। চোখে ঝরে পড়তো ক্রুদ্ধ আগুন। শহীদের রক্তের ভেজা গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো আমাদের চোখেমুখে নাকে। আমরা বিনম্র হতাম। ক্রুদ্ধ হতাম। উন্মত্ত হতাম। পুরোটা মহড়াকাল আমরা কেউ স্বাভাবিক হতে পারতাম না। নির্দেশক আরিফ ভাই ছিলেন আরও বেশি সংবেদনশীল আবৃত্তিকার। তার অনুভূতি ছিল আরও প্রগাঢ়। খুব ঘষে মেজে একেকজনের ভেতর থেকে বের করে আনছিলেন হৃদয় নিঙ্ড়ানো বেদনার ঘন প্রবাহ। আমরা একাকার হয়ে পড়তাম একেকটি চরিত্রের সঙ্গে। ১৮ থেকে ২৫ সবাই ছিলাম এই বয়সের তরুণ। রক্তে আগুন। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার চরম আর পরম শপথ এখান থেকেই আমাদের আরও গাঢ় হয়। কবিতার সঙ্গে। আবৃত্তির সঙ্গে। আহা এদের সঙ্গে আবৃত্তির সঙ্গে সেই প্রথম গাঁটছড়া বাধার দিন আমার। এখনো রক্তে শিহরণ তোলে।
হাসান আরিফ ভাই স্রোত আবৃত্তি সংসদের এই প্রোডাকশনটি নির্দেশনা করছিলেন। সময়ের সবচেয়ে তুখোড়, সবচেয়ে মেধাবী আবৃত্তিকারদের সঙ্গে আমার অসাধারণ দিনযাপন। একদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন ঘনিষ্ঠ কাজ, অন্যদিকে হাসান আরিফের মতো প্রাজ্ঞ একনিষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মীর নির্দেশনা। বিশিষ্ট করে তুলেছিল পুরো অনুষ্ঠানটিকে। প্রথম মঞ্চায়নটি হয়েছিল জার্মান কালচারাল সেন্টারে। যার আবহ সঙ্গীত করেছিলেন সাদি মোহাম্মদ ভাই নিজে। পরবর্তী সময়ে বাপ্পা মজুমদার, হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল যুক্ত হয়েছিলেন প্রযোজনাটির আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে। দ্বিতীয় প্রযোজনাটি ছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে। তখন আবৃত্তির খুব কদর ছিল। থাকতো হল উপচেপড়া দর্শক। পাবলিক লাইব্রেরির ৬০০ আসন সেদিন উপচে পড়ছিল দর্শক-শ্রোতায়। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল সব শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়দের। সারা আরা মাহমুদের চোখে ঝরে পড়া জল আমি নিজে তারপাশে বসে দেখেছি, যখন তন্ত্রা আপা পড়ছিলেন তার লেখাটি। যেখানে বর্ণনা করা আছে, কী করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয়ে গেছিল রাজাকাররা। বিজু আপার পড়া শেষ হওয়ার পর সেদিন শহীদ আলিম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বিজু আপাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলেন। পুরো পাবলিক লাইব্রেরির দর্শক আর আমাদের অর্থাৎ পারফর্মারদের মাঝে তৈরি হয়েছিল অসাধারণ এক শোকের, অনুভবের আর অনুশোচনার পিনপতন নিঃস্তব্ধতা।
চলবে…