॥পর্ব–২৮॥
তারপর আর পেছন ফিরে চাইনি। আমি আগুনে ঝাঁপ দেই। স্যান্যাল দা বলেছিলেন, ওই আংটি রিং-ফিঙ্গার থেকে খুলবে না কখনো। দ্বিধার দোলাচলে ভাসতে ভাসতে আমি তখন ওই আংটিকেই একমাত্র বাঁচানোর উপায় জেনে ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলাম। আংটিটি আঁকড়ে ধরেছিলাম এই ভেবে যে, এটি তার কাছ থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করবে। সে হয়তো আমাকে সত্যি ভালোবাসে না। ভালোবাসে ওই মেয়েটিকে। কিন্তু যেদিন আমার ছবির পেছনে তার ওই নীল প্রেমের যাতনার কথা পড়ি, সেদিনই আমার মনে হলো আমি আর উদ্ধারের পথ খুঁজতে চাই না। আংটিটির আর দরকার নেই। অবসান হয়েছে সব সন্দেহের। আমিও তার ওই নীল আগুনেই ঝাঁপ দিতে চাই। আমি পুড়ে যেতে চাই। আমি ছাই হয়ে যেতে চাই। কী এক গভীর বিশ্বাস এক লহমায় আমাকে গলে যেতে দেয়! আমাকে ভুলে যেতে দেয়। আমি অনন্তের পথে ক্রম ধাবমান হয়ে উঠি। হয়ে উঠি নিম্নগামী। নেমে আসতে থাকি নিচে। পড়ে যেতে থাকি গভীর প্রেমে। হাতের আঙুল থেকে আমি খুলে ফেলে দেই সে আংটি। তার পর গভীর প্রেমে কেটে যায় কত কত দিন। এখানে স্বাধীন সব। এখানে উদ্দাম আমরা। গতিময় সব আজ আমাদের। প্রতিদিন তার আসা-যাওয়া। আমাদের পরস্পরকে কাছে আনে আরও।
বিভোর প্রেমে গভীর আমরা দু’জন যখন, কোথাও আমাদের নিবিড় করে পাওয়ার অবকাশ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোর আনাচে কানাচে তেমন কোনো নিরাপদ জায়গা নেই, যেখানে অন্তত ঠোঁটে ঠোঁট রাখা যায়। চুমু খাওয়া যায় গোপনে। একান্তে। তবু বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের সামনের বিরাট খোলা মাঠে যখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। সোস্যাল ওয়েরফেয়ার ডিপার্টমেন্টের পাশে পড়ে থাকা একতালা আধো ভাঙা দালানের আড়ালে দুর্ভাগা প্রেমিক প্রেমিকারা গাঢ় হয়ে আসে। চুমু খায়। কেউ কেউ ওই বিরাট মাঠটার অনেক অনেক ভেতরে, যেদিকে প্রায় কেউই যায় না, সেদিকে চলে যায়। কিন্তু অন্ধকার গাঢ় হতে পারে না। হলের পিতলের ঘণ্টায় ঢং ঢং ধ্বনি বেজে উঠতে শুরু করে। হঠাৎ থেমে যায় আবেগের গতি। হঠাৎ নেমে আসে প্রেমিক প্রেমিকাদের মুখে ঘন অন্ধকার। ঘণ্টায় বাজে ১৯২২ সাল। বাজে ১৯২২ সালের প্রকটোরিয়াল রুলস্। আধো খাওয়া চুমুর যাতনা নিয়েই ছাত্রীদের ঢুকে পড়তে হয় হলে। প্রেমিকরা ফিরে যায় একই বেদনা নিয়ে। তখন ছাত্র-ছাত্রীরা আর ছাত্র-ছাত্রী নয়। প্রেমিক-প্রেমিকা। জীবাত্মায় পরমআত্মার খোঁজ। মাঝপথে থেমে যায়। এমনই নম্র আলোছায়ায় কোনোদিন খুব কাছে আসা হয় আমাদেরও। গোপনে কোনো কেনো দিন ঠোঁটৈ ঠোঁট খুঁজে পায় আমাদেরও। আরও খানিক স্পর্শ করে থাকা চায় মন। স্পর্শ করে থাকার নেশা ধরে থাকে রোজ। তারচেয়েও গোপনে লাগে রক্তে আগুন। পুড়ে যায় ভেতর। পুড়ে যায় বাহির। গলে যায় নদী। অকারণ পিচ্ছিল পথ যখন তখন। সব নতুন। নতুন ভালো লাগা। নতুন বাতাস। নতুন ঘ্রাণ। চিনে নেওয়া। উজাড় করে দেওয়া। চলে ভালোবাসার সপ্তপদী ঊষা থেকে গোধূলি ধরে। তার কোনো পিছুটান আমি দেখি না আর। আমি কথা তুলিও না অন্য কোনো।
তখন আমরা প্রথমবারের মতো আমাদের। চির আপন। এই এতগুলো দ্বিধার দিন যাপনের পর বুঝি বৃষ্টি এলো চৈত্রের ফাটা মাঠে। ভেসে যাই নতুন হাওয়ায় আমরা দুজন। ছেঁড়া পাল। তবু নৌকায় আসে নতুন আনন্দের বেগ। নতুন জোয়ার। স্রোতে লাগে আরও হাওয়া। এখন যেন বহমান সব স্তব্ধ হয়ে থাকা জল। সে আর আমি-আমরা দুজনে চলতি হাওয়ার পন্থী। দূরে চলে যাই কখনো সঘন। কখনো হাওয়ায় হাওয়ায় উদ্দাম। বয়স ১৮। প্রথম প্রেমের জোয়ার এতটাই গভীর ছিল আমাদের। কত যে দিন চলে গেছে কেবল দুজনে। এখান থেকে সেখানে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে। কখনো চারুকলায় কিংবা ধানমন্ডি-২-এ মিঠু ভাইয়ের গ্যালারিতে কল্পনা চাকমার ছবির এক্সিবিশন দেখতে দেখতে। ক্লাস ফাঁকি দিতে দিতে। এর তো আর অন্ত নেই। নেই বাকি স্রোত আবৃত্তি সংসদের প্রোডাকশনের রিহার্সেলে কামাইয়েরও। আর ঠিক এমনিই সময় রাশিয়ার প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএস শেষ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফিরে এলো আমার বড় ভাই। রামপুরায় বাসা নিলো। আর দেশে এসেই তার প্রথম কথা হলো—শাপলার আর হলে থাকার দরকার নেই। ও আমার সাথে বাসায় থাকুক।
আমার মাথায় বাজ। এ অবাধ স্বাধীনতা। এ দারুণ প্রেম। এ মোহময় যাপন। মায়া মততায় প্রেমে-অপ্রেমে পার হয়ে যাওয়া দিন আর রাতেরও তবে ভাগ হয়! দ্বিখণ্ডিত হয়! আমি মেনে নিতে পারলাম না। আমরা বড় ভাইকে ডাকি ভাইজান বলে। ভাইজানের পছন্দ হলো না ছেলেটিকে। এলেবেলে ভবঘুরের মতো তার রঙ রূপ আর চলাফেরা সব। আমার সংস্কৃতিমান উচ্চশিক্ষিত পরিবারে এই বাউণ্ডুলে ছেলে একেবারে বেমানান। নানা কথা চলতে থাকে পরিবারে আমার মাথার ওপর দিয়ে। ময়মনসিংহে মায়ের কানে যায় আমার কথা। আমার ওই বাণ্ডুলের সঙ্গে চলাফেরার কথা। একদিন ভাইজানের সামনে ধরা পড়ি দুজনে একসঙ্গে হলের গেটে হেঁটে আসার সময়। অপরাধীর মতো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাইজান দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রথম সেদিনই সরাসরি। ততদিনে জেনে গেছে রুমের সবাই তার কথা। আমারও বিশেষ লুকানো চাপানো ছিল না কিছু। বিশেষত মেয়েদের হলে দেখেছি মেয়েদের নিজের প্রেমের কথা প্রথম প্রথম খুব গোপন করে রাখে। প্রায়ই ঘুরে বেড়াচ্ছে যে ছেলেটির সঙ্গে। ও কে? প্রশ্ন করলেই বলছে, ও তো আমার পাড়ার ভাই। বাড়ি থেকে আমার খোঁজ খবর করতে পাঠিয়েছে। আমার সে রকম কিছু ছিল না। আমি সবারই কাছে বলেছি, ও আমার বিশেষ বন্ধু। যে কারণে রুমমেট মিলি আপা, করবী আপা, ডলি আপা—সবাই ওকে চিনতো। আর জানতো। মাঝে মধ্যে ওদের সঙ্গে কথাও হতো বেশ। খুব আলাপি আর মন ভোলানো কথা ছিল তার।
জানা ছিল খুব গভীর। লিখতো অসাধারণ সব কবিতা। কার্ল মার্কস-লেলিন সমাজতন্ত্র আগাগোড়াই পড়া ছিল তার। ছিল পড়া রাসেল রুমী শেক্সপিয়র। অনায়াসে একটানা বলে যেতে পারতো সেক্সপিয়রের লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প কিংবা হ্যামলেটের কোনো ডায়লগ। খুব সহজে মুখস্ত বলে যেত সুধীন্দ্রনাথের কোনো কোনো কবিতা। নারীহৃদয় হরণ সব কিছুই ছিল তার আয়ত্তে। সহজে মেয়ে বন্ধুরা কেবল নয়, ছেলেরাও তার কথায় ভীষণ আকৃষ্ট হতো। মা হারা এক ছেলে। মা মরে গেছে খুব ছোট বেলায়। একমাত্র আপন বলতে আছেন বাবা। বাবার বয়স হয়ে গেছে অনেক। ছন্নছাড়া ভবঘুরের মতো এই ছেলেটির মা হারার কাঙালপণাটুকুই আমার বুকে বাজতো সবচেযে বেশি। যখন তখন হলের গেটে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্লাসে যাব। হঠাৎ বাইরে এসে দেখি সে দাঁড়িয়ে। রিহার্সসেলে যাব, দেখি সে টিএসসির গেটে দাঁড়িয়ে। আর কি রিহার্সাল কিংবা ক্লাসে যাওয়া হয়! এভাবেই অবশেষে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে সিট পেয়ে যায় একদিন। আমি ভাবি, যাক অবশেষে এবার তার আসা-যাওয়াটা একটা নিয়মের মধ্যে পড়বে। লেখাপড়ার তোড়জোর শুরু হলে এমনিইতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আর আমারও নিয়মতো ক্লাস আর আবৃত্তির ক্লাসে নিয়মিত হওয়া হবে। ততদিনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্রোত আবৃত্তি সংসদের নিয়মিত সদস্য হয়ে গেছি। আর স্রোত আবৃত্তি সংসদের খুব প্রয়োজনীয় একজন পারফর্মার হয়ে উঠেছি। অসাধারণ সব প্রোডাকশন তখন স্রোত আবৃত্তি সংসদ করে চলেছে একের পর এক।খুব কোকিল কণ্ঠ নয় আমার। বরং হার্স। কর্কশ লাগে যা আমার নিজেরই কাছে বরাবর, তাকেই লোকে হাস্কি বলে বেশ কদর করতে শুরু করলো।
স্টেজে কাজ করতে একটি প্রধানতম বাধা হয়ে দাঁড়ালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী হলগুলোতে চলতে থাকা সূর্যাস্ত আইন। সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ছাত্রী হলে ঢুকে পড়তে হবে।কিন্তু আমার রিহার্সেল শেষ হতে হতে হয়তো সাড়ে সাতটা আটটা বাজবে। কোনো কোনো শো-এর দিন রাত প্রায় নটা বাজবে। তখন লোকাল গার্ডিয়ানের অনুমতি দেওয়া চিঠি আনতে হবে। সেটা এপ্রুভ করাতে হবে। তারপর হয়তো হলে ঢোকা যাবে। নয়তো ফিরে যেতে হবে লোকাল গার্ডিয়ানের বাসায়। এ এক দারুন ঝক্কি। তবু কোনোমতো ম্যানেজ করে চলতে থাকে। কখনো লোকাল গার্ডিয়ানের সই নকল করে নিজেই চিঠি দেই। কখনো ৮ টায় ফিরবো। শো শেষে এটা সেটা করতে করতে রাত নটা বাজলে হলে ফিরে হাউজ টিউটর পাওয়া যায় না। তিনি তার হাউজে ফিরে গেছেন। তাকে আর আনা যায় না। তিনি দরজা খোলার অনুমতি দেন না। ফিরে যেতে হয় কোনো বন্ধুর বাসায়। কারণ তখন লোকাল গার্ডিয়ানের বাড়ি যাওয়া মানে হলো—বিশেষ ধরনের দৃষ্টির সম্মুখীন হওয়া। এ মেয়ে না জানি কী করে এসেছে বাইরে থেকে, এত রাতে! ভাইজানের বাসায় এত রাতে যেতেও সাহস হয় না। ইচ্ছেও করে না। ভাইজান তো জেনে গেছে সব। নিজের চোখে আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখে গেছে। তাকে কোনোমতেই বিশ্বাস করানো যাবে না যে, আমি প্রোগ্রাম শেষ করে ফিরেছি। দেরি হয়েছে বলে হলে ঢুকতে দেয়নি। তার ভার মুখ আর নির্বাক অবিশ্বাস ভেতরে শত শত যাতনার শেল বিদ্ধ করতে থাকে। এ ধন্দ মনের ভেতরে আরও বড় এক গভীর অন্ধকারের জন্ম দেয়।
চলবে…