॥পর্ব-২৫॥
মায়ের সে বাণী গভীরে প্রবেশ করে, যখন নিজেকে এক স্বাধীন সম্মানিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলো। সঙ্গে ভেতরে ভেতরে এক দ্বিবিধ মর্মযাতনার দ্বারপ্রান্তেও এনে দাঁড় করালো আমাকে। এও সত্যি। আমি তো অনেক আগেই সে অধিকার করেছি বর্জন। পড়ে গেছি বাঁধা। মর্মযাতনা এ কারণে যে, আমি সেই কাঁটার আঘাত থেকে নিজেকে রক্ষাও করতে পারছি না। বার বার হেরে যাচ্ছি নিজের সঙ্গে যুদ্ধে। আমি তখন আঘাতে রক্তাক্ত। ফুলের সৌরভে সুরভিত। দ্বিধার দোলাচলে দোদুল্যমান। আমি পলায়মান।
আমি জলকুসুমের অনাঘ্রাত আদরে আর সম্মানে প্রকম্পিত। যতই পালাতে চাইছি তার কাছ থেকে, ততই আরও নিবিষ্ট সে। আরও একান্ত সে। কিন্তু পাশে পাশে সেই নারী। আমার কী করা উচিত! আমার কী ভাবা দরকার! সেই ১৭/১৮ বছর বয়সে আমার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই দিক হারাতে লাগে। আমি গোপনে নীরবে কেবল আঁকড়ে ধরি সেই আংটি। সে চলে গেছে সেদিন। সুহাসিনীকে সঙ্গে নিয়েই। আমি নীরবে তাকিয়ে দেখেছি। চেয়ে থেকেছি ওদের চলে যাওয়ার পথের দিকে। কানে তখনো কেবলই বেজে চলেছে তার কাঁচের চুড়ির রিনিরিনি কঙ্কন। তবু কেন আমি! কেন যে তবু! প্রতিটি বিকেলে দাঁড়াই হলের বারান্দায়। প্রতি সন্ধ্যায় ছাদে উঠি। কিন্তু নিজের ভেতর কী এক অদ্ভুত পরিবর্তন টের পাই। হলে আসার পর একলা জীবনে আমার দারুণ সম্পদ হয়ে উঠেছিল যে একাকী সময়। নীরব আত্মকথন। আত্মদর্শন। সেখানে থেকে কেবলই সরে যাচ্ছি।
সরে যাচ্ছি দূরে। সরে যাচ্ছি নিজের কাছাকাছি অবস্থান থেকে নিচে। তখন আমি তাকাতাম ওপরে। কত লোক আসে যায়। কত লোক গল্প করে। কত বন্ধু ফুল এনে দেয়। এসব দেখতে দেখতে আমি তাকাতাম আকাশের দিকে। সন্ধ্যার আলো ক্রমে গাঢ় হয়ে এলে আমি তাকাতাম নক্ষত্র কিংবা চাঁদের দিকে। কখনো ইলেকট্রিসিটির লোড শেডিংয়ের সময় নিচের ঘাসের মাঠ থেকে রুবেলের গান ভেসে এলেও আমি নিচে তাকাতাম না। কান খুলে শুনতাম ওর গান। আর দেখতাম আকাশ। ব্যপ্ত তারার ভিড়ে কোনো একটি তারাকে মনে হতো আমিই। আমি সেই বিশাল আকাশের কিনারায় এক আলোকশিখা। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমার নিচে তাকাতে থাকা। আমার নিচে নামতে থাকা। কারও চলার পথের দিকে তাকিয়ে থাকা। কারও আগমনের পথের দিকে প্রতীক্ষা আমার। কারও জন্য অপেক্ষা কেবলই আমাকে ধাবিত করে নিচে।
ছাদের ওপর থেকে প্রতি সন্ধ্যায় আমি নামতে চাই নিচে। কিন্তু কার কাছে যাব!কে আছে আমা্র! ঠিক ঠাহর করতে পারি না। সেদিন যেমন করে বিশ্বচরাচর উপেক্ষা করে ছাদের সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসেছিলাম। যে শক্তিতে যে বিশ্বাসে যে আবাহনে আজ তার বিন্দুমাত্র লেশ নেই। তবু মন মানে না। প্রতি সন্ধ্যায় মনে হয় কে যেন আসবে। সে যেন আসছে। সে যেন পেছন থেকে ডাকছে–জলকুসুম। কে যেন সাদা শার্টের ভেতর থেকে বের করে আনছে এইমাত্র কলি থেকে ফুটে ওঠা গোলাপ। এইমাত্র নিজেরেই বুকের ওমের থেকে ফুটে উঠেছে যে ফুল।
সেই বিষাদঘন দিন রাত সন্ধ্যের পর একদিন সঙ্গোপনে উপলব্ধি করি ‘ফল ইন লাভ’ অর্থ প্রেমে পড়া। প্রেমে পড়া কথাটা এ জন্যই বলা। প্রেমে পড়লে মানুষের সাধারণ জ্ঞান লোপ পায়। অর্থাৎ মনের স্বাভাবিক অবস্থা থেকে পতন হয় মানুষের। তাই কখনো বলা হয় না প্রেমে ওঠা। বলা হয় প্রেমে পড়া। বুঝতে পারি খুব গোপনে নিজেরই সে পতন। তাই আমি প্রতি সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে আসতে চাই নিচে। প্রতিদিন আকাশের নীল থেকে দৃষ্টি পক্ষেপণ করি নিচে। ঘাসের মাঠে এবং পথের ধুলিতে। সেই থেকে নামছি নিচে… আমি…আমি লালমাইর খাড়ি পথ বেয়ে নেমে এসেছি যেদিন সমতলে। সেদিন থেকে আমার পতন শুরু। আমি রক্তরাগ আকাশের আভা হারিয়েছি যেদিন।
সেদিন থেকে আমার যাপনের কাল ভয়াবহ। আমি সকালের সূর্য হারিয়েছি যেদিন অট্টালিকার ভিড়ে সেদিন থেকে আমার নেমে আসার শুরু। আমি শিউলির ঘ্রাণে জেগে ওঠা ভোর হারিয়েছি সেদিন থেকে আমার পতনের নিঃশব্দ অহঙ্কার। আমি খুব গোপনে টের পেতে থাকি। বুকের গভীরে কান্না জমে আজও। সেই বুনো পেয়ারা ঘ্রাণ এখনো মাতাল রাখে সময়। সেই অবাধ অগাধ নীলাকাশ এখনো ব্যাপ্ত করে অন্তরের সীমানা। এখনো রাত মধ্য ডেকে ওঠে বাগডাস…সমস্ত কালো অন্ধকারকে ভেঙে দিয়ে রাতের ঘুম থেকে। এখনও ভেতরে পাহাড় ভাঙে।
চলবে…