॥পর্ব-২২॥
কত দ্রুত নিচে নেমে পড়েছিলাম সেদিন—বিধাতাই জানেন। এক দৌড়ে বিশাল ছাদটা পার হয়ে আসি। পাঁচ তলা নামি। চার তলা নেমে পড়ি। তিন তলা, দোতালা, নিচতলা, টিভি রুম, রিডিং রুম ছাড়ি…। টানা লন ধরে সম্মোহিতের মতো সোজা নিচে নেমে আসি। মেইন গেটের সামনে এসে দাঁড়াই। কী করে বোঝাই, নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণহীনতার এই ব্যাপ্ত অনুভব! কী করে নিজেকে ধরি। প্রস্তুতি নেই। বাইরে যাব। জামা-কাপড়ের ঠিক নেই। বাইরে বের হওয়ার কাপড় নেই গায়ে। আটপৌরে ঘরের কাপড় পরে আছি। এখন রুমে ফিরে কাপড় চেঞ্জ করব, সে সময়ও নেই হাতে। হলের গেট বন্ধ হতে আধা ঘণ্টাও বাকি নেই। এত লোক বাইরে বসা। সে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! কার কাছে খুঁজছে আমাকে! কার কাছে জানবে, আমি কোথায়! কার কাছে জানবে আমি কত নম্বর রুমে থাকি! কার কাছে আমার খবর চেয়ে পাঠাবে! যদি ফিরে চলে যায়! চলে যায় যদি! আর যদি না আসে ফিরে! মনে মনে এসব ভাবি। আমার গতি আরও দ্রুত হয়। কত কিছু যে ভাবতে ভাবতে আমি গেট পার হই। এদিকে সেদিক তাকিয়ে তাকে খুঁজতে হবে। এই ছিল আমার প্রস্তুতি। কিন্তু না। খুঁজতে হয়নি তাকে একেবারেই। বাইরে বের হতেই চোখের সামনে সে। খুব স্বাভাবিক তার ভঙ্গি। যেন সে জানতোই আমি দেখেছি তাকে। দেখেছি ছাদের ওপর থেকে। যেন সে জানতো আমি নামছি। আমি নেমে আসছি দ্রুত। তারই জন্য নেমে আসছি আমি। আমি নেমে আসছি ছাদ থেকে। ভাঙছি পাঁচ চার তিন দুই এক তলা…।
আমি নেমে আসছি সেই স্বর্গ থেকে, একা হয়ে ওঠার প্রথম প্রহরে পেয়েছিলাম যে স্বর্গ আমার। আমি নেমে আসছি প্রকৃতির বিমুগ্ধ কোল থেকে। শান্ত আত্মার বিনম্র বোধন যেখানে। এক অলিখিত অধরা পরম নির্ভরতার দরজা খুলে। সব…সব…ফেলে আমি নেমে আসছি মাটির পৃথিবীতে। নেমে আসছি বৃষ্টির মতো। নেমে আসছি ঝড়ের মতো। আমি নামছি দ্রুত। ধেয়ে আসছি নদীর মতো। নেমে আসছি আমি তারই জন্য। অন্য এক নারীর প্রেমে আটকে থাকা এক মানুষ কেন আমাকে এভাবে টানে! কেন এতটাই মুগ্ধ হয়ে থাকে! আমিই বা কেন কাটিয়ে উঠতে পারি না ওই কবিতার রেশ! নেমে আসি। যেন শত জনমের পথ আমার শেষ হয় এখানে এসে। এখানে পথ শেষে খুব স্বাভাবিক সব। কিন্তুআমি.. আমি স্বাভাবিক নই একেবারেই। আমি অস্থির। আমি অসংহত। আমি নিয়ন্ত্রণহীন। কণ্ঠস্বর কি খানিক কেঁপেও ওঠে আমার সেদিন, কেমন আছ?
এই তো। তুমি?
আমি অবাক। আমি মুগ্ধ।
তুমি?
সেই মনোহরণ হাসি তার মুখে, হ্যাঁ। চলে এলাম। আর থাকা গেলো না।
চলে এলাম মানে?
মানে ময়মনসিংহে থাকা আর সম্ভব হলো না।
কী করবে এখানে?
সে তার স্বভাবসুলভ অপ্রস্তুত করার অস্ত্রটা প্রয়োগ করে বসে, আরে তোমার হলে এলাম। তুমি এভাবে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে না কি?
আমি লজ্জিত হই। কিন্তু কী করব, বুঝে উঠতে পারি না। কোথায় বসব। এখানে! মাঠে! এই অত লোকের মাঝে! কে কী ভাববে! কে জানে! তখনো এতটা বুদ্ধি হয়নি। আমার বোধে আসেনি, এটা কত বড় হল। এত এত লোকের মাঝখানে কে রাখে আমার খবর। সবার মাঝখানে পড়ে গেলে আমি অতি ক্ষুদ্র। তুচ্ছ। তাছাড়া সবাই যার যার কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত। যার যার অনুভব বিনিময়ে এতটাই মগ্ন! কারও সময় নেই নতুন কে এলো। কে তার পছন্দের মানুষের সঙ্গে কোথায় বসলো! তার খবর রাখবার সময় কারও নেই তখন। আমি লজ্জা কাটাতে পারি না। অত সবের মাঝখানে অত মানুষের মাঝে বসার কথা ভাবতেই পারি না। আমি বলি, এসো গেস্ট রুমে বসি।
না থাক। এখন আর ভেতরে ঢুকব না। আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কিছু খাব। চলো বাইরে চল।
আমি কিছু না ভেবেই তার সঙ্গে আগাই। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই বিডিআর তিন নম্বর গেটের কাছে। কিছু পুরি সিঙ্গাড়ার দোকান আছে ওখানে। দেখি হলের অনেক মেয়েরাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে ওখানে নাস্তা করছে। কিছু সময় কাটে অস্বস্তিতে। অসংলগ্ন। অসাধারণ। বিল পে করি। হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে আসি। যথারীতি ঘাসের মাঝে বসি কিছুক্ষণ।
আমি এসেছি, আসলে পরীক্ষা দিতে। অ্যাডমিশন টেস্ট।
আমি অবাক, অ্যাডমিশন টেস্ট! কোথায়?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ও
এতক্ষণে খুলেছে রহস্যের ঘোর।
পরীক্ষা কবে?
আগামীকাল আর পরশু।
ঢাকায় থাকবে কোথায়?
জগন্নাথ হলে। অমিতদার ওখানে।
অমিতদা কে?
ময়মনসিংহের এক পরিচিত দাদা। বায়োক্যামিস্ট্রিতে পড়েন।
আচ্ছা। কোনো অসুবিধা হবে না তার?
কী যে বলো? বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এটা একটা সাধারণ ঘটনা। পুরনো ছাত্রদের কাছে দরকারে ভাই বন্ধু কত লোক এসে থাকে।
আচ্ছা।
ঠিক তখনই গেটে ঘণ্টা পড়তে শুরু করে। ভেতরে ঢুকে পড়তে হবে। আমি সচকিত হয়ে উঠি। সেও উঠে পড়ে আমার সঙ্গেই। হাঁটতে হাঁটতে হলের গেট অবধি আসে। আমি সহজ হতে পারি না। হলের গেটে কারা কারা দেখছে কে জানে! কী না কী ভেবে বসে! আমি ভেতরে ঢুকতে নিয়েছি।ওদিকে শোনা যাচ্ছে সূর্যাস্ত আইনের ঘণ্টা।অবিরাম। সন্ধ্যার পর হলের বাইরে থাকা যাবে না। মামা একটানা বাজিয়ে চলেছে ঘণ্টা।আমি এক পা আগাই গেটের ভেতর। তখনই পেছন থেকে বেজে ওঠে সেই প্রিয় নাম—জলকুসুম।
বুকের ভেতর এক ঝলক রক্ত ছলকে ওঠে। এক মুহূর্তের স্তব্ধতা গ্রাস করে আমার সম্মুখ। আগাতে পারি না। সামনে তখন ঘনায়মান অন্ধকার। ছাত্রীরা সব তড়িঘড়ি হলে ঢুকছে। দুই/একজনের সঙ্গে ধাক্কা খাই। অসাড় পা। পেছনে তাকাই আবার। দু’পা পিছিয়ে আসি তার দিকে। শাদা শার্টের ভেতর থেকে কয়েকটি কচি পাতাসহ বের করে দেয় সেই পরিচিত ভঙ্গিতে। সেই অসাধারণ মুগ্ধতায়। অন্তরতম শুদ্ধতায়। একটিমাত্র গাঢ় জাম রঙের গোলাপ। সে ফুলের নাম জেনেছিলাম তারই কাছে। আগে অন্য একদিন। গভীর গাঢ় সে ফুল। এত গভীরতা এখানে চারপাশের পাপড়িগুলো থেকে এসে কেন্দ্রে মিশেছে। এমন আমি প্রথম দেখেছি। সে গোলাপের নাম পাপ্পামেলন…
চলবে…