॥ পর্ব-৭ ॥
২৫
মিলি, চইলাই আসলা?
ক্যাম্পাসে শীতকালীন ছুটি চলছে। ভাবলাম ঘুমের শহরে ফিরি। তাই এলাম। শাহরিয়ার, তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার উপস্থিতি তোমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।
তা হবে কেন! তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে। হাতভর্তি বেলোয়ারি চুড়ি তো মাঝে-মধ্যেই পরতে পারো?
সময়-সুযোগ হয় না। তুমি আমাদের বাসাতেই থাকতে পারতে?
কেন, রাতে ছাদে হাতভর্তি চুড়ি ও শাড়ি পরে হাঁটতে আর গল্প করতে? চুড়ির টুংটাং ছন্দে আন্দোলিত করে গবেষক থেকে কবিতে মাইগ্রেসন করতে?
চান্স পাইলেই মজা নিয়ে ফেলো। খুবই মন্দ। শাহরিয়ার, গল্পের কয়েকটা অংশে মুক্তার মায়ের কথা শুনলাম। তার পরিচয় কি? পাগলাপীরে গিয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করার সময় নিশ্চয় তার সম্পর্কে জেনেছো?
হুম, জেনেছি।
তাইলে বলো।
সে মোখলেসের প্রতিবেশি। দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। সে প্রত্যেকদিন যা যা কাজ করে গল্পগুলো থেকে তো জেনেছোই। তাই এ প্রসঙ্গে না বললাম।
ঠিক আছে। সাইতুন সম্পর্কে বলো। সমীরণ আর কি বললো?
বললো…
২৬.
সাইতুন কইল, সমীরণ আপা, বইনের বিয়ার পর আঙ্গোর অবাবটা আরো বড় অয়। বাপ কাম-কাজ হইরা যা জমাইছিন বইনেরে বিয়া দিবার সময় সব খরচ হরে। কয়দিন পর বাপটা মইরা গেলো। অসুখ-বিসুখে দুই বাই মইরা গেলো। বইন থাহে জামাইবাইত। মা আর আমি থাইক্যা যাই সংসারো। মা’র খাওয়া-পরার দায়িত্ব আমারে নিন লাগে। ডাহায় আয়ি কামের আশায়। আপা, কুনুহানো যায়া দাম পাই না; আঙ্গোর কপালো খালি দুঃখু।
বুঝ দিবার জন্যে উইয়াক কনু, শোনেক সাইতুন, দুঃখ ধনীরও থাকে। ওমার দুঃখ থাকে মনত। ওমরা দুঃখটা বাইরত আনে না, গরীবেরটা যতবেশি বাইর হয়। ধনীরঘর দুঃখটাক সামলে আখে। গরীবেরঘর প্রকাশ করি ফ্যালে। ওমরা অভিনয় করি করি দক্ষ কামলা হয়া ওঠে। দুঃখও অভিনয় মানি সুখযাপনত মন দেয়, যন্ত্রণা ভিতরত দুলি আখি।
অয় কইল, আপা, অ্যাতো শক্ত কতা মাথাত ডুহে না তো। ডাহায় আয়া গার্মেন্সো যাই পরীক্ষা দিবার। বিশ দিন দইরা চেষ্টা হরছি চারহির লাইগ্যা। মাসের অ্যাক তারিখ যেদিন, হেইদিন আমরা গেলাম। অ্যাক-দেড় শ’ ছেরি খাড়োইয়্যা থাকলো চারহির লাইগ্যা। অ্যার মইধ্যে যারে তাগোর পছন্দ অয় তারে লইয়া যায়। ছেরিডার লেহাপড়া আছে কি নাই এইডা দ্যাহে না। এইরহম হইরা বিশ-পচিশজুনরে লইয়া গেলো। যে ছেরিডা দেখতে সুন্দর বাইচ্ছা বাইচ্ছা হেইডারে নিছে। আঙ্গোর মতো কালা ছেরি তাগোর চোক্ষো পড়ে না। অ্যার লাইগ্যা আঙ্গোর চারহিও অইলো না। পরেরদিন আরেকটায় গেলাম। তারপরের দিন আরেকটায় গেলাম। চেষ্টা হরলাম। যদি এইডাত অয়। অয় না। এইতা হরে লাইনসুপার, সুপারবাইজার। মালিকে তো জানে না, হরেও না এইতা। অরাই ডাইক্যা লইয়া যায়। যাগোর লাইগ্যা মোবাইল আইতাছে হ্যাগোরে খুইজ্জা নিতাছে। যারা ট্যাহা দিবার পাইতাছে তাগোরে লইয়া যাইতাছে। আমরা তো গেরাম থাইক্যা অবাবো পইড়া শহরো আইছি। ট্যাহা নাই, পইসা নাই, মোবাইলও নাই। ডাহা শহর খুব অ্যাকটা বালা মনে অইলো না। ডাহার চায়া আঙ্গোর দ্যাশ-গ্রামই অনেক বালা। মানুষের উপরে মানুষ। গাড়ির উপরে গাড়ি। বারোন যায় না। মানুষে মানুষে বেঈমানি। এক জাগাত যাইবার চাইলে বাসের বিতরে কতক্ষণ যে বইয়া থাহুন লাগে। অবাব থাকলেও দ্যাশো খায়া, পইড়া, থাইহা শান্তি। শহরো এই শান্তিটা নাই। বাসার পানি ফুডায়া খায়ুন লাগে। এইরহম হইরা চলছি বিশটা দিন। আইলাম একটা আশা লইয়া, হেই আশাটা অইলো না। মনডা খারাপ। ট্যাহা-পইসা বাইঙা আইলাম, কাম অইলো না। নিরাশ মন লইয়া গাজীপুরের পথো আডতাছি। অ্যার আগে হুনছিলাম সাভারো গার্মেন্স আছে। স্থির হরলাম ওইনো যায়াম। যাওয়ার পথ তো চিনি না। মৌচাক মুড়ো আইতে শুনলাম হেলপার কইতাছে সাভার, সাভার। আমিও উইড্ডা পড়লাম গাড়িত। গিয়া বইলাম পিছনের সিডো। ওইডাই খালি আছিন। চিনি না বইল্লা লগের সিডো বওয়া অ্যাকটা মহিলার লগে আও হরলাম। জানবার চাইলাম সাভার কতদূর? হ্যায় জানবার চাইলো আমি কই থাইক্যা আইছি। কি হরি। কই আছিলাম। অ্যাহন ক্যান সাভার যাইতাছি। সব শুইনা কইলো,
আমার ভাই সাভারের আল মুসলিম গার্মেন্টসে চাকরি করে। তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমার সাথে চলো, তোমার একটা ব্যবস্থা হবে। আমি শুইনা খুশিই অইলাম। অয় আরো কইলো, আমি যেখানে নামবো তুমিও সঙ্গে সঙ্গে নাইমো। ভাড়া দিতে হবে না। আমিই দিব তোমার ভাড়া।
আমি কইলাম, আপনে ক্যারলাইগ্যা আমার বাড়া দিতাইন?
কইলো তুমি তো অসুবিধায় আছো। ভাড়া দিতে যে টাকা খরচ হবে সেই টাকায় তুমি একবেলা খায়া নিয়ো। তুমি তো আমার বইনের মতো।
ইয়ার পর সাইতুনের কি আর কিছু কবার থাকে? থাকে না। অয় মহিলার সাথে বাস থাকি নামে। ওমরা নামতেয়ে গাড়ি আসিল। সাইতুন কইল, কি ঠা-া! গরমো রাস্তাত আডতে আডতে শইল্লো যে পুড়া দাগ অইছিন কয়েক মিনিটের মইধ্যে হেই দাগ মুইছ্যা যাওয়া শুরু হরলো। চোখ বন্দ অইয়্যা আইলো।
ইয়ার পর অয় কিছু কবার পায় নাই। সকালে মুই ঘর থাকি বাইর হইলে দেখং অয় পড়ি আছে সাভারের অন্ধ গলির চিপ্যাত। গাওত কাপড় ঠিক নাই। পাওয়োত অক্ত। চুল আউলা-ঝাউলা। সারা আইত মনে হয় কিছু খাবার পায় নাই। দেখনু, কথা কবার চায়, কিন্তু কথা ঠোট থাকি বাইর হয় না। পরে উইয়াক য়ুটি আর কলা কিনু দিনু। তখন দেখং অ্যাকনা কথা কবার পায়। বুঝনু অয় হামার অ্যাত্তিকার মানুষ। নিয়া আসনু মোর ঘরত। কয়দিন পর সাইতুনক জিগানু, তুই চাকরি কইরবার চাইস? কইল,
চাই তো।
চাকরি-বাকরি কায়ো দিবার নয়। তুই তো অতো পড়ানেখাও করিস নাই। মুই যে কাম করং, তোক সেই কামের টেনিং করাইম। তুই করবু তো এই কাম?
আপা, আমি তো কাম হরবারি চাই। বাড়িত ট্যাহা পাডান লাগবো। দ্যাশো মা’ডা না খায়া আছে।
ঠিক আছে। তুই কয়দিন য়েস্ট নে। মুই শিখাইম তোক সোগে। ভাগ্য ভালো যে তোর প্যাট বাধে নাই। ওমরা তোক মারি ফ্যালে নাই। কষ্ট নেইস না। য়েস্টত থাক। গাওটা ঠিক হোক।
২৭.
মিলি, আস্তে হাঁটো, মনে হচ্ছে জগিং করতে বের হয়েছো?
কিছু বলবে?
একটা বিষয় খেয়াল করেছো?
কী?
খেয়াল করলে দেখবে ব্যারেজের আশেপাশে যারা আছে তারা বিভিন্ন স্থানের মানুষ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল কুড়িগ্রাম, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারি, বগুড়া, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে; এমনকি আসাম বা শিলিগুড়ি থেকেও এসেছে। এখানে সস্তা জমি পেয়েছে, মৌমাছির মতো মানুষ ঝাঁক বেঁধেছে। এখানে এসে লোকজন স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। প্রথম দিকে তারা একটি পেশায় জড়িত ছিলো।
যেমন?
যে মাছ ধরতে চেয়েছে সে মাছ ধরেছে। যে কৃষিকাজ করতে চেয়েছে, সে তাই করেছে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে এই মানুষেরা পেশার বদল ঘটাতে বাধ্য হয়। একটি নির্দিষ্ট পেশায় লেগে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। যে মাছ ধরে সে অন্যের জমিনে দিনমজুরের কাজ করে। অন্যের ঘর-বাড়ি ঠিক করে, আবার রিকশাও চালায়। কৃষকও পরিবর্তিত পেশা বেছে নিয়েছে। চরবাসী ভাঙনে বিচ্ছিন্ন হয়ে খাস জমিতে আশ্রয় পেয়ে ঢাকায় ভিড় বাড়ায় কিংবা অন্য কোথাও যায়। যা পাচ্ছে তাই করে দিনযাপন করছে। তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে বলে ভাষাতেও পৃথক পৃথক অঞ্চলের ভাষার প্রভাব পড়েছে। সাইতুন, মহিউদ্দিন, সুলতানরা ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। তারা বাড়িতে এ অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করে। বাজারে গেলে রংপুরের ভাষায় কথা বলতে হয়। প্রতিবেশির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাদের দেশীয় ভাষা ব্যবহার করে। পরিস্থিতি অনুযায়ী তারা ভাষা ব্যবহার করে। অবচেতনভাবেই তারা এটি করে থাকে। খুব ভারি কথা বলে ফেললাম?
না। ঠিক আছে।
মিলি, পাগলাপীরের খোলায়েশায় তিস্তার ক্যানেল আছে। চলো সেদিকে যাই। যেতে যেতে মহিউদ্দিন আর সুলতানের বাকি গল্প জানাচ্ছি।
ঠিক আছে। চলো। আর একটা বিষয় এ গল্পও তো মনে হয় সেদিন জেনেছিলে?
হুম। তারা তো আইনুদ্দিন চাচার বাড়িতে কাজ করতে গিয়েছিল। চাচা হলেন পাগলাপীরের মানুষ। তাদের গল্প সেদিনই জেনেছি।
চলবে…