॥ পর্ব-২৪॥
আটকের অনুমিত তালিকা তদন্তকারীর বুকপকেটে সেঁধিয়েছে খানিক আগে। তাতে লেখা কিছু অনুমোদিত নামের পাশে কারখানা ব্যবস্থাপকের লাল কলমের আঁচড় কাটা; মাথাবিহীন টিকচিহ্ন সব।
তদন্ত চলাকালীন এলাকাত্যাগ নিষিদ্ধ। মাননীয়রা, আশা করি, এ বিষয়ে জানেন সবাই। তাচ্ছিল্যে ভরা জড় অথচ সবল কণ্ঠ প্রধান তদন্তকারীর।
তো, বিপদ এড়ানোর স্বার্থে সবাই এখানে এসেছেন, আমার আশা। আর এখানে তো নিশ্চয়ই অভিজ্ঞও অনেকে আছেন। একটা ব্যাগও হয়ত গুছিয়ে এনেছেন তারা, কারাবাসের প্রস্তুতি। কী, ভুল বলেছি? সুবিধা হবে না। ম্যান ভালো না আমি, বুঝলেন? মানে আপনাদের জন্য ভালো না। নগদ টাকা নাহয় হজম হয়ে যাবে, জানি, ওটা তো তরল জিনিস, টাকা। অন্য যে কোনো জিনিসে আকার নেবে, টেরও পাওয়া যাবে না। কিন্তু অতোগুলো তামা তো আপনারা গলাতে পারবেন না। গলিয়ে করবেনও বা কী। ওগুলো বেচতে হবে। কিন্তু বাপুরা বেচবেনই বা কোথায়। সব জায়গায় বলে দেওয়া আছে, সঅব। বুঝলেন সেয়ানা ম্যান?
লোকটা গুদামঘরে জড়ো সবার সামনে পায়চারি করতে করতে ওপর থেকে নিচ পরখ করতে শুরু করল সবার। একবার সৌরভকেও আগাগোড়া দেখে নিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসল। তবে ঝুঁকি নিলো না। সঙ্গে সঙ্গে অন্য কথার আবরণে ঢেকে দিলো হাসির উলঙ্গ শরীর।
এরপর একের পর এক উত্তপ্ত পেরেক ফুটিয়ে যেতে থাকল লোকটা সবার হাত, পায়ের পাতা, উরু আর বাহুতে। তার পরিহাসসজল চোখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে সলিল। মন নয়, মান বাঁচাতে ক্রমশ ধূর্ত হয়ে ওঠা চোখের মণি দুটো ভেজা খয়েরি। গোলকের সাদা অংশটুকু লালচে হয়ে আছে। সলিল যা আশা করে নি তাই দেখতে পেল। মানুষটির চোখের ভেতর দিয়ে মনের ভেতরটা পড়তে পারা যায়। তলপেটে বাড়তি কোনো মেদ নেই, অথচ থাকবে বলে যেন সে আশা করেছিল।
তদন্তকারী এসেছে সাদা পোশাকে, তাই জ্বলজ্বলে বর্ণমালায় নাম পড়ার উপায় নেই। দেখতে পেল, লোকটা তাকে নিরীক্ষণ করছে। সলিলের ভারি গোঁফ, না কামানো গাল থেকে ক্ষেতের নাড়ার মতো বেরিয়ে থাকা দাড়ি। প্রশস্ত চশমা পরা চোখ, একপাশে সিঁথি, ঘন কালো চুল। পরনে সাদা শার্ট আর একই রকম সাদা পাজামা। মনে হলো, দক্ষিণ পাশের জানালা দিয়ে আলো আসছে ঠিক। কিন্তু ওর গালের ওপর আলো এসে পড়ছে উত্তর দিক থেকে। যেন কাঁপতে থাকা জলের ওপর থেকে তাকিয়ে সলিল দেখতে পেল জলের নিচে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের দৃষ্টি বয়েসী বিপ্লবীর মতো গম্ভীর এবং প্রশ্নবান।
তদন্তকারী ঘাড় বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল, একবার নিচের দিকে, আরেকবার সমীরের মুখে। বুঝি চেনার চেষ্টা করছে তাকে। নির্লিপ্ত চোখে সলিলও দেখছে তাকে এবং ওই দৃষ্টিও অস্বস্তিকর। প্রতিযোগিতায় নাছোড় প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে বিরক্ত হলো তদন্তকারী। কিছুটা অহমবশত, কিছুটা প্রভাব হারানোর ভয়ে।
শুরুটা তার আমুদে কণ্ঠেই হলো, যেমনটা হয়ে থাকে বরাবর। ধীরে মুখটা হয়ে উঠল কঠোর। এরপর দ্রুতই চুকে গেল সব।
সলিল, তারেক আর হাসনাত ছাড়া বাকিদের ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড় খুলিয়ে হাতকড়া পরিয়ে হাঁটতে বাধ্য করা হলো। রোদে ঝিকিয়ে উঠতে থাকল ওদের ঘর্মাক্ত শরীর। ওদের পেছন পেছন এগোতে থাকল গোটা কারখানার শ্রমিক দল। কেউ পাশের জনকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকল, কেউ চোখ মুছতে লাগল, কেউ আবার দিয়ে উঠল সশব্দ করতালি। দিনটা অন্যান্য দিনের তুলনায় মাটি তাতানো, চাঁদি ফাটানো। গাছগাছালির ডালপাতার ফাঁক ফোকর গলে আসা আলোর সরলরেখা সলিলের চোখের কাচে প্রতিসরিত হয়ে ঝিলমিল করছিল। চোখতে ক্লান্ত করছিল। কিন্তু মনকে করছিল উদ্দীপিত। চারপাশে তাকিয়ে সেই উদ্দীপনা সলিল আর কারো ভেতর দেখতে পেল না। হাসনাত মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। তারেক নির্লিপ্তভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে। সলিলই কেবল মুখ ঘুরিয়ে সবার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে একা। তার চোখের তারায় আলোর বাড়তি প্রতিফলন। ওপর আর নীচের পাতা দুটো কিছুটা বেশি রকম ফোলা, যেন কাঁচা ঘুম থেকে মাত্র তাকে মা ডেকে তুলেছে।
পেছন পেছন অনেকটাই আনমনে, অর্ধচেতনে এগিয়ে আসতে থাকা কর্তা আর শ্রমিকরা ধীরে পিছিয়ে গেল। পিছিয়ে গেল প্রধান তদন্তকারী। সৌরভের সঙ্গে শলা পরামর্শে ব্যস্ত লোকটা।
সলিল দেখতে পেল, কথার ফাঁকে ফাঁকে থেকে থেকে দুজনেই তাকাচ্ছে তার দিকে। সলিলকে তাকাতে দেখে সৌরভ কথার রেষে হাত নাড়ানো থামাল। তার দিকে ফেরানো চিবুকটা উঁচু হয়ে বারবার নেমে যেতে থাকল প্রধান তদন্তকারীর। ঘামে ভেজা বড় কালো মুঠোফোনটা থেকে থেকে হাতবদল করতে হচ্ছিল তাকে। ঘাড় ব্যথা করছে বলে মুখ ফেরাল সলিল। পথের ওপর দিয়ে একটা বেড়াল দৌড়ে চলে গেল। পেছন পেছন দৌড়–চ্ছিল ছোট্ট এক মেয়ে। বন্দিদের দেখতে পেয়ে সে অবাক! পথের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছে এখন। সামনে জংলা ফুলের ঝোপের আড়ে লুকিয়ে গেছে বেড়ালটা।
পুলিশের ভ্যান থামানোর জায়গাটা কারখানার ফটক থেকে অনেকটা দূরে। রাস্তা বড় খারাপ, এবড়োথেবড়ো, তাই সামনে আসে নি। লাল মাটি মাড়িয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এ পথে মেহেদির সঙ্গে সলিল অনেক সন্ধ্যায় হেঁটে গেছে। যে অংশের পর আর যায় নি, তার বাইরে সগর্বে নাক তুলে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের ভ্যান। কাছে গিয়ে দলটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
সলিল তারেক আর হাসনাতকে বাধ্য করা হলো সবার আগে উঠে যেতে। বাকি আর জনা দশেক সন্দেহভাজন ঘাড় গোঁজ করে গিয়ে উঠল গাড়িতে।
বেড়ালের পিছু ধাওয়া করা ছোট্ট মেয়েটি হেঁটে গাড়ির চলে এসেছে। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাবা!
ওর বাবা লোকটা কোর বিভাগের সবচেয়ে শান্ত শিষ্ট লোক রওশন। শপথনগর থেকে সপরিবারে ফিরে কেওয়া গ্রামেই সে থিতু। ছোট্ট মেয়েটা আবারো চিৎকার করে উঠল। রওশনের মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন এলো না। নির্লিপ্ত মুখে হাত পা চালিয়ে গাড়িতে উঠে এলো, ফিরেও তাকাল না। এরপর দু পায়ের ফাঁকে মুখ আড়াল করে বসে থাকল চুপচাপ। শিগগিরই তাকে আড়াল করে দিলো অন্যান্য সহকর্মীরা।
এদের প্রত্যেকের সঙ্গে দুঃখ সুখের আলাপ হতো সলিলের। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছ থেকে মুখ আড়াল করতে ব্যস্ত। এতে অপরকে মৃদু স্বরে জায়গা করে দিতে বলা ছাড়া আর কোনো বাক্যবিনিময় হলো না একের সঙ্গে অপর কারো।
জড়ো মাথাগুলো সরিয়ে হঠাৎ এক প্রিয় মুখ দেখা দিলো সলিলের চোখে। তার কপাল থেকে ঘাম ধারা মেনে নেমে আসছে। দু’কাঁধ থেকে গলার পাদমধ্যে নেমে আসা হাড়ের ওপর ঝিকিয়ে ওঠা ত্বক। বুকের ওঠানাম স্পষ্ট। মরিয়া কণ্ঠে মেহেদি বলল, আমার মেরুদ- শেষ হয়ে গেছে ভাই। অনেক কষ্টে এলাম। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আটকে রাখতে পারবে না তোমাকে। কারণ আমি আছি, এই পল্লব আছে।
ভিড়ের বাইরে পল্লবের মুখটা দেখা গেল, দু চোখে উদ্বেগ।
মেহেদি বলে চলল, সম্ভব হবে না সলিল তোমাকে আটকে রাখা। এটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগো না যেন তুমি।
সলিল চুপ করে থেকে কেবল শুনে গেল কথাগুলো। তারেক পাথরের মতো মুখ করে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল। মেহেদির দিকে একবার তাকাল বটে, কিন্তু কোনো বাক্যব্যয় নয়। হাসনাতেও উৎসুক অসহায় চোখ মেহেদির দিকে। ওই চোখে চোখ পড়ায় মেহেদি মলিন হাসল। যেন বলে উঠল, তোমার বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারছি না হাসনাত। তবে চেষ্টা করব আমি, কথা দিচ্ছি। ওই বাক্সময় চোখের ওপর থেকে হাসনাত চোখ ফিরিয়ে নেওয়া মাত্র মেহেদির মুখে কথা ফুটল। তুমিও আশা হারিয়ে না হাসনাত, চেষ্টা চলবে।
ওদিকে এসমস্ত কথায় গাড়িতে উঠে বসা নিরাপত্তারক্ষীসহ অন্যান্য শ্রমিকরা তখন এ ওর মুখ চেয়ে অবশেষে মেহেদির দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করতে শুরু করেছে।
আমরাও নির্দোষ স্যার! কিচ্ছু জানি না! বিশ্বাস?
আমার কথাও বলবেন স্যার, ঘরে আমার পরিবার না খাওয়া!
স্যার, আমার কথাও! আমি নির্দোষ স্যার, আমি নির্দোষ! কসম খোদার!
স্যার স্যার, আপনার পায়ে পড়ি স্যার, আমার কথা কেউ শুনলো না।
আপনি আমাকে অন্তত বিশ্বাস করেন স্যার, কোনোদিন আপনার অবাধ্য হই নাই স্যার!
গাড়ি চলতে শুরু করলে কথার অসম্পূর্ণ বর্তনী কেবল বিব্রতকর নিষ্ক্রিয় শরীর নিয়ে বাতাসে ঝুলে থাকল কিছুক্ষণ। আঁকড়ে ধরার কেউ থাকল না বলে পথে পড়ে গড়াল এরপর। ক্রমশ চোখের আড়াল হয়ে গেল পিছু নিলো না।
গাড়ির ছাদ গড়িয়ে বাতাস এসে ঢুকে পড়ছিল পেছনে। আরামপ্রদ নাতিশীতোষ্ণ বাতাস, যন্ত্রের মন্দ্রগম্ভীর স্বর, আটক মানুষগুলোর সম্মিলিত স্বেদগন্ধ, ধরাণাতীত বাস্তবতার ভর, নিয়ত পরিবর্তনশীল বর্তমান এই পঞ্চপ্রপঞ্চ সলিলের মগজে শত স্নায়ুবৃক্ষে ফোটালো সহস্র তন্দ্রাকুসুম।
অবজেকশন! দেখুন সলিল মিস্ত্রী, এই এভাবে কিন্তু আমার তাকিয়ে থাকবার কথা ছিল। কিন্তু আমি পারছি না, পারছেন আপনি। কেন? এমন তো কথা ছিল না? বলুন জনাব সলিল। বোধয় নিজেকে জাদুকর ভাবছেন আপনি? বুজরুকি দেখিয়ে লাভ নেই আজ। তাছাড়া এটা কামরূপ কামাখ্যা নয়। এখানে কোনো জাদুবিদ্যার স্থান নেই। সবই নিরেট বাস্তব। আমি বাস্তবতা মাপতে খারাপ নই, আমি ম্যান ভালো নই। আপনাকে খুব ভালো করে জানি। চোখ নামান!
দেখুন, আপনার ক্ষেপে ওঠা ঠেকানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। বরং আপনাকে উসকে দিতে পারি। ক্ষেপে উঠুন প্লিজ। বহুদিন হলো আপনারা সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠতে পারেন না। হৃদয়ক্ষ্যাপা হতে আপনারা পারেন না দাদাভাইয়েরা। আপনারা যে ক্ষ্যাপা হন তাকে বলে উদরক্ষ্যাপা। শুনুন, আমিও কিন্তু আপনাকে ভয় পাচ্ছি। বলতে দ্বিধা নেই, আমার ধারণা, আমাদের এই ঠা-া যুদ্ধ অথবা চারপাশের গোটা পরিস্থিতি, যা দেখছেন, তার সবটা শিগগিরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
বলে সলিল ঘুরে তাকাল এক যুবকের দিকে। তার দুই পায়ে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে তোলা, শার্টের হাতাও গোটানো। চোখে মুখে যুদ্ধংদেহী ভাব।
কী তারেক, আমাকে নিয়ে অনেক ঘুরেছ বলে খুব ক্ষেপে আছ বুঝি? আমি তো তোমাকে কিছু বলতে পারি না আসলে। ওই মুখ আমার আর নেই। বরং সুযোগ তোমার যথেষ্টই আছে। আমি তোমাকে জোর করে ওই কারখানায় নিয়ে গেছি, এজন্যে তুমি রাগ, তাই না? সত্যি কথা কি জানো? আমি নিজেও খুব অনুতাপে ভুগেছি, খুব অনুতাপে। কেন যে আমি; আচ্ছা থাক, কিছু ব্যাপারে সবাই সব জানে। কিন্তু কোনোভাবেই তা নিয়ে কথা বলা যায় না। তাই না? আমি এটা দেখেছি। এ সময়ের জন্য আলাদা একটা ভাষা দরকার। ঠিক না বন্ধু? থাক, তোমাকে এখনই জবাব দিতে হবে এমন নয়।
তদন্তকারী হঠাৎ বেশ হাশিখুশি হয়ে উঠল। দাদাভাই, আপনারা তো ঘুরেছেন শ্রমিকদের ঘরে ঘরে। আমি অনেক আগে থেকেই আপনাদের পিছু পিছু রয়েছি কিন্তু হাহাহা। হ্যাঁ, আপনারা আমাকে লক্ষ করেননি আমি জানি। করলে আর আমার লুকোনোর কোনো স্বার্থকতা থাকত বলুন? মানুষ আমাকে খবর দিয়েছিল; দিচ্ছিল বারবার। কর্মকর্তা আর কর্মচারীতে তো বন্ধুত্ব হয় না, এটাই বলছিল। কিন্তু আপনারা তার বিপরীত করে দেখালেন। কিভাবে সম্ভব হলো? ভেতরের জাদুটা চেয়েও বুঝতে পারলাম না। এখানে হাইয়ারআর্কি ভীষণ মান্য এক বিষয় বুঝলেন? যাক সব আপনাকে ব্যাখ্যা করব না। তবে আপনাকে পেছন পেছন গিয়ে যে বিষয়টা দেখেছি, সেটা তো আপনাদের বলতেই হয়।
তদন্তকারীর মুখের ভাব বদলে গেল। ভুরু জোড়া চলে এলো কাছাকাছি। চোখদুটো এদিক ওদিক ঘুরতে থাকল। মুখটা হয়ে উঠল ছুঁচাল, যেন স্থূল ষড়যন্ত্রী। আরো বলল, আমি দেখেছি, হতদরিদ্র শ্রমিকদের ইতর জীবনের স্বাক্ষী একেকটা ঘরের একটা কোনো কোণে রঙিন না হোক অন্তত একটা সাদাকালো টিভি হলেও আছে। ছোট নয়। বড় রীতিমতো। ছোটলোকগুলোর না খেতে পেলেও চলে কিন্তু টিভি দেখা চাই!
ব্যারাকের মতো সারি সারি ক্লিষ্ট টিনসেড বাড়ি। খোলা একেকটা দরজা। দাঁড়িয়ে আছে সলিল আর তারেক। পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে মনময়পুর সদরের তদন্তকারী। পরনে হাফপ্যান্ট থাকায় বেরিয়ে এসেছে লোমশ স্ফীত একজোড়া পা। তা দেখে এক শিশু তার সঙ্গীর দৃষ্টি আকৃষ্ট করে পা দেখিয়ে হিহি করে হাসতে লেগে গেল।
পুলিশ ভারি বিব্রত তাতে। বলল, দেখো বাবুরা, আমি কিন্তু হাঁটুর নিচে গুলি করি, তাই এমন পোশাক। হেসো না হেসো না! এটা যদি না পরি তো গুলি করবো বুক বরাবর! তাই বুঝি তোমরা চাও? বিশ্বাস হলো না? দেখবে, দেখবে? কী বলছো?
শিশু দুটি অস্ফুট স্বরে কী যেন বলে উঠল, আঞ্চলিকতার টান থাকায় আতঙ্কিত সলিল একবর্ণও বুঝতে পারল না, কিন্তু দিব্যি উত্তর দিয়ে গেল পুলিশ।
বাচ্চারা! একদম তোমাদের মতো, ঠিক তোমাদের মতো আমারও যে দুটো ছানা আছে। তাদের নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকতে চাই বলে টমটমের অগ্নিসংযোগের মামলাটা আমি তুলে নিয়েছি বাবারা! ওই ঘটনার পর তো মালিক শালিক সব উধাও! যেন জানেই না, জানতেও চায় না যে কারখানায় আগুন লেগেছে, শত শত মানুষ পুড়ে মরেছে। সবাই এতো করে নিষেধ করার পরও আমিই মামলাটা করলাম। আমার তখনও অনেক সাহস ছিল, হ্যাঁ, এই এত্তো সাহস! আর এরপর? দেখো না, এই এতটুকু হয়ে গেছি, আমি লুকিয়েছি মানুষের পেছনে। তোমার আমাকে দেখে হেসো না। আমি কী বলেছি বুঝেছ? হেসো না। অবশ্য তোমরা একেবারেই ছোট, একদম আমার দুটির মতো। সেকি! তোরাই! বাবার সঙ্গে মশকরা করিস? কর কর, এমনটাই তো সংবিধানে লেখা ছিল। ছিল না, মানে পরে লেখা হয়েছে। আগে এমন কিছু লেখা থাকবে, ভুলেও শুনতে পাইনি। ওই ভুলের মাশুল দিতে এখন পেছনে লুকিয়ে আছি। কী? কেন শুনতে পাইনি? সে তো আরেক গল্প রে! এতো কথা তোদের বলব কবে?
ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় সিমেন্টের প্রলেপ দেওয়া মেঝে এখানে ওখানে ফেটে চৌচির। কোথাও চাঙড় উঠে গিয়ে বালি, ইট বেরিয়ে পড়েছে। একই দশা দেয়ালেরও। কোনো এক সময় দেয়ালে সাদা রঙ করানো হয়েছিল। আজ তা আর বোঝার কোনো উপায় নেই। উইপোকা মাটি তুলে গাছের মতো নকশা করেছে দেয়ালে দেয়ালে। পলেস্তরা খসে বেরিয়ে আছে ইট। জায়গায় জায়গায় নাক ঝাড়ার প্রমাণ। শিশুদের কেউ প্রশ্রাব করতে চাইলে তাকে আর বাইরে নেওয়া হয়নি।
এরই ভেতর শ্রমিকরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে টেলিভিশন দেখছে। মগ্ন হয়ে থাকায় তাদের প্রত্যেকের ঘাড় ধীরে ধড়ের ভেতর ঢুকে গেছে, মুখ হয়ে আছে হা।
ওদের সাড়া পেয়ে চমকে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে ধড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ গ্রিবা। সলিল দেখো, যে নারীর যৌবন যতো প্রস্ফুটিত, সে ততো বেশি সংকুচিত ওখানে!
যৌবন কোনো আশীর্বাদকাল নয়, বরং অভিশাপের কাল তারেক!
দেখা গেল নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাটা পড়া শ্রমিকদের। ওরা বুক ঘষটে চলে মাটির কলসে কাত করে জল ঢেলে খাচ্ছে। ঘরের এক কোণে খর্বাকার পশুর মতো করছে সঙ্গম। যে শিশুটির জন্ম হবে এতে, সে শিয়রে বসে আছে, দেখছে হবু বাবা মায়ের কা-কিম্ভূত। এরকম একজন সঙ্গম থেকে সরে এসে ওদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বাইরের রোদের আলো পড়ল তার নাকের নিচের অংশে, বুকে, কাটা পড়া হাত দুটিতে, পায়ে। চোখ জোড়া কেবল দেখা গেল না। বলল, মালিককে বলবেন তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। তার পাঠানো ভাতায় আমাদের খুব ভালো তো চলেই, আরও কিছু বাঁচে!
ভেতর থেকে বৃদ্ধা কণ্ঠে কেউ একজন বলল, অনেক বাঁচে! খোদা তার ভালো করুক, এটাই চাই।
সাঁ সাঁ সাঁ! দুপাশে পেরিয়ে যাচ্ছে গাছ।
সত্যি, খোদা তার ভালো করুক!
তারেক ঘাড় বাঁকিয়ে মুখের স্থবির ভাবে একটুও বদল না এনে বলল, ঠিকাছে, তাই বলব।
চাপা আলোর মাপা অন্ধকার ঘরে দেয়ালের হুকে ঝুলছে সাদা শার্ট। বুকের কাছে কালো তরল কিছু জমে মড়মড়ে হয়ে আছে। সলিল একবার মড়মড়ে জায়গাটা শুঁকল, কোনো গন্ধ পেলো না। বুক পকেটে অনেকগুলো পুরু ভাঁজের কাগজ। সামনে পেয়ে অপরিচিত এক তরুণকে জিজ্ঞেস করল, তোমার শার্ট? পকেট এতো ভারি কেন?
ছেলেটা বলল, আমি আসলে খুব কাজের ছেলে বুঝলেন? কিন্তু এটা কেউ সহজে বিশ^াস করতে চায় না। বিশ^াস করুন আমি আসলেই ভীষণ কাজের মানুষ। কাজ যে কেবল ভালো বুঝি তাই না, এক মুহূর্ত থাকতে পারি না কাজ ছাড়া আমি।
সলিল মুগ্ধ। তারেকের দিকে একবার চেয়ে ফের তাকাল ওই তরুণের দিকে।
তরুণ বলে গেল, মানুষ বুঝতে না চাইলে কী আর করা যাবে বলুন? তাই এ ব্যবস্থা। পকেট ভর্তি কাগজ। মনে করবেন না যেন, আমার কেবল কাগজই আছে, কলম নেই! আগে মানুষ বুকপকেটে কলম রাখত। এখন তো অনেক আধুনিক হয়েছে, তাই রাখে হিপপকেটে।
ছেলেটা নিতম্বের দিক থেকে কলম বের করে এনে দেখাল। লেখনী বস্তুটা বৃত্তচাপের মতো বেঁকে গেছে।
সলিল বলল, এটা দিয়ে আর লেখার অবস্থা কি আছে আদৌ?
তরুণ খুশিতে ঝলমল করে বলে উঠল, দিব্যি!
বুক ঘষটে আরেক খোঁড়াকে মাটির কলসের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সলিল তার সাহায্যে এগিয়ে গেল। হাত তুলে বলল, রাখুন গো! আমি আপনাকে জল ঢেলে দিচ্ছি গো! এভাবে কষ্ট করতে দেখলে ভালো লাগে, বলুন?
কলসের সামনে গিয়ে মাটির লাল ঢাকনিটা সরিয়ে ভেতরে তাকিয়ে শ্রমিকের দিকে না তাকিয়েই বলল, তা, কী করে হলো এমন দশা আপনার, বলুন তো? পা কাটলো কেমন করে?
লোকটা কোনো উত্তর দিলো না। ঘরের ভেতর অন্ধকার ছিল জমাট। ওটা ভেঙে বাইরের আলো আসতে পারছিল না। কিন্তু সলিল যেই না ইচ্ছে করল, কলসের ভেতরটা আলোয় ভরে উঠল। দেখল, কলেসের নিচে মাটি এঁকেবেঁকে জমে কেঁচোর আকার নিয়ে পড়ে আছে। ঢালবে বলে কলস কাত করতেই ঘটল আলোড়ন। তাতে মাটি গুলিয়ে উঠে স্বচ্ছ জল ঘোলা করে দিল।
সলিলের মুখের পরিবর্তনে বিকলাঙ্গ শ্রমিকের অর্ধাঙ্গী সব বুঝে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, এ কী করলেন? উপকার করতে এসেছেন নাকি ক্ষতি করতে! কত কষ্ট করে থিতিয়েছিলাম, সব বরবাদ হয়ে গেল।
সলিল ওদের সামনে আমতা আমতা করতে থাকল। কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। শ্রমিকটি সলিলের আশ^াস পেয়ে মেঝেতে স্থির হয়ে বসে জিরোচ্ছিল। খেদোক্তি করতে করতে আবার হামাগুড়ি দিতে শুরু করল কলসের দিকে। বলল, যান যান, ভণ্ড! অক্ষম! তেলপড়া খান, যান যান!
ফিরতে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা একটা রূপালি চৌকো আয়নায় সূর্যের ঝিলিক পড়ায় চমকে তাকাল সলিল। হেঁটে কাছে গেল আয়নার। পেছনে কালো দাড় পড়া কাঠের মসৃণ পিড়ির ওপর রাখা আধুনিক মডেলের দামি মুঠোফোন, রঙ ফর্সাকারী ক্রিমসহ হরেক রকম দামি প্রসাধনী আয়নার দৃশ্যমান। কাছেই গোমড়া মুখে বসে আছে এক কিশোরী।
এক কিশোর সলিলকে দেখে একটা ধাতব রূপালি বেল্টের ঘড়ি গম্ভীর মুখে পরতে শুরু করে দিলো।
কিশোরীটি চেঁচিয়ে বলল, ইশ্, বন্ধ ঘড়ি পরে ভাব দেখো না!
কিশোর ছেলেটা এ কথায় লজ্জা পেল, কিন্তু ওটা মুহূর্তের। পরমুহূর্তে দাঁত খিঁচিয়ে মার দেখাল মেয়েটাকে।
সলিল একবার তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। ভাবল, ছেলেটাকে খুলে দিয়ে দেবে কিনা। কিন্তু, এ যে তার বড় শখের ঘড়ি! সুপাত্রে পড়বে তো?
একবারমাত্র ভেবে ঘড়ির বেল্টে হাত দিয়ে ঠিক জায়গায় চাপ দিতেই কিট করে শব্দ হলো। এ শব্দ ভারি মিষ্টি লাগে সলিলের কানে। এই ঘড়ি সে সচরাচর হাত থেকে খুলতে চায় না। কিন্তু তার স্ত্রীর কাছে গেলেই হয়েছে। দুষ্টু মেয়েটির কাছে আসামাত্র এটা আর হাতে থাকবে না। তার লক্ষই হচ্ছে ছল করে হাতঘড়িটা খুলে দেওয়া; একবার ঘটে নি। অসংখ্যবার।
ঘড়িটা খুলতেই দেখা গেল সামনে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। আর কেমন বদলেও গেছে চারপাশ। উঁচু ছাদের সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির অভিজাতদর্শন কামরায় দাঁড়িয়ে আছে সলিল। শুভ্রা কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করল, বলল, বেশ, সবকিছুতেই তুমি আমার মতো হয়ে পড়েছ, কিন্তু আরও একটু সামাজিক হবে কবে বলতো? উঠোনে নানা নানুভাই আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলো গে না, যাও! তাদের একটাবার ফোন দিয়েছ নাকি দিয়েছ তাদের একটা কোনো চিঠির উত্তর? ছিহ্!
বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল উঠোনে গজিয়ে ওঠা লাউ কুমড়োর লতা একটা দৃঢ় মাচায় নিজেদের এলিয়ে দিয়ে আরাম করছে। গাছগুলোর গোড়া নিড়িয়ে দিচ্ছেন এক বৃদ্ধা। হালকা কমলা রঙা শাড়ি তার, পাড়ে কালো নকশা লাগাতার। চুল টান টান করে বাঁধা। সলিলের দিকে ফিরে মিষ্টি করে হাসল, চেহারাটা বোঝা গেল না, যেন কুয়াশা ঝুলছে বৃদ্ধার মুখের ওপর।
ওদিকে মাটিতে পা ছড়িয়ে রুলটানা খাতায় ক খ লিখছে এক শিশু। তেল জবজবে মাথা, কানের পাশ গড়িয়ে নামছে সান্দ্র তরল, পরিপাটি আঁচড়ানো চুল। বর্ণগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি অর্থহীনভাবে জুড়ে দিয়ে বানাচ্ছে অভিনব সব শব্দ। জিভটা প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে লেপ্টে আছে ওপরের ঠোঁটের সঙ্গে, কাজে এমনই মগ্ন। হঠাৎ ওই শিশুর পিঠে পড়ল ঘা!
তদন্তকারীর কাণ্ড! সলিল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। চোখে জমা হচ্ছে বেমানান স্পর্ধা, একেবারেই বেমানান।
তদন্তকারী বলল, কারখানায় ডাকাতি! আমার পুরো সন্দেহ আপনার ওপর! আপনার কোনো কথা সাজানো আছে? থাকলেও বা কি। চলুন। উঠুন, উঠুন, গাড়িতে উঠুন। আমাকে ছড়ি চালাতে বাধ্য করবেন না।
সে মুহূর্তে সলিল খুব ভয় পেয়ে গেল। স্ত্রী পুত্রের সামনে পুলিশ এমন কথা তাকে বলতে পারে সে ভাবতেই পারেনি। মনে পড়ল, বন্ধু তারেক বলতো, পুলিশের কোনো মানজ্ঞান নেই। বোধয় কথাটা পুলিশটাকে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। সঙ্গে যখন স্ত্রী আছে, সন্তান আছে, তাদের সামনেই যেহেতু এমন অনাকাক্সিক্ষতভাবে এই বিটকেল লোকটা এমন এক অশোভন বাক্য বলে বসলো, তখন উত্তরটাও দিতে হবে শান্ত স্বরে ওদের সামনেই। তাতে হয়তো লুপ্ত সম্মানের কিছুটা হলেও ফেরৎ আসবে। কে জানে, পুলিশের সঙ্গে কখনও নাকি জুয়া খেলতে নেই। তবু এই ঝুঁকিটা নিতেই হবে, ভাবল সলিল। বলল, আমাকে সন্দেহ না করার কোনো কারণ নেই। আমাকে সন্দেহ আপনি করতেই পারেন, কারণ সন্দেহের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। আর সন্দেহ করার জন্যই মাসে মাসে আপনাদের বেতন দেওয়া হয়। কিন্তু আপনাকে বলছি শুনুন, যতোই সন্দেহ করুন না কেন, আমার চুলের ডগাটিও আপনি বা আপনার সাগরেদদের কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। শুনতে চান কেন? শুনতে চান? কারণ আপনি এ মুহূর্তে বাস করছেন আমার ইচ্ছের জগতে। আমার ইচ্ছের জগতে আমি চাইলেই আপনি নীরব আর অথর্ব হয়ে থাকবেন। কেউ জানবে না। শুধু আমিই জানব যে অপরাধী আপনাদের কব্জায়, এরপরও তাকে আপনাদের দরকার। না, আমি মোটেই পাগল হয়ে যাইনি। আপনি জেনে রাখুন, যেভাবে আমার সন্তানের পিঠে আপনি লাঠি বসালেন, আমার ইচ্ছের জগতে আপনার স্বজনরাও কিন্তু আমার হাতে নিরাপদ থাকল না!
এ পর্যায়ে শুভ্রা দৌড়ে এসে ওর বাহু ধরল। সলিল, তুমি না হিংসা করো না, তুমি না আঘাতের বিপরীতে আঘাত করো না! তাই তো আমি তোমাকে ভালোবেসেছি? এমন করলে কিন্তু একবারে চলে যাব, আর কখনও ফিরব না, ভালোও বাসব না। আমি তোমার কথা কত বলি সবাইকে, এই তার মূল্য তুমি দিলে, না!
সলিল শুভ্রার হাতটা সরিয়ে দিয়ে তদন্তকারীকে উদ্দেশ করে বলল, এই কারখানা ছেড়ে এক চুলও আপনি নড়তে পারবেন না। এখানেই আপনাকে শেষ নিঃশ^াস ফেলতে হবে। সব কাজ করতে হয় এখানেই করবেন, এখানে থেকে করবেন, খবরদার!
তদন্তকারী মুখদাঁত খিঁচিয়ে বলল, এবার বুঝেছি আপনাকে শুরু থেকেই কেন আমার চেনা চেনা লাগছিল! আসলে আপনার মতো ভণ্ড, ছদ্মবেশী নিয়েই তো আমাদের কারবার। আমাকে এ কারখানায় আটকে রাখার ভয় দেখাচ্ছেন! সাহস তো কম নয়? এই দেখুন! আমি এই মুহূর্তে কারখানা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি! পারলে আমাকে আটকান।
হাহাহা, যান তদন্তকারী সাহেব, যান। আপনি আসলে আমার মন বুঝতে পারেননি। আপনাকে আটক রাখার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। আর তা ছাড়া আমার ক্ষমতার সবটা খাটিয়েও আমি তা পারব না, এটাই জানতাম। আমি শুধু আমার আপন মানুষদের সামনে একটু চিৎকার করে দেখালাম। ওদের বোঝালাম যে আমিও পারি। আর ওদিকে আপনাকেও এও বোঝাতে চাইলাম, দিনের শেষে বাড়ি ফেরার পর আপনিও একজন চিৎকার সর্বস্ব সামাজিক মানুষ ছাড়া আর কেউ নন। আপনারও আত্মীয় পরিজন আছে, যেমন আছে আমাদের। তাদের প্রতি আপনারও দায় আছে, যেমন আছে আমাদের।
থামল সলিল।
তো বেশ, বলল তদন্তকারী। আপনার পরই আমার দ্বিতীয় সন্দেহ তারেকের ওপর। আর কারখানার সবাই তাই বলে। যা রটে, তা তো কিছুটা হলেও বটে। আর একজন তো আছেন সন্দেহের সমস্ত প্রশ্নের অতীত!
হাসনাতকে দেখানো হলো।
ওহ! হাসনাত। হাসনাত ভালো ছেলে অফিসার। সদর দপ্তর থেকে এসেছে। আর ওর সঙ্গে আলাপও হলো মাত্র সেদিন। অকপট, সৎ ছেলে হাসনাত। আপনি চাইলে সদর দপ্তরের লোকদের জিজ্ঞেস করতে পারেন।
পুলিশ হাত তুলে থামিয়ে বলল, ওটা করতে আপনি বলার জন্য বসে নেই আমি। সদর দপ্তর থেকেও তার ওপর সন্দেহ প্রবল। যাহোক। অতো কথায় কাজ নেই;
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সলিল বলে উঠল, আর তারেক! সে তো আমার বন্ধু! ও এই কাজ করতেই পারে না। ওর চোখে তাকিয়ে আমি গতরাতে সমস্ত শ্রমিকের ঘর ঘুরে এলাম আরো একবার। ঘরের কোথাও আমি উদ্ধত কিছু পাইনি, আমাকে বিশ^াস করতে পারেন। সব কিছুই কী ভীষণ বিনয়ী!
যত অপ্রাসঙ্গিক কথা!
আপনি মন দিয়ে শুনুন অফিসার, কী বলছি আমি! সত্যিই যদি রহস্য সমাধান করতে চান, আমার এসব কথা কাজে আসবে, মোটেও এসব অপ্রাসঙ্গিক নয়। ওদের ঘরে সবকিছুর ভেতরই ভীষণ বিনয়। ওদের ভাঙা মেঝে, আবর্জনার স্তূপের দিকে খোলা ওদের শিকবিহীন জানালা, দরজার হুকে ঝোলান মলিন শার্ট, এক কোণের ছোট্ট টেলিভিশন, উঠোন লতানো অপরাজিতা, ওহ! এই বিনয় আর যত্ন ছাড়া আমি গরিবের ভেতর কখনও আর কিছু দেখলাম না। আর যা আছে ধান্দাবাজির মতো ব্যাপার, নেশা, খুন খারাবির আরেক অন্ধকার জগৎ, সেখানে দেখবেন শ্রমিক শ্রেণির সদস্য কেউ নেই।
নাটকীয় ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁট উল্টে ভুরু দুটো তুলে বলল সলিল, দুর্লভ!
পরমুহূর্তে মুখটায় আবার অসহায় অনুরোধ রাখার সহিষ্ণু ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে বলতে শুরু করল, আপনি যখন শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করবেন, তখন আপনাকে তাদের পথে চিন্তা করতে হবে, যা কিন্তু আপনি একদম করছেন না। আপনাকে ওদের মানসিকতা বুঝতে হবে, জানতে হবে যে মনের কোন পিচ্ছিল গর্তে অপরাধ প্রবণতার জন্ম হয়। ওই গর্তের খোঁজ পেলেই আপনি এগোতে পারবেন। অন্যথায় যা হবে তা হলো সময়ের অপচয়।
হঠাৎ চোখে গৃহস্থবাড়ির ঘর। উত্তর দিকে কারাগারের মতো শিকদেওয়া জানালা। এর নিচে চৌকি। মন খারাপ করা কালচে হলুদ আলো ঘরময়। সে ঘরের পুবদেয়াল ঘেঁষে রাখা টেবিলে ঘাড় গুঁজে এক নারীর কাছে চিঠি লিখছে সলিল। নারী দেখতে অবিকল শুভ্রা, তবু সলিল যেন নিশ্চিত, তার চিরচেনা সেই শুভ্রা এ নয়। এই নারীর রকমটি তার অচেনা।
সলিল লিখছিল;
এখানে আসার রাতে আমার চোখে পড়েনি, উঠোনে দুটি কবর…
এ বাক্য লেখার পর ওই নারী ঘরের ভেতর আবির্ভূত হলো। কোলের ওপর হাত দুটি আড়াআড়ি ফেলে শান্ত মুখে বসে থেকে শুনে ওর গেল কথা।
বজ্রপাতের মড়া, তাই উঠোনেই কবর দেওয়া হয়েছে, নয়ত মরদেহ চুরি করে লোক। কবরের ওপর দুটো করে গাঁদা ফুল গাছ, শুভ্রা। ওই মড়া দুটি কাদের জানো? গৃহস্থের দুটি মেয়ের। ওরা যমজ। যেমন একসঙ্গে এসেছিল, তেমনই একসঙ্গে চলে গেছে। পরে এসেছিল আরেকটি বোন। তৃতীয় এই বোনটি বড় দুই বোনের কবরের মাটি নিড়িয়ে দিতো, আগাছা বেছে দিতো। কুলো নেড়ে বাছতো চাল, এরপর উঠোন দিতো ঝাঁট। বিকালে চৌকাঠের কাছে মাদুর পেতে প্রার্থনার শীতল পাটি বুনতো, ভারি সুন্দর।
গ্রামের গৃহস্থবাড়ির মেয়ে, স্বাস্থ্যে সৌন্দর্য্যে তার প্রমাণ ছিল। একদিন বিকেলে এসে কী দেখি জানো? তেমন কিছু তো নয়। মেয়েটা জানালার শিকে জমা ধুলো ঝাড়ছিল উঠোনে হেঁটে হেঁটে, পরনে মনময়পুরী শাড়ি। গোড়ালির বেশ খানিকটা ওপর তুলে পরা। শ্যামল একজোড়া পা। আর অনাবৃত শ্যামল বাহু, কোমল সুন্দর। তাকে দেখে আমার অন্ধকার শীতল ঘরে ঢোকার পর কী এক ঘোরে যেন আচ্ছন্ন হলাম। মনে হলো ওর ললিত দেহটা বুঝি খুব করে চাই।
আমি ওই ভাবনাকে আর স্থান দিইনি মনে আর এক মুহূর্তও। আমি আমার মনের আয়নায় আঁচড় পড়তে দিইনি, ঘর থেকে বেরিয়ে গেছি। যদি ওই চিন্তা, ওই মোহ আবার আমায় পেয়ে বসে?
ওটুকুই। তবে ওটুকু ভাবনায় আসার জন্যেও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি। শুধু যদি তুমি বলো, ক্ষমা, তবেই নিজেকে শান্ত করতে পারব। তুমি কি বলবে? পাশবিক প্রবৃত্তি তো মানব বিবেকের শূচিতা অশূচিতার সূক্ষ্ম হিসেব বোঝে না, ওই বোঝাপড়ায় আস্থা রাখে না। ওই বিবেকটুকু যখন পার্থক্য, তখন ধরে রাখতো তো হবেই, বলো শুভ্রা? তুমিও কি তাই মনে করো না? আমার মন অনুতপ্ত হয়েছে।
মাথা থেকে বিন্দু প্রবৃত্তিপ্রিয় ধারা হয়ে নিচে নেমে এসে জননপথ অবধি এসেছে। আমি তাকে ফের তালুতেই ফেরৎ পাঠিয়ে রাধাকে বিজয়ী করেছি। ভালো করেছি না?
আমি আত্মার সাধারণ ধারণা মানি না। কিন্তু একান্ত নিজস্ব যে ধারণা আত্মার, তার ধ্যানে আমার পূর্ণ মতি আছে। আছে বলেই এর চর্চায় রিপুর তিল পরিমাণ ক্ষতিও সইব না। তোমার শরণাপন্ন হতেই হলো আমাকে। বলো, ক্ষমা করেছ?
ওই অচেনা শুভ্রা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকল, শত ডাকেও আর এমুখো হলো না। কাঁপছিল থেকে থেকে। একসময় ধীরে ধীরে সলিলের দিকে ফিরল প্রিয় মুখ। মুখের ওপর কুয়াশা জমে আছে। খানিকটা কাটলে দেখা গেল শুভ্রা আর আগের মতো নেই। তবুও মান্য। বলল, ক্ষমা করব, প্রায়শ্চিত্যের পর। সলিল বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকল। উল্টোদিকে তারেকের সঙ্গে হাঁটুতে হাঁটুতে হলো ঠোকাঠুকি। তারেকের বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে সলিল বলল, ভয় পেয়ো না। আরও বড় অভিজ্ঞতার দিকে আমরা যাচ্ছি। আমাদের মুক্ত ইচ্ছে আর অগণিত মানুষের কাজের লব্ধি আমাদের ওদিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রকৃতি এমনটাই চায়, মুক্ত ইচ্ছের লব্ধির জয় হোক। মানুষ যে কোনো পরিবেশের সুবিধা নিতে পারে। সামনের অভিজ্ঞতা হয়ত বড় কোনো আন্দোলনের জন্য আমাদের তৈরি করতে পারে।
তারেক মৃদু হাসল। সলিল বলে গেল, তুমি কর্মী। তোমার হয়ত ভীষণ কষ্ট হচ্ছে কাজের পরিবেশ ছেড়ে যেতে। শক্তিমতি তোমার মতো কোনো মেধাবীকে হয়তো পাবে, কিন্তু তোমার মতো এমন নিবেদিতকে আর কোনোদিন পাবে না। কেননা মেধার পথে অভিন্নতা আছে। নিবেদনের পথে সবাই ভিন্ন। না পেলেও ক্ষতি কি? মানুষ কি আর চিরকাল এক জায়গায় থাকে, না থাকতে পারে? প্রকৃতি যদি চাইতো, মানুষ থাকুক, তো দুটি পা না দিয়ে শেকড় দিয়ে দিত। কী বলো বন্ধু! তবে কী জানো, মানুষেরও কিন্তু শেকড় গজায়। তার স্থলচর অস্তিত্ব যে বৃহত্তর মাটির প্রাণরস পেয়ে বেড়ে ওঠে, বিকশিত হয়, সেখানেই তার মূল ক্রমশ গভীরে ঢুকে পড়ে। চাই আরও পুষ্টি! বেড়ে উঠতে চাই আরও, আরও! তাতে যদি কখনও টান পড়ে, রক্তক্ষরণ হয়।
মনময়পুর থানায় ওরা পৌঁছে গেছে। মূল ফটকের পর হাঁটাপথের দুপাশে মেহগণি গাছের সারি। গাছে গাছে ফলের খোল ফেটে হাঁ। নিচে ইট বিছানোর পথের ওপর, খাঁজে, ছড়িয়ে রয়েছে, সেঁধিয়ে রয়েছে গাঢ় রঙা ফলগুলো। এর ভেতর দিয়ে ওদের দুজনকে টেনে নিয়ে যাওয়া হতে থাকল। আরও এগোতে দেখা গেল থানার বারান্দায় একাটা লম্বা মতোন বেঞ্চি পাতা আছে। তাতে বিমর্ষ মুখে বসে আছে চারজন। ওরা প্রত্যেকে সুরবঙ্গ যুদ্ধে অঙ্গহারানো সৈনিক। ওদের কাঁধের ওপর তাকিয়ে বোঝা যায়, খানিক আগে সৈনিক পদবী ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে।
সলিলরা পেরিয়ে যাওয়ার সময় ফিরেও তাকাল না ওদের কেউ।
তারেক কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। সলিল তার আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারেক কাছে এলে বলল, আমাদের দেখে নিশ্চয়ই রাজবন্দির মতো লাগছে ওদের কাছে, তাই না?
পরমুহূর্তে চোখের আলো গেল নিভে। বিমর্ষ হয়ে উঠল স্বর। দেখো, আমার আত্মবিশ^াস কতো কমে গেছে। কেমন লাগছে সেটাই এখন বড় হয়েছে। যাহোক, আমাদের দেখলে এখন আমাদের পরিবারের কেমন গর্ব হবে বলো তো? ধুস্! আমি বেরোতেই পারছি না চক্র থেকে। আমাকেই কেবল ঘোরাচ্ছ তোমরা, আমি একাই কেবল কথা বলে যাচ্ছি। কই, তুমি, তোমরা তো কিছুই বলছো না। শোনো, আত্মবিশ^াস কমে গেছে বললাম না এইমাত্র? কথাটা তুলে নিচ্ছি। কমেনি। দেখো, আমরা একদিন ঠিইক মুক্তি পাব। ঠিক পাব, দেখো! জানো তোমরা?
রাতের খাবারের পর বিছানা বালিশ নিয়ে রবি রওনা হলো সলিলের নতুন ঘরের দিকে। রবির পেছন পেছন জামা কাপড় আর বইপত্র বোঝাই দুটো ব্যাগ নিয়ে আসছিল সলিল। মাটিতে গড়া গাঁয়ের পথ, এখানে ওখানে গাছের শেকড় ফেঁপে ছিল। অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। যথেষ্ট ধীরে চলার পরও দুবার হোঁচট খেতে হয়েছিল সলিলকে। মানুষ যতো ধীরেই হাঁটুক না কেন, কোনো প্রতিবন্ধকে হোঁচটটি খেলে বুঝতে পারে, বেগ আসলে যতটা ভেবেছিল ততোটা কম ছিল না, তাই না তারেক? কারণ অঙ্গ সংবেদনশীল, আর অনঙ্গ মন তো আরও। সব মিলিয়ে অনেকটা পথ। উপরন্তু সঙ্গে বোঝা নিয়ে হাঁটায় পথের দূরত্ব বেড়ে হয়ে উঠল কয়েকগুণ।
অন্ধকারে উত্তর দিকে যেতে যেতে হঠাৎ পশ্চিম দিকে মোড় নিলো রবি। রবিই তখন সলিলের চলার পথের আলো। সেও নিলো পশ্চিমে মোড়। এগোতে এগোতে সামনে মুক্ত হলো ইংরেজি ইউ আকৃতির এক বাড়ি। ইউর ঠিক মুখে বড় কালো ফটক, নিরেট নয়, নকশাদার, তাই ভেতরটাও চোখে পড়ে। আধফালি চাঁদের অন্ধকারে যতটা দেখা যায় তাতে ভেতরে যে দৃশ্য চোখে পড়েছিল, তা দেখার জন্য সলিলের মন তৈরি ছিল না। পাশাপাশি দুটো কবর।
পথের একপাশে এমন কবর পড়ে থাকতে আগে কখনও দেখেনি রূপোসনগরে বেড়ে ওঠা সলিল।
ফটক পেরিয়ে ঢোকার মুখে এক পাশে কাচারি, আরেক পাশে গোয়াল ঘর পড়ে। মধ্যখানের হাঁটা পথের একাংশ টিনের চালায় ছাওয়া। কাচারি পেরিয়ে যেখানে ঘরের মূল অংশ শুরু। এর প্রথম ঘরটা শক্তিমতি কারখানার ভাড়া নেওয়া। সেখানেও লতাপাতার নকশা করা ধাতব দরজা এবং সেটিও নিরেট নয়। আগের মতো নির্বিঘ্নে এখানে ঢোকা গেল না। চাবি দিয়ে তালা খোলার প্রয়োজন হলো। পাশাপাশি দুটি ঘর, কিন্তু ঢোকার দরজা একটাই।
দ্বিতীয় ঘরটা প্রথমটার সঙ্গে দরজাপথে সংযুক্ত।
প্রথম ঘরটা পল্লবের। পাশের ঘরটা সলিলের জন্য বরাদ্দ। ঘরের ভেতর ঢুকে স্বল্প শক্তির হলুদ আলোটা জ্বলালানো হলে তীব্র মন খারাপ করা একটা পরিবেশ ঝুলে থাকল। ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে দুই কবাটের বন্ধ জানালা। জানালার শিকগুলো জেলখানার শিকের মতো, সারি সারি, উলম্ব। জিনিসপত্র থলেছাড়া করে ফের গোছগাছ করতে করতে রাত এগারটার মতো বেজে গেল। রাত এগারটার ভেতর দিয়ে সলিলের কোলে এসে পড়ল তার হারানো শহর। যখন রাত এগারটা বাজত, মুক্তমঞ্চের আড্ডায় ভাঙন ধরত তখনই কেবল।
আড্ডায় ভাঙন মাত্র ধরেছে। বাসের ঠাণ্ডা জানালার পাশে বসে আছে এখন সলিল। শহরে রাজনীতির অবস্থানিরূপক এই বাসের জানালা। যেদিন দলগুলোর বিরোধ চরমে ওঠে, খোলা জানালা দিয়ে পেট্রোল বোমা এসে পড়ে।
বলছিল সহযাত্রী। অপুকে কখনো না দেখলেও মনে হলো এ অপু না হয়ে যায় না।
কত মানুষ যে পুড়ে মরল ওই পেট্রোল বোমার আগুনে! কোনোদিন বিরুদ্ধপক্ষ ছুড়ল বোমা, কোনোদিন সরকারপক্ষ ছুড়িয়েছে বলেও শোর উঠল। মানুষ হয়ে উঠল উত্তম জ্বলালানি। বোমা ছুড়তে দক্ষ হয়ে উঠল তরুণ পকেটমার থেকে শুরু করে ছোট ছোট পথশিশুরা। অমন সহস্র সন্ত্রস্ততায় বাড়ি ফিরে চাবির মোচড়ে দরজা খুলে অন্ধকার বসার ঘর পেরিয়ে নিজের আলোকিত ঘর দেখতে তোমার কেমন লাগে? টেবিলের ওপর রাতের খাবার ঢেকে রাখা!
নিজ ঘরে সলিল। পড়ার টেবিলে বাবার চিঠি, অযোগ্য পুত্রের ভার নিতে অপারগতার কথা শীলিত ভাষায় লেখা। টেবিলে মায়ের বেড়ে রাখা খাবার, পরিবারের সবার মনের মতোই শীতল।
আবার কেওয়ার সেই ঘর। জানালার সঙ্গে টেবিল পাতার সুবিধা ছিল না। কারণ আলো ছিল পুবের দেয়ালে।
সকালে লেখার সুযোগ পেল না সলিল। ঘুম ভেঙে দাঁতে ব্রাশটা লাগিয়েই জল। এরপর পায়ে যা পরে আছে তাই পরিপাটি করে জুতো পরে দৌড় রীতিমতো। কারখানার বাঁশি বেজে বুঝি শেষ হয়ে গেল!
পাশের ঘরের পল্লবদার সঙ্গে কথা বলার উপায় থাকল না। কেন? কারণ রাতে একই সময় ঘরে ফিরছে না পল্লব দা। গাঁয়ের পথে অনেকটা হেঁটে এরপর আসবে ঘরে, কানে মুঠোফোন। প্রেম! কানে দূরালাপন ধরা অবস্থাতেই বিছানা নিলো পল্লব, সে অবস্থাতেই ঘুম।
মেহেদি ভাইয়ের সঙ্গেও পরে বহুদিন আর হাঁটতে যাওয়া হলো না সেই প্রথম দিনগুলোর মতো। মেহেদি ঘাড় গোঁজ করে তার ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। পদক্ষেপে ধীরতা, যেন চাইছে কেউ এসে তাকে ফেরাক!
রাতে ফিরে প্রথম প্রথম দিনলিপি রাখল সলিল। নিজের সঙ্গে কত কথাই না হচ্ছিল তার। ধীরে ধীরে আলস্য পেয়ে বসল, কলমটা হয়ে উঠল হাতে ওঠার পক্ষে প্রচ- ভারি। আর খাতার সাদা পাতাগুলো হয়ে উঠল ঘুমের জমাট সাদা মেঘ। এতোসব উপেক্ষা করেই কোনো একদিন ডায়রিটা বের করে লেখাগুলো পড়ছিল সলিল। অব্যক্তটা পড়া আজো শেষ হলো না। কোনো এক দিনের লেখা শেষ বাক্য পড়ে চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না সলিল। কী লেখা আছে কে জানে! শুধু এটুকু জানে, গোপন নরম অনঙ্গে ঘা খেয়ে তার কারখানাকঠিন মনখোলস বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
সমীর শক্তিমতির চাকরি ছাড়ার ওপর এলাকাময় ঘুরে বেড়াচ্ছে খুব। হাতে একটা বল।
হ্যাঁ স্যার, অফিসে আসতে যেতে কত জায়গা যে কাছে ডাকত আমাকে! যেতে পারতাম না। হয় কারখানার বাঁশি বেজে গেছে, নয়ত দিনভরের ক্লান্তি। এখন অবসর।
সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরোলে কোনো প্রায়ান্ধকার টং দোকানে চা খেতে ঢুকতেই দেখা গেল টেবিল আর বেঞ্চির সরু ফাঁক গলে সমীরকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে।
তুমি কি আমার ওপর রাগ, সমীর?
স্যার, আমি জানি আপনি এটা ভাবছেন। কিন্তু এটা কত বড় মিথ্যা, সে তো আমি জানি। এখন তো আর বলতে বাইরের বাধা নেই। কিন্তু ভেতরের সংকোচ আছে। আপনার দেখা পেলে আমার খুব অপরাধী লাগে স্যার। আমি আপনাকে এতো বেশি ভালোবাসি, এতো বেশি আমি আপনাকে ভালোবাসি যে পালানো ছাড়া উপায় থাকে না। আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না স্যার। আমি আপনার মতো কথা বলতে জানি না। শুধু যেটুকু টের পাই, কোনো ক্রমে বললাম। স্যার আমার হাত ধরুন। চারদিক খুব দুলছে।
আমি জানি কী হচ্ছে সমীর। ডাউকির চিড় ধরে একটা কোনো অঘটন ঘটবে আজ! আর দেখো সাদা পালের মড়াতোলা নৌকা। এ নৌকা এখন কেবল মহানন্দার ওপর দেখা যায়। তুরাগের পর চলে এসেছে, মানে কী এর?
বোধয় শালবনটা তলিয়ে যাবে স্যার।
গাড়িটা থেমেছে। ধাতব মেঝে থেকে এঁকেবেঁকে আঁচ উঠছে আগুনের। একে একে নেমে বাঁধানো কালো মেঝের সবাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। এরপর সিমেন্ট বাঁধাই করা কালো মেঝেতে অবসন্ন পা রেখে এগোলো সবাই। প্রধান তদন্তকারী থানার উঠোনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো। হাতের ইশারায় অপর ইউনিফর্মিত সদস্যদের বলল, এগিয়ে চলো! ওদের নিয়ে যাও!
এ গলি ও গলি ঘুরিয়ে দলটাকে দু’ভাগ করে দুটো চৌকো ঘরে ঢোকানো হলো। একে অপরের পিচ্ছিল গায়ের সঙ্গে লেগে ফসকে ঘষটে মাথা নিচু করে ওরা ঢুকে পড়তে থাকল ঘর দুটোর ভেতর। বাইরের আলোয় ঘরের সামনের অংশটুকু কিছুটা কেবল আলোকিত। তীব্র জৈব দুর্গন্ধে মগজ নড়ে উঠল সলিলের। পেছনে তাকিয়ে দেখল, দরজা লাগিয়ে দিচ্ছে এলানোর টুপির কালো প্রহরী, আসেনি হাসনাত বা তারেক। ফিরে ভুরু দুটো উঁচুতে তুলে তখনো সবার মুখ পরীক্ষা করতে থাকল সলিল। বেশিরভাগই নিরাপত্তারক্ষী। ভীত মুখগুলো সলিলের নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস হাতড়ে ফিরছে। নির্বাক।
হাসনাত কারাগারের শিক মুঠোয় নিয়ে মাখা ঠেকিয়ে পায়ের পাতা দেখতে থাকল। তার নিচের ঠোঁটটা কাঁপছিল তিরতিরিয়ে। ভাঙবে না জোর পণ করেছিল। হঠাৎ কান্নার ঢেউ তার প্রশস্ত পিঠে। সশব্দে উড়তে থাকা মাছিকে অনুসরণ করতে গিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো তার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তারেক। হাজতের পকেট দরজায় ভারি তালা সাঁটানোর গম্ভীর ধাতব শব্দ পেয়ে তাকাল প্রহরীর দিকে। চোখের ওপর পড়তেই নিজ চোখজোড়া নামিয়ে প্রহরী তাকে ঘামে ভেজা পিঠ দেখালো; সুরবঙ্গের মানচিত্রপ্রতিম।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-২৩॥ হামিম কামাল