॥ পর্ব-২২॥
কারখানায় ওই উৎসবের রাতে ঘুমপ্রতারিত মেহেদি বইয়ের পাতায় এমনভাবে ডুবে ছিল যে পাতাবাহারের নিচে ক্ষণিকের ধস্তাধস্তিকে তার রাতপাখির পাখসাট বলে ভুল হলো, ধরে নাও। সেলুলোজের ওপর ছাপা কার্বনিত অক্ষরের ভেতর বসে হার্ভার্ড তখন স্পার্টাকাসের ঝিকিয়ে ওঠা চোখের কথা বলছে। স্পার্টাকাস তার দুর্ধর্ষ সঙ্গীদের নিয়ে দুয়ার ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসেছে তখন। ‘কথা বলা পশুরা’ কী করে এতো দুর্দম, এমন দুর্মর হয়ে উঠতে পারে রোমকরা বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না। ঠিক তখন দরজার বাইরে চাপা কণ্ঠে নাম ধরে ডাক শুনতে পেয়ে মেহেদিরও অবিশ্বাস হলো। জসিমের কণ্ঠ! ক’টা বাজে ঠিক?
পরপর দু’বার ডাকা হলো তাকে। মেহেদি! মেহেদি!
এ কণ্ঠ জসিমের। আগের রাতে ব্যক্তিত্বের সংঘাতের পর দিনভর তার সঙ্গে কোনো কথা বলে নি জসিম। এতো রাতে ফিসফিসিয়ে কী মনে করে? নাকি আধিভৌতিক বিষয়াদি। আবার শোনা গেল ডাকটা। বেশ মরিয়া এবার, যেন কেউ ছুরি ধরে ওপরটানে কাটছে। একসঙ্গে অনেকগুলো কথা এলো।
ভাই মেহেদি, দরজাটা একটু খোলো ভাই, দরকার খুব, ও ভাই!
হিসহিসে স্বর, গোপন তথ্যবাহী। মেহেদি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো মেঝেতে। শেষবারের মতো দ্বিধা করে ছিটকিনির দিকে এগিয়ে গেল এরপর। খুলে দিতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল ছ’সাতজন কালোয় মোড়া লোক। বাতিটা ভেঙে দেওয়ার আগমুহূর্তে দেখা গেল দলের একমাত্র রঙিন সদস্য হিসেবে জসিম আছে বটে, তবে অবস্থাটি তার করুণাপ্রত্যাশী অথর্ব বিকলাঙ্গের মতো। প্রয়োজন শেষে তার মুখের ভেতর কাপড় সেঁটে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। দুর্ধর্ষ দলটা যে আঁধারে শ্রমের বণ্টন এবং সুচারুতা বিষয়ে দক্ষ তা বোঝা গেল। দু’জন দু’পাশ ও একজন পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেহেদির হাত বিশেষ পন্থায় কষে বেঁধে ফেলল নাইলনের দড়িতে। হাত দুটো শরীরের দুপাশে সেঁটে থাকল, একচুলও নাড়ানো গেল না। মাংসের ভেতর কেটে বসে যেতে থাকল বাঁধন, কোনো শব্দ করা গেল না। কাপড় গুঁজে মুখ বেঁধে ফেলার কাজও যুগপৎ সম্পন্ন হয়েছে। এরপর বন্ধ জানালা ঘেঁষা টেবিলটা ঘিরে যে দুটো চেয়ার উপযুক্ত পথে ব্যবহৃত হওয়ার আশায় এতোদিন পড়ে ছিল তাদের অপেক্ষার হলো অবসান। কোমর থেকে নাইলনের দড়ি খুলে নিয়ে চেয়ার দুটোর সঙ্গে দুজনকে কষে বেঁধে, ওই অবস্থায় যথাসম্ভব নিঃশব্দে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়া হলো।
কারখানার বানবাতির আলো ইতোমধ্যে নিভেছে। রাতটাও পড়েছে চাঁদবিহীন। আকাশে মেঘ বলে নক্ষত্রও অদৃশ্য। তবু ঘরের ভেতরকার অন্ধকার চোখ সওয়া হয়ে আসায় আবছা কিছু আকার ধীরে মেহেদির চোখে স্পষ্ট হলো। চোখটা অন্তত না বাঁধায় বাঁচোয়া। ওই আলোয় জসিমের মুখ আঁচ করে চেয়ারটাকে নাড়ানোর চেষ্টা চলল কিছুক্ষণ। কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোলো ঠিক, কিন্তু তাকে ঠিকঠাক আকার দিতে যে জিভের এতো বড় ভূমিকা আছে তা এর আগে কখনো টের পাওয়া যায় নি। পাশ ফিরলেই জসিমের ছাদমুখো ছাঁদ, হয়ত তার চোখজোড়া খোলা আছে। কিন্তু এটুকুই। চোখের ভাষা পড়ে নেওয়ার কোনো উপায় মিললো না। নড়তেই একেকবার মেরুদণ্ডের হাড় নড়ে যাওয়ার উপক্রম, দুই পাটির দাঁতে তার প্রকাশটা ধরা পড়ছিল।
ওদিকে জসিমের ঘরে একইভাবে শুয়ে আছে হাসনাত, বন্ধমুখ চেয়ারবন্দি। কানের পাশে আরশোলা ঘোরাফেরা করছে। অতিথিশালার দরজাটা তখনো ভেজানো, যেমনটা থাকে সবসময়, ভেতরটাই কেবল ফাঁকা। কিন্তু কাজ কাঁচা নয়। হাসনাতের বিছানায় বালিশ চাপিয়ে তার পুতুল তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কানের কাছে শুঁড় দিয়ে সুড়সুড়ি দিতে লেগেছে আরশোলা। একই পরিবারের দুঃসাহসী মধ্যবয়েসী অপর সদস্য তার অনড় পায়ের ডান বুড়ো আঙুলের কোণটা কামড়ে এক চিমটে শক্ত পুরু চামড়া তুলে নিলো। ঘরের সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল কেউ? কোরের গুদামঘরের বড় ফটকটা মৃদু সরসরিয়ে সরে গেল বোধয়।
স্পার্টকাস, স্পার্টাকাস! আমাদের উদ্ধার করো এসে!
মনে বলে চলল মেহেদি। সে কথা তার চোখের ভেজা উপরিতল ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ পেল না।
জসিমের ভারি শরীরে চেয়ারের নকশাও কেটে বসার জোগাড়। পা দুটো অসাড় হতে শুরু করেছে। বাইরে ইঁদুরে বেড়ালের হুটোপুটির মতো শব্দ। দু চোখ বন্ধ করতেই এক ফোঁটা জল চোখের কোণ ধরে গড়িয়ে কানের ভেতর পশল। মুখের ওপর বাঁধা কাপড়টা লালায় ভরে গেছে। দুজনের মধ্যখানের গলিপথে একটা ছোট ইঁদুর ঢুকে পড়ে পথ না পেয়ে ফিরে গেল। ইঁদুরের পেছন পেছন নিশ্চয়ই সাপও এসেছে। থেকে থেকে শীত নামানো বৃষ্টির এমন ভারি আশীষ! সমস্ত ফাঁক ফোকর গর্তে জল ঢুকে পড়ে ইঁদুর সাপ দুটোকেই বাস্তুহারা করে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ করায়। মোটা গলায় ডাকে অশ্বিনী ব্যাঙ। বুকের ওপর দিয়ে একটা সাপও কি তবে চলে গেল? হতেই পারে না। তবু একদম পাথরের মতো থাকতে দোষ কি? হাত পা অনুভূতি হারাতে বসেছে পুরোপুরি, নড়াচড়ার শক্তি ক্রমশ লোপ পাওয়ায় মেহেদির মনটা বড় কাঁদছে। মূল ফটকরা খুলে এটা যন্ত্রদানব কি গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে? পিঠের নিচে ঠাণ্ডা মেঝে অনেকক্ষণ। চারবার নাকচাপা হাঁচি হলো, মৃদু শব্দে।
একটা দুটো বাক্য, সরু কান্না। লকড় লকড় ঘুরছে চাকা। প্রথমে একবার এগিয়ে ফের পেছাল। জসিমের কল্পনায় একদল বামন খোক্কস গোটা কারখানা পিলপিলিয়ে দখলে নিয়ে যাচ্ছেতাই করছে। যন্ত্রদানব আবার গুঁড়ি মেরে বাইরে বেরিয়ে গেল, মাটির রাস্তার ঝাঁকুনি খেল কোনো খাঁজে, মেঝেটা ঘূর্ণনশীলা চাকার চাপে তরঙ্গিত হলো, কেঁপে উঠল।
সৌরভের ঘরের দরজাটা বন্ধ তখনো। দেখলো, বন্ধ কাচের জানালার ওপাশে হলদেটে পর্দা ভেতরের পাখার বাতাসে নড়ছে। নিচতলায় পড়ে থাকা রবির কাছে পুরোটাই হয়ত দুঃস্বপ্নদৃশ্য।
ভারি খাবারের রাতে ঘুমের ভেতর ঘনঘন এপাশ ওপাশ করছিল রবি নিচতলার ঘরটায়। একেকবার পাশ ফেরার পরপর চোখের পাতার নিচে দিগবদল করছিল কালো দুটো মণি। তাকে কাবু করতে আসা দুজনের একজন কণ্ঠে দরদ ঢেলে তার নাম ধরে ডাকল, রবি! ও রবি! স্বপ্নে বাবার ডাক শুনে রবি আধখোলা চোখে চিৎ হয়ে শুলো, মুখটা অল্প হা হয়ে আছে। আগত দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসল একবার। দ্বিতীয়জন হাসি থামিয়ে ঠোঁটে আঙুল বসিয়ে যেন বলল, চুপ চুপ! আর কোনো ডাক না! রবির পা দুটো গলে গিঁটটা কষে পড়তেই সে ধড়মড়িয়ে উঠল। কিন্তু তখনো সচেতন সে নয়। শিয়রের কাছে হাঁটু গেড়ে অপেক্ষমান লোকটা আর দেরি না করে ঝুঁকে এসে তার নাকের ওপর একটা নোংরা কাপড় ধরল চেপে। এসময় মটমটিয়ে উঠল লোকটার হাঁটুর গিঁট আর হাড়। রবির ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে গেলে লোকটা এগিয়ে এসে মাথাটা দখলে নিয়ে নোংরা কাপড়টা মুখের ভেতর পুরে দিতে চাইলে, নিষেধ করল অপরজন। মুখটা কেবল বাহির থেকে বাঁধা হলো। এরপর উপুড় করে হাত।
একশ কুকুর ডাকছে কারখানার সীমার বাইরে। কাঁদছে দুয়েকটা। ওদের কর্কশ স্বরে রবির জ্ঞান যখন ফিরল, সৌরভের ঘরে ওঠার সিঁড়ির মুখে, ঢালাই রাস্তার ওপর পড়ে আছে তার দলিত শরীর। আকাশের চাপা লাল মেঘের পরত সরছে দ্রুত। নকল ভোরের আলোয় রবির বিকৃত মুখ, কান্নাভেজা গাল দু’পাশে দুই সশস্ত্র পর্যবেক্ষকের চোখে স্পষ্ট হলো।
অফিসের নিচতলার ওই গুদামঘর থেকে দৌড়ে সামনের দিকে আসতে থাকা ট্রলিগুলোর দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখল রবি। হঠাৎ থেমে যেতে দেখে ফের অস্বস্তিতে দেখতে চাইল ডাকুগুলোর মুখ। নেতার ডাকে ওরাও তখন সচকিত হয়ে উঠেছে। কণ্ঠে একটা নেভানো কান্না সরু ধোঁয়ার মতো লতিয়ে উঠতেই নিচে তাকাল সশস্ত্র দুজন। রবি বড় বড় চোখে মুখ ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করা মাত্র কপালে বন্দুকের বাঁটের ঘা খেল। কেঁদে উঠল ভীত নিচু স্বরে। হঠাৎ চাঁইয়ের হাতের ইশারায় জুতোয় মচমচিয়ে দৌড়ে কোরের গুদামঘরের কাছে চলে গেল লোক দুটো। এরপর রবির নাকের সামনে দিয়ে কিছু লোক দৌড়ে চলে গেল পশ্চিমের ফটকে। আরেকটু হলেই মাড়িয়ে দিয়েছিল মুখটা। ঝটকায় খানিকটা পেছনে সরিয়ে নিলো মাথাটা রবি। ওর ওপর কারো চোখ নেই তখন। সামনের ফটকটা খুলে হড়হড়িয়ে পেছনে টেনে খুলে দেওয়া হলো। ঢালাই দেওয়া ফটকগামী রাস্তা ধরে সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে চলল লম্বা হাতের কুঁজো এক লোকটা। তার পাশ দিয়ে দলের সদস্যরা ছুটোছুটির সময় নিরাপদ দূরত্ব রাখছে। রবির ঝিমঝিমে মাথাটা কান্নাভারি চোখের পাতাকে বারংবার তন্দ্রাকামাতুর করে তুলছে। খুলির ভেতর ক্ষণিরে ফাঁপা অন্ধকার, দীর্ঘক্ষণ। ছোট এক ট্রাকের পেছনের খুলে নেওয়া ডালা দুটো মৃদু আপত্তি তোলা ধাতব শব্দে দুলছে, হঠাৎ আবার দেখতে পেল রবি। তবে ওটুকুই। জ্ঞান ফের এলো যখন ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে বাহির থেকে ছিটকিনি তুলে দেওয়া হলো।
আলমগীরের চিড় ধরা খুলির ওপর জমাট চুল। তার নিস্পন্দ শরীর পাশে রেখে নজরুল তখনো নড়ছে; হাতে ঘাড়ে মুখে মশার কামড় থেকে বাঁচতে যতটুকু না নড়লেই নয়।
বদ্ধ জানালার বাইরে খুব ধীরে আলো গোপন আলো ফুটে উঠল। সলিলের জানালার বাইরে একটা কাঁঠাল গাছের ডালে এসে বসল ত্রস্ত দোয়েল। মুহূর্তে উড়েও গেল। কারখানার ভেতরে কোনো স্পার্টাকাস এলো না। কোথাও ফাঁসিতে দুলছে তার বন্ধুদের মরদেহ। আর তার পা দুটো কেটে নেওয়া হয়েছে। দেখা গেল পায়ের গোছায় গভীর ক্ষতের মতো বসে গেছে নাইলন।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-২১॥ হামিম কামাল