পর্ব ২০
বলছিলাম গিনি আপার কথা। সেই গিনি আপা, যিনি সংসার-স্বামী-সন্তান সামলে নিজের ইচ্ছেমতো চাকরি করতে পারছিলেন না। তবু থামেননি। নিজেকে গুছিয়েছেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায়। দুর্দান্ত লক্ষ্যে। নিবিড় একাগ্রতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে এম এ করারও অনেক বছর পর আবার বিএড পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন। এমএড করেছেন ফার্টক্লাস নিয়ে। তারপর বহু বহু বছর পর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে জীবনের প্রথম কর্ম জীবন শুরু করেন। কাজ শুরু করেন অদ্বিতী আর অম্লান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠের মাঝামাঝি একজন আর অন্যজন শুরু করেছে হয়তো। আজ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে সেই গিনি আপার কথা না বললেই নয়। তাহলে আধাআধি রয়ে যাবে সব। কারণ আমি নারী লিখতে বসেছি কেবল আমার নারী জীবনের কথা লিখতে নয়। আমার দেখা জানা সব নারীদের কথা লিখতে। তাদের যাতনা তাদের প্রেম তাদের বিরহ তাদের দহন যুদ্ধ তাদের লোভ লোভের ফসল খেসারত তাদের প্রতারণা প্রতিহিংসা এমনকি ভালোবাসা । খুব ছোট বেলায় গিনি আপার গল্প বলতেন, মা আমাদের গিনি যে কি মার খেতে ওর মায়ের হাতে জানিস না।
কেন মা? গিনি আপা তো কত লক্ষ্মী!
আরে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর কথা না। ও যখনই পড়তে বসতো তখনই ঘুমা তো।
কী বলো? যখনই পড়তে বসা তখনই ঘুম?
হ্যাঁ। আর বেদানা (আমার ছোট খালার ডাক নাম) উঠান থেকে পেয়ারা গাছের ডালটা একটানে ভেঙে নিয়েই শুরু করে দিত মারা। ফর্সা চামড়ায় লাল লাল ফোসকা পড়ে যেত। তবু মেয়েটা পড়তে বসলেই ঘুমা তো।
সেই গিনি আপার বাসায় আমার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু। সেই গিনি আপা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বেলায় বাংলাদেশে কুয়েত মৈত্রী হলে প্রবেশের বেলায় আমার লোকাল গার্ডিয়ান। ছোট বেলায় আব্বা সামার সাইণ্সের ট্রেনিংয়ে গেলে কুমিল্লার লালমাইয়ের কোল ছেড়ে ছোট ছোট ভাইবোনসহ ময়মনসিংহে ছোট খালার বাসায় রেখে যেতেন আমাদের। সেই গিনি আপা প্রতিবারই নতুন কাপড় কেটে নিজের হাতে সেলা্ই করে নতুন জামা বানাতেন আমার জন্য। খুব মনে পড়ে আজও। আজও তিনি অনলাইনে আমার প্রতিটি লেখাও গভীর মনোযোগে পড়েন। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে সিট পাওয়ার জন্য সেই গিনি আপাই আমার হলে এসে প্রভোস্টের কাছে ইন্টারভিউ দিয়ে গেলেন।
শুরু হলো আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে কুয়েত মৈত্রী হলে দ্বিতীয় নিবাসে বসবাস। ময়মনসিংহের এক বন্ধু তাহেরা। তার বড় বোনের রুম ২১৮। তিনি রুমে বেশি থাকেন না। তার বান্ধবীর রোকেয়া হলের রুমেই বেশি বেশি থাকেন। তার রুমেই আমি প্রথম উঠি ডাবিলিং হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে তখন ভর্তি হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সিট পাওয়া যায় না। স্নানের অভাবে একজন পুরনো ছাত্রীর সঙ্গে নতুন একজনকে দেওয়া হয়। যার বেড পড়ার টেবিল এসব শেয়ার করতে হয়। এর প্রচলিত নাম ডাবলিং। নামে ডাবলিং হলেও তিনি যেহেতু বান্ধবীর ওখানে থাকেন সেহেতু আমি তার বেড আর পড়ার টেবিলটি বেশ ফাঁকাই পাই।মাঝে মধ্যে এসে দুই/একদিন হাজিরা দিয়ে যান। না হলে হাউজ টিউটর আবার খুঁজতে শুরু করে দেন। বেশ একা একা দিনযাপন তখন আমার। সদ্য মনোবেদনার দুঃসহ যাপনের কাল আমার তখন। প্রথম প্রথম খুব একা একা লাগে আমার হলের জীবন। সব সিনিয়াররা আমার চারপাশে। কেমন একটা আতঙ্ক সারাক্ষণ। কোথায় কী ভুল করে ফেলি! সিনিয়ার ছাত্রী তো নয় এক একজন যেন এক একটি দুঃস্বপ্ন। সন্ধ্যা ছটায় হলের গেট বন্ধ হয়ে গেলে আমি একা একা ঘুরি। ২১৮ নম্বর রুমে সব বড় আপারা থাকেন। তাদের সঙ্গে গল্প করা হয় না আমার। নিজেকে মনে হয় কোথায় যেন কী চুরি করে এসে লুকিয়ে আছি। ডাবলিংয়ের এতটাই যাতনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। তারপর আছে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ। কথাগুলো চলে এমন:
তুমি কার ডাবলিং?
ও অমুকের?
আচ্ছা তুমি কোন দল করো?
আমি তো কোনো দল করি না।
কেন? বাড়ি থেকে কি কোনো দলটল কেউ করে না?
না।
কাউকে সাপোর্ট করে না?
তা হয়তো করেন।
কাকে করেন?
ছাত্রলীগ? ছাত্রদল?
আমি ঠিক বুঝি না। বাড়ির একেক জন একেক মত সাপোর্ট করে। তবে আমার বাবা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন বলে পাকিস্তানি আর্মিরা আব্বাকে বন্দুকের সামনে দাঁড় করে দিয়েছিল। তারপর খুব ভালো উর্দু জানতেন বলে তাদের মিথ্যে বলে বেঁচে গেছিলেন।
আচ্ছা। তাহলে তো তুমি ছাত্রলীগের সাপোর্টার?
না না । আমি কোনো দল করি না।
ওই হলো। তোমার বাবা যা করেন, তুমিও তাই।
না না। আমার বাবা আওয়ামী লীগ করেন না।
কেন?
আমি আসলে কোনো দল করতে চাই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি লেখাপড়া করতে।
রাজনীতি ছাড়া তুমি লেখাপড়া করবে কী করে?
কেন?
কোনো দলে যোগ না দিলে তোমাকে তো হলেই থাকতে দেওয়া হবে না।
কেন?
আরে দলই তো শক্তি। যে দলে অবস্থান করবে, সে দল তোমাকে শক্তি যোগাবে। টাকা যোগাবে আর যা যা লাগে।
আমার তো কিছু চাই না।
টাকা-শক্তি কিছুই তোমার চায় না?
কেন। আমার বাবা তো মাসে মাসে টাকা পাঠাবেন।
এই মেয়ে তো দেখি একদম বোকা।
দলে এসো দলে এসো। না হলে বাঁচতে পারবে না।
আমি কোনো দলে যোগ দেব না।
খুব রাগ হয়ে যান সিনিয়ার আপা। ভ্রূভঙ্গিতে পুরোপুরি বিরক্তি আর রাগ। একটা কটূক্তি করে চলে যান, ঠিক আছে। দেখা যাবে।
আমি প্রমাদ গুনতে থাকি। এ কি কথা? আমি আমার মেধা আর যোগ্যতায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পড়ালেখা করতে এসেছি। আমাকে কেন রাজনীতি করতে হবে? ছোট বেলা থেকেই মা বলতেন বিশ্ববিদ্যালয় এক উদার মুক্ত বিশাল অঙ্গন। ওখানে পড়তে গেলে দেখবে মন কত বড় হয়। কত বিশালতা অর্জন করবে ওখানে তুমি ভাবতেও পারছ না এখন। আমি মায়ের কথার কোনো মিল পাই না এখানে এসে। প্রথম হলের অভিজ্ঞতা আমাকে কেবলই বিভ্রান্ত করে তোলে। কেবলই বিষাদে ভরে যায় মন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিনিয়ারদের পছন্দ মতো আমার চলতে হবে এখানে? এই বিশাল অঙ্গনে? হলে থাকতে হলে রাজনীতি করতেই হবে। আমি বুঝি কি না বুঝি, ভালো লাগুক আর না লাগুক, হলে থাকতে হলে রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে? কক্ষনো আমি রাজনীতি করব না।
চলবে…