ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই মনের কোণে গুঞ্জরিত হলো ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে থাকে সারা মন’, ‘তারা এদেশের সবুজ ধানের শিষে চিরদিন আছে মিশে’ গানের পঙ্ক্তিগুলো। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত একটি স্মৃতি আলতো করে দোলা দিয়ে গেলো আমাকে। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। বাঙালি তরুণ হওয়ার সুবাদে কবিতা লেখার চেষ্টা। সঙ্গে গানও। হঠাৎ একদিন মনস্থির করলাম গান লেখার যে চেষ্টা, এটি কতদূর হয়ে উঠছে, তা যাচাই করতে হবে। দেখা করব মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে। সালটা বোধ করি ১৯৯৪। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র, তিনি বাংলাবিভাগের শিক্ষক। দেখা করলাম। আমার গানের খাতাটা তার হাতে তুলে দিলাম সসংকোচে। তিনি নিলেন এবং গভীর মনযোগ দিয়ে দেখলেন। উপদেশ দিলেন। প্রথম দেখা কিন্তু মনে হলো আমি তার দীর্ঘদিনের ছাত্র। এখানটায় ব্যক্তি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান অনন্য। আমার আর গান লেখায় সেভাবে নিমগ্ন হওয়া হয়ে ওঠেনি। সময়ের দাবিতে প্রবন্ধে আত্মমগ্ন।
গবেষক ডক্টর তপন বাগচী আমার পছন্দের লেখকদের মধ্যে একজন। ডক্টর তপন বাগচী লিখেছেন ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে নিয়ে (চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, জুন ২০১০)। বইটি পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। হাতে তুলে নিলাম। পড়লাম। অভিভূত হলাম। চলচ্চিত্র সম্বন্ধে, চলচ্চিত্রের গান সম্বন্ধে অনেক কিছু জানলাম। লেখক যখন তপন বাগচী, তখন নতুন কিছু পাবই, এই বিশ্বাস থেকে বইটা গভীর মনযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চমৎকৃত হলাম। বিশেষ করে বইটির প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায় অত্যন্ত তথ্যবহুল। প্রথম অধ্যায় ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্মেষ: প্রাসঙ্গিক কথকতা’ বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসের চুম্বক উপস্থাপনা। এটি পাঠান্তে পাঠক চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার জানতে পারবেন এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানবেন। ১৮৯৫ সালে যাত্রা শুরু করা চলচ্চিত্র কিভাবে ধাপে ধাপে উৎকর্ষ লাভ করেছে তার একটি সারাংশ বক্তব্য রয়েছে এই অধ্যায়ে। বিশেষ করে উপমহাদেশে কখন, কিভাবে চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করে, এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের উদ্ভবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পাঠককে তৃপ্ত করবে।
পক্ষান্তরে ‘চলচ্চিত্রের গান: আনুপূর্বিক প্রেক্ষণ’ নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে সবাক চলচ্চিত্রে সঙ্গীত ও গানের ব্যবহারের ধারাক্রমিক ইতহাস বর্ণনা; যা পাঠক অত্যন্ত সন্তষ্টির সঙ্গে পাঠ করবেন বলে আমার ধারণা। নির্বাক যুগেও যে চলচ্চিত্রে সঙ্গীত ও গানের চল ছিল এই ইতিহাস পাঠককে রোমাঞ্চিতও করবে। চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১৮৯৫ সালে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন, তখন সেই নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে ছবি প্রদর্শনীর সময় হলে আবহ সঙ্গীতরূপে পিয়ানো বাজানো, পরবর্তীকালে কোনো কোনো চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীতে বিখ্যাত সঙ্গীতকার দিয়ে সঙ্গীত পরিবেশনা থেকে শুরু করে আজকের হায় হাপ্পা যুগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের ধারাবাহিক আলোচনা এই অধ্যায়কে সুখপাঠ্য করেছে।
চতুর্থ অধ্যায় ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গান: বিষয় বিবেচনা’ অধ্যায়ে গবেষক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বিশাল সঙ্গীত ভাণ্ডারকে চার ভাগে ভাগ করেছেন।
১ ভাষার গান
২ দেশের গান
৩ প্রেমের গান
৪ চলচ্চিত্রের গান
বিষয় ভিত্তিক গানের ভাগ সাধারণ পাঠককে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গান পাঠে উৎসাহিত করে তুলবে। গানের বিষয় ভিত্তিক শ্রেণীকরণের পাশাপাশি একটি গানের একটি দুটি কলি উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। যা পাঠকের অধিকতর অতৃপ্তির কারণ বলে মনে হয়েছে। বিখ্যাত সেসব গানের পুরো অংশ এবং বিষয়ভিত্তিক অধিকতর গানের উল্লেখ থাকলে পাঠক আরও উপকৃত হতে পারতেন। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আমাদের আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের মহীরুহ। তাই তাঁর গান সম্পর্কে পাঠক শ্রোতার রয়েছে অপরিসীম কৌতূহল। এদিকটা বিবেচনায় রেখেও গবেষক বিষয়ভিত্তিক বহুল সংখ্যক গান সংযোজন করতে পারতেন।
পঞ্চম অধ্যায়ে ‘মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের চলচ্চিত্রের গান নিবিড় পাঠ’ একটি ভিন্ন ব্যঞ্জনা। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কবে থেকে কিভাবে চলচ্চিত্রের গান লেখা শুরু এবং বিখ্যাত সঙ্গীতকারদের সঙ্গে কাজ করা, কোন কোন বিখ্যাত শিল্পী তাঁর গান গেয়েছেন এসব তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচিত গান উদ্ধৃত করে তার সাধারণ আলোচনা সত্যিই চমৎকার। বর্ণিত অধ্যায়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গান বাণী, কাব্যময়তা প্রভৃতি বিষয়ে বিশিষ্টজনদের মূল্যায়ন এই অধ্যায়কে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই অধ্যায়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গানের উল্লেখপূর্বক তার নিবিড় পাঠ ও সাধারণ আলোচনায় গবেষক মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখেছেন। নিবিড় পাঠের সাধারণ আলোচনায় গান সম্পর্কে গবেষকের ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ গানকে বুঝতে আরও সহায়ক।
বইয়ে আলোচনার পাশাপাশি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামনের নানা সময়ের স্টিল ফটোগ্রাফি ব্যক্তি মনিরুজাজামানকে বুঝতে সহজ করে দিয়েছে এবং বইয়ে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বইটি একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে গবেষণা গ্রন্থ ও স্মৃতির অ্যালবাম।
মামুন কায়সার অংকিত চমৎকার প্রচ্চদ সম্বলিত বইটিতে অসংখ্য বানান ভুল পাঠককে অপরিমেয় পীড়া দেয়। গবেষক ও প্রকাশক আর একটু যত্ন নিলেই অনায়াসে বানান ভুল এড়ানো যেত। বিশেষ করে উদ্ধৃতির ভেতরেও বানান ভুল সামান্য হলেও গবেষণা কর্মের মান ক্ষুণ্ন করেছে।
বইটিতে ‘প্রকাশকের কথা, কৃতজ্ঞতা, অবতরণিকা, প্রথম অধ্যায়-বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উন্মেষ: প্রাসঙ্গিক কথকতা, দ্বিতীয় অধ্যায়- চলচ্চিত্রের গান: আনুপর্বিক প্রেক্ষণ, তৃতীয় অধ্যায়-মনিরুজ্জামান ব্যক্তি ও শিল্পী, চতুর্থ অধ্যায়- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গান: বিষয়-বিবেচনা, পঞ্চম অধ্যায়- মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের চলচ্চিত্রের গানের শ্রেণিবিভাগ, পরিশিষ্ট ১ ও পরিশিষ্ট ২ সংযোজিত হয়েছে।
আমাদের চলচ্চিত্রের গান নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। এক্ষেত্রে তপন বাগচী পথিকৃতের দাবিদার।