॥পর্ব-১৭॥
সমীর কারখানা ছাড়ার মাসে কারও মুখ আর না দেখলেও পরের মাসের শেষাশেষি এক শুক্রবার লাবু এলো তাদের এক ঘরের বাসায়। ছুটির দিন ছিল বলে ঘরে তারেকও ছিল সেদিন। ওদের আলাপের ভেতর ঢুকে না পড়ে বরং দুপুরের রান্নার জন্যে সবজি কোটাবাছা শেষ করতে লেগে গিয়েছিল। কাজ শেষ হতে একটা রূপালি বাটিতে সব ঢেকে রেখে হাত ধুয়ে একটা শার্ট চড়িয়ে গায়ে, আলনায় ঝুলন্ত অপর এক প্যান্টের পেছনপকেট থেকে মানিব্যাগ হাতড়ে নিয়ে প্যান্টের পকেটে রেখে ঘর ছাড়ল।
দরজার বাইরে পা রেখে আবার ফিরে তাকিয়ে বললো, দুপুরের বেশি বাকি নেই। সবজি চড়িয়ে দিস। আর ভাতটা?
প্রশ্নটা করল যেন নিজেকেই। এক মুহূর্ত ভেবে বললো, লাবু যেন খেয়ে যায়। সবজি ওভাবেই কেটেছি। আর অপেক্ষা করিস না। আমার ফিরতে বিকেল।
লাবু প্রতিবাদ করে ওঠার আগেই ছায়াটা তার অন্তর্হিত হলো। তারেক চলে যাওয়ার পর ঘরের বাতাস খানিকটা উষ্ণ হলো। দুই বন্ধু অনেকটাই বরফ হয়ে মুখোমুখি বসেছিল, প্রায় কথাহীন। উষ্ণ বাতাসের প্রভাবে বরফ গেল গলে। পরস্পরের আরও কাছাকাছি হলো ওরা। কত কথাই না বললো একে অপরকে। মনের ভেতর ফেনিয়ে ওঠা কথাগুলোর কোনটা কাকে টেক্কা দিয়ে কে আগে বলবে তারই প্রতিযোগিতা যেন লেগে গেল। ঠোঁট চলতে থাকল দ্রুত, নড়তে থাকল হাত পা। সমীরের মনে হলো, কারখানায় থাকতে লাবুর সঙ্গে কোনোদিন এভাবে আলাপ হয়নি, ওকে কোনোদিন আজকের মতো আপন মনে হয়নি। আর লাবু দেখল, সমীর এই কদিনের অবসরে অনেকখানি বদলে গেছে। চোখ কেমন কোটরে বসে গেছে। কালির হালকা ছাপও অক্ষিকোটরের নিচের ফুলো জমিনে অল্প টের পাওয়া যায়। চোয়াল ভেঙে উঠে এসেছে হনুর হাড়। কিন্তু ওর কথাবার্তা আগের চেয়ে অনেক বেশি গোছানো। মাঝে মাঝে মনে বুঝি বই পড়ে সব বলছে। শুনতে লাবুর ভালো লাগল বলে সমীরকেই দিলো বেশিটা বলার সুযোগ। নিজে বললো অল্পই। আর যা বললো, তাও তার নিজ কথা নয়।
মনময়পুরে কারাখানার অভাব ছিল না। সমীর ভেবেছিল, একটা না একটাতে তার কাজ দিব্যি জুটে যাবে, এ নিয়ে ভাবনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাস্তবতাটুকু টের পেতে পেতে বাড়তে থাকল মনের উদ্বেগ। সদ্য তরুণের মুখেও এই উদ্বেগ কথা বলতে থাকল বলিরেখার ভাষায়। সমীরের কপাল, চোখের কোণ তার বড় ভাইটির মতোই হয়ে উঠতে থাকল বুড়োটে। ওর সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ মন এক দুশ্চিন্তা থেকে আরেক চিন্তার ডালে শাখাচরদের মতোই ঝাঁপিয়ে বেড়াত। আর এই নিরন্তর বিচরণশীল মনকে যে বলবে, এবার থাম, এমন কোনো বন্ধু ছিল না। সমীর লাবুর কাঁধে হাত রেখে বললো, কিভাবে শুধু ভাইয়ের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে গেল, কিন্তু ঘুম আর এলো না। আরও বললো, তার সঙ্গে তারেকের সম্পর্ক সেই প্রবল ঝড়ের পর স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল দিন কয়েকের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে তারেক যেন আবার দূরে সরে যেতে থাকল, কোনোভাবেই সমীর তাকে ডেকে কাছে পেল না।
তুই তো নিজেই দেখতে পেলি কিভাবে বেরিয়ে গেল। বড় ভাই কোনোদিন এভাবে বেরিয়ে যাওয়ার মানুষ ছিল না।
দেখে শুনে সমীরের মনটাও ভারি হয়ে উঠতে থাকল। মনের ভার নিজেই যখন আর বইতে পারছে না, হয়ে উঠল খিটখিটে। খিটখিটে এক বনমানুষ যেন বুকের পর্শুকার ভেতর আটকা পড়ে হাড়গুলো ধরে ঝাঁকুনি দেয় সারাক্ষণ। মিথ্যে মামলার ক্ষুব্ধ আসামি যেমন কারাগারের লোহার শিক ধরে ঝাঁকিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে চলে আর বলে, আমি নির্দোষ, আমি এখানে থাকার জন্য জন্মিনি, আমাকে ছাড়ো! আমাকে ছাড়ো!
ওদিকে তারেকের মুখ চোখের ভাব দেখেও কি আর বোঝা যেত ওর ভেতরও সাঙ্ঘাতিক ভাঙাগড়া চলছে। দুজন চোখাচোখি হলে তারেকই আগে সরিয়ে নিতে শুরু করল চোখ। কারণ বড় ভাই নিজেকে আরও অনেক বেশি দোষী ভাবতো। আর বড় ভাই নিশ্চয়ই কিছু লুকাতোও। যারা কিছু লুকায়, তারা চোখের দিকে তাকাতে পারে না। কারণ চোখ হলো মনের আয়না। এই চোখ সরিয়ে নেওয়ার চাপটা হালকা করতে গিয়ে তারেক মাঝে মাঝে ঘুমন্ত সমীরের মুখের দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে থাকত। সমীর একদিন ঘুম ভেঙে স্বপ্নদৃশ্যের মতো দেখেছিল তার ভাইটির ভেজা ভেজা দুটো চোখ। অপরাধবোধ, মমতা, নিরন্তর অন্তঃপীড়ার সাক্ষী দুটি চোখ। সমীর তাকিয়ে থাকতেই আবার সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। ধরেও যেন ধরতে পারছিল না তারেকের মনোলেখ। এমন দুবোধ্যতা ক্রমেই দুর্বহও হয়ে উঠল।
সমীরের পর এবার লাবু শোনালো তারেকের কথা। লাবুর হাতের ওপর বেড়েছিল চাপ। কারণ ওই গল্পটুকু যদি লাবু না করতো, তারেকের বিচিত্র মনন তার বর্তমানে দাঁড়িয়ে যে ভাষায় কথা বলছে, সে ভাষার সবচেয়ে কম্পমান অবয়বটা সমীর কখনো দেখতে পেতো না।সমীর চলে আসার পর কারখানার উত্তপ্ত পরিবেশ তো ক্রমেই থিতিয়ে এলো। তারেককে বিব্রত করার প্রতিযোগিতাও এলো কমে। সবই যখন ক্রমে ঠিক হয়ে আসছিল বাহ্যত, ভেতরের অস্থিত অবস্থাটা বোঝালো তখন তারেক নিজে, হাতে লেখা একটা অব্যাহতি পত্র জমা দিয়ে। চিঠিটা নিজেই সে নিয়ে গিয়েছিল সৌরভের কাছে। রবি তখন জলভরা বোতল নিয়ে সৌরভের শিখিয়ে দেওয়া আদব মেনেই দরজায় দুবার গাট্টা দিয়ে কাঁধে ঠেলে ঢুকেছে ঘরটায়। দেখে, সৌরভ একটা আয়তাকার সাদা কাগজ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলছেন, আর সামনে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছেন বড় ভাই। কাগজটা ছেঁড়া হয়ে যেতে বস বললেন, সোজা কাজে যাও তারেক। আর কখনো এমন কিছু দেখতে চাই না।
সেদিন কারখানা ছুটির পর বেলচা আর ঝাড়ু হাতে টুকরোগুলো সরিয়ে নিতে ঢুকেছিল রবি ঘরে। বেরিয়ে আসার পথে লাবুর সঙ্গে সিড়িতে দেখা। তামাকোর তৈরির অংশে লাবু তখন শংকরকে খুঁজতে এসেছিল। রবি দেখল সমীরের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি এসে কাকে খুঁজে না পেয়ে বিমর্ষ মুখে ফিরে যাচ্ছে। এখনই তাকে বলা যায়। সমীরকে আর সবার মতো রবিও ভালো বাসতো খুব। আর ওই সূত্রেই সমীহ করতো তারেককে। সমীর চলে যাওয়ার পর তারেককে সবাই টেনে নামানোর যে অসহ্য প্রতিযোগিতা শুরু করল, তখন তার অটল ধৈর্য্যশীল মূর্তি আর আড়ালে ভেঙে পড়া দেখতে পেয়ে আগের সমীহের অংশটুকু বিবর্তিত হয়েছিল মমতায়, প্রেমে। এখনো মাঝে মধ্যে গোটা কারখানায় ওই একটিমাত্র প্রাণীই আছে, লাবুকে যে জিজ্ঞেস করে সমীরের কথা।
না, সলিল স্যার কখনো লাবুকে জিজ্ঞেস করে নি সমীরের কথা।
না, তারেকের সঙ্গেও তাকে আর দেখা যায় নি। তারেকই তাকে এড়িয়ে চলেছে কিনা এমন কোনো দৃশ্যও চোখে পড়েনি লাবুর।
খানিক বাদে কথাপ্রসঙ্গের ঘটে মোড়বদল। হ্যাঁ, কারখানায় একসঙ্গে কাজের সেই দিনগুলোর কথা কেন মনে পড়বে না সমীরের? কোথাও যেন একটা গোপন রোমাঞ্চ ছিল, যে রোমাঞ্চের কথা কোনোদিন কাউকে বলে নি সমীর, তবে আজ লাবুকে সে কথা বলা যায় যদি কারও কাছে কোনোদিন প্রকাশ না করে। তামার নকশায় কাটা পাত জড়ো করে, তার বুকে পিঠে তার জড়ানোর কাজে ব্যাখ্যার অতীত এক আনন্দ পেত সমীর। আর এই আনন্দের সঙ্গে সাড়া দিত তার জননাঙ্গও; আশ্চর্য ব্যাপার। অনেক’দিন হয়েছে এমন। কিন্তু যন্ত্রের সঙ্গে এমন দেহজ প্রেমঘটিত ভূতুড়ে সম্বন্ধের কথা কাউকে বলার নয়, ভোলারও নয়।
মনে পড়ে কারখানার সেই প্রকৌশলী তরুণীর কথা। চেনা গৃহস্থের তৃতীয় এক ঘরে সে থাকত। স্থানীয় পাল পাল মূর্খের পা দলনে তল নড়া জল কম ঘোলা হয় নি। তার সঙ্গে সমীরের কোনোদিন দেখা হয়নি বটে, তবু আজকাল সেই তরুণী তার অলস মুহূর্তগুলোর কল্পনায় একটু আধটু দেখা দিতে শুরু করেছে। সদ্য তারুণ্যপাওয়া প্রেমকাতর মনের ভেতর কুমারসম্ভব মনপ্রবণ গল্প তৈরি করতে শুরু করেছে। আবার ওইসমস্ত গল্পকে গোপনে স্বপ্নেও চালান করে দিতে হয়ে উঠেছে ভীষণ তৎপর। কারখানায় থাকতে কতবার শুনেছে চলে যাওয়া ওই প্রতিভাবতী ক্ষ্যাপা সুশ্রী মুখটির কথা। শুনেছে দুষ্টু মহাব্যবস্থাপক এলে তাকে গাড়িতে নিয়ে বেড়াতে বেরোতে চাইতো, সে কথা। গল্প শুনতে শুনতে তখন ওই মহাব্যবস্থাপকের ওপর ভীষণ রাগে মনে মনে কাঁপতো সমীর। এখন চোখ বন্ধ করলেই দেখে ওই আধপ্রৌঢ় ধূর্ত মূর্তিটাকে মাটির ওপর শুইয়ে মনের সুখে সে ঘুষি চালাচ্ছে, লাথি ঝাড়ছে, মুখ দিয়ে ছুটেছে ভদ্রস্থ খিস্তির বান। মাথাটা ঝিমিঝিমিয়ে উঠতো।
একদিন স্বপ্নে দেখল, লম্পট লোকটার হাত থেকে তরুণীকে উদ্ধার করে একটি অপরাজিতার বিনিময়ে দিব্যি তার মন জয় করা গেছে। বন্ধুরা আমোদ করতো তাদের নিয়ে, তাকে নিয়ে; বলছে, বয়সে বড় এক মেয়ের প্রেমে মজেছে দেখো, কী কা-! কিন্তু তাদের দুজনের যৌথ হৃদয়বৃত্তির তোড়ে ওসব কথার কুমির নদে জল পেলো না। কারখানার পশ্চিমে যে গারো পাহাড়ের একাংশ এসে মিশে গেছে, যেখানে পাহাড়ি গভীর অরণ্য বলে মানুষের প্রবেশের ওপর বিকট নিষেধাজ্ঞা। সে অরণ্যের কাছে চলে গেল দুজন, ললিত যৌবন দিয়ে মুগ্ধ করলো পরস্পরকে। এমন সময়, ওই ঝাপসা মধ্যরাতে, বনবর্তী লোকালয়ের পাকা ধানের ক্ষেত মাড়াতে এলো শত শত বুনো হাতি।
ওই ক্ষেতের মধ্যখানে মধ্যখানে প্রহরীদের বিশ্রামের জন্যে যেসব শনের ছাউনি দেওয়া বাঁশের মাচা থাকত, ওগুলোর ওপরই মূলত বুনো হাতির ক্রোধ। এসে সব গুঁড়িয়ে দিয়ে ফিরে যেতো। আর ধানের সুগন্ধী ক্ষেত শেষ করতো গোদা পায়ে মাড়িয়ে। ভয়ার্ত মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে দুধের বড় টিনের কৌটা আর কাঁসার থালা পিটিয়ে হাতি তাড়াতে চাইতো। আর হাউমাউ করে কাঁদতো কেবল।
সেদিন গ্রামবাসী দেখলো এক অদ্ভুত দৃশ্য। ওই হাতির যে দলনেতা, তার ঘাড়ের ওপর বসে আছে দুটো নিরাবরণ ছেলে মেয়ে। মেয়েটির ঘাড়ের ওপর দিয়ে ছেলেটি সে ভয়ার্ত গ্রামবাসীকে অভয় দিলো, শোনো! এরা তোমাদের বন্ধু! আজ থেকে তোমাদের কোনো ক্ষতি ওরা করবে না। তোমরা শুধু কথা দাও, বনে ঢুকে আর কখনও ওদের খাবার, ওদের ডেরা নষ্ট করবে না! সুযোগ পেলেই ওদের দলছুট ছানা ধরে নিয়ে যাবে না। যদি কথা দাও, তাহলে ওরাও কথা দেবে, তোমাদের লোকালয়ে আর কোনোদিন হামলা চালাবে না। বরং খুব বন্ধু হবে, খুউব। কতো বড় বন্ধু যে ওরা হবে তা শুধু একটা উদাহরণ দিয়ে বলি। তোমাদের কাছ থেকে ফড়িয়ারা যখন মাত্র ফুটো পয়াস সব ফসল নিয়ে রেলগাড়িতে তুলতে যাবে, তখন শিঙা ফুঁকে ওদের ডেকো। ওইসব ফড়িয়াদের ওরা দরমুজপেটা করবে। আর কী করবে জানো? আকালের দিনে বন থেকে কাঁদি কাঁদি কলা এনে খাওয়াবে তোমাদের। কথা এ পর্যন্ত আসতেই ওই প্রকৌশলী মেয়েটা তার ঠাণ্ডা গালে চুমু খেয়ে বললো, দারুণ বলেছ! এরপর গ্রামের সবাই ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে থাকল।
হঠাৎ গ্রামবাসীদের একজন খুব কাছে চলে এলে দেখা গেল তার হাতে এক মানুষ সমান লম্বা ভীষণ এক বল্লম! আর দুচোখে এতো ভীষণ ভয়, যেন অক্ষিকোটর থেকে এখনই ফেটে বেরিয়ে পড়বে। লোকটা কালো শরীরটা পেছনে বাঁকিয়ে ডান হাতের পেশিতে সমস্ত জোর এক করে খুব কাছ থেকে বল্লম ছুঁড়ল। বল্লমের সূক্ষ্ম স্ফীত ফলাটা ভোঁতা শব্দ করে গাঁথল কোথাও। বিকট বৃংহতিতে হাতিটা পা দুটো উঁচু করে দাঁড়ালো। ভীত, অসতর্ক ওরা দুজন চিৎকার করে পড়ে যেতে থাকল মাটির ওপর; তখনই কেঁপে উঠে ভাঙলো ঘুমটা। সেই স্বপ্নের রেশ গোটা সপ্তাহে আর কাটলো না।
এরপর লাবু বললো তার ভাবকল্পনার কথা। এমন অনির্দিষ্ট কোনো অনন্যাঙ্গনার কথা সেও কি আর ভাবে না? প্রায়ই তো তার মনে গুরুতর কিছু প্রশ্ন জেগে ওঠে। কী সেই প্রশ্ন?
যে মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে হবে তার; হবে গাঢ় প্রেম; কী করছে সে এখন?
প্রশ্নের সূত্র ধরে আরও কতো কথা মনে আসে। সেসব প্রশ্নের মতো শোনালেও প্রশ্ন নয়, উত্তর আছে আশা করে বারবার পড়ে গেলেও কিছুই মেলে না।
মনে হয়, যেখানে সে আছে সেখান থেকে আয়নার পর আয়না লাগিয়ে তার প্রতিবিম্বটা এ পর্যন্ত নিয়ে এসে যদি তাকে দেখা যেত? যদি দেখা যেত বিরাট এক আয়নার সামনে রঙিন শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে বাঁকানো চুলের পুরু গোছা ধরে ঘাড় কাত করে আসমনে আঁচড়ে চলেছে, গুনগুনিয়ে গাইছে আর মৃদু মৃদু হাসছে! এই মেয়েটি যখন তার হবে, তখন তাকে সুখী করার জন্যে কী না করবে সে? কী করবে গুছিয়ে ভাবা যাক। এক, প্রত্যেক সকালে আগে আগে ঘুম থেকে উঠে ঘর ঝাঁট দেবে। খুব যত্ন করেই তা করবে যেন আচমকা শব্দে মেয়েটির ঘুম যেন ভেঙে না যায়। দুই, সকালের নাশতা তৈরি করবে একদম মেয়েটির মনের মতো করে। তিন, বাগান থেকে তুলে আনবে রঙিন তাজা ফুল, রাখবে বিছানার কাছে দাঁড়ানো চার পেয়ে টুলের ওপর মাটির নকশি ফুলদানিতে। ঠিক এই সময়ে হঠাৎ আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যাবে মেয়েটির। বিছানায় শুয়ে থেকেই আলিঙ্গন করতে চাইবে তাকে, মিষ্টি করে ডাকবে নিশ্চয়ই?
আধো আলোআধো অন্ধকার কল্পনার সেই ঘর। শিথানের চৌকো খোলা জানালার বাইরে বাতাস তাড়িত ঝলমলে নীল সাগর।
দুপুরের খাওয়া সেরে কিছুক্ষণ গড়িয়ে শব্দবাণে বিস্তর রাজা উজির মেরে, জানালাপথে হঠাৎ বাইরের সোনালি বিকেল দেখে ওরা ধড়মড়িয়ে বিছানা ছাড়ল। এরপর স্নানঘরে গিয়ে চোখেমুখে জল ছিটিয়ে এসে, দরজায় একটা রূপালি চিনে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে শিল্পনগর পরিভ্রমণে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
চাবি কী করবি? লাবুর প্রশ্ন।
এটা আমারটা। ভাইয়ের মানিব্যাগে আরেকটা আছে। সমীরের উত্তর।
মনময়পুরের যে অংশে সার বেঁধে নিয়মিত দূরত্বে দাঁড়ানো সব পোশাক কারখানা, ভেবে চিন্তে সেদিকেই চলল দুজন। তরুণ মনের উদ্দেশ্য, সম্পূর্ণ ভিন্ন আমেজের কোনো কাজের সুযোগ সন্ধান করা, যে কাজের ক্ষেত্র অতীত অভিজ্ঞতার যত বদ্ধ গুদামঘর, নাট বল্টুর প্যাঁচ কষা যন্ত্র, তপ্ত ঘরদগ্ধ মুখ, লোহা কাটার সহস্র কাঁচভাঙা বিশ্রী শব্দ, ঝালাইয়ের পোড়াগন্ধী হাওয়া আর ধাতু ঝলসানো চোখ জ্বালানো অসহ্য নীল আলো, আর যতো ঢং ঢাং ঢং ঢাং এই সমস্ত ভুলিয়ে দেবে। কারখানাগুলোর বাইরে ঝোলানো বা দেয়ালে সাঁটিয়ে রাখা বিজ্ঞপ্তিগুলো পড়তে পড়তে এগোলো দুজন। দেখা হলো অনেক বিজ্ঞপ্তি; শ্রমিক চাওয়া হয়েছে, যোগ্যতার মাপকাঠি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিচার করে আবেদন করতে বলা হয়েছে; সবই পরিষ্কার। কিন্তু এরপরও মনের কোথায় যেন বাধা। মন বলছে, তোমাকে এখানে চাওয়া হয়নি, তোমাকে নয়, তুমি চলে যাও, এটা তোমার জায়গা নয়, এখানে যারা কাজ করে তোমার চেয়ে অযোগ্য অদক্ষ ছেলেমানুষ সবাই। সুতরাং তুমি ফিরে যাও!
অবশেষে সবচেয়ে পুরনো পোশাক কারখানা বিন্দুর বিরাট বিকট বহুতল সশব্দ বপুর সামনে দাঁড়িয়ে স্থির হলো দুজন। পোশাক কারখানায় ভিন্ন অভিজ্ঞতা খুঁজতে এসে বাইরে থেকে দেখে দুজনেরই মনে হলো, ওদের কারখানা যদি ছাদখোলা লক্কড়ে ট্রেন, তো এসব কারখানার একেক বদ্ধ নরককুণ্ড। অবশেষে বড় ভাইকে শুধাবে বলে সিদ্ধান্তে এলো দুজন। এরপর বহু দিনের সঙ্গবিচ্ছেদ পুষিয়ে নিতে সারা বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের প্রথমাংশ অবিরত হেঁটে বেড়াল দুই বন্ধু। গেল সেই প্রাচীন বটগাছের কাছে। পাশে যার বয়ে চলেছে বনবিষ্ণু আদিম তুরাগ নদ, ওপারে শালবন ঘন।
বাসায় ফিরে দেখা গেল তখনো আসে নি তারেক। ভাত তখনও ভিজে ওঠেনি আর সবজিও বেশ। স্টোভ জ্বালিয়ে অল্প আঁচে গরম করে নেওয়ার ভাত হয়ে উঠলো অপ্রিয় শুষ্ক, আঁশওঠা। সবজির চমৎকার সবুজ রঙটা গেল মরে। খেয়ে নিয়ে বাতি জ্বালিয়েই রেখে শুয়ে পড়ার পর চোখ যখন প্রায় আঠালো হয়ে এসেছে, তখন হঠাৎ দরজায় শব্দ। তারেক। ঘামে ভেজা ক্লান্ত বিধ্বস্ত একটা মুখ। দেখেই ঘুম গেল চটে। শার্ট খুলে হাতে নিতেই দেখা গেল প্রশস্ত পিঠ ধরে দরদরিয়ে নামছে ঘাম। বুকপকেট থেকে খসে মেঝেতে পড়ল ভাঁজ করা কিছু সাদা কাগজ, কটা ভিজিটিং কার্ড, দুটো খুচরো পয়সা, একটা ছোট্ট সবুজ লাইটার। ঝুঁকে জিনিসগুলো একে একে তুলে নিতে থাকল তারেক। দৃশ্যটা সারাজীবনের জন্য সমীরের মনে একটা মায়াউৎসারী ছবি হিসেবে আঁকা হয়ে থাকল। দরজা খুলে শেষবার জলবিয়োগের ঘরে গিয়ে ফিরে আসার পর নিঃশব্দে বিছানা নিলো সমীর। তারেক তখন ভেজা হাতে হাড়ি কড়াইয়ের ঢাকনা উল্টে দেখছে। ওদিকে কারখানার দিকের জানালার কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। আসছে রাতের ঠাণ্ডা বাতাস। সঙ্গে উষ্ণ রক্তের ঘ্রাণে মাতাল বন্য মশককুল।
পরদিন সকালে একটাই ডিম ভাগ করে সাদা ভাতে মাখিয়ে খেলো দুটি ভাই। তারেক বরাবরই একটু দ্রুত খেয়ে থাকে। ভাতের লোকমা চার আঙুলে তুলে বুড়ো আঙুল দিয়ে মুখের ভেতর ঠেলে দিয়ে বেশিক্ষণ চিবোনোর ধৈর্য তার হয় না আর। পেষণদাঁতের সংস্পর্শে পুরোপুরি আসবার আগেই আলজিভের সীমা ডিঙিয়ে গলনালীর ঢেউয়ে উঠে পড়ে। বিষয়টাকে যতোখানি সম্ভব নির্ঝঞ্ঝাট করতে চায় বলে বাঁ হাতের পাশে সবুজাভ কাচের গ্লাসে রাখে জল। এখন পর্যন্ত খাওয়া পুরোপুরি শেষ হওয়া ছাড়া সেই জল গলধঃকরণের কোনো প্রয়োজন হয়নি। সেদিনই ঘটলো ব্যতিক্রম। এক লোকমা শুকনো ভাত গিলে নিতেই হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ে থাকবে, তখনই খাবার গলায় নানেমে মাথায় উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাতও। সমীর হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে এগিয়ে হাতে তুলে দিলো কাচের গ্লাস। গলায় ঢালার পর ভাত নেমে সমীরের দিকে তারেক একটিবার তাকালো কি তাকালো না, আবার মাখতে শুরু করল ভাত। সমীর লক্ষ করল বটে, কিন্তু ক্ষুণ্ন হলো না অন্যদিনের মতো। খানিকক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে হয়ত বুঝে নিলো, ভীষণ সংবেদবাহী ওই প্রসঙ্গটা সে তুলকে কিনা আদৌ।
খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে তোয়ালের রোঁয়া ওঠা পাড় আঙুলের ওপর রেখে মৃদু মৃদু চাপ দিতে দিতে তারেক জানালার বাইরে দূরের কারখানার দিকে তাকিয়ে ছিল যখন, সমীর খুলল তার মুখ। বেপরোয়া ভাব তার চোখে, ভুরুতে। সেখানে নিজের সঙ্গে লড়াই স্পষ্ট। আবার নিজের ওপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও উল্লেখ্য অভিন্ন সেই স্পষ্টতার কথা।
লাবু আমাকে বলেছে বড় ভাই। সেদিন ও বলেছে আমাকে, আপনি কারখানায় জবাব দিতে নিয়েছিলেন। পরে সৌরভ স্যার কাজ ছিঁড়ে ফেলেছে। ধীরে ধীরে বলে গেল সমীর। ঠোঁটে মৃদু হাসি। সেই হাসির কোথাও আত্মসমর্পণের কোনো চিহ্ন নেই। এই সমীরকে তারেকের কিছুটা অচেনা হয়ত বোধ হলো। কিছু বলতে গিয়ে মুখ খুলেও সে আর বললো না।
লাবু কণ্ঠে গাঢ় মমতা নিয়ে বললো, বড় ভাই, আমার জন্যে অনেক করেছেন। আমি জানি কত কষ্ট আপনি সয়েছেন এই নষ্ট ভাইটার জন্য। অতো অপমান আপনার প্রাপ্য ছিল না। আর ছিল না বলেই গিয়েছিলেন সৌরভ স্যারের কাছে। তারেকের দিকে এক পা এগিয়ে এলো সমীর। বললো, আমার একটা কথা শুনুন বড় ভাই। আপনাকে আমি কিছু দিনের জন্য হলেও ছুটি দিতে চাই। জানি, ছুটি নেওয়ার মানুষ আপনি না, তারপরও। এটা আমার অনুরোধ। কথা শুনে তারেক খানিকটা কৌতূহলী চোখে তাকালো সমীরের চোখে। সমীর মাথা নিচু করে বলে গেল, হয়তো মনে মনে হাসছেন ভাই। হাসবেনই তো। নিচ থেকে মুখ তুলে তারেকের চোখের দিকে তাকালো এবার হাসির আলোয় উজ্জ্বল একজোড়া তরুণ চোখ। আমি যে কোনো কাজ এখনো পাই নাই! তবে, শিগগিরই পেয়ে যাবো আমার বিশ্বাস। আমি আর লাবু গতকাল গিয়েছিলাম গার্মেন্টস পাড়ায়, জানেন? তো, গিয়ে ওদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আমার মনে হয়েছে, যেখানে চাই সেখানেই আমি ঢুকতে পারি। মনে হয় না কোনো সমস্যা হবে, কোথাও আমাকে আটকাতে। আর তাই যদি হয় তো আমি এরপর গার্মেন্টে কাজ করে দেখতে চাই ক’দিন। জানি না কেন, হয়ত সেখানে মরণ আমাকে টানছে ভাই। শেষ কথাটা বলে চোখজোড়া পরীক্ষা করার জন্য ভাইয়ের দিকে তাকাল সমীর। যেন প্রয়োজনে কথা ফেরাতে রাজি, এমনভাবে বললো, আপনি কী বলেন?
খোলা জানালা দিয়ে পুবসূর্যের আলো আসছিল, একটা কৌণিক রেখা ধরে ঢুকছিল ঘরের ভেতর। সে আলোর রেখার ভেতর ধুলোর ওড়াউড়ি, যেন কত শত ছায়াপথ নিহারিকা এসে জমাট বেঁধেছে। আর সমীরের ছোট্টবেলার কল্পনার ঘোড়া ছুট ধরেছে সেই আলোর রেখা বরাবর। তেরছা সেই আলোর রেখার একাংশ এসে পড়েছে তারেকের এক বাহুর ওপর। পরিশ্রমী হাতের শাখায়িত শিরাউপশিরা হয়ে উঠেছে দৃশ্যমান। সমীরের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বহু সময় গেল কেটে, অবশেষে তারেকের গলায় উঠল স্বর। একবার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে দৃষ্টিপথ তার মাথার ওপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বললো, আর কিছুদিন যাক না। অস্থির হয়েছিস কেন। আর কিছুর জন্য না, আমি ক্লান্ত খুব। তাই জবাব দিতে গিয়েছিলাম। জমানো টাকা বেশি নাই আমার, কমও নাই। দুজনে চালিয়ে নিতে পারবো।
অনেক’দিন পর ভাইয়ের এমন খোলামনে দুটো কথা বলার সুযোগসুতোটাকে ধরে, কথার ঘুড়ি মাটিতে নামিয়ে এনে আবার নিজেই ওড়াবে বলে সমীর তখন ঠিক করেছে। তার অকাল বুড়োটে কপাল আর চোখের কোণে ফের কৈশোর খেলে গেল। বললো, আমিও প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম ভাই, আর কটা দিন যাক। কিন্তু আপনি যা করলেন, তাতে তো আর বসে থাকা যায় না। ভেবেছিল এ কথায় তারেকের মুখে খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। তা নাহয়ে পরিবেশকে উল্টো খানিকটা লঘু হয়ে উঠতে দেখে বললো, প্রথমে ভেবেছিলাম যে কাজ করেছি এতোদিন তেমন কাজ খুঁজব। কিন্তু পরে ভাবলাম এটায় সমস্যা আছে। ইদানিং অনেক কিছু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আপনার সঙ্গে হয়তো মতের অমিল হবে, তারপরও অনেক ঝুঁকি নিতে ইচ্ছে করে।
তারেক বললো, হুম, বড় হয়েছিস তো।
না না, তা না। সমীর মন্তব্যটাকে যেন খুব যত্নে বুকে নিয়েছে। আমি ছোট। বুদ্ধিতে অনেক ছোট। আর শরীরেও। কিন্তু সলীল স্যার বলতো, বুকে কৌতূহল নিয়ে অভিযানে বের হয়ে নাপড়লে বুদ্ধির শিশুঅবস্থা কখনো কাটে না। ভাই, ওরা নবীশ লোক নেবে। আমি কাজ করতে চাই।
তারেক কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মুঠোফোনটা তুলে সময় দেখে নিলো। সমীর বিব্রত হয়ে উঠল খানিকটা। ক্ষান্ত নাদিয়ে আরও বেগ আনলো কথায়। নবীশ চেয়েছে তো, বিন্দুর কথা বলছি, বিন্দু টেক্সটাইল। এর মানে, বোধয় কঠিন কিছু দেবে না। করতে থাকলাম আপাতত? আর চোখ কানও রাখলাম খোলা। সুযোগ পেলে চলে গেলাম, ভালো লাগলে থেকে গেলাম। ভাই? কিছু বলুন? আপনার তো সময় হয়ে গেল। এসব কথা রাতেই আমি তুলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু উপায় ছিল না ভাই। আপনি যদি বলেন, তো আজকের দিনটা আমি কাজে লাগাতে পারি।
ওসব কারখানার ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই আমার। শান্ত কণ্ঠে বললো তারেক। তবে বিন্দুতে তো ঝামেলা হচ্ছে। আসতে যেতে দেখিসনি?
না, তেমন কিছু তো কই চোখে পড়ল না আমার। সমীরের কণ্ঠে সাবধানী বিস্ময়। গতকাল তো আমি আর লাবু বিকেলের দিকে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। আর এরকম ঝামেলা তো সব কারখানাতেই টুকটাক লেগে থাকে।
দেখ, নিজে যা বুঝিস ভাই, করতে পারিস। আমার দিক থেকে কোনো কথা তুলবো না। ভালোটা তো বুঝতে শিখেছিস, বেছে নিতেও শিখেছিস। তারেকের কণ্ঠ নিখাদ গম্ভীর। ভাইয়ের বিষয়ে সে সত্যিই নির্লিপ্ত হতে পেরেছে, চোখের ওপরকার অকম্পিত ভুরুও অনেকটা যেন সেই স্বাক্ষ্য দেয়। আর একটা কাজ করতে পারিস, এইটুকু বলে একটা শব্দ লক্ষ করে দরজা দিকে তাকালো তারেক, দেখল গতদিনের সবজির কাটা টুকরো ঘন ঘন চোয়াল বদল করে কামড়ে চলেছে একটা নেংটি ইঁদুর। তারেকের দৃষ্টি অনুসরণ করে সমীরও দেখল ইঁদুরটাকে। কালো পুতির মতো চোখ, ছোট গোঁফ, লালচে নাকের ধূসর লোমশ জীব। খণ্ডিত লেজটা মাটিতে আরামে শুয়ে আছে। হ্যাঁ, যা করতে পারিস, আবার কথার সুতোটা ধরল তারেক, কারখানা ছুটি হওয়ার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকলি কিছুক্ষণ। এরপর তোর বয়েসী কাউকে ডেকে জেনে নিলি, কেমন চলছে ভেতরে, নতুন আসতে চাস। দেখ কী বলে। অনেক সময় ভালো তথ্য মেলে। আবার দুষ্ট লোকও তো কম না, বেছে জিজ্ঞেস করতে পারলে খুব কাজে আসে এটা। দেখতে পারিস, একটা ধারণা করা আরকি। আমি এক আধটু গোলমাল দেখছি ক’দিন, তাই বলছি। এসব পোশাকের কারখানায় গোলমাল হওয়ার পরবর্তী কটা দিন খুব ভয়ঙ্কর, যেটুকু দেখলাম। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ারও উপযুক্ত। আর বিন্দু অনেক পুরনো কারখানা তো, ভেতরে অনেক রাজনীতি। নবীশ চেয়েছে কারণ তাহলে অনেকে আবেদন করবে। অনেক লোক আবেদন করলে আবার বিশেষ কিছু বাছাই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ওরা যাবে, এভাবে সমস্যা। রাজনীতির সুযোগ বেশি থাকে। তাই বলবো, বিন্দুর ক্ষেত্রে অতো আশা নাকর, মালিকও নাকি তেমন সুবিধার না। আশপাশের আরও কটা আছে কারখানা, ঢুঁ দিয়েছিস? অবশ্য রসুনের সব কোয়ারই গোড়া এক ভাই। সমীরের কাঁধে হাত রেখে বললো তারেক, দেখ, হয়ত আমার কথা কোনো কাজেই আসবে না। করা নাকরা তোর ওপর। তবে আমি দেখেছি, এটা কাজে আসে।
জলের একটা হলুদাভ বোতল আর এঁটো মেলামাইনের প্লেটগুলো নিয়ে সমীর ঘরের বাইরে চলে গেল। টানাবারান্দার সীমানা দেয়ারের ওপারে প্লেটের ওপর জল ঢেলে হাতে ডলে পরিষ্কার করে আবার যখন ঘরে ঢুকেছে, তারেক তখন বেরোনোর উদ্যোগ করছে।
খানিক বাদে সমীরও বেরোল। পথ ধরলো মনময়পুর সদর বাসস্ট্যান্ড এলাকার। শিল্প এলাকায় দুপুরের আঁচের রকম আলাদা। আর অনতিদূরে অরণ্য, এরপরও হাওয়াটা ধরনে ভারি। মেটে রাস্তা ছাড়িয়ে পাকা রাস্তায় উঠে এসে সমীর এক পাশ ধরে হাঁটতে শুরু করল। ভারি যানবাহনের অবিরত সঙ্গমে রাস্তা ভেঙে সুড়কি বেরিয়ে পড়েছে, কাঁকর ছড়িয়ে পড়েছে, স্থানে স্থানে বিশ্রী সব খাদ। ধুলোও উড়ছে দেদার। ওসবের ভেতর দিয়ে চুল লাল করে বড় বড় পা ফেলে সদরে এসে পৌঁছুল সমীর। এরপর জনাকীর্ণ বাস স্টেশনটা পেরিয়ে আরও খানিকটা দক্ষিণে এগোলো।
মহাসড়কের পাশেই একটা শিশুকড়ই গাছের নিচের একাকী একতলা পাকা চৌকো ঘর সমীরের গন্তব্য। তার বয়েসী ছেলে মেয়েদের সেখানেই বেশি আনাগোনা। তেমন অনেককে একের পর ঢুকতে বেরোতে দেখে, দুপাশে একবার করে চোখ বুলিয়ে কোণাকোণি রাস্তা পেরোল সমীর। চৌকো ওই ঘরটার ছাদের ওপর সবুজ মখমলের মতো শ্যাওলার আস্তর, একটা কোমল সবুজ শিশু অশ^থও মাথা তুলেছে। পেছনে উর্বর অরণ্যধন্য জমি ক্রমশ নিচে নেমে গেছে। প্রথমে কিছুটা বিঘতদীঘা ঘাসের মাদুর, মাটি দেখার উপায় নেই। এরপরই শুরু হয়েছে ঘন ঝোপ। অনিয়মিত বিরতিতে সবুজ অন্ধকার তৈরি করে রাখা সব বৃক্ষ। তাদের ফাঁকে ফাঁকে নিজের মতো বেড়ে ওঠা, নামঅজানা ফুলের অল্প ঘনত্বের ঝোপলতার আঁকবাঁক। ওসবের মধ্যে থেকে থেকে মাথা তুলেছে শেয়ালকাঁটা হাতিশুঁড়ের একটা দুটো ঔষধি বিরুৎ। ঢাল যেখানে শেষ হয়ে আবার সমতল মাটি শুরু হয়েছে, সেখানে আরও খানিকটা পেরোনোর পর ক্রমশ ঘন হয়েছে এইসব ঝোপঝাড়।
কম্পিউটার আর ফটোকপির এই চৌকো ঘরের সুবাদে পেছনের ঢালে ইতস্তত বেড়াচ্ছে অজস্র বর্জিত কাগজ। পাশেই বাড়ি, এমন ছোট্ট ছেলের আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে ছড়িয়ে ছিটিয় ছুঁড়ে ফেলা যতো কালো আর রঙিন ছাপাকালির সিরিঞ্জ। ঢালের শেষে এক জায়গায় দেখা গেল ঝরা পাতা আর ফেলে দেওয়া কাগজের ছোট খাটো স্তূপ। স্তূপটার ওপর আকাশের দিকে ভাঙা পায়া তুলে দিয়ে উপুড় হয়ে আছে একটা কাঠের টুল। সারা গায়ে কালচে সবুজ শ্যাওলার স্তর পড়েছে ওটার। দোকানটার পাশে দাঁড়িয়ে সমীর আর এক শিশু আকাশের দিকে মুখ করে থাকা ওই টুলটা দেখল একইসঙ্গে। সপ্তাহ খানেকের কামিয়ে নেওয়া মাথায় তার ছোট ছোট চুলের মখমল যেন পাতা। মাথার পেছন থেকে আসা সূর্যের আলোয় লালচে দেখাচ্ছে। ছেলেটার পরনে সাদা হাফহাতা শার্ট, শক্ত কলারটা তুলে দেওয়া। আর নিচে খয়েরি হাফপ্যান্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে খয়েরি পা। পাদুটো জুতোবিহীন। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ উড়ে গেছে। সেখানে চামড়া ক্রমে মোটা আর শক্ত হয়ে এসেছে। দেখে আরও একবার ছেলেটার দিকে তাকালো সমীর। তার তেজি চোখজোড়া দেখে আঁচ করল ছেলেটা তাকে প্রতিযোগী মনে করেছে। আর কিসের প্রতিযোগী সেটাও পরিষ্কার হলো পর মুহূর্তে। এক দৌড়ে ঢাল ধরে নেমে টুলটার কাছে পৌঁছে গেল ছেলেটা। শুকনো পাতা আর কাগজের স্তূপটাকে একবার প্রদক্ষিণ করল শ্বাপদের মতো। আর থেকে থেকে তাকাতে থাকল সমীরর দিকে। কোনো ফন্দি আছে তার। হঠাৎ সামনে ঝুঁকে টুলটা নেওয়ার জন্য সে হাত বাড়িয়েছে, এমন সময় সমতলের পর আবার নেমে যাওয়া ঢাল বেয়ে উঠে এলো দুটি ছেলে। নীল পলিথিনের ব্যাগের ভেতর শুকনো পাতা আর বাতিল কাগজ ভরে পাটের আঁশ দিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি ফুটবলের মতো গোলাকার বস্তু একজন বুকের সঙ্গে ধরে রেখেছে। ওরা এখানে খেলতে এসে থাকবে, কিন্তু এই মুহূর্তে ওই আগন্তুক বালকের কাণ্ডে চোয়াল শক্ত করে মুখর হয়ে উঠল। ওই টুলে হাত দিতে নিষেধ করল, নিচের কাউকে বেল দেওয়ার ভয় দেখাল। ছেলেগুলোর ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো জামা নেই, বুকের হাড় গোনা যায়। একজনের পরনে হাঁটু পর্যন্ত চলে আসা সবুজ ডলার আঁকা হাফপ্যান্ট। আরেকজন কারও দেওয়া ঢোলা টিশার্টের দুটি হাতা দিয়ে সরু দুটি পা ঢুকিয়ে কোমরে মেরেছে কঠিন গিঁট। প্রত্যেকের স্নায়ু টান টান হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। অবশেষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিছু হটল সাদা শার্ট। নিচের পাতলা ঠোঁট দিয়ে চেপে রেখেছে ওপরের ঠোঁট, আর থেকে থেকে সমীরের দিকে চাইছে। সবাইকে তার প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে মুখটাকে এমন শক্ত করে রেখেছে যে যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে কেঁদে ভাসাতে পারে। সমীরকে সরে পড়তে না দেখে ছেলেটা মুখ আড়াল করে দাঁড়াল। ওদিকে ঝোপঝাড় ভেঙে আগের মতোই ফুটবল খেলার চেষ্টা চালিয়ে কিছুক্ষণ, ঠিক সুবিধা করা গেল না। এরপর বলটা হাতে নিয়ে একজন আরেকজনকে লক্ষ করে সবেগে ছুঁড়ে পালাতে থাকল। খেলাও জমে উঠলে, উচ্ছ্বাসও ঘন হলো। সাদা শার্ট এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে আমার ধীরে ধীরে এগোতে থাকল ঝরাপাতার ওই স্তূপটার দিকে। ছেলে দুটো খেলা থামিয়ে তৎক্ষণাৎ তাকালো আবার, সতর্ক দৃষ্টি তাদের।
ছেলেদের স্নায়ুযুদ্ধে রেখে ঘরটার দিকে এগোলে সমীর। সকালে ঢাকা ছেড়ে আসা সাদা বিরাট এক বাস টায়ারের পিচ কামড়ানো শব্দ তুলে পাশ কেটে এগিয়ে বাসস্টেশনে গিয়ে দাঁড়াল। ভেতর থেকে নামতে শুরু করল যাত্রাক্লান্ত মানুষগুলো; আধময়লা লম্বা ফতুয়ার বৃদ্ধ, মলিন বোরকার কুঁজো বৃদ্ধা, রং জ¦লা শাড়ির ভীত নারী, লুঙি গামছার উদ্ধত পুরুষ, সারি সারি রুগ্ন শিশু। বাসের ছাদ থেকে নামানো হতে থাকল ঝাঁকাভরা মোরগ, বেড়ের ফাঁক গলে সমস্তক রঙিন রঙিন কণ্ঠগুলো বের করে পাখিগুলো অস্থির হয়ে এদিক ওদিক চাইছে; আরও এসেছে সবজির চালান, দুটো সাইকেল। পেছনের মই ধরে ধরে টুকরি কোদাল সামলে নামল দুই যোগাড়ে। তলপেটের ডালা খুলে জাদুকরী সব মোট যারটা তাকে দ্রুত বুঝিয়ে দিতে থাকল বাসের তরুণ ছিপছিপে সহকারী।
সবার ভারি ব্যস্ততা। একা সমীর সব তাকিয়ে দেখার অবসরে দণ্ডিত। তার চোখ, তার পায়ে চলন, হাতের দোলন বলে দিচ্ছে এই দণ্ডটা সে বেশ উপভোগ করছে।
দোকানের তিন দিকে কালো কাচের জানালা। আলাদা কোনো আলো ঘরে জ্বলছে না, পাল্লা সরাতেই বাইরের আলোয় ঘর আলোকিত হয়েছে। চিবুক বুকে ঠেকিয়ে বুকপকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করলো সমীর। সরল মুখ করে এগিয়ে গেল খুব মাপা গোঁফের এক তরুণে দিকে। ওই তরুণ তার কম্পিউটারে সামনে কাঠের টুলের ওপর বসে পা নাড়ছিল প্রবল। তার পাশেই আরেকটা টুলের ওপর বসে জ্বলজ্বলে মনিটরের দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে এক তরুণী। সমীর কাছে যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তাকে, চোখে পড়ল চোখ। কোনো নারীর মুখে সরাসরি তাকিয়ে অভ্যাস নেই সমীরের। এক মা ছাড়া অন্য কোনো নারীর সংসর্গেও সে আসে নি কখনো, বলা চলে। আর মায়ের স্মৃতিও মনের এই নতুন গড়ন তৈরি হওয়ার আগের অবলম্বন। এবং ভাবমূর্তির দিক থেকে সেই স্মৃতির বাহিকা নারীটির রকম আলাদা। নারীকেন্দ্রিক কল্পনাবিলাসিতার দিক থেকে লাবুর চেয়ে এগিয়ে থাকার পেছনে এই অভাবটাই তাকে শক্তি দিয়ে থাকবে, নিজের প্রতি এমন সন্দেহ সমীরেরও আছে। তাই কোথাও মানুষজাতির এই প্রকরণটির সামনে যদি ঘটনাচক্রে সে পড়েও গিয়ে থাকে, সবসময় নিজেকে সাবধান করে দেয়। বলে, সাবধান! তুই জানিস না কী থেকে কী হয়ে যেতে পারে। কোন কথা, কোন হাসি, কিংবা চাহনির কেমন ধরন কখন কারণ আপত্তির, অস্বস্তির, বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। মনের অমন হঠাৎ সঙ্কোচনের মুখে সমীরের মনে হলো স্বপ্নে তাড়া করার মতো এমন মুখ এর আগে আর একটিও সে দেখেনি। ভেতরের বিস্ফোরণে নিজে টের পেয় শক্ত বূহ্য রচনা করে ফেলল সমীর। বাইরে কিছু বোঝা গেল না। দেখা গেল, দোকানের ছেলেটা একটা ইংরেজি ফরম পূরণ করছে। মেয়েটির মতো সেও একবার মুখ তুলে তাকালো। এরপর ফের মনিটরের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো বটে, দেরি হবে; কিন্তু কণ্ঠের কর্কশতায় আর অভিব্যক্তির রূঢ়তায় কথাটা শোনালো দূর হ-এর মতোন।
সমীর মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে বললো, আমার তাড়া নেই ভাই। আপনি আগে হাতের কাজ শেষ করুন।
সমীরের মধুরকণ্ঠ প্রত্যুত্তর শুনে তরুণের মুখের পেশিগুলো অনেকটাই শিথিল হয়ে এলো। প্লাস্টিকের একটা লাল টুল আঙুলে দেখিয়ে বসতে ইশারা করল। সমীর সেই ইশারা মেনে বসে চুপচাপ দেখতে থাকল কাজ।
অপর দোকানি একটা পুরনো, বড়, হলদেটে নকলিযন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে অক্লান্তভাবে কাগজ সরবরাহ করে চেলেছে। যন্ত্রের ভেতর এপাশওপাশ করছে তীব্র সাদা আলো। চাপা আধাজান্তব ভয় ধরানো গোঙানিও আসছে তার ভেতর থেকে। সমীর দেখল, দশবারো বছরের এক ছোট্ট ছেলে এগোতে পেছাতে সেই আলোটাকে চোখে ভয় নিয়ে অনুসরণ করছে। পরনে স্কুলে পোশাক। সাগরনীল প্যান্ট আর তাতে গুঁজে পরা একটা সাদা শার্ট; শার্টের পকেটে ছোট সোনালী সেফটিপিন দিয়ে আঁটা একটা আকাশীনীল ব্যাচ। নাকের নিচে হালকা গোঁফের রেখা আর থুতনিতেকপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মেয়েটার কাজ হতেই সমীর গিয়ে ওই টুলের ওপর বসলো। খানিক আগের আসনধারিনীর ওম তখনো ওখানে দিব্য। ভাঁজ করা কাগজটার ভাঁজ খুলে সমীর এগিয়ে দিলো ওই তরুণের হাতে। ভুরু দুটো কুঁচকে কাগজের এমাথা ওমাথা একবার দেখে নিলো ছেলেটা। এরপর কিবোর্ডের পাশে কাগজটা বিছিয়ে বলপেন গলিয়ে বানানো একটা চাপপাথর নিয়ে রাখলো তার ওপর। নির্বাক্যে লেগে গেল খটাখট লিখতে। পাখার নামিয়ে আনা গরম বাতাসে থেকে থেকে উল্টে যেতে চাইলো কাগজটার চাপা নাপড়া অপর কোণ। তখন হাত দিয়ে চেপে রেখে বেশ খানিকটা দেখে নিয়ে এরপর কিবোর্ডে সরোষে আঙুলি চালিয়ে যেতে থাকল তরুণ। সমীর একটা আঙুল দিয়ে উল্টোপ্রবণ কোণটা চেপে ধরল।
তৈরি হতে থাকল পোশাক কারখানায় নিয়োগের জন্য আবেদনপত্র। পরপর বেরোল এর তিনটি সংস্করণ, তাতে তিন পৃথক প্রতিষ্ঠানের নাম কেবল লিখিত হয়েছে, দেওয়া তথ্যে আর কোনো অদলবদল নেই। এরপর বুকপকেট থেকে বেরোলো একটা ছবি। সেই ছবি নিজের ভেতর নিয়ে জাদু দেখালো কম্পিউটার। একটি ছবি জন্ম দিলো আরও কুড়িটির। কলম চেয়ে নিয়ে তিনটির পেছনে নাম লিখে পিন সাঁটিয়ে তিন পৃথম খাকি খামের ভেতর সযতনে ভরা হলো আবেদনপত্রগুলো। খামের ওপর নিজ নাম, ঠিকানা, কাক্সিক্ষত পদ আর তারেকের মুঠোফোন নাম্বারটা লিখে সেদিনের মতো শেষ হলো অভিযান।
ঘর থেকে বেরিয়ে ঢালের নিচে তাকাল সমীর। টুলটা তেমনই আকাশের দিকে ভাঙা পায়া তুলে পড়ে আছে ঘাসে। হয়ত ওটার আকর্ষণ ফুরিয়েছে। শিশু তিনটির কাউকে কোথাও চোখে পড়ল না। বাসস্টেশনে লোকের ভিড় লেগেই আছে। যেখানে মানুষ, সেখানেই রুপালি দুমড়ানো থালা হাতে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনুনয়মুখো কোনো না কোনো অথর্ব লোক, কী নারী, কী পুরুষ। গেরুয়া কিংবা কাছাকাছি রঙের সেলোয়ার কামিজ পরিহিতা কোনো মেয়েকে যখনই দেখা গেল, তার মুখশোভা না দেখে সমীর শান্ত হলো না। অতো অধ্যবসায়ের পরও সেই মেয়েটিকে আর কোথাও দেখতে পাওয়া গেলো না।
চলবে…