॥পর্ব-৭॥
লোকটার ওপর সত্যি সত্যিই বিরক্ত হলো মশি। এতক্ষণ বসিয়ে রেখে আসার সময় হলো তার এখন! একবার ভাবল বলে দেয়, এখন আর আসবেন না। কাল সকালে আসেন। তখন যা বলার বলবেন। কিন্তু পেছন থেকে আরেক জনের গলা আরেকটু চওড়া শোনা গেল, মাঝিভাই, আছেননি?
বিরক্তির সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য কৌতূহলও বোধ করল মশি। এত রাতে এরা নিশ্চয় স্রেফ খোশগল্প করার জন্যে আসতে চাইছে না। কোনো উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা কী, বুঝতে পারছে না।
আসুন, সাড়া দিল সে। অনেক আগে আসার কথা ছিল আপনার। আমি ঘুমাতে চলে যাচ্ছিলাম।
হে হে হে করে হাসল মাফলারঅলা। ঠিক বলেছেন। কিন্তুক এই ভাইয়ে আসতে একটু দেরি করি ফেলাইছে। কিছু মনে কইরেন না, ভাই। আপনের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে হয়তো। তয় বুঝেন না, কাজের কথা বলে কথা।
তক্তা বেয়ে নৌকোয় উঠে এলো ওরা। মশির সঙ্গে ছইয়ের ওপর উঠে বসল।
বলুন।
একটু ক্ষণ চুপ করে রইল ওরা। তারপর ম্যাচ মেরে বিড়ি ধরালো দ্বিতীয় জন। একটু কেশে নিয়ে বলল, ভাইজান একটা কথা…
হুম।
সরকারের কাছ থেইকা এই গম আনতে কত কষ্ট হইছে জানেন? আমগো দুই ভাইয়ের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হইছে।
কেন?
বোঝেন না?
না।
থেমে গেল দ্বিতীয় জন। কী বলবে, বুঝতে পারছে না। প্রথম জন অর্থাৎ মাফলারঅলা গলা খাঁকার দিল। খাড়ান, আমি বুঝাই কই।
একটু দম নিলো। তারপর বললো, বুঝলেন মিয়া ভাই? গত একমাস ধরে এই গমের পেছনে ছোটাছুটি করতাছি। একবার এই অফিস, একবার সে অফিস। একবার একে ধরো, আরেকবার তাকে ধরো। কষ্টের চূড়ান্ত।
হুম। কথা সত্য। সায় দিলো মশি। কিন্তু কাজটা যখন জনগণের, তখন কাউকে না কাউকে তো কষ্ট করতেই হবে।
শুধু কি কষ্ট? দ্বিতীয়জন বললো। টাকা খরচ? গাঁটের পয়সা খরচ করে কাপ্তাই-রাঙামটি আসা যাওয়া, একে টাকা খাওয়ানো, ওকে টাকা খাওয়ানো… বুঝলেন, ব্যাটারা টাকা ছাড়া মাল ছাড়ে না।
ব্যাপারটা এতক্ষণেও না বোঝার কথা নয়। অবাক হলো না মশি। সব খানেই তো এমন কিছু ঘটছে। যে যেখান দিয়ে সামান্য সুযোগ পাচ্ছে, সেখান দিয়ে কাজে লাগাচ্ছে। এরাও সে উদ্দেশ্যে এসেছে। কিন্তু মশি কী করবে? তবু শেষ পর্যন্ত শুনতে চাইল সে। ঠিক কথা বলেছেন। সবখানেই তো এসব চলে। এছাড়া তো কাজ হয় না। তবে আপনারা মানুষ ভালো। জনগণের জন্যে কষ্ট করছেন, পকেটের পয়সা খরচ করছেন। নিশ্চয় আগামীতে এর ফল পাবেন। অন্ধকারে ওর মুখে সামান্য হাসি ফুটল। দেখতে পেল না লোকগুলো।
হে হে হে। হাসল মাফলারঅলা। একদম ঠিক বলেছেন, ভাই। দশ কথার এক কথা। তবে কথা হলো, দশের কাজ করতে হলেও তো টাকা খরচ করতে হয়। আমরা গরিব মানুষ। অত টাকা কোথায় পাই? নিজেদেরও তো সংসার, বউ-পোলা আছে। তাদের খাওন দাওন আছে। আছে কিনা কন, মাঝিভাই? আছে না?
অবশ্যই আছে। স্বীকার করল মশি। তো এখন কী করবেন। আমারে এসব শুনাইয়া লাভ কী রে ভাই? জনগণের কাজ পারলে করবেন, না পারলে নাই… চুপ করে গেল।
উসখুস করছে লোকদুটো আর বিরক্ত বোধ করছে মশি। আর কিছু বলবেন, ভাই?
হুম। বলল মাফলারঅলা। পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল কিছু একটা। বাড়িয়ে ধরল মশির দিকে।
কী এটা?
টাকা। নেন। আপনার জন্য।
মশি হাসল। ভাই, আপনি ভুলে গেছেন। ভাড়ার টাকা আগে দিয়ে ফেলেছেন। কাপ্তাই থেকে নৌকা ছাড়ার আগেই।
একটু যেন দমে গেল লোকটা। সঙ্গীর দিকে চাইল। এবার হাল ধরল সঙ্গী। বলল, ভাই আপনি বুঝতে পারছেন না। এটা আপনাকে আমরা সম্মান করছি।
কেন? সম্মান করার কী হলো?
ভাই, আপনি মাঝি মানুষ। আপনার একটা আলাদা ইজ্জত আছে। আপনি এটা রাখেন। সামান্য চা-পানি খাওয়ার জন্য। কেউ জানবে না। আমাদের লোক ঠিক করা আছে। বেশি না, মাত্র চার বস্তা…
কী? ব্যাপারটা আগেই আঁচ করার পরও কেমন চমকে উঠল মশি। একদম না। কাল সকালে লোকজন নিয়ে আসবেন। মাল আনলোড হবে। এবার যান। আমি ঘুমাব।
লোকদুটোর মুখ দেখে মনে হলো, বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। মুখ কালো হয়ে গেছে। রাগের চিহ্ন। তবে মশি ভয় পাচ্ছে না। জানে এরা কিছুই করতে পারবে না। উল্টোপাল্টা কিছু করতে চাইলে নিজেরাই ফেঁসে যাবে।
তবু বসে রইল দুজন। মিনিটখানেক পরে যেন শেষ চেষ্টা হিসেবে বলল, মাঝিভাই, শোনেন। একটা কথা কইছি, একটু রাখেন। আমরা ভাই কষ্ট করছি, তার একটা দাম আছে না? আপনে একটু চিন্তা করেন…
মশি উঠে দাঁড়াল। সশব্দে বিশাল এক আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল। আপনারা যান, ভাই। কাল সকালে মাল আনলোড করানোর ব্যবস্থা করেন। এখন ঘুমাব। তারপর একজন নাইয়ার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল, ধনু, ওই ধনু। ওঠ, নৌকার পানি ফেলতে হবে। কইরে…
চিড়ে যে গলবে না, বুঝে গেল দুই জন। এরপর আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে নেমে গেল নৌকো থেকে।
সকালে ওপরে উঠল মশি। চায়ের দোকানটায় গিয়ে বসল। দোকানদার চা এনে দিতেই লোকগুলোর কথা জিজ্ঞেস করল।
একগাল হাসল দোকানদার। না মেয়াভাই, এখনো আসেনি।
চায়ের কাপে চুমুক দিল মশি। মুখ তুলতে দেখল মেয়েটিকে। দোকানে এসেছে। মেয়েটাও তাকাল মশির দিকে। একটু ইতস্তত করল। তারপর কাছে এসে বলল, মাঝি, আপনার নৌকা আনলোড করছেন না কেন?
অদ্ভূত এক সুরেলা টান মেয়েটার গলায়। প্রশ্নটা একটু বেখাপ্পা শোনালেও কিছু মনে করল না মশি। ভাবল, মেয়েটা এ প্রশ্ন করতেই পারে। কারণ ত্রাণ তো এসেছে সেটলারদের জন্যেই।
নৌকা আনলোড করানোর জন্যে তো বসে আছি। কিন্তু আপনাদের লোকজন নেই। আনলোড করবে কে?
কেন, আপনারা আনলোড করবেন। আপনারা এনেছেন, আনলোডও আপনার করবেন না?
একথা আর কেউ বললে মশি রেগে উঠত। কিন্তু যে বলছে, সে একজন মেয়ে। মেয়েদের কথায় রাগ করা যায় না। মশি হেসে চুপ করে রইল।
তবে সে নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। কাল রাতে লোকগুলো টাকা সাধাসাধির পর নৌকো থেকে নেমে আসার সময় বলেছিল, সকাল আটটার মধ্যেই লোকজন নিয়ে এসে গমের বস্তা নামানো শুরু করবে তারা। কিন্তু এখন প্রায় নয়টা বেজে গেছে, লোকগুলোর দেখা নেই। লোক দুজন না এলে গম নামানো হবে না। মশি নিজেই নামাতে দেবে না। কারণ যারা কাপ্তাই থেকে গমের বস্তা নিয়ে এসেছে, তাদের কাছেই মাল বুঝিয়ে দিয়ে যাবে ও। সেটাই নিয়ম। পরে কোনো সমস্যা হলে তাকে দায়ী করতে পারবে না।
নৌকো থেকে গম আনলোড করার জন্যে হৈ চৈ শুরু করে দিল পল্লবী। তার সঙ্গে জুটেছে ওর বয়সী কয়েকটা ছেলে। মশির সামনে এসে হম্বি তম্বি শুরু করল। গম নামাতে হবে। এখনই। মশি পল্লবীর দিকে চাইল। বলল, যারা আমার সঙ্গে কাপ্তাই থেকে গম নিয়ে এসেছে তারা কোথায়?
পল্লবীও তাকাল ওর দিকে। বলল, সকাল থেকে তাদের দেখা নেই। খুঁজে এসেছি তাদের ঘরে গিয়ে। কোথায় গেছে বলতে পারছে না কেউ।
মশি খেয়াল করল, মেয়েটা ওর সঙ্গে শুদ্ধভাষায় কথা বলছে। আর ওর বাচনভঙ্গিতেও কোনো জড়তা নেই।
ব্যাপারটা বুঝতে পারছে মশি। কাল রাতে তাকে তাদের প্রস্তাবে রাজি করাতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়েছে লোকগুলো। সকালে তাই নৌকো থেকে গম আনলোড না করে গা ঢাকা দিয়েছে এখন। লোকগুলো হয়তো ভেবেছে, এভাবেই শায়েস্তা করা যাবে ত্যাঁদড় মাঝিকে। ওরা মাল বুঝে না নিলে নৌকো থেকে মাল নামাতে পারবে না মাঝি। ফলে ভরা নৌকো নিয়ে ঘাটে বসে থাকতে হবে। তাতে মাঝির ক্ষতি। নৌকোর মালিক ডেমারেজ গুনবে।
বুদ্ধিটা অবশ্য ভালই। তেমন হলে মশি সত্যি সত্যিই সমস্যায় পড়ে যাবে। তাদের নৌকোর রসদ ফুরিয়ে এসেছে। যেদিন মাল নিয়ে ধানগোদা পাড়ার ঘাটে এসেছে, তার পরের দিনই দুপুরের দিকে তাদের ফিরে যাওয়ার কথা। দেরি হলে নৌকোর মালিক দুশ্চিন্তা করতে শুরু করবে। হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু ভাবতেও শুরু করবে। ভাববে হয়তো নৌকো বেচে দিয়ে পালিয়েছে মাঝি।
নিজের সমস্যাটা বুঝতে পারছে মশি। দুদিনে জায়গায় আজ নিয়ে চারদিন। নৌকো এখনো আনলোড হয়নি। কাপ্তাই গিয়ে মালিককে কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখানকার সমস্যা বলে লাভ হবে না। যতদিন যায়, মালিক ততদিনের ভাড়া কাটবে। দেখা যাবে ভাড়া থেকে যা পাওয়া গেছে, তার পুরোটাই তাকে দিয়ে ফেলতে হবে। এরপর নাইয়াদের বেতন আসবে কোত্থেকে? কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, নৌকো আনলোড করবে কে আর মাল বুঝেই বা কে নেবে?
পল্লবীর দিকে চাইল সে, যারা কাপ্তাই থেকে মাল নিয়ে এসেছে, তারা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। তারা না এলে মাল বুঝিয়ে দেব কাকে?
ওদের আসার দরকার হবে না, বলল পল্লবী। মাল আমরা নামাব।
বেশ। কিন্তু বুঝে নেবে কে?
আমরা বুঝে নেব। আমরা বুঝে নেব। কয়েকজন এক সঙ্গে হৈ চৈ করে উঠল।
না। ওদের থামিয়ে দিল পল্লবী। বুঝে নেবে মুরব্বিরা। তারপর কয়েকজনের নাম বলল, হামিদ কাকা, আলম ভাই, জয়নাল জেঠা, আপনারা মাল বুঝে নেন। মাঝিকে স্লিপ লিখে দেন, মাল বুঝিয়া পাইয়াছি।
সবাই সম্মতি জানাল ওর কথায়। একজন বলল, পল্লবী, কাগজ তুমিই লিখে দাও। আমরা দস্তখত করে দেব। যারা দস্তখত পারবে না, তারা টিপসই দেবে।
এরপর আধঘণ্টার মধ্যেই নৌকো আনলোড করা শুরু হলো। দশ-বারো জন মিলে নৌকো থেকে গমের বস্তাগুলো তুলতে লাগল।
পল্লবীর উৎসাহের শেষ নেই। গমের বস্তা ওপরে তোলা থেকে সেগুলো কোথায় রাখা হবে, কে সেগুলোর দায়িত্বে থাকবে এসব ঠিকঠাক করছে মুরব্বিদের সঙ্গে কথা বলে। মশি অবাক হয়ে খেয়াল কলল, মেয়েটার মধ্যে কেমন একটা সহজাত নেতৃত্বের ভাব রয়েছে। ওর চেয়ে বড়রাও শুনছে ওর কথা। কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ওর সঙ্গে আলাপ করে নিচ্ছে। একসময় মশি অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, ওর চোখ অনুসরণ করছে মেয়েটাকে। কেমন এক আকর্ষণ অনুভব করছে ওর প্রতি।
চলবে…