॥পর্ব-৬॥
অনেকে মনে করেন সাহিত্য এক ধরনের তথ্য বা বার্তাবাহী লেখ্য মাধ্যম। যা আমাদের মনের সংবাদ দেয়। তাই তারা লেখার মধ্যে ম্যাসেজ খোঁজেন। সৈয় শামসুল হক বলতেন উপন্যাস উঁচুমানের সাংবাদিকতা। এ তত্ত্বটি এদেশে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। যেমন, ‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ স্বরূপ’ তত্ত্বও মানেন কেউ কেই। প্রচলিত তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিষ্ণু দে সংবাদগুলোকেই কাব্য বলতে চেয়েছেন। এই নতুন তত্ত্ব সচেতন পাঠকের মেনে নিতে কষ্ট হবে। কারণ সংবাদ কি কাব্যগুণে গুণান্বিত? বিষ্ণু দে কি তাহলে বোকার মতো বা তরুণ তাত্ত্বিকের মতো ঠেলার চোটে কথাটা বলে ফেলেছেন মাত্র? সব সংবাদই কি কাব্য? বিষ্ণু দে এ কথা বলেন নাই। সব কবিতাই তো কবিতা নয়। তিনি সব সংবাদকে কাব্যের অন্তর্ভুক্ত দেখতে চেয়েছেন। এখানে তিনি কবিতার অধিক্ষেত্রকে অনেক বড় করে দেখতে চেয়েছেন। মধ্যবিত্তের ব্যক্তিগত প্যানপ্যনানি, বিপ্লবের তত্ত্ব আর কতদিনে কবিতায় নতুনত্ব আনতে পারে? বিশাল এই জগৎকে রবীন্দ্রনাথ যেমন সুরের রাজত্বের আনন্দধারারূপে দেখেছেন বিষ্ণু দে ঠিক তেমনি কবিতার আয়তন বৃদ্ধির জন্যই নতুন করে কবিতার সংজ্ঞা সৃষ্টি করে নিতে চেয়েছেন।
কবিতার প্রতি কতখানি নিবেদিত হলে এই বয়সে কবিতার আয়তন বাড়িয়ে সার্বভৌমত্ব প্রসারিতত করে—সেই চল্লিশের দশকে—কমিউনিস্ট যুগেই লেখা কিন্তু রেখে দেওয়া অকমিউনিস্ট কবিতা জুড়ে দিয়ে এ গ্রন্থের নাম রাখেন ‘সংবাদ মূলত কাব্য’।
‘অন্য অঙ্ক’ নিজের হিসাবের ভিন্নতার কথা স্পষ্টভাবে এখানে জানান। আপেক্ষিকতা মানেন, নিরপেক্ষতা নয়। সেখানেই ঘটে ইতরবিশেষ। রাজনৈতিক তত্ত্ব গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির আপেক্ষিকতা থাকে। এটা বিপ্লবী কবিরা মানেন না। তাঁরা সবার জন্য অনপেক্ষভাবে একই সূত্র ব্যবহার করার পক্ষপাতী। বিষ্ণু দে এখানেই ব্যতিক্রম।
‘এরা সব বিশ্বের পাণ্ডব’ কবিতায় যুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কবি। যুক্তি আর আবেগ মানুষের বিপরীত মানসিক অবস্থা। অতিরিক্ত যুক্তি ও বুদ্ধিবাদী কবিতা লিখে কবি তীব্র সমালোচিত হয়েছিলেন। সেই তিনিই এখন যুক্তির বিরুদ্ধে।
চাঁদাবাজির মতো সামাজিক উৎপাতে বিরক্ত হয়ে লেখেন ‘সান্ত¦না’র মতো কবিতা। নিজেই চাঁদাবাজির শিকার হলেই ভেতর থেকে আসে এ ধরনের কবিতা।
প্রাণের ভয়ে তুমিই দিলে চাঁদা
এখন চাও বৃথাই সান্ত্বনা!
‘দুই কর্মীর এক দাদার জন্য’ কবিতাটি রাজনৈতিক ব্যঙ্গের সুর লক্ষ করা যায়।
প্রথমে বনে বসন্তের প্রভাব হৃদয়ে স্নায়ুতে গোপনে
কাজ করে চলে, লক্ষ্য করেছ কি তুমি?
সমস্যা হল বিষ্ণু দে কথাসাহিত্য রচনা করেন নাই, তাই কবিতার ভেতরেই অনেক গল্প-উপন্যাসের গল্প ও ঘটনা মিলেমিশে আছে। সেখানে বিমূর্ত হয়ে আছে বহু চরিত্র, বিচিত্র কণ্ঠ। বহুস্বরের সমাবেশ, সব কথা কিনা সপষ্ট বোঝা কঠিন।
‘তখন চৈতন্যে চাই’ কবিতায় কবির তত্ত্ববিরোধী অবস্থান।
তবু যবে লুব্ধ তত্ত্ব মদমত্ত হুঙ্কারে ফিসফাসে
লাল-কালো অস্ত্র হানে দগ্ধ করে প্রতিরোধ
‘বহু সূর্য অস্তগত’ কবিতায় বার্ধক্যকে শিশু বলে অভিহিত করেছেন। এটি আমাদের সমাজে প্রচলিত সামাজিক সত্যেরই অংশ। আবার ‘আদি অন্তে’ কবিতায় তুলে ধরেছেন বার্ধক্যের ইতিবাচক দিক। বুদ্ধদেব বসু বার্ধক্য পছন্দ করতেন। সে রবীন্দ্রবার্ধক্যের প্রতি রোমান্টিক আবেগ থেকে চাওয়া। তিনি মধ্য তিরিশেই নিজেকে বৃদ্ধ ভাবতে শুরু করেন। কিন্তুবিষ্ণু দের বার্ধক্য অভিজ্ঞতা পুষ্ট উচ্চারণ।
বয়স তো ক্ষতি নয়, বয়সেই স্নায়ুর সংহতি
মনের বিশুদ্ধি ক্রিয়া, বলা যায় বিষঙ্গীকরণ
এই কোরয়ারেন্টাইন ধ্যানের পথে একাকীত্বের বিশুদ্ধ প্রস্তুতি। কবিতায় বয়সের মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি মরুর উদাহরণ টেনেছেন। সেটা আরবের মরুভূমিতে জন্মগ্রহণকারী হজরত মোহাম্মদেরই কথা। যিনি নবুয়তি লাভ করেছেন একটি নির্দিষ্ট বয়সের পরে। কাজেই বয়সের মূল্য অনেক।
কিংবা আরো ভালো তুল্য দীর্ঘ আয়ু ফিনিশীয় শ্যোনে
আরব্য মরুভূ যার অগ্নিবর্ণে জন্মমৃত্যু মেনে
জরায় জতক বাঁধে সহাবস্থ সূর্য পরিক্রমা!
রাগ-দ্বেষ-লোভ সব যখন কমে আসে তখনই ধ্যানের প্রস্তুতি শুরু হয়।
দেহাতিরিক্ত প্রেমের কথা অনেক দিন ধরেই বলছেন বিষ্ণু দে। এতে অবশ্য রবীন্দ্রনাথেরও পক্ষপাত ছিল। আধ্যাত্মিক ভাষায় লেখা বলে রবীন্দ্রসাহিত্যে এ বিষয়টি পৃথক করে দেখার সুযোগ ছিল না। বিষ্ণু দে দিনে দিনে দেহাতিরিক্ত হৃদয়ের প্রেমের দাবিতে জোরালো করেছেন তার কবিতার ভাষা। ‘দেহকে সাধে মনে’ কবিতায় তাই দেখি। আত্মপরিচয় সংকট দেখিনিজেকে না চেনার কথা ‘সে মুখ নিয়ত পালটায়’ কবিতায়। আরো গভীরভাবে উপলব্ধির কথা লিখেছেন ‘ডানায়’ কবিতায়।
‘বৈদেহী’ কবিতায় দেখি,
আমার প্রদীপহীন নিত্য সন্ধ্যা তোমার তুলসীমঞ্চে নত
হে বৈদেহী, অয়ি পতিব্রতা!
…
আমার আকাঙ্ক্ষা তাই তোমার বন্দনায় ঘিরে
তুমি পুণ্যভূমি দ্বীপ আমার সমুদ্রে,
সুন্দরী অপাপবিদ্ধা! শুধু হৃদয়ের বালুতীরে
এ সময়ের কবিতা থেকে বোঝা যায় বিগতযৌবনে প্রেমের অস্তিত্ব সম্ভব। মানুষ শুধু কাম নিয়ে বাঁচে না। যতদিন সম্ভব বাঁচে। কিন্তু যৌবনের ফুরানোতে জীবন শেষ হয়ে যায় না। জীবন মূলত বাঁচে প্রেমে। প্রেমের বহুমাত্রিকতা বয়সে বয়সে ভিন্ন হয়। নতুন হয়। রবীন্দ্রবার্ধক্যের জীবনসূত্র আর বিষ্ণু দের বার্ধক্যের জীবনসূত্র অভিন্ন নয়। রবীন্দ্রনাথ ঐশী বিশ্বাসে আস্থাশীল ছিলেন, কৃতজ্ঞ ছিলেন। বিষ্ণু দে ঐশী ভাবনাতাড়িত হলেও বিশ্বাসী নন, আস্থাশীল নন, সমর্পিত নন, কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই ওঠে না।
‘দুর্বহ অদ্বৈত সিদ্ধি’তে স্পষ্ট ভাষায় বিষ্ণু দে জানান অদ্বেতবাদ তার কাছে দুর্বহ। তাই দ্বৈতবাদেই আস্থা। দেহ ও আত্মা ভিন্ন। এ সময়ের কবিতায় অতনু, অনঙ্গ, দ্বৈত, অদ্বৈত এ জাতীয় শব্দানুষঙ্গ ঘুরে ফিরে আসছে। ‘রক্তে মাঘ’ কবিতায় দেখি, ‘অথচ এও সত্য দৃদ্ধ রক্তে হৃদয় স্বাধীন’।
অনেক দিন ধরেই বিষ্ণু দে’কে প্রেমের প্রার্থনায় কাতর দেখছি। ‘শুদ্ধ নীল গান’ কবিতায় প্রেম পেয়েও দ্বিধাগ্রস্ত।
বিদায়ের লগ্ন জেনো সর্বদাই
প্রাক্তনের পায়ে কেন লাজাঞ্জলি দাও?
কানে যার কৃষ্ণপক্ষ রথের উধাও
চক্রের আসন্নধ্বনি, যে দিকে পালাই অন্ধকারে আকণ্ঠ ধুলায়,
তাকে কেন মাল্য দান?
এখানে কবিকে মনে হচ্ছে মৃত্যু আসন্ন দেখে মৃত্যুভয়ে হিসাবের খাতা তুলে রাখা একজন চিরপথের যাত্রী প্রেম নয়, প্রিয়া নয় মৃত্যুর ভেতর দিয়ে অনন্তপথের যাত্রার জন্য প্রহর গুনছেন। এ সময় প্রেমের দান কার কাছে কতটুকু আর মূল্য পাবে? ছোট্ট এ কবিতাটির বাকি অর্ধেকও আমরা পড়ে ফেলতে পারি এ বিষয়টি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য।
নাকি ঠিক সেই হেতু?
কারণ, সময় যার ঊর্ধ্বশ্বাস সূর্যাস্তে সেতু,
তারই চোখে চাও, জ্বলে সাত্ত্বিক আবেশ
নিশ্বাসে প্রশ্বাসে রাসে যমুনার শুদ্ধ নীল গান?
সব শেষে কী পেলাম? ব্যক্তিপ্রেম কৃষ্ণপ্রেমে রূপান্তরিত হলো? বৈষ্ণব অনুষঙ্গে প্রেম যমুনার শুদ্ধ নীল গান হয়ে অনন্তের পথে রয়ে গেল। ‘জাতক’ কবিতায় নৈর্ব্যক্তিক কবিতা বৈদেহী প্রেম প্রাধ্যান্য পেয়েছে। ‘মৃত্যুর বিশ্রাম চাই’ কবিতায় নিজের ক্লান্তির কথা, দাঙ্গার প্রতি ধিক্কার আছে। এ সময়ের কবিতায় দেখছি বিষ্ণু দে’র নেতিবাচকতা, হতাশা বাড়ছে। ‘স্বর্গনরক’ কবিতায় তার তীব্র প্রকাশ দেখছি। তন্বীদের নিয়ে স্বপ্ন, আশা এবং হতাশা আছে ‘ঈপ্সা’ এবং ‘বাছা কতটুকু জানে’ কবিতায়। মন আর দেহের দ্বৈতবাদ নিয়ে আরো স্পষ্ট উক্তি আছে ‘হ্যাঁ মন আর দেহ’ কবিতায়।
তবে বিষ্ণু দে একেবারে নিরাশ নন। তিনি বাস্তবের কঠিন অবস্থা থেকে পলায়নের জন্যই কি স্বপ্নে আস্থাশীল হচ্ছেন? ‘স্বপ্নেই আরোগ্য আজ’ কবিতায় তাই মনে হয়। তবে স্বপ্নের রাজ্যেও কবি পুরোপুরি স্বস্তি পাচ্ছেন না। স্বপ্নে আছে দুঃস্বপ্ন।
খেদ শুধু এই: জীবনমরণ-মানা স্বপ্নের অভ্যাসে
থেকে থেকে আসে দুঃস্বপ্ন এবং
ঘুম ভেঙে যায় প্রায় বুকে-চাপা মৃত্যুতে অসাড়;
সমস্ত শরীর নীল রং এমনকী স্বয়ং চৈতন্যেও রুদ্ধশ্বাস
না-জীবন-না মরণ অন্ধ
শূন্যের ময়াল নাগপাশে ॥
কিছু কিছু কবিতায় ইতিবাচকতা উঁকি দেয়। বিষ্ণু দে রবীন্দ্রনাথের রূপনারাণকে কত ভাবে কত কবিতায় ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার করেছেন! তিনি রূপনারায়ণ, রূপনারায়ণপুর এমন নানা নামে কবিতায় তুলেছেন। এই রূপনারায়ণ নদী বা রূপনারায়ণপুর গ্রামটি কি কবির ইউটোপিয়া? মাঝে মাঝে তিনি ইতিবাচক লেখাও লিখেছেন। নাকি এই লেখা এসেছে নিকজনদের সমালোচনার ফলে? ‘সাবেক মেঘের গান’ কবিতাটির শুরুটা রোমান্টিক আকাশ দিয়ে শুরু হলেও পুরোটা আশাবাদী নয়। তবে ‘এই দেশে শীতেও সবজি বাঁচে’ কবিতায় দেখি মনের আরামও পান কবি বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যে এবং নিসর্গের রঙে। ‘কী বিশ্বাসে পেল এ নিশ্চিতি’ কবিতায় কবির মনে যে প্রশ্ন দেখি তা অনেক কবিরই। জীবন এবং জগতের রহস্যের সন্ধানে সারাজীবন বিদ্যা আর বুদ্ধির চর্চা করেও শিক্ষিত লোকেরা যেখানে বার্ধক্যে পৌঁছে হতাশায় নিমজ্জিত হন সেখানে গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের জীবন দর্শনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে যা মানুষকে বিদ্বানের চেয়েও আশাবাদী করে রাখে?
বিশাল নদী রেখে যারা সরু খারের পাড়ে জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন তারা কোথা তেকে জীবনে এত রস পান? এ কী সমবয়ী জীবনের সমাবেশ থেকে? আধনিক জীবনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তাহলে আমাদের কোন আলোয় নিয়ে যায় যে আলো মূলত অন্ধকার? প্রগতি কি আলো নাকি ঔপনিবেশিক অন্ধকার?
আর এখানে কি দুপাড়ের সম্বন্ধ-প্রীতি নিকট স্পর্শের
স্থায়িত্বের প্রসাদের দাবি সম্পূর্ণ মেটাবে?
কী দ্বৈতে কী দ্বৈতাদ্বৈতে সবই সংলগ্নতা চায়
এই নদীমাতৃক বাংলায়, আমাদের নাটমঞ্চে সহস্রের
মেলায় বা সহস্রের রাসে।
বিচ্ছিন্নতাবোধের কালো পর্দাঢাকা অন্ধকার থেকে জনজীবন আলোতে আসতে পারে সহস্রের মেলায় আর রাসে। যেখানে ব্যক্তিত্ববোধের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সবাই একাকার হয়ে যেতে পারে লোকজ উৎসবে। এখানেই বাঙালির প্রাণ যেন প্রাণ খুঁজে পায়।
চলবে…
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-৫॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-৪॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-৩॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-২॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-১॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ