ফকির আলতামাস ও বিবি সুরাইয়ার তালা
অট্টহাসির রোল পড়ে গেল গাছতলায়। সবার চোখ যেন বুঁজে আসছে হাসির জোয়ারে। যখন হাসি প্রায় থেমে এলো, সাধু বললেন, হাসি একটি উচ্চস্তরীয় ধ্যানবৃত্তি। এতে তোমরা সম্পূর্ণ সত্তা দিয়ে নিজেদের জাগ্রত করতে পারো। তোমরা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো অত্যন্ত উঁচুমানের দরবেশের কথা শুনেছ। কিন্তু আজ আরেকজন মহান ব্যক্তির কথা বলব, যিনি এতটাই নিজেকে আড়াল করে রাখতেন যে, আমরা তাঁর সম্পর্কে জানতে পেরেছি সামান্যই। তাঁর নাম ফকির আলতামাস।
তুর্কমেনিস্তানের খোরাসানে তিনি বাস করতেন। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতোই ছিল তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ পরিহাসপ্রিয় স্বভাব। লোকে তাঁর প্রতি এতটাই আগ্রহী ছিল যে, তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে কবরখানাতেও ঢুঁ মারতো। তিনি যেকোনো স্থানে যেকোনো সময় অবস্থান করতেন।
একবার ফকির আলতামাস, হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছুলেন মার্ভ শহরের এমন এক স্থানে, যেখানে ভদ্রলোকের যাতায়াত ছিল কম, কারণ ওটি ছিল পতিতালয়। তিনি ঘুরতে ঘুরতে একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন, ঘরটি বাইরে থেকে তালা দেওয়া এবং ঘরের ভেতর থেকে এক নারীমুখ জানালায় বসে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। ফকির সে নারীর দিকে তাকালেন কিছুক্ষণ, তারপর দুয়ারের সামনে এসে বসলেন। ভেতর থেকে নারীটি বলে উঠলো, হে মান্যবর! আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে একজন সাধু দরবেশ, আপনি এখানে কেন?
আমি তোমার কাছেই এসেছি।
হায়! কী বলেন? আপনার মতো মানুষ আমার কাছে আসবে দুনিয়া কি এতই নিচে নেমে গেল?
না-না বরং নিচে থেকে আমি তা তুলতে চেষ্টা করছি।
সে নারী হেসে উঠে বললো, আচ্ছা, কিভাবে তা করবেন আপনি!
তুমি দেখতে চাও?
জ্বি।
তবে তোমার ঘরের চাবিটি দাও।
সে চাবিতো আমি খদ্দেরদের দেই টাকার বিনিময়ে, ওরা পরে দিতে চায় না বলে আগেই ওদের কাছ থেকে তা আদায় করি।
ঠিক আছে, তোমার দাম কত?
একঘণ্টার জন্য ২ দিরহাম।
আচ্ছা, এই নাও আমি ৪ দিরহাম দিলাম, এইবার চাবিখানা দাও।
বারবণিতা সেই নারী ৪ দিরহাম হাতে পেয়ে কিছু বুঝে না উঠতে পেরে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চাবিটি দিল। ফকির তালাটি খুললেন এবং তা নিজের গলায় লকেটের মতো ঝুলিয়ে দিয়ে হাঁটতে লাগলেন সমগ্র এলাকা। তালাটি ছিল বড় এবং এতে নম্বর যুক্ত ছিল ৫, পতিতালয়ের সব দরজার তালাতেই এ রকম নম্বর লেখা থাকে চিহ্ন হিসেবে।
সেই ৫ নম্বর তালার নারী ফকিরের পিছু নিলেন, ফকির যেখানেই যাচ্ছেন তার তালাটি গলায় ঝুলছে আর পেছনে সে নারী তাঁকে থামাতে সচেষ্ট। একটা হাসির রোল পড়ে গেলো সমগ্র এলাকাটি জুড়ে। কেউ বলে উঠলো, এ যে দেখছি পাগল মজনুর পেছনে ছুটেছে লায়লা; কেউ বললো অবশেষে ৫ নম্বর, খদ্দের হিসেবে পেল একটি পাগল; কেউ আবার বলে উঠলো দেখো, দেখো, লোকটা নিজেই ৫ নম্বরের তালা হয়ে তাকে কেমন জব্দ করলো!
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সমগ্র পতিতালয়ে যখন অট্টহাসির রোল পড়ে গেল, তখন সেই নারীটি অবশেষে ফকিরকে থামাতে না পেরে কেঁদে উঠলো। তার কান্না এতটাই করুণতর হয়ে উঠলো যে অবশেষে ফকির আলতামাস ক্ষান্ত হলেন, কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কী হয়েছে মা? কাঁদছো কেন?
সে নারী এতটাই হতভম্ব হলো ফকিরের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং অবশেষে মা সম্বোধনে যে তার অভিব্যক্তিতে বিরাট শূন্যতা ছেয়ে গেল। চুপ করে রইল কতক্ষণ। পরে বললো, আপনি যে কাজটি করেছেন, আমার সর্বনাশ করে ছেড়েছেন। এখন আমি খদ্দের পাব না, কারণ সবাই আমাকে নিয়ে বাজে কথা বলবে, যে আমার কাছে পথের পাগল ও ফকিরও আসে। কী অবস্থা হবে আমার একটু ভেবে দেখুন? আমি কোথায় যাব? এখান থেকে বেরুবার পথ নেই আমার। এখানেই মরতে হবে।
সে নারীর বেদনাহত মুখের দিকে তাকিয়ে ফকির আলতামাস হেসে উঠলেন। বললেন, তোমার কি এই জীবন ভালো লাগে?
এ আপনি কেমন কথা বললেন? আমার বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বনই নেই এটি ছাড়া।
কিন্তু এখন তো তোমার এই অবলম্বনটিও আর রইলো না আগের মতো। তবে তুমি অন্য কিছুর কথা ভাবছ না কেন?
কী বাজে কথা বলছেন আপনি? বুড়ো মিথ্যাবাদী। আমাকে ঠকিয়ে আপনার কী লাভ হলো? আপনি আমাকে ভোগ করলেও তো আমার এত বড় ক্ষতি হতো না, এরা কেউ দেখতে পেতো না কিন্তু আপনি যা করলেন, তাতে আমার সর্বনাশ হয়ে গেল।
তোমার কিছুই হয়নি। তুমি বরং একটা কাজ করো, আমার সঙ্গে চলো। কোথায়?
এখানে তো আর ভালো করে থাকতে পারবে না তুমি, ভাবছ কেন? আমার সঙ্গে গেলে হয়তো একটা গতিও হতে পারে তোমার। এই বলে ফকির হাসতে লাগলেন। সমস্বরে অন্য নারীরাও হেসে উঠলো, ওরা বলে উঠলো, যা-যা, তোকে রাণী করে রাখবে, তুই হবি ফকিরাণী, মন্দ কী!
৫ নম্বর তালা গলায় ঝুলিয়ে ফকির আলতামাস সমস্ত বারবণিতাদের হাসাতে হাসাতে চললেন সামনের দিকে। পেছনে যখন তাকালেন তখন তিনি পৌঁছে গেছেন লোকালয়ের বাইরে এক জলাশয়ের কাছে, একটা খোরাসানী ডুমুর গাছের ছায়ায়। তিনি দেখতে পেলেন, সে নারী দূরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তাঁর কাছেই।
কাছে আসার পর অত্যন্ত নীরব হয়ে সে বসলো ফকিরের পাশে। একসময় বলে উঠলো, এখন আমাকে দিয়ে আপনি কী করবেন? আর আমি তো এভাবে বের হয়েও আসতে পারবো না, ওরা আমকে খুঁজতে বেরুবে, পতিতালয়ের সর্দার আমাকে টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। ফকির এ কথা শুনে বললেন, তুমি এখন ওদের কথায় ফকিরাণী, তোমাকে এখন কেউ নিতে আসবে না। আর আসলেও আমি তার ব্যবস্থা করবো।
কিন্তু আপনি আমার এই সর্বনাশ কেন করলেন?
তুমি কী করে জানলে যে তোমার সর্বনাশ হলো? এমনও তো হতে পারে তোমার জীবনে নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো। তুমি যে নম্বরের ঘরে থাকতে সেটি ছিল সবচাইতে কম খদ্দের যে ঘরে যায়।
অত্যন্ত অবাক হয়ে নারীটি প্রশ্ন করলো, আপনি কী করে তা জানলেন!
আমি জানি। তুমি জানো না, এই পতিতালয়ে জীবনের একটি দীর্ঘসময় পার করেছিলাম, ভালো করে জানি সবকিছু। আমি ছিলাম এর দালালদের সর্দার। কত অপকর্ম করেছি তার হিসাব নেই, কিন্তু একসময় এখানেই আমার জীবনে পরিবর্তন শুরু হয়। এই পতিতালয়ের প্রতিটি কোঠা ও ইট আমাকে জানে, কিন্তু আমিই জানতাম না আমার নিজেকে। একদিন জীবনে বিতৃষ্ণা ও ঘেন্না ধরলে বেরিয়ে পড়ি সব ছেড়ে এবং পণ করি সবচেয়ে অবহেলিত ৫ নম্বর তালাটি যে ঘরে ঝুলবে সে ঘরের সবচাইতে অবহেলিত নারীটিকে বের করে আনবো। তোমার মতো অনেককেই আমি লোক হাসিয়ে বের করতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবাই আসেনি, তুমি এসেছো।
তবে আপনি সমগ্র বারবণিতার কেন পরিবর্তন চাইছেন না, কেবল ৫ নম্বর তালার দিকেই লক্ষ্য? ফকির তার কথা শুনে হেসে উঠলেন, তবে যে তোমার মতো শত ফকিরাণী আমার পেছনে পেছনে ছুটতো এভাবে। নারীটি এবার হাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে ডুমুর গাছের তলায় গড়িয়ে পড়লো। ফকিরের একটির পর একটি কথায় তার হাসি এতটাই পেল যে অবশেষে তার চোখে জল এসে গেল। সে এখন কাঁদতে লাগলো কিন্তু সে কান্না এক অপূর্ব আনন্দময় অভিব্যক্তির জন্ম দিল চোখে-মুখে।
পতিতালয়ে সবচেয়ে উপেক্ষিত ছিলে তুমি। তোমার ভেতরে ছিল তাই বেদনা ও বিষাদের জ্বালা। অন্যরা তা বুঝতে হলে তাদেরও একটি সময় পর তোমার মত পরিস্থিতিতে আসতে হবে। তোমার ভেতরে মরতে থাকা অস্তিত্বের নিভু নিভু সলতেটি আমি পরিবর্তন করতে চেয়েছি। আমি জানি মানুষ সন্তাপ ও মর্মজ্বালায় দগ্ধ না হলে জীবনকে বদলাতে পারে না। অন্যদের তাই অপেক্ষা করতে হবে তোমার মতো গভীর বেদনার।
আপনি কী করে জানলেন যে, আমার ভেতর তা আছে?
জানি, না থাকলে তুমি আসতে না। ভেবো না আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি, আমি উপলক্ষ মাত্র, তুমি এসেছো তোমার নিজের তাগিদে।
হে মহান ফকির আপনার নামটি জানতে পারি?
আলতামাস।
সে নারী তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো, আপনিই সেই বিখ্যাত মহাপুরুষ ফকির আলতামাস! আপনার কথা আমার এক খদ্দেরের কাছে শুনেছিলাম। শেষবার সে যখন এসেছিল, আপনার কথাই বলেছিল। সেবার আমাকে সে ভোগ করেনি, কেবল আপনার নাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল।
হুম, তাঁর নাম আলপ্তগীন, সে এখন আমারই পথের পথিক। তোমার নামটি মা?
সুরাইয়া।
আলপ্তগীন তোমার কথা বলেছিল আমায়। তোমার প্রতি তাঁর ভালোবাসাও ছিল। সে তো প্রায় সাত বছর আগের কথা। আজ তুমিও এলে তাঁরই পথে। যে পথ প্রত্যেকের নিজের অনুসন্ধানের পথ। তুমি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। আলপ্তগীন সংসারের আবদ্ধতা হতে মুক্ত হয়ে গেছে। সে আসবে কিছুদিন পর, তুমি চাইলে তার সঙ্গে দেখা করতে পারো। তার আগ পর্যন্ত আমার সঙ্গেই থাকো।
জীবনের অত্যন্ত নাটকীয়তাপূর্ণ অধ্যায়ে এসে পতিতালয়ের এক উপেক্ষিত নারী সুরাইয়া খুঁজে পেল তাঁর জীবনে নতুন দিশা। কালে সে পরিণত হলো মার্ভখ্যাত বিবি সুরাইয়া নামে। মার্ভ অঞ্চলের নানান লোককাহিনীতেও বিবি সুরাইয়া সম্পর্কে এবং তার মানস স্বামী ফকির আলপ্তগীনের গল্প বিদ্যমান। সঙ্গে তাঁদের গুরু ফকির আলতামাসের আশ্চর্য সব হাসির কাণ্ডকারখানা মুখে মুখে ফেরে আজও সেখানে।
ফকির আলতামাস ও পাগল আশিকের কথা
একবার নিশাপুরের পথে পা বাড়ালেন আলতামাস। নিশাপুর প্রাচীনতম জ্ঞানচর্চা ও অধ্যাত্ম্যচেতনার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রখ্যাত সুফি কবি ও মহাপুরুষ আত্তার, ওমর খৈয়াম ও জালালুদ্দিন রুমির স্মৃতিবিজড়িত। সে অনেক পরের কথা। তাদের কেউই তখন বেঁচে নেই। নিশাপুরের জ্ঞান ও অধ্যাত্মচর্চায় একটা সাবেকি কাঠামো দৃঢ়রূপে বহাল তখনো। এই কাঠামোর ভেতর তৈরি হচ্ছেন জ্ঞানী ও পণ্ডিতগণ।
ফকির আলতামাস, তথাকথিত জ্ঞানী ও পণ্ডিত কিছুই ছিলেন না। তিনি যখন একটি কাপড়ের থলে কাঁধে ঝুলিয়ে সফরে বেরুলেন, তাঁর সঙ্গী ছিল একটা বাজপাখি। পথে মানুষজন জিজ্ঞাসা করতে লাগলো গন্তব্যস্থলের কথা, জবাবে তিনি বললেন, নিশাপুর যাচ্ছি।
আচ্ছা! কিন্তু আপনি তো জ্ঞানী ও পণ্ডিত কিছুই নন!
তাইতো যাচ্ছি, কিছু জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য আমারও দরকার যে।
সবাই হাসতে লাগলো। একে একে মার্ভের মানুষজন এসে বিদায় জানাতে লাগলো তাঁকে। আর বললো, নিশ্চয় আপনি সেখান থেকে পরিবর্তিত একজন মানুষ হিসেবে ফিরে আসবেন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। আপনি জ্ঞানী হয়ে আমাদেরকেও আলোকিত করে তুলুন। ফকির আলতামাস সকলের প্রত্যাশা পূরণ হোক বলে পা বাড়ালেন দীর্ঘ অভিযাত্রায়।
তিনি পায়ে হেঁটে আর তাঁর পোষা বাজপাখির দিকনির্দেশনায় দিন বিশেক পথ পাড়ি দেবার পর পৌঁছুলেন সেখানে। এই বিশদিন ভ্রমণের কথা তোমাদের কিছু বলি। প্রথমে মার্ভ হতে বেরিয়ে তিনি যে স্থানে এসে উপনীত হলেন সেটি অত্যন্ত পুরনো শহর বৈরামআলী। বাজারের পথে একটি মসজিদের পেছনে কিছু গাছের ছায়া দেখে বসলেন তিনি। প্রচণ্ড গরমে বাজপাখিটিকে আদর করতে করতে ঝুলি হতে জলের মশকটি বের করে একগ্রাস জল মুখে পুরে বাজপাখিটির ঠোঁটে লাগিয়ে পান করাতে লাগলেন। দৃশ্যটি দেখতে পেল এক মধ্যবয়সী আঙুরবিক্রেতা।
এ কী! মুখের জল বাজকে খাওয়াচ্ছেন!
হ্যাঁ, বাজইতো, মানুষতো নয়!
মানে?
এই বাজটি পুরুষ নয়, নারী। মানুষ হলে যদি তোমাদের সামনে ঠোঁটে ঠোঁটে মিলিয়ে একের জল অন্যে পান করতাম আস্ত রাখতে?
লোকটি হেসে উঠলো। বললো, ওহে মুসাফির, আপনাকে দেখে দরবেশের মতন মনে হচ্ছে, আপনি কোথা হতে এসেছেন?
আমি এসেছি এমন এক স্থান হতে যেখানে মা তাঁর সন্তান জন্ম দেবার পর কোলে তুলতে পারে না, চিৎকার শুনে কেঁদে ওঠে তবু বুকে তুলে ধরে বলতে পারে না, আয় আমার বুকের ধন আমিই তোর মা!
কি বলেন! কোন সে স্থান? আর এমনই বা কেন? কি কারণ?
সে স্থানটির নাম পৃথিবী, তার সন্তান হলো মানুষ আর মা হলেন নূর মোহাম্মদ। ফকির আলতামাসের এই কথা শুনে আঙুরবিক্রেতার দোকান হতে ধেয়ে আসলো এক পাগল। সে এতক্ষণ ওখানে শুয়েছিল। হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে ফকির আলতামাসকে মারতে শুরু করলো। দু’এক ঘা দেবার পর আলতামাস হাসতে লাগলেন, আর বলতে লাগলেন, মা আমায় মারিস নে আর, তোর ছেলে মরে যাক তাই কি চাস তুই?
এ কথা শুনে সে পাগল জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো ফকির আলতামাসকে আর বলতে লাগলো এতদিন ছিলি কোথায় তুই? এ নাটকীয় কাণ্ডকারখানা দেখে আঙুরবিক্রেতার বুদ্ধিনাশ হবার জোগাড়। কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। কেবল উভয়ের আজব রোদন দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। যখন ওরা নীরব হয়ে এল তখন সে প্রশ্ন করলো ব্যাপারটি খুলে বলতে। বিশেষ করে পাগলটিকে বললো, তুমি ওকে মারতে গেলে কেন? আবার ওকে জড়িয়ে ধরেই কান্না জুড়লে?
পাগল অত্যন্ত নীরব হয়ে রইলো কিছুক্ষণ। আঙুরবিক্রেতার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার পাগলামি এই ফকিরের কথা শুনে সীমানা অতিক্রম করে গেল, আমার নাম আশিক। আমি বহুকাল আমার পাগলামির পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারি নাই, মজনু হয়ে পথে পথে ঘুরেছি যেন লোকের কাছ হতে প্রাপ্ত বেদনা ও তিরষ্কারে হৃদয়ে মর্মাহত হয়ে কেবল খোদাকেই অনুভব করতে পরি। কিন্তু এই অনুভবের মাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমায় এসে থেমে রয়েছিল আজ বহুবছর। তোমার আঙুরদোকানে আশ্রয় দিলে আমি পঁচে যাওয়া আঙুরের রসপান করে ভুলে থাকতাম সেই দুঃখকে। মাঝে মাঝে খোদাকে বেরহম বলেও মনে হতো, কেন তিনি আমাকে মুক্তি দিচ্ছেন না, অথচ আমি নেহাত ভুলে গেছি দুনিয়া ও পরমসত্তার পর্দাগুলিকে, যে পর্দার ভাঁজে ভাঁজে তিনি লুকিয়ে থাকেন পরমমমতার পরশ বুলিয়ে।
পাগল আশিকের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। আঙুরবিক্রেতার যৎসামান্য জ্ঞান রয়েছে অধ্যাত্মজীবন সম্পর্কে। সে বুঝতে পারলো এই দুজনের মিলন নিঃসন্দেহে বড় কোন একটি আধ্যাত্মিক ঘটনা। দোকান হতে একলতা আঙুর হাতে তুলে বাড়িয়ে দিলো ফকির আলতামাস ও পাগল আশিকের দিকে এবং বললো, আপনারা উভয়ই অত্যন্ত উচ্চমার্গের সাধক, আমার পক্ষ থেকে আপনাদের এই সামান্য ফলাহার, আপনারা তা গ্রহণ করুন।
ফকির আলাতামাস একটি আঙুর লতা হতে ছিঁড়ে টিপে রস বের করতে করতে বললেন, আমাদের জীবন হতে আমরা এইভাবে বের করে নিতে চাই জীবনরস, তাতে জীবন মৃতপ্রায় হয়ে ওঠে। পাগল আশিকও এইভাবে খোদাকে পেতে চাইছিল, কিন্তু আঙুরফলস্বরূপ জীবন কিসমিসস্বরূপ সাধনাকে আত্মস্থ না করতে পারলে হয় সে পঁচে যাবে নয় থেঁতলে যাবে, পরিত্যাক্ত হবে; একটি কিসমিস একশতটি আঙুরফলের চাইতে অধিক কার্যকর সুস্বাস্থ্যের জন্য।
আশিক অত্যন্ত নিষ্ঠাবান সাধক কিন্তু রসভিয়ানের রীতি সম্পর্কে সে উদাসীন বলে তার আঙুরস্বরূপ সাধনা বারবার পঁচে গেছে কিংবা সময়ের করাল গ্রাসে পরিণত হয়েছে। আজ যখন নুর মোহাম্মদরূপী মাতৃশক্তির কথা বললাম তার ভেতরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা প্রেমের প্রগাঢ়রস ভিয়ান করে উঠেছিল, তাই সে দেখতে পেয়েছে নিজেকে নূরসাগরের গর্ভজলে, আজ তার জন্ম হলো আলোর সন্তানরূপে।
সাধু এই বলে আজকের মতো ফকির আলতামাসের নিশাপুর যাত্রার গল্পে বিরতি দিলেন। আজকের আলোচনাটি নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গভীর তত্ত্বালোচনা। একজন প্রশ্ন করলেন, আমরা তো আদি সুফি ও ফকিরি ধারা সম্পর্কে তেমন জানি না। আপনার এই অসাধারণ গল্পে নূর মোহাম্মদের কথা এসেছে, তিনি কি ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ আ.?
প্রশ্নটি যৌক্তিক। এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অত্যন্ত কঠিন। এই নূর মোহাম্মদ কেবল মক্কায় জন্মগ্রহণ করা ইসলামের নবী মোহাম্মদ রসুল নন তার চাইতে বৃহৎ পরমসত্তাময় সর্বকালীন মোহাম্মদ। সুফিরা বলেন এই সর্বকালীন মোহাম্মদ সৃষ্টির আদিতম রূপ, যাঁকে পরমসত্তা আল্লাহ তাঁর নিজের নূর ভিয়ান করে রূপ দিয়েছিলেন। এ ছিল স্রষ্টার প্রথম রূপপ্রকাশ। এই নূরী বা আলোকময় রূপকে তিনি নূরে মোহাম্মদ নামে স্বীকৃতি দেন। বলা হয়ে থাকে পরবর্তীতে সমগ্র সৃষ্টিজগতের বিকাশের মূলই ছিল এই নূর মোহাম্মদ। যা কালে কালে সকল মহাপুরুষগণের সর্বোচ্চ বিকাশের পথে বুদ্ধত্বলাভের মুল চাবিকাঠি, সুফিরা একে বলেন মারেফত, ফানা বা নির্বাণের পর বাক্বা বা পরমসত্তাময় পরিনির্বাণের দিকে এই নূর মোহাম্মদ হলেন তাই সব মহাপুরুষের মা।
চলবে…