॥পর্ব-১৮॥
আমাদের ঠোঁটে ঠোঁট। দারুণ সন্ধ্যা তখন। খুব কাছাকাছি থাকা দুটি সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ শরীরে কী যে গভীর দোলা। কী যে এক মোহময় শিহরণ! সেই প্রথম জানা। মফস্বল শহর। রাস্তা নির্জন। সদ্য খুলে দেওয়া ব্রহ্মপুত্রের ব্রিজের ওপর গাড়ির গতি ধীর। ঠিক কবিতার মতো প্রহর। কেউ নেই চারপাশে। কেবল সে আর আমি। গভীর চুম্বনে ঘনায়মান অন্ধকার। লুপ্ত যেন বিশ্ব চরাচর। হঠাৎ নদীর জলে চাঁদের ছায়া দেখে আমার মনে পড়ে যায়, আমি এই সন্ধ্যায়ও ঘরের বাইরে। বাড়িতে এতক্ষণে কী না কী হয়ে গেছে, কে জানে! আমি ছুটে বের হই। তাড়াতাড়ি একটা রিকশা ডাকি। ভেতরে তখন অস্থির সময়। মায়ের উৎকণ্ঠিত মুখের ছায়া ভেসে ওঠে মানসপটে। প্রকৃতি পরিস্থিতি আর মানুষের ওপর বাড়ে রাগ। বাড়ি ফিরে কী বলবো? মা যেসব প্রশ্ন করবেন, কী জবাব দেব? কিছুই গোছাতে পারি না। মায়ের চোখের ওপর দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলা তখন কেন, এখনো এই বয়সেও আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সদ্য দীর্ঘ এক চুমু খাওয়ার দারুণ অনুভব বুকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে আরও আরও কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে যখন কোনো কিশোর কিংবা কিশোরী অপেক্ষা করে থাকে, তখন আমি ভীত হয়ে রিকশায় চড়ে বসেছি। চলেছি আর চলেছি পথ। পথ যেন আর শেষ হয় না। যখন শেষ হলো পথ, তখন আর হাত সরে না। দরজায় কলিং বেল বাজাতে হাত বাড়াতে পারি না। তবু বাজাতে হয়। ঘরে ঢুকি নত মুখে।
আমাদের বাড়িতে বাবার কঠোর অনুশাসনে আর মায়ের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে ছেলেরাও সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকতে পারে না খুব দরকারি কাজ ছাড়া। আর আজ আমি–বাড়ির ছোট মেয়ে–সন্ধ্যা পার করে বাড়ি আসতে আসতে রাত করে ফেলেছি প্রায়। নিজের ঘরের দিকে আগাই। মা ডাকেন
এদিকে এসো।
বুকের ভেতর এক হিম স্রোত বয়ে যায়।
কোথায় গিয়েছিলে?
আমি মাথা নত করে থাকি।
বড় ভাই-বোনেরা সবাই তটস্থ। আমার মুখে কথা সরে না। মা আবার প্রশ্ন করেন, এত রাত অবধি কোথায় কী কাজ তোমার?
আমি চুপ করে মাথা নিচু করে পায়ে পা ঘষি ফ্লোরে।
মাথা তোলো
এই শব্দে আমার বুকের ভেতর পাথর ভাঙতে শুরু করে। মাথা তুললেই জানি আমি, মা জেনে যাবেন সব। চোখে তাকালেই পড়ে ফেলবেন আমার ভেতরের সব গোপন। আর ঠোঁটে বুঝি আঁকা আছে তখনো তার চুমুর গভীর পরশ। নিষিদ্ধ প্রেমের নিদারুণ যাতনা। আমার মায়ের চোখে অন্তত তা আর আজ এড়ানো যাবে না।
মাথা তোলো। তাকাও আমার দিকে।
ধমকে মাথা তুলি। আর চোখ তুলে মায়ের দিকে এক পলক তাকাতে পারি। তার তীক্ষ্ণ চোখের প্রখর নিরীক্ষণী দৃষ্টির সামনে আমার অপরাধী চোখ খুব বেশি সময় ধরে দৃষ্টি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। মা তেমন কিছু বলেন না। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন সব। তাই বুঝি আর কথা বাড়ান না। চলে যেতে বলেন তার সামনে থেকে।
তার দৃষ্টির প্রক্ষেপণ একটা চিকণ সূঁচের মতো বুকের গভীরে এক দারুনভাবে প্রোথিত হতে থাকে। আমি একা একা নিজের ঘরে এসেও মুখ তুলতে পারি না। নিজের চোখে তাকাতে পারি না। আগের সেই সহজ আমাকে আর খুঁজে পাই না নিজের ভেতর। বার বার কেবলই মনে হয় ঠিক হয়নি। একদম ঠিক হয়নি এসব। মায়ের কাছে ধরা পড়া আর চুমুর স্পর্শ দুইয়ে মিলে আমাকে সারারাত পর্যুদস্ত করে রাখে। আমি আনন্দে রাত কাটাতে পারি না। চুমুর পরশ অনুভব করে সুখ অনুভব করতে পারি না। মনের পর্দায় ভেসে থাকে সেই মেয়েটির মুখ। আচ্ছা ও কি ওই মেয়েটিকেও ঠিক এমন করে চুমু খায়? আচ্ছা, এও কি সম্ভব? দুজন নারীকে একইসঙ্গে কি ভালোবাসা যায়? দুজন মানুষকে কি একই অনুভবের গভীরতায় এমন করে চুমু খাওয়া যায়? আমার ছোট অনভিজ্ঞ মাথায় এসবই কেবল ঘুরতে থাকে। নিজের ওপর রাগ হতে থাকে। কিন্তু ওই সময়ে ওই বয়সে প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শের ওই নিদারুণ আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারা আমার মতো একজন সাধারণ নারীর পক্ষে একেবারেই সম্ভব ছিল না। শুধু এটুকু বুঝতে পারি, ঠিক হচ্ছে না। এভাবে আগানো একদম ঠিক নয়। এভাবে চলতে দেওয়া ঠিক নয়। কী করব, কার সঙ্গে আলোচনা করব–এমন কাউকেই পাই না। কে দেবে এই কঠিন বিপদে আমাকে দিকনির্দেশনা?
অনেক ভেবে-চিন্তে মনে পড়ে আমাদের পারিবারিক অস্ট্রোলজার স্যান্যাল দা’র কথা। তিনি তখন গৌরীপুর কলেজের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। অ্যামেচার এস্ট্রোলজার। অসাধারণ একজন মানুষ।আমার জীবনে তার যুক্ততা নানাভাবে নানা বিষয়ে বার বার। কোকড়ানো কালোচুলে গাঢ় শ্যাম বর্ণের প্রায় ছ’ফুট দীর্ঘ এক সনাতন পুরুষ। নাকের নিচে পুরু গোঁফে আর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রোজ্জ্বলতা অদ্ভুত এক গম্ভীরতা দিয়েছে তাকে। আচরণে তিনি কতটা সহজ, তা টের পেয়েছি পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে, বহুভাবে। তার বাড়িতে মাঝে মধ্যে যাই আমি মেঝো ভাইয়ার সঙ্গে। আমার মা আর মেঝোভাইয়া দুজনই মোটামুটি এস্ট্রোলজিতে বিশ্বাসী। স্যান্যাল’দা আমাদের বাড়িতেও আসেন। দীর্ঘ সময় ধরে বসে পারিবারিক নানা বিষয়ে মা প্রায়ই তার সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি মেঝো ভাইয়ার খুব কাছের মানুষ। এই ভীষণ বিপদে আমার তারই কথা মনে হলো। কিন্তু ওই গম্ভীর স্থিতধী আর আমার বয়ষের তুলনায় এত বড় একজন মানুষের কাছে এসব কথা আমি কী করে বলব, কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। সুযোগ খুঁজতে থাকি। তার বাড়ি চিনি না। আমার পক্ষে তাকে ডেকে এনে আমাদের বাড়িতে এসব কথা বলা কোনোদিনই সম্ভব নয়।
সুযোগ মিলে যায় একদিন। মেঝোভাইয়া স্যান্যালদার বাড়ি যাবে তার দরকারে। কিন্তু তিনি খুব ভোরে ময়মনসিংহ থেকে গৌরীপুর রওনা হন কলেজের উদ্দেশ্যে। তাই আমাদের আগে আগে গিয়ে তাকে বাড়িতে পেতে হবে। আমার মতো জীবনভর আলসে মেয়ের পক্ষে অত ভোরে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা খুব অসম্ভব। যদিও লেখাপড়ার বিষয়ে আলাদা। যাই হোক যেতেই হবে তার কাছে। আমি খুব ভোরে উঠে মেঝো ভাইয়ার সঙ্গে রওনা হই। মেঝো ভাইয়ার সঙ্গে কিছু কথাবার্তার পর তিনি আমার দিকে তাকান। আমি কিভাবে কী বলব, বলব করছি মনে মনে। তিনিই তোলেন কথা।
বাহ! বেশ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছ। তাও বাংলা সাহিত্য। দারুণ। দারুণ।
এসো এদিকে তোমার হাতটা একটু দেখে দেই।
ওহ! আল্লাহ বাঁচালেন। এতক্ষণে মেঝোভাইয়া মুখে খুললেন।
দেখুন তো দাদা। ওর কী কী যেন সমস্যা আছে। এসব থেকে কী করে নিজেকে সামলাবে কিছু বলতে পারেন কি না?
আমি মেঝো ভাইয়ার কথায় অবাক। তাহলে কি মা মেঝোভাইয়ার সঙ্গে কিছু বলেছেন? আমি যেন মেঝো ভাইয়ার সঙ্গে এখানে আসি, সেটা মনে মনে চাইছিলেন মা? তাইতো আমি স্যান্যাল দার বাড়ি যাব শুনে কেউ কোনো বাধা দিল না?কেউ কোনো প্রশ্নও করল না? এরপর আর কী কী কথা দাদাকে বলবে মেঝো ভাইয়া আমি তারই জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। আর লজ্জায় লাল হয়ে যাই। কিন্তু না। চিরকালের স্বল্পবাক আমার মেঝো ভাইয়ার কথা ওই পর্যন্তই। বসে থাকলো পাশে। তিনি আমার চোখের দিকে কিছুক্ষণ গভীরভাবে তাকিয়ে থাকলেন। বেশ কিছুক্ষণ। মৃদু হাসলেন। গভীর চিন্তায় হাতের রেখায় মনোনিবেশ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে। তারপর যা বললেন, তা স্যান্যালদা একাই বললেন।
ভীষণ মানসিক এক দ্বিধার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি এখন।
আমি অবাক হয়ে তাকাই তার দিকে।
আমার চোখে প্রশ্ন তিনি পড়তে পারলেন। তাতে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালেন। আর তার দৃষ্টির সব অর্থ আমিও পড়তে পারলাম। অনেক কথা বলে গেলেন তিনি চোখে চোখে। দুজনেই বুঝতে পারি সব। আর মুখে কেবল কয়টি কথা বললেন—সব কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না আশা করি। তুমি ইন্টেলিজেন্ট, এটা তুমি অলরেডি প্রমাণ করেছ। তুমি একটু সতর্ক হবে। সতর্ক থাকবে। তুমি হৃদয়চালিত মানুষ। কিন্তু আমি বলব, তুমি মস্তিষ্কের কথায় চলতে অভ্যেস করো। না হলে খুব কষ্ট হবে তোমার। হৃদয়ের কথা না শুনে বুদ্ধির মূল্য বেশি দেবে। বাস্তব ভাবা আর বোঝার চেষ্টা করবে। আই ওয়ান্ট টু সে, ইয়্যু জাস্ট ট্রাই টু কন্ট্রোল ইয়র ইমোশন, ফ্রম নাও।
বলে মেঝো ভাইয়ার দিকে একবার তাকালেন। তার দৃষ্টিতে অনেক কথা লেখা ছিল সেদিন। মেঝো ভাইয়াও কান খুলে সব শুনলেন। মাথা ঝাঁকালেন। আমার ধারণা বুঝতেও পারলেন কিছু একটা। আমি তার কথা সব বুঝতে পারি আর লজ্জায় মাথা নত করে উঠে আসতে থাকি। চলে আসার আগে তিনি হঠাৎ আবার আমার হাতটা ধরে ফেলেন। দাঁড়াও দাঁড়াও, দেখি? তোমার ডান হাতের রিং ফিঙ্গারে একটা সোনার আঙটি দেখতে পাচ্ছি?
চলবে…