॥পর্ব-১৪॥
একই ঘরে কাজ করার সুবাদে টিয়া বরাবরই সমীরকে চোখে চোখে রাখত। সমীরের চোখেমুখে অস্থিরতা আর অপক্ব অপরাধীর মুখভাব দেখে টিয়া সাবধান হয়ে গিয়েছিল সেদিন। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে বলেছিল, সমীরকে এখন নিবিঢ়ভাবে লক্ষ করা দরকার। এবং তাকে একা থাকার সুযোগ দিয়ে যদি লক্ষটা করা যায় তবে এরচেয়ে ভালো আর কিছু হয় না। হাবেভাবে স্পষ্ট প্রকাশ হয়ে পড়ছিল সমীর একটা কোনো ভাব গোপন করছে। একটা কিছু হয়ত কোথাও ঘটিয়ে এসেছে। একা থাকলেই কেবল প্রকাশ পেতে পারে তার কোনো আভাস। এর অপেক্ষাতেই তো দিনের পর দিন কাটিয়েছে টিয়া। একবার ভাবলো খুব বেশি কিছু ভেবে বসছে। হতে পারে তার শরীরটা খারাপ লাগছে হঠাৎ, তাই করছে এমন। সেক্ষেত্রে জিজ্ঞেস করলেই তো অনেকটা মিটে গেল।
কী সমীর? খারাপ লাগছে তোর? হাওয়া লেগেছে?
হ্যাঁ, শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে হঠাৎ। বলেছিল সমীর।
আর এই করেই টিয়াকে সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিল। শরীর খারাপ লাগলে সমীর কখনই তা এভাবে বলার মানুষ নয়। এর আগে যতো খারাপই লাগুক, জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে সবটা অস্বীকার করে এসেছে এ ছেলে। একদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে আজ টিয়ার মতো প্রকাশ্য গোপন শত্রুর কাছে এভাবে সত্য স্বীকার করবে, তা হতে পারে না। টিয়া সিদ্ধান্তে চলে এলো। এই অস্বাভাবিকতা নিশ্চয়ই কোনো স্বাভাবিকতা ভঙ্গের ফল।
সিদ্ধান্তের অগ্রযাত্রার বিপরীতে জন্ম নেয় পিছুটান। ফের টিয়ার মনে হলো, কে জানে, হয়তো আজই ইচ্ছে করে বলেছে, কারণবিহীন!
কিন্তু ওই পিছুটান কেটে দেওয়ার মতো ধারালো ছুরিও তৎক্ষণাৎ টিয়ার হাতে চলে এলো। তার মানে আজই একটা কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে এবং এই অস্বাভাবিকতা একটা ধারাবাহিকতা মেনে এগোবে এরপর। সমীরের কাঁপতে থাকা নিচের ঠোঁট ফুলে থাকা নাকের পাটা টিয়ার মনকে জানান দিচ্ছিল এ কথা।
চিরকাল মাথার ভেতর সমীরের পা হড়কানো যে পতন টিয়া ঘটতে দেখেছে তা বাস্তবে ঘটার বা ঘটানোর কোনো সুযোগ আজ না-এসে যায় না।
মনে বলল, ইস্, সমীরের মতো একটা পুঁটির জন্যে আমি বুঝি এমন মরিয়া হয়ে ছিলাম? হ্যাঁ ছিলাম। কেমন পুঁটি সে? এমন পুঁটি যে রীতিমতো বোয়াল হতে চায়। আজ বোঝা না গেলেও কাল তা স্পষ্ট বোঝা যাবে। না, না। একটা কোনো সুযোগ ঠিকই পাবো যদি ভাগ্য আমাকে সমর্থন করে আজ।
টিয়া তাই অন্যমনস্কতার ভান করে নিজ কাজ করতে লেগে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে মোবাইল ফোনে এক কাল্পনিক বন্ধুর ডাকের অভিনয় করে কথা বলতে বলতে গিয়েছিল বেরিয়ে। বাইরে গিয়ে অনবরত কথা বলে চলেছিল টিয়া, কথার তো আর অভাব নেই।
হ্যাঁ, বাড়ির সবাই ভালো? ছুটি আর পেয়েছি। তোরাই বরং যা বন্ধু তোদেরই তো দিন। তারপর? কেউ জুটলো?
থেকে থেকে এমন প্রশ্ন করছিল আর প্রতিউত্তর দিচ্ছিল টিয়া। নিজ প্রতিভায় নিজেই হয়ে পড়ছিল মুগ্ধ। মুখ থেকে আত্মপ্রসাদের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তার। কিন্তু দপ করে দিলো তাকে নিভিয়ে। এই আলো বেশি করে ছড়ালে আগেও বহুবার চোখ নিজ চোখই ধাঁধিয়ে গেছে আর দেখতে বেঁধেছে গোল। এই গোল এবার বাঁধা চলবে না। দরজার কব্জার সরু ফাঁক দিয়ে সে সমীরকে দেখছিল।
ঈশ্বরের দয়া, দেখতে না দেখতেই বাইরে তাকিয়ে থাকা সমীরের দেহে একটা ত্বরিৎপ্রবাহ যেন খেলে গিয়েছিল। সরু ফাঁক দিয়ে লম্বা শরীরটা মুহূর্তের জন্য নিচের দিকে ঝুঁকে পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়াল আবার।
আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে কথা শেষ করে খুব বিমর্ষতার ভান করে ঘরে ঢুকে পড়ল টিয়া। যে জায়গায় সমীর নিচু হয়ে আবার উঠে এসেছে বলে মনে হয়েছিল সেখানটা থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে এটা ওটা করতে থাকল। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকেছিল সমীরের সুহৃদ লাবু। সমীরকে কী যেন বলতে গিয়েও পেরে উঠছিল না। তার সরল মুখের ভাবটা টিয়াপড়তে পেরেছিল স্পষ্ট। সমীরও লাবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল পাশ কাটিয়ে। লাবুকে আরও বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল এসময়। কটা মুহূর্ত বিমূঢ় অবস্থায় কাটানোর পর হঠাৎ নড়ে উঠেছিল লাবু। এরপর কোনদিকে গিয়েছিল তার দিকে চোখ দেওয়ার অবকাশ টিয়ার ছিল না।
টিয়াদের ঘরে অন্য শ্রমিক যারা কাজ করে, সেদিন একটা বিপুলাকৃতির ট্রান্সফর্মার ট্রাকে তোলার সময় ওরা গিয়েছিল কপিকলের দড়ি টানতে। ওই কাজ শেষ হওয়ার পর বাঁশি বাজতে আর অল্প সময় বাকি আছে বলে এখানে সেখানে হাঁটাচলায় সময়ক্ষেপণ করছিল ওরা, কাজের ঘরে ফিরে আসেনি আর।
টিয়াও বেরিয়ে পড়ায় সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিল সমীর। ফিরে এসে এতো দিনের অপেক্ষার ফসল ঘরে তুলতে তৎপর হয়ে উঠতে পেরেছিল প্রতিপক্ষ।
টিয়া ভেবেছিল, যদি এখানে থেকে যাই এখন কোনো না কোনো অজুহাতে সমীর আবার ফিরে আসতে পারে। কিন্তু ও কী লুকিয়েছে তা দেখার গরজটা আমার ছোট নয়। সূত্র উদঘাটনের জন্য তাই একটা জুয়া খেলতে হবে। জুয়ার ধর্মটা এই— হয় মিলবে, নয় হারাবে। ঝুঁকিটা নিতেই হবে সুতরাং।
টিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পরিত্যক্ত উঠানে ঢোকার গলিমুখে আড়াল হয়ে থেকেছিল। বাঁশি বেজে উঠলে সবাই ফটকের দিকে এগোয়, এদিকে কেউ আসে না সচরাচর। আর যদি এসেও থাকে, সে বলবে, বসার জন্য একটা কাঠের রোল নিতে এসেছিল ব্যাস।
সাধনা তার বৃথা যায়নি। সমীর এসে আরো একবার ঘরের সামনে থেকে ঘুরে গিয়েছিল। বাঁশিটা বেজে উঠলেই ছুটেছিল পুবে। এরপর টানা যন্ত্রিক স্বরটা শেষ হওয়ার আগেই বেরোনোর সারিতে দিব্যি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আরো বেশ কজন দাঁড়িয়ে গিয়েছিলতার আগেই। দূরে ধাতব পাতে রঙ করার এক চিলতে উঠানে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিল লাবু, শংকর, আমান ওরা। বেরোনো অসঙ্গত নয় মনে করে বেরিয়েছিল টিয়াও। বুকে হাত বেঁধে একটা একটা পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন তার আজ বেরোনোর কোনো তাড়া নেই। বরং সাধারণ শ্রমিকদের এমন তাগাদা দেখে সে মনে করুণা অনুভব করছে।
লাবুদের চক্রটা ভেঙে গিয়েছিল ততক্ষণে। কী বুঝে ছেলেটা একবার পেছনে তাকাতেই আর চোখাচোখি হলো টিয়ার সঙ্গে তার। ওদিকে দ্বাররক্ষীর হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে সমীর। তল্লাশি শেষ হতে হাসিমুখে সমীরকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করল বৃদ্ধ। মাথা নিচু করে ফটকের পকেটদরজা দিয়ে বেরিয়ে ওপাশে হারিয়ে গেল সমীর। সুতরাং আর অপেক্ষার কোনো মানে হয় না টিয়ার। জরুরি কোনো কথা মনে পড়ে গেছে হঠাৎ, এমন একটা ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলেসঙ্গে সঙ্গে ঘরমুখো হয়েছিল।
কাজের ঘরে আর সমীরকে যেখানে ঝুঁকতে দেখেছে সেখানে খুঁজে দেখল টিয়া। পাওয়া গেল না কিছুই। যদিও তার মন জানে না ঠিক কী সে খুঁজছে, তবু একটা কিছু আজ সে পাবে এটা নিশ্চিত। তার চোয়ালের দৃঢ়তা, পেশির সাবলীলতা ওই বিশ্বাসের প্রতিনিধত্ব করছে। চোখজোড়া ঘরের একোণ ওকোণ ক্ষণে ক্ষণে চষে বেড়ালো।
মনে করলাম আমিই, আমিই একটা কিছু লুকোব, আমার সহকর্মী বাইরে গেছে, এখনই ফিরে আসতে পারে, সুতরাং সময় কম।যেন বিড়বিড়িয়ে জপতে লেগেছিল টিয়া। কোথায় লুকোব? আমি ঝুঁকলাম। কিন্তু ঝুঁকে রাখব কোথায়? আশপাশে যে কিছু লুকোনোর মতোই কোনো আড়ালই নেই।
টিয়া ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করল, সমীর যদি সত্যিই কিছু লুকিয়ে রাখে, তাহলে কোথায় রাখার কথা তার মনে আসতে পারে? ছেলেটা বুদ্ধিমান, কিন্তু সরল। ধূর্ততা তার ভেতর নেই। কিন্তু আজ সে এমন কিছু করেছে যা তার জন্য মিথ্যা। আজ অন্যদিন। সুতরাং ধূর্ত না হলেও আজসমীরের ওপর তা ভর করবেই। নয়ত টিয়ার এতোদিনের মানুষ চেনা ব্যর্থ।
বাইরে কোলাহল। করিডোরে কারো পায়ের শব্দ কী? তলপেটে চক্রপাক। মাথা কাজ করতে চাইছে না। শরীরের ঘাম শুকিয়ে এসেছিল। আবার আদকা মনের, শরীরের পরিশ্রমে ঘেমে আবার উৎকট গন্ধ বেরোতে লেগেছে।
টিয়াকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে সমীর? সারল্য, সততার স্বভাববিরুদ্ধ। একটা যখন হয়েছে তখনস্বভাবের বিরুদ্ধে যায় এমন আরও কিছু কাজ সমীরের হাত ধরেই হয়েছে এটা নিশ্চিত। যেহেতু অনভ্যস্ত, সুতরাং সমীর এমন একটা কিছু করেছে যা একইসঙ্গে ধূর্ততা এবং বোকামো। যদি এসবে অভ্যস্ত হতো, বোকামোটা কাটা পড়ে যেত এতোদিনে। তখনো কাটা না-পড়া ভুলটা কী হতে পারে?
শুধু কোথায় লুকিয়েছে তা মুখ্য নয়। কী লুকিয়েছে সেটাই মুখ্য। কেমন বস্তু সেটা, তার ওপরই নির্ভর করছে কোথায় আছে তার পর্যাপ্ত আড়াল। আর ঘটনা ঘটেছে অল্প কয়েক মুহূর্তেই।
দরজার বিপরীত দিকের পাঁচ তক্তার একটা তাকের ওপর জড়ো করে জঞ্জালের ওপর দিকে চোখ বোলাতে লাগল টিয়া। লোহার পাতসহ নানা রকম পরিত্যক্ত ধাতব যন্ত্রাংশ কোথাও সাজানো, কোথাও এলোটে মেলোটে হয়ে জমে আছে ওখানে অনেকদিন। সপ্তাহে দুদিন এগুলো পরিষ্কার করা হয়। জায়গা থেকে প্রায় না নড়ে সমীর এখানেই রাখতে পারে কিছু। টিয়ার মন খুব জোর দিলো এখানটাতেই— জায়গা থেকে বলতে গেলে নড়েইনি সমীর।
একেবারে নিচের তাকের প্রথম পাতটা ওল্টাতেই পেয়ে গেল আরাধ্য বস্তুগুলো। টিয়া জানত না আদৌ সে কী খুঁজছে। কিন্তু তার বিচারক্ষমতা রায় দিলো—এ দুটো বস্তুই তুমি খুঁজছে চাঁদ! কারণ পকেট ট্রান্সফর্মার থাকার কথা নিরীক্ষা বা গবেষণার ঘরে। এখানে নয়। তার ওপর মহাব্যবস্থাপককে তাড়ানোর পর থেকে এখন পর্যন্ত বন্ধ আছে ওই বিভাগের কাজ। আর কেউ কখনো এনে রেখেছে কোনো কাজে, এমন কিছুও মনে পড়ছে না।
আরো কিছু থাকতে পারে ভেবে বেশ কটা কয়েকটা পাত ওল্টাল টিয়া। তাকের পেছনেও একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলো। মিললো না কিছুই।
ট্রান্সফর্মার দুটো হাতের মুঠোয় নিয়ে দ্রুত ভাঁড়ারঘরের দিকে যেতে যেতে টিয়া ভাবতে লাগল, কেন সমীর এই ট্রান্সফর্মার দুটো সরিয়ে লুকিয়ে ফেলার কথা ভাবতে পারে?
টিয়া মুখটা কুঁচকে একবার শ্বাস নিলো। কখন দাঁড়িয়ে পড়েছে নিজেও লক্ষ করেনি। ওপরের পাটির দাঁতের মাড়ির সঙ্গে ওপরের ঠোঁট জড়িয়ে মুখটা বিকৃত করে, চোখ দুটো বড় করে বুঝি বড় কিছু দেখার চেষ্টা করল।
কারণটা স্পষ্ট। নিজের প্রয়োজন।
কতদিনের পুরনো শ্রমিক। যেন তেন ভাবেও যদি ফেলে রাখতো ওর টেবিলটার ওপর, তীর্যক চোখে একবার দেখা ছাড়া আর কিছু করার কথা হয়ত ভাবারো প্রয়োজন হতো না। কিন্তু মনের ওই যে দুর্বলতা? ধরা পড়ে যাওয়ার বুকধড়াস অপিরিচত ভীতি? যাবে কোথায়। এসবই ভুলটা করিয়ে নিলো। বেচারা, কারখানায় বললে মিলবে না এসব নির্ঘাৎ। আবার কিনতে হলে রূপোসনগর দৌড়–তে হবে। যাবেও বা কেন, টাকাও বা কোথায়। আবার হয়ত চটজলদির ব্যাপার। তখন তো সম্ভবই নয়। এ অবস্থায় একটা সমাধান, ভাঁড়ারঘর থেকে নেওয়া। এ মুহূর্তে অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে থাকা এই যন্ত্রাংশগুলোর কোনো খোঁজ যেহেতু আপাতত পড়ছে না, সুতরাং একরকম লুকিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই কাজটা হয়ে যায়। হয়ত সমীর এগুলো যেমন গোপনে নিয়েছিল তেমনই গোপনে ফেরত দিয়ে যেত, কে জানে।কিন্তু ফিরিয়ে দিয়ে যাক বা না-যাক, চোর সেজে নিয়েছে তো! সরিয়েছে তো! যা ঘটে নাই তার কথা তোলা থাক। যা ঘটেছে তার ফল তো ভোগ করতে হবে।
ফলটা তো ভোগ করতে হবেই!
স্বগোতোক্তির ঝাপটায় টিয়ার মুখ থেকে করুণাটা ঝরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দুপাশে পড়ল টান, কুঁচকে উঠল ত্বক। চোখ দুটোর তীব্র দৃষ্টি ভাঁড়ার ঘরের পথের দিকে। বলল, সুতরাং কেন তাকে ধরিয়ে দেওয়া হবে না? আজ ছোট ট্রান্সফর্মার, কাল তবে কী?
আর এটা একটা কারখানা। এবং কীসের কারখানা তা কি বোঝার দায় প্রতিষ্ঠানের নেই? সুতরাং, এখানকার শ্রমিক হিসেবে টিয়ার যা কাজ তা সে করবেই। আর সমীর এতোদিন যা গোপনে করে এসেছে, আজ তার প্রতিদান পাচ্ছেমাত্র, আর কিছু নয়।
হাহা, আর কিছুই নয়!
এরপরও তার মনে এই প্রশ্ন জ্বলতে থাকল, সমীর এটা সরিয়েছিল কেন? নিজের ওই প্রয়োজনটাই বা কী? আর মহৎ সেই প্রয়োজনের কথা আর কে কে জানে? এ দুটো জিনিস দামেও অল্প, পুরো ব্যাপারটা হয়ত আদৌ এতো বড় নয়। ভালো হতে গিয়ে উল্টো যদি হাসির পাত্র হয় টিয়া? ফিরে যাবে? যাবে ফিরে? কেন যাবে না? কেনই বা যাবে?
বিদ্যুতের ডালপালা যেমন আকাশের বেশ কিছু বিন্দুকে যুক্ত করে, তেমনই হঠাৎ এক শোনা কথা মুহূর্তের জন্যে মনে বিদ্যুতের মতো ডালপালা মেলতেই বেশ কিছু চিন্তাবিন্দুর যোগ ঘটাল। কে যেন বলেছিল তাকে, একটা রোবট বানাচ্ছে সমীর।
এই তো মিলেছে!
কিন্তু রোবটে এটা কিভাবে কাজে লাগবে? সেটা কি তারও জানার কথা ছিল না? কিন্তু মনে পড়ছে না কিছুতেই। মন তো আরো অনেক কিছুতে ব্যস্ত এখন। চিন্তা তাই ধারাবাহিকতা হারিয়েছে। তবে এটুকু মনে পড়ছে, না চাইতেই মনে আসছে, রোবটের কথা শুনে ঈর্ষান্বিত হওয়ার আগে প্রাণখুলে প্রশংসা করেছিল টিয়া। তাতে অবাক হয়েছিল সাগরেদরা তার।
এই দুই আমাকে কি মেলানো যায়?
সমীর একটা রোবট বানাচ্ছে শোনার পর বরং ভীষণ এক ইচ্ছে জেগেছিল একবার গিয়ে দেখে আসে।
সাগরেদদের অবাক চোখের সামনে নিজের ভাবমূর্তিটা আবার ফিরিয়ে আনা এবং উঁচুতে তোলা; দুটি কাজ একসঙ্গে করার উদ্দেশ্য থেকে বলেছিল, সত্যিই যদি ভ-টা রোবট বানিয়ে থাকে, তাহলে একটা বড় কাজ হচ্ছে, বলতেই হবে এটা। ওইসব কর্তাবাবু প্রকৌশলী আছে না, তত্ত্ব জানে বলে দেমাগ? সারাক্ষণ শুধু মনে করিয়ে দেয়? ওদের গালে কষে একটা চড় দেওয়ার কাজ হবে। যেই করুক, এটা হবে আমাদের কাজ, বুঝলি?
টিয়া যখন কারখানার ভাঁড়ারে পৌঁছুল, দেখল তার ঈশ্বর আজ সব দিক থেকে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনটা পুরোই তার আজ, সন্দেহ নেই।
মকবুল তখন টালি খাতা দেখে দিনের শেষ হিসেবের নিকেশ করছিল। এই সময়টায় সবাই যখন বেরিয়ে যায়, তখন কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ার পরও সঙ্গে সঙ্গে বেরোতে পারে না মকবুল। সব হিসেবের নিকেশ করতে আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। নিয়ে তার আক্ষেপেরও নেই শেষ।
আমি তো আর তারেক ভাইয়ের মতো পাগল না,কথার আদি মনময়পুরী টানে সে প্রায়ই বলে। আমি একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। ঘরে আমার আপন মানুষ আছে। নিজের কাজ আছে। ওপিশশেষ হওয়ার পর আর একটা মুহূর্তও আমার মন টেকে না, এটা কি আমার দোষ। দিনভর মন দিয়ে করি কাজ। এই সময়টা এসে মেজাজটা গাঢ়ু!
বাক্যে এক ধরনের কাব্যিক ব্যঞ্জনা আনার কৃত্রিম চেষ্টাটা তার ধরা পড়ে ক্রিয়াপদকে বিশেষ্যের সামনে নিয়ে আসার খেলায়। শুনে হাত তালি দিয়ে হাসি আমুদে সঙ্গীরা।
মরার সময়ও কবিতা ঝাড়িস তুই, পারিসও!
টিয়া গম্ভীর মুখে তার টেবিলের ওপর পকেট ট্রান্সফর্মার দুটি রেখে স্থির চোখে মকবুলের দিকে তাকাল। মকবুলের মাথায় জালি টুপি, ভেতর দিয়ে চোখে পড়ল তার তেল চাপিয়ে বসানো মিশকালো চুল। মাথা নিচু করে লিখতে থাকায় টিয়ার চোখে ওই টুপি, ওই চুলই আগে চোখে পড়ে। টুপিটা বোধয় অনেকদিন সাবানজলের সংসর্গে আসে না। কয়েক জায়গায় বুনন ছুটে যেতে ধরেছে। এক জায়গায় আগুনে পুড়িয়ে গিঁট জমে আছে কালো।
কাচের টেবিলের ওপর আকারের তুলনায় ভারি ট্রান্সফর্মার দুটো রাখায় একটা ভঙ্গুর শব্দ উঠল। তা অনুসরণ করে মকবুলের দৃষ্ট প্রথমে ট্রান্সফর্মার দুটো, এরপর রগ ওঠা হাত বেয়ে উঠতে উঠতে টিয়ার কালো চোখজোড়ায় থামল এসে। ওই চোখ দুটো তখন স্থিরপ্রতীজ্ঞ ষড়যন্ত্রীদের মতো শান্ত প্রাণহীন। মকবুলের চোখেজোড়াও তখন আলোহীন অনেকটাই; ক্লান্তিতে।
প্রথমে মকবুল বুঝতে পারল না কিছুই, কিন্তু টিয়ার নির্বাক কঠিন রূপ দেখে আঁচ করল কিছু। বস্তু দুটো দেখিয়ে গম্ভীর নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গেল পাওয়া?এরপর বাক্যটা যথাযথ হয়নি মনে করে আবার বলল, কোথায় ছিল এসব?
টিয়া তার চোখজোড়ার মতোই শান্ত কণ্ঠে বলল, ডরৎরহম এর ঘরে। মানে আমারই ঘর। জঞ্জালের নিচে লুকোন ছিলো। তুলে নিয়ে এলাম।
লুকোন ছিল ভায়া, আর তুমিই পেলে খোঁজ? কে রেখেছে লুকিয়ে, দেখেছ কাউকে তুমি?
নামটা যদি বলি পাল্টা আবার অনেক প্রশ্ন করবেন। যদি আমাকে নিয়ে সন্দেহ করে কোনো প্রশ্ন আর না শুনতে হয়, তাহলে বলতে পারি।
আগে তো বলো। পরে করি প্রতীজ্ঞা।
আগে প্রতীজ্ঞা করুন। পরে শুনবেন। এখানে কারখানার স্বার্থও জড়িত।
মকবুল বলল, কারখানার স্বার্থ তুমিই যখন আমার চেয়ে বুঝেছ ভালো, তো ঠিক আছে। তোমাকে সন্দেহ করার কী আছে। গুণী কর্মী তুমি আমাদের। যা বলি ওটা তো ¯্রফে মজা। সারাক্ষণই করি। বলো ভায়া, বলো।
সমীর।
কী!
জি। সমীর। যা বলেছি তাই।
কারখানার যেসব সংবেদনশীল জায়গায় বিশ্বস্ততার পরাকাষ্ঠা দেখানো জরুরি বলে মনে করে শক্তিমতির কর্তৃপক্ষ, ওসব জায়গার একটি এই ভাঁড়ারঘর। এখানে কাজের উপকরণ মূল্যবান সব যন্ত্রাংশজমা থাকে। বিশ্বস্ততার গুরুত্ব ক্রয় বিভাগের চেয়ে এখানে কোনো অংশে কম নয়। তাই সততায় পরীক্ষিত সামর্থ্যবানদেরই কেবল এখানে বসতে দেওয়া হয়। মকবুলকে সবাই এমন পদের অলঙ্কার বলেই জানে। আর মকবুলের কাছেও বিষয়টা স্বাভাবিকতার মতোই। ছোটবেলা থেকেই ধর্মভীরু এবং ধর্মগর্বী মকবুল মধ্যখানে অপুর সংসর্গে এলে একবার শুনলো, নীতি থেকে ভ্রষ্ট হওয়ার যে ব্যাপার, তা যেসব ধর্ম লোকে মানে সেসবের নিরীখে অধর্ম হওয়ার আগে, সাধারণ মানবধর্মের নিরীখেই অধর্ম। তাই যদি হয়, তো ধর্মগুলোর সুসমাচারের প্রচারণাগুলোকে নিজ সম্পদ বলে লোক শোনানো ঢ্যাঁড়া পেটানোকে অকাজ ছাড়া আর কী বলা যায়, বলো?
ধুর, কী যে বলো তুমি কিছু বুঝি না,মকবুলের ভাষ্য।
বোঝো না ঠিক তা না,বলেছিল অপু।বোঝো, আবার বোঝোও না। মানে বোঝা না-বোঝের মাঝামাঝি। এভাবেই তো বলি মকবুল ভাই, বলতে হয়। নয়ত আবার আমাকে নিয়ে ছুটবে।
তা তোমাকে নিয়ে ছুটতে তো আর এমনিতেও কারো বাকি নেই ভায়া। গজগজ ফোঁসফোঁস।
তোমার এই শব্দগুলো কিন্তু দারুণ।
কথা বোঝার মতো করে না বললে বলারই বা দরকারটা কী?
অপু হেসে হাতটা ধরে বলেছিল, তুমি আমার বড় ভাই, তোমাকে একটা কথা আমি গর্ব করেবলছি। যে ধর্ম তোমাকে পাবে,সে ধর্মই নিজ সৌভাগ্য বলে মানবে।
ধুর, তোমার কথাগুলো শোনায় কেমন!অপুর বাহুতে বাঁধা পড়ে গোল গোল চোখ বিস্ফারিত করে কপট রাগে রগ ফুলিয়ে দ্বিমত করে মকবুল।
তুমি যদি কোনো ধর্ম নাও মানতে, তবু তুমি ঠিক এমন সৎ মানুষটাই থাকতে। কেন জানো? কারণ তোমার ভেতর মানুষের নীতি ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠিত আছে। মানবধর্মের নীতি প্রতিষ্ঠিত আছে। এটা তোমার পূর্বপুরুষের মানে বাপ দাদা, তার দাদা, তারও আগের সময় থেকে চলে আসা সাধনার ধন। এই ধন এখন তুমি বহন করছ। এক জন্মে এমন সততা আসে না। তোমার বাবা, তার বাবা, তারও বাবা সবাই কিন্তু এক ধর্মের ছিলেন না। কিন্তু সততার এই চর্চা ঠিকই তোমার কাছে চলে এসেছে। কী বুঝলে? কৃতিত্বটা তোমারই আসলে। ধর্মের নয়।
মকবুল তার কথাটা পুরোপুরি নিতে না পারলেও ফেলতেও পারেনি। এই মধ্যবর্তী অবস্থাটাই তাকে অহমের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আর দিয়েছে বলেই আজও সে সবার মুখে মুখে স্মরতে থাকা নামটি হয়ে আছে। এবং পরীক্ষায় তার উৎরে যাওয়াও থেকেছে অবিরত। নিজে উৎরে চলেছে বলেই মানুষের কাছেও তার প্রত্যাশাও তেমন।
মকবুল প্রায়ই বলে থাকে, শোনো কথা, তোমাদের মতোন এমন নাক উঁচু ভাব না আমার, বুঝলে চাঁদা ভায়ারা? যারা মনে বড়, মহৎ, তারা যে বয়সেরই হোক, এই মকবুলের শ্রদ্ধার পাত্র। ভালো মনের মূল্য আমি জানি। কারণ আমাকে বহু পথে বহুভাবে ওই মূল্যটা শোধ করতে হয়েছে। এর বেশি কিছু বলব না, কারণ কথা অনেক। তাই কোত্থেকে শুরু করব খেই পাই না। কুসুমটুকু তো বললাম।
ওই শুরুটা মকবুল কখনও করে না। পাছে আত্মম্ভরিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
সমীর এই মকবুলের শ্রদ্ধারআর আদরেরপাত্র। কে না জানে তা। তাই নামটা শোনার পর ওই বিগতযৌবন লোকটি হলো নতমুখী, নীরব। ঠোঁটের ওপর চেপে বসলো ঠোঁট, ভুরু দুটো হলো আরও কাছাকাছি। টিয়ার মনে হলো তার চোখের দিকে একবার সন্দিগ্ধ হয়ে তাকাতে চাইলো মকবুল। কিন্তু কঠোর আত্মনিয়ন্ত্রণে চোখ জোড়া অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।
এবার আরও সরাসরি আক্রমণের সময় এসেছে, ভাবল টিয়া। আর কোনো রাখঢাক নয়, এসব অনেক হয়েছে। কোনো প্রেতকে যেন মাটির তলে পাঠিয়ে শেষ পাথরটা চাপা দিতে চায়; মকবুলের কানে বাজল এমনই এক কণ্ঠ।
আমি নিশ্চিত। সমীরই পকেট ট্রান্সফর্মার দুটো সরিয়েছে।
দেখেছে কে?ঠেলতে থাকা পাথরে পড়ল মকবুলের হাত। তার চোখের ভাষা এমন যেন এই এক প্রশ্নে টিয়ার সব তৎপর উত্তরকে আগাম নস্যাৎ করে দেবে।
টিয়াও সমান গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, প্রশ্নটা সহজ মকবুল ভাই। উত্তরটা এতো সহজ নয়।
বুঝলাম না।
জিনিস সরাতে আমি দেখিনি। কিন্তু আমি ওকে ঢুকতে দেখেছি। একটা অপরাধী মুখ করে ঢুকছিল। আমার তখন সন্দেহ হয়।
কথা কটা বলার সময় টেবিলের এক কোণে তাকিয়ে ছিল টিয়া। ওখানে তখন উড়ে এসে বসেছে একটা রঙিন ডানার ঝিকমিকে নীল মাছি। দুহাত জড়ো করে যেন সেমাই পাকাতে লেগেছে। সেদিক থেকে চোখজোড়া সরিয়ে এনে মকবুলের গোলাকার চোখগুলোর ওপর রাখল টিয়া চোখ।
আমি তখন ফোনে কথা বলার ভান করে বেরিয়ে যাই। আর দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকি। দেখি ও হঠাৎ ঝুঁকে একটা কিছু লুকিয়ে ফেলল।
টিয়ার কথার সুরটা ছিল এমন ছিল, যেন বাক্য তার শেষ হয়নি। মকবুল তাই কোনো কথা না বলে আরো বলার সুযোগ দিলো তাকে। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর মুখ খুলল মকবুল।
ঘরে আর কেউ ছিল না? থাকার তো কথা।
ছিল না কেউ।টিয়ার জবাব। তখন মাল তোলা হচ্ছিল ট্রাকে। সেখানে গিয়েছিল।
মকবুলের চোখে ভেসে উঠল সমীরের মুখটা। হ্যাঁ, ভাঁড়ার ঘরে সমীর এসেছিল বটে। আর, টিয়ার কথাগুলো শোনার পর এই মুহূর্ত থেকে মনে হচ্ছে, তার মুখটা ঠিক অন্য অনেক দিনের মতো নির্ভীক শান্ত ছিল না। তাছাড়া, সবসময় যেমন সম্ভাষণ বিনিময় হয় দুজনের মধ্যে, সেটাও আজ হয়নি কেন যেন। এ প্রশ্ন মকবুলের মনে এসেছিল তখনই। কিন্তু এসেই ফের সরে গেছে। অহেতুক মনে প্রশ্নের জায়গা দেওয়া তার অভ্যাসের ভেতর পড়ে না। কাজের চাপ তো তারও কম নয়। শেষে যেভাবে ছেলেটা বিদায় নিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল বুঝি কোনো তাড়া আছে তার।
কিন্তু এ বেলায় মনে উঁকি দিলো ভিন্ন ওই সম্ভাবনার কথা। এজন্যেই কি আজ সমীর তাকাতে পারেনি তোমার চোখে?
মকবুল ওপরনীচ একবার মাথা নেড়ে টিয়ার কথার অস্পষ্ট স্বীকৃতি দিলো যেন। তবু সমীরের দিকে ঝুঁকে রইল তার মন। এভাবে আরো কিছু সময় কাটল। বাহিরটা নীরব থেকে নীরবতর হতে থাকল।
মকবুল সাবধানী কণ্ঠে বলল, টিয়া, শোন চাঁদ। এটা নিয়ে এখনই কাউকে কিছু বলিস না যেন। আমি সমীরকে আগে একবার অন্তত জিজ্ঞেস করি। ও এমনটা করার ছেলে না। আমি যেমন জানি, আমার মনে হয়, তুইও এটার সঙ্গে দ্বিমত করবি না। সত্যিই যদি সমীর এটা করে থাকে…।
অসমাপ্ত বাক্যটা মাঝবাতাসে ঝুলিয়ে মকবুল থম মেরে গেল। জড়তা কাটানোর জন্য মাথাটা এপাশ ওপাশ দোলালো একবার। তার ঘাড়ের ওপর স্থির পড়ে থাকা বাঁকানো চুলে দোল লাগল। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগের কথারই পুনরাবৃত্তি করল তার মুখ। দেখি আমি নিজে জিজ্ঞেস করে। এর আগে যেন খবরদার কাউকে কিছু বলিস না!
কথাগুলো যেমন তেমনভাবে মেনে নিলেও, শেষ বাক্যের ওই খবরদারশব্দটা যেন টিয়ার মগজে গিয়ে বিঁধল। খবরদার কেন বলবে? তার মুকে ফুটে ওঠা অসন্তোষ লুকোনোর কোনো চেষ্টা করল না টিয়া। কুঞ্চিত ঠোঁটজোড়া বসল একটার ওপর আরেকটা চেপে; ছুঁচালো হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। কোনো সমঝোতায় আসতে অক্ষম দ্রোহীর মতো কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে মুখ খানিকটা বিকৃত করে বলল, যাই। সবাই বেরিয়ে গেছে। আর শোনো ভাই, কেবল আমি নই। আরও অনেকে এটা জানে। এবং দেখেছে। আমি শুধু খানিকটা বাড়তি কাজ করে তোমার কাছে ফেঁসে গেলাম।
এবার রূঢ় হয়ে উঠল মকবুল। ফেঁসে গেলি মানে? কী ভাবিস আমাকে তুই? কোন কথাটা এখানে খারাপ বলেছি শুনি? নাকি তোকে কোনো দোষ দেওয়া হয়েছে!
ওই যে বললে— খবরদার!
এতো হীনমন্যতাতেও তুই ভুগিস! হায় আল্লাহ, তোর মতো একটা এতো বড় ছেলে! এটা তো একটা কথার কথা ছিল। মানুষ বলে না এমন?
মকবুল চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নিরুত্তর টিয়ার কাঁধে হাত রেখে কণ্ঠটা ন¤্র করে বলল, নিজের দিকে টানিস না সবকিছু। এ কারখানায় কেউ কারও বন্ধু ছাড়া শত্রু না, আমার বিশ্বাস। ট্রান্সফর্মার দুটো কোনো কাজেও তো নিতে পারে, পারে না?
বাৎসল্যগুণে এ বাক্যটা আওড়াল বটে, তবে বলার পরই এর ফাঁকটুকু ধরতে পারল মকবুল। নিবন্ধিত না করেই যদি কাজে নিতে পারে তো মকবুলের আর ভাঁড়ারের কর্তা হয়ে টেবিল দখলের দরকার কী? মুখটা ম্লান হলো মকবুলের। যাচ্ছে ভুলের প্রতি পল। টিয়াও কেমন টিটকিরির ঢঙে হাসল।
হাহ্! তুমি তবে আর কেন? আর কাজের জন্য বললে তো? ঠিকই আছে। কাজের জন্যই। তবে কারখানার কাজ না, নিজের কাজ। তার ভাই যেমন করে।
মকবুলের সঙ্গে তারেকের সম্পর্কটা পুরনো। ওদের গল্পটাও অজানা নয়। আগের রূঢ় কণ্ঠে ফিরে এলো স্বর। টিয়া! তারেককে তুই জানিস না! এক ঢিলে দুই পাখি, তাই না?
অসম বয়েসী দুই সহকর্মী একে অপরকে হারানোর ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় বুঝি নেমে গেল। দুজনের মুখাবয়বেই স্পষ্ট সেই ভাব।
টিয়ার ঠোঁটে আগের সেই হাসি। যেন কথাটা শুনতেই পায়নি এমনভাবে আগের কথার খেই ধরে বলে গেল, আর কারখানার কাজ হলে তো আজ না লাগলে ভাঁড়ারে রেখে যাবে, আবার কাল নেবে। তেমনই তো নিয়ম। কেন মনে নেই তোমার নিজের দেওয়া লেকচার? হিসেব রক্ষার হিসেব? নাকি সেটা সেটা শুধু আমাদেরই জন্য। বন্ধুর ভাইয়ের জন্যে না।
মকবুল হেসে ফেলল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টাটা সে মন দিয়েই করছে। বলল, আজ তোর কী হয়েছে রে? শোন! আচ্ছা থাক, বল। সমীরের নিজের কাজ মানে কী। বাড়তি কথা না বলে কুসুমটুকু বল। নিজের কী কাজ করছে সে?
টিয়া কথা আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল তৎক্ষণাৎ। কাঁধ থেকে মকবুলের হাতটা নম্রভাবে সরিয়ে দিতে দিতে বলল, কত কিছুই তো আজকাল বানান তিনি। নতুন স্যারের যোগ্য সহচর হয়েছেন কিনা!
মকবুলকে প্রশ্নালু চোখে দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল টিয়া। যেন সময়ের এতোটা ক্ষেপণ পুষিয়ে নিতে চায়।
চলছে…