॥ পর্ব-১৪॥
আমি আর কী করব? আমার খুব ইচ্ছে করেছিল এখানে থেকে যাই। আমার খুব ইচ্ছে করেছিল থেকে যাই এই ব্যাপ্ত চরাচরে। থেকে যাই এই আলো-আঁধারিতে। কিন্তু এই বাঁদরমুখো প্রাণীগুলো আমার পথ ফুরিয়ে দিল। কিন্তু পথ কি আসলে ফুরিয়ে যায়! আমি পেছনে ফিরি। তখন মনে হয়, পথ আসলে কখনো ফুরায় না। তখন দেখি ধোঁয়া ওড়ে কোথাও। দূরের গাঁয়ে। স্বপ্নগ্রামে! ওখানে কি যাওয়া যায় না! বাঁদরমুখো প্রাণীগুলোর অট্টহাসি সেখানে যেতে দেয় না! এই না-যাওয়া নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। তখনই ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারিদিক।
আমি সে-ধোঁয়ার ভেতরে ওই শিশুটিকে আবার দেখতে পাই। আগে যখন তাকে একান্তে পেয়েছিলাম বিনোদন কেন্দ্রের পার্কের বেঞ্চিতে বসে, তখন তাকে ডাক দিয়েছিলাম। ডাক শুনেই সে দৌড় দিয়েছিল। এখন আগের মতো একই ঘটনা ঘটুক তা চাইনি। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে ডাকব না। পাছে ডাক শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়! আমি চুপি চুপি তার পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। পেছনে পড়ে থাকল অনেক কিছু। বিশেষ করে বাঁদরমুখো প্রাণী, বাঁদরমুখো প্রাণীগুলোর হাসি, থাকলো পোষা মানুষটি।
এভাবে হাঁটছি আমি। ছেলেটি নিঃশব্দে হাঁটছে। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। আমিও তার দিকে তাকিয়ে তাকেই অনুসরণ করছি। বিবিধ ভাবনা এবং এই পরিবেশ প্রায়ই আমার মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি আমার সব মনোযোগ ওই শিশুর প্রতিই নিবদ্ধ রাখছি। কারণ এবার তাকে আমি হারাতে চাই না।
হঠাৎ বাঁদরমুখো প্রাণীর হাতে বন্দি, মানুষ-খেলা দেখানো সেই মানুষটির জন্য বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। মনে হলো, আমি কি কোনোভাবে একটুও চেষ্টা করতে পারতাম না! আমি কি পারতাম না বিষয়টি আরেকটু গভীরভাবে ভাবতে! লোকটি তো আসলে বন্দি। কোনোভাবে মনুষ্য সমাজ থেকে সে বিচ্যুত হয়ে এখানে এসেছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের করুণ প্রাত্র হয়ে এখন এই দাশের জীবন যাপন করছে। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠতম প্রাণীটি কতিপয় বাঁদরমুখো প্রাণীর অধীনে থেকে যাপন করছে তার জীবন। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠতম প্রাণিটি কতিপয় বাঁদরমুখো প্রাণীর অধীনে থেকে দিয়ে যাচ্ছে বিনোদন। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠতম প্রাণীটি কতিপয় বাঁদরমুখো প্রাণীর অধীনে থেকে যাপন করছে দাসের জীবন। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠতম প্রাণীটি কতিপয় বাঁদরমুখো প্রাণীর অধীনে থেকে যাপন করছে শিকল-শৃঙ্খলিত জীবন। মানুষ নামক শ্রেষ্ঠতম প্রাণীটি কতিপয় বাঁদরমুখো প্রাণীর অধীনে থেকে তাদের দিয়ে যাচ্ছে হাসির খোরাক। আমি, আর কিছু না হোক, অন্তত সহানুভূতিটুকু তো প্রদর্শন করতে পারতাম। আমি তো তাও করলো না। চলে এলাম। একটি শিশু আমাকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে এলো। একটি শিশু আমার সব মনোযোগ তার দিকে কেন্দ্রিভূত করতে সমর্থ হলো। আমিও ভূতগ্রস্তের মতো শিশুগ্রস্ত হয়ে তার পিছু পিছু চলে এলাম।
আমি আসলে হাঁটতে হাঁটতে কতদূর গিয়েছিলাম, তার ধারণা ছিল না। এভাবে আবার হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যাচ্ছি, তাও জানি না। শুধু জানি, আমি এই শিশুর সঙ্গে কথা বলার জন্য যাচ্ছি। শুধু জানি, এই শিশুর সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। শুধু জানি, এই শিশুর সঙ্গে কথা বললেই আমি অনেক কিছু জানতে পারব। শুধু জানি, এই শিশুর কাছে রয়েছে অনেক প্রশ্নের উত্তর। কারণ সে আমাকে কয়েক ঘণ্টা ধরে জড়িয়ে আছে। এমনকি আমি এই অজানা জায়গায় রাস্তা থেকে নেমে এই বিশাল প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতে এত গভীরে চলে এসেছি, এত দূরে চলে গেছি, আলো আঁধারি ভেদ করে, অন্ধকার ভেদ করে, প্রাকৃতিক আলো ভেদ করে, প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম আলো ভেদ করে। এত সব কিছু ভেদ করে আমি যখন একটা জায়গায় পৌঁছালাম, যখন দেখলাম বিচিত্র কিছু, তখনো সে আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই। কে এই শিশু! আমার সঙ্গে লেগে থেকে আমার সব মনোযোগ ও কৌতূহল শুষে নিচ্ছে। কেন আমার মস্তিষ্ক থেকে সরে যাচ্ছে না সে! কেন আমার চোখের গোচর থেকে সরে যাচ্ছে না সে! এই বাদরমুখো প্রাণীরা যা করছে, তা দেখতে দেখতে হয়তো বা আমিও একসময় বাঁদর হয়ে যেতাম। এই বাঁদরমুখো প্রাণীরা যা করতো, তা দেখতে দেখতে হয়তো বা আমিও একসময় প্রতিবাদ করে ফেলতাম। তখন কি আমাকেও ওরা পোষ মানাতো ওদের মতো করে! তখন কি ওরা আমাকে দিয়েও ও রকম মানুষ-খেলা দেখাতো! আসলে অনেক কিছুই হতে পারতো। সেগুলো হয়তো বা ভালো হতো। হয়তো বা ভালো হতো না। কিন্তু এই শিশুর উপস্থিতি আমাকে এগুলোর কিছুই হতে দিলো না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার পিছে পিছে চলে এলাম।
এভাবে কত দূর তার পিছে পিছে এসেছি, তা জানি না। কারণ আমি কত দূরে গিয়েছিলাম, তাই-ই তো জানি না। আমি আসলে কোথায় গিয়েছিলাম, তা যেমন জানি না, তেমনি এখন কোথায় যাচ্ছি, তাও না। আমি জানি না কত দূরে যাচ্ছি। শুধু জানি আমি শিশুটির কাছে যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি শিশুটির সঙ্গে কথা বলার জন্য।
হাঁটছি আর হাঁটছি। চোখ রাখছি শিশুটির দিকে। হাঁটছি আর হাঁটছি। আর লক্ষ রাখছি শিশুটির গতি-দিক। হঠাৎ দু’জন লোক আমার সামনে এসে রীতিমতো ধমকের সুরে বলেল, আচ্ছা লোক তো আপনি!
আমি বিস্মিত হয়ে অভিযোগকারীর দিকে তাকালাম। শিশুটি তখনো একটু একটু করে হাঁটছে। লোকটি আবারও ধমকের সুরে বলল, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? এক বাস লোক এত রাতে এই রাস্তায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আর আপনি লাপাত্তা। আপনি তো কাউকে কিছু বলেও যাননি।
যে লোকটি কথা বলছে, আমি তার সঙ্গে একজনকে দেখেছিলাম। এখন দেখি আরও একজন। তারা দুই জন আমাকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে নির্দেশ করলো, আরে ভাই চলেন তো। জানেন এই জায়গাটা কত খারাপ? আমি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো, কত খারাপ? কেমন খারাপ?
আমার এ কথা শুনে লোক তিনজন একসঙ্গে আমার দিকে ভস্মদৃষ্টিতে তাকালো। আমি আর কিছু বলার সাহস পেলাম না। হাঁটতে হাঁটতেই এদিকে-ওদিকে তাকালাম। শিশুটিকে দেখা গেলো না কোথাও। কিছু দূর হেঁটেই বুঝতে পারলাম আমরা বাসের নিকটে এসে পড়েছি। বাসের ভেতরে লাইট জ্বলে উঠলো। আমরা চার জন নিঃশব্দে বাসের ভেতরে উঠে পড়লাম। কেউ কিছু বললো না আমাদের। যেন এরকমই হওয়ার কথা ছিল।
বাস চলতে শুরু করলো। আমি সিটে গা এলিয়ে দিলাম। আর ভাবতে থাকলাম একটু আগের ঘটনা নিয়ে। আমি কোথায় কোথায় গেলাম। আমি কী কী দেখলাম। আমি চোখ বন্ধ করলো। ভাবতে লাগলাম। বাস থেকে নামার পর যা যা হলো, সবকিছু একে একে আমার স্মৃতিতে চলে এলো। এই চলন্ত বাসে বসে থেকেও আমি যেন ঠিক আগের দৃশ্যে চলে গেলাম। কিন্তু দৃশ্যগুলো খাপছাড়া হয়ে হয়ে আমার স্মৃতিতে আসছে। কিছুটা এলোমেলো। কিছুটা বিক্ষিপ্ত। এভাবে একসময় ওইসব দৃশ্যের সঙ্গে অন্যান্য দৃশ্য জট পাকাতে শুরু করলো আমি স্মৃতির সঙ্গে কল্পনা, কল্পনার সঙ্গে বাস্তব, বাস্তবের সঙ্গে চিন্তা-সবকিছু একেবারে গুলিয়ে ফেললাম।
উঠোনে মা দাঁড়িয়ে আছে। আমি বই পড়ছি। আমার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটুক মা সেটা চায় না। তাই একটু ইতস্তত করতে থাকে। চোখের সামনে বই থাকলেও মনোযোগ মা’র দিকেই ছিল। আমি বললাম, মা কিছু বলবেন?
মা বললেন, এবার ঈদে কী নিবি?
আমি একটু কপট রাগ দেখাতাম। যেন মা সত্যি মনে করেন, কথা না বাড়ায়, কী নেবো আবার। সবই তো আছে।
তাই কি হয়? কিছু নে বাবা।
না। আমার কিছুই লাগবে না। সবই তো আছে।
মা রাগ করেন। বাবা রাগ করেন। অগত্যা বলি, ঠিক আছে আমাকে না হয় টাকাই দেন। কিছু কিনে নেব।
বাবা টাকা দেন। কিন্তু আমার কিছুই কেনা হয় না। মা জিজ্ঞেস করেন, কিরে ঈদ তো চলেই এলো। কিছু নিলি না তো।
আমি বলি, নেব তো।
আমি কিছুই নেই না। আমি টাকা রেখে দেই। ফিজিক্সের স্যার কে টাকা দেওয়া হয়নি দুই মাস।
ঈদের আগের রাতে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি কিনি। মা রাগ করেন। কিছুই কিনলি না? আমি বলি, আমার তো সবই আছে। খামাখা কিনে কোনো লাভ আছে? যেটা আছে, সেটা আমি কিনব না। যেটা দরকার, সেটা কিনেছি। আমিও একটু রাগের অভিনয় করি। মা চুপসে যান। হয়তোবা ভাবেন, ঈদের আগের এই আনন্দময় মুহূর্তে কথা বাড়ালে যদি মন খারাপের মতো কিছু হয়! মা খানিকটা বিমর্ষ হয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করতে করতে আমার সামনে থেকে চলে যান।
আচ্ছা আমি যে একটা শার্ট গায়ে দিয়েই প্রতিদিন ক্লাসে যাই, প্র্যাকটিক্যাল করতে যাই, তা কি আমার সহপাঠী সহপাঠিনীরা লক্ষ করে! যদি করে, তাহলে তো এক মহা কেলেঙ্কারির মতো ব্যাপার হয়ে যাবে! আমি অবশ্য তেমন কোনো কিছু কখনোই লক্ষ করিনি।
চিরচেনা ওই শার্ট গায়ে দিয়ে করুণ চোখে তাকাচ্ছে এবার, ওই ছেলেটি, যাকে আমি বিনোদন পার্কের পিকনিক স্পটে দেখেছিলাম। আমি তো তাকে অনেকবার দেখলাম। বিনোদন পার্কের ঘূর্ণি এলাকায়। পায়ের কাছে মাছ লাফানো ইষৎ শীতল জায়গায়। মেঠো চাঁদের হালকা আলো-কুয়াশার ভেতরে। কিন্তু কোনোবারই তার চোখের দিকে তাকানো হয়নি। সুযোগই হয়নি। এবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কী করুণ তার চাহনি। দেখেই বুকের ভেতরে কেমন করে ওঠে। আমি এবার ভালো করে বাসের জানালার কাঁচে চোখ রেখে তাকে আরও ভালো লক্ষ করি। আরে! তাকে তো আমার মতো লাগছে! আমি এখানে কেন? আমি কী করছি এখানে? আসলে তো আমি নই। আমার ছেলেবেলা! আমার ছেলেবেলা এখানে কেন? আমার ছেলেবেলা বাসের জানালার কাঁচে এলো কিভাবে। স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগে। ঘোর-ঘোর লাগে। বিহ্বল-বিহ্বল লাগে। আমার কেমন জানি ঘুম-ঘুম লাগে। আমার কেমন জানি তন্দ্রা-তন্দ্রা লাগে।
চলবে…