॥তিন ॥
সেবার চৈত্র গেল, বোশেখ গেল। জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি। বৃষ্টি নেই। কাপ্তাই হ্রদের পানি শুকিয়ে তলানিতে। মূল কর্ণফুলীর প্রতিটি বাঁক উপবাঁক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কাপ্তাই জেটিঘাটের কর্মচাঞ্চল্য গেছে থেমে। বারোমাস ধরে উজান থেকে কাঠ, পাথর, ফায়ারউড টানা নৌকোগুলো ঘাটে বসে আছে। খেপ নেই। পাহাড় থেকে গাছ কেটে নামাতে পারছে না পাহাড়িরা। বড় নৌকোগুলো মালের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছাতে পারছে না পানি কমে যাওয়ায়। এ সময়টা কাপ্তাই জেটিঘাটের নেয়ে-মাঝিদের জন্য সবচেয়ে খারাপ সময়। কর্মচারীদের বিদায় করে দিয়ে ঘাটে নৌকো বেঁধে বাসায় গিয়ে ওঠে নৌকোর মালিকরা।
সে সময় মফিজ সওদাগরের নৌকোয় চাকরি করত মশি। খেপ বন্ধ হয়ে যেতেই মফিজ সওদাগর নৌকোর মাঝি মশিকে ডেকে বললো, লোকজন বিদায় করে দাও। নৌকো ঘাটে থাকবে। তুমি ইচ্ছে করলে নৌকোয় থাকতে পারো। তবে বেতন পাবে না।
রাজিই ছিল মশি। বেতন না পেলেও থাকার জায়গাটা তো থাকছে। আবার চাকরিটাও যাচ্ছে না। খেপ চালু হলেই চাকরিও চালু হয়ে যাবে ফের। তবে সময়টা ছিল কঠিন। জেটিঘাটে নাইয়ারা ঘুরে বেড়াচ্ছে ফ্যা ফ্যা করে। চাকরি নেই, কারও পকেটে পয়সাও নেই। চায়ের দোকানে, ভাতের হোটেলে বাকি। দেখা গেছে, একেক জন নাইয়া দুতিন বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকছে।
মশি নিজেও উপোস ছিল দুবেলা। এর মধ্যে হঠাৎ করে নেভি ক্যাম্পে নালা কাটার কাজ পেয়েছে। এক লোক এসে নিয়ে গেছে তাদের দুতিন জনকে। সারাদিন কাজ করে সন্ধেয় ফেরার সময় নগদ টাকা। সে রকমই কথা ছিল। নগদ টাকা হাতে পেয়ে ভালোই চলছিল দিনকতক। হোটেলে বেশ ভালোমন্দ খাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গেল।
এর মধ্যে অবশ্য বৃষ্টি হয়েছে দুদিন রাতের বেলা। বৃষ্টি দেখে চোখ-মুখ উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে জেটিঘাটের নাইয়া-মাঝিদের। বৃষ্টি মানে পানি। আর পানি মানে নৌকো চলাচল। সওদাগর আর মাঝিদের ব্যবসা ফের শুরু হওয়ার লক্ষণ।
নেভি ক্যাম্পের কাজ শেষ। সারাদিন অফুরন্ত অবসর। সকালে আজমীর বেকারী থেকে ভাজি পরোটা দিয়ে নাস্তা সেরে নৌকোয় এসে উঠেছে মশি। ব্যাগের ভেতর থেকে মাসুদ রানার ভারতনাট্যম খণ্ডটা বের করে দুপুর পর্যন্ত পড়েছে। তারপর হোটেলে গিয়ে ভাত খেয়ে কয়েকজন মিলে তাস খেলতে বসেছে। হৈ চৈ করে কাটিয়েছে আছরের ওয়াক্ত পর্যন্ত। দুটো কালো হার আর একটা লাল জয় নিয়ে পরের গেমটাও যখন একবার কালো জয় আর আরেকবার লাল হারের কাছাকাছি, এমন সময় নৌকোর সামনে এসে দাঁড়াল দুজন লোক। হাঁক দিল, ভাই, মাঝি আছে?
তাস গুটিয়ে রেখে বেরিয়ে এলো মশি। লোকগুলোর কাছে গিয়ে বললো, আমিই মাঝি। কী দরকার?
দুজনের একজন বললো, নৌকা ভাড়া করতে চাই। যাবেন?
যাব মানে? মশি হাসল। কী মাল? কোত্থেকে? কোথায় যাবে?
গমের বস্তা। কাপ্তাই থেকে বিলাইছড়ি যাবে। যাবেন?
লোকদুটোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাইল মশি। দুজনেরই পরনে লুঙ্গি-শার্ট। এমন গরমেও একজনের গলায় আবার লাল মাফলার জড়ানো। এরা স্থানীয় ব্যবসায়ী না। সেটলার। কথার টানে বোঝা যাচ্ছে ময়মনসিং-টিংয়ের দিকে হবে বাড়ি।
লোকটা বুঝিয়ে বললো, বিলাইছড়ির সেটলারদের জন্যে সরকারি সাহায্য এসেছে। ধানগোদা পাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে যাবে এসব বস্তা।
বস্তা কোথায়? কয় বস্তা? মশি জানতে চাইলো। লোকটা জানালো বিশ বস্তা গম। কাপ্তাই নতুন বাজারের একটা দোকানে রাখা আছে। নৌকো ঠিক করা হলেই আনার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
তিনশ টাকায় রফা হয়ে গেল। যাদের সঙ্গে এতক্ষণ ধরে তাস খেলছিল, তাদের থেকে দুজনকে নাইয়া হিসেবে নিল মশি। লোক দুজনকে বলে দিল, মাল নিয়ে আসেন। আজকেই চলে যাব বিলাইছড়ি।
সন্ধের আগে নৌকোয় গমের বস্তা ভরে যাত্রা করলো মশি। কাপ্তাই থেকে নিয়মিত পথে গেলে বিলাইছড়ি ঘণ্টা তিনেকের পথ। এটা লঞ্চ, স্টিমার কিংবা স্পিডবোটের হিসেব নয়, দাঁড়ের টানে এগিয়ে চলা নৌকোর গতির হিসেব। রাত দশটার মধ্যে ধানগোদা পাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের কাছে পৌঁছে গেল।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতির ধুম লেগেছে এখন। বড় বড় পাহাড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি গ্রাম। ধানগোদায় আগে চাকমাদের ছোট্ট একটা গ্রাম ছিল। গ্রামের পাশে বিস্তীর্ণ এক পাহাড়ে বাঙালি বসতি শুরু হতেই গ্রাম ছেড়ে সরে গেছে সব চাকমা। উঁচুমতো একটা টিলায় নৌকো ভেড়াল মশি। টিলার ওপরে টিম টিম করে দুএকটা বাতি জ্বলছে। দোকানপাটের মতো মনে হচ্ছে। টিং টিং করে চায়ের কাপে চামচ নাড়ানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।
নৌকো ভিড়িয়ে নাইয়া দুজন উঠে গেছে ওপরের টিলায়। চা খাবে। কাপ্তাইয়ের নাইয়াদের পয়সা পকেটে থাকে না। থাকে চায়ের দোকানে। পনেরো বিশ দিনের একটা খেপ মেরে আসতে পারলেই হলো। এর পর ঠিকানা জেটিঘাটের বিভিন্ন চায়ের দোকান। কাপের পর কাপ চা খাওয়া আর রাজা-উজিরের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা।
চলবে…