॥৩॥
বিষ্ণু দে গবেষক বেগম আকতার কামাল লিখেছেন ‘আলেখ্য’ কাব্যের রচনাকাল ১৯৫২-৫৮। কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। এ কাব্যের প্রথম কবিতাটির নাম ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’; রচনাকাল ১৯৪৪। এর পরে আছে বিখ্যাত কবিতা ‘জন্মাষ্টমী’, রচনাকাল ১৯৪৭। এর পরেও ১৯৪৬, ৪৭ ও ৪৮ সালে লেখা কবিতা আছে অনেকগুলো। এর পরেরগুলো তারিখবিহীন। সম্ভবত সেগুলোই ১৯৫২ থেকে ৫৮ সালে লেখা।
এর মধ্যে গেছে বিষ্ণু দে’র এলিয়ট পর্ব। এলিয়ট পাঠ করেছেন, কবিতা অনুবাদ করেছেন এবং অনুবাদ করা কবিতা রবীন্দ্রনাথকে পড়িয়েছেন আধুনিক কবিতার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মানসে। বিষ্ণু দে এলিয়টকে নিয়ে লিখেছেন তিনটি প্রবন্ধ; ‘টমাস স্ট্যার্ণস এলিয়ট’, ‘এলিয়টের মহাপ্রস্থান; এবং ‘এলিয়ট প্রসঙ্গ’। ইংরেজিতেও দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘টি.এস. এলিয়ট’ এবং ‘মিস্টার এলিয়ট এমং দি অর্জুনজ’। সমকালীন কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্তও এলিয়টকে নিয়ে গদ্য লিখেছেন। তাহলে বোঝা যায় এলিয়ট শুধু বিষ্ণু দে’র একারই চর্চা এবং চিন্তার বিষয় ছিল না। নতুন করে শুরু হয়েছে আরাগঁ পর্ব।
বন্ধু জন আরউইন ছত্তিশগড়ের লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেন। সেই Folksongs of Chattishgarh গ্রন্থের সমালোচনা লেখেন বিষ্ণু দে। ‘ছত্তিশগড়ী গান’ নামে একটি কবিতাও রচনা করেন। এ সময় তিনি লোকসঙ্গীতে আগ্রহী হন; ‘লোকসঙ্গীত’ নামে প্রবন্ধও লেখেন।। অসমবয়সী শিল্পীবন্ধু যামিনী রায়কে নিয়ে একের পর এক বাংলা এবং ইংরেজি প্রবন্ধও লিখে চলেছেন। যামিনী রায়কে নিয়ে লেখার সময় বিষ্ণু দে পাশ্চাত্যের চিত্রকলা নিয়েও আগ্রহী হন। মাতিসকে নিয়ে কবিতা লেখেন। পিকাসো এবং অন্যদের নিয়ে প্রবন্ধও লেখেন।
১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় আসে; এবং তারা লেখক-শিল্পীদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে তাদের ওপর নানা রকমের উৎপীড়ন শুরু করে। এরই প্রতিবাদে ১৯৩৫ সালের জুন মাসে প্যারিসে ম্যাক্সিম গোর্কি, রোমাঁ রোলাঁ প্রমুখের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী সম্মেলন (International Association of Writers for the defence of Culture) অনুষ্ঠিত হয়। তারই অনুপ্রেরণায় পরের বছর এপ্রিল মাসে ভারতের লখনউ শহরে হিন্দি সাহিত্যিক প্রেমচন্দের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’। প্যারিসের সম্মেলেন যদিও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় তবু সেখানে আন্দ্রে জিদ, আন্দ্রে মালরো, অলডাস হাক্সলি, ইএম ফরস্টার প্রমুখ অকমিউনিস্ট লেখকও উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করেন। অনুরূপ ভারতের সম্মেলেনেও অকমিউনিস্টরা অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩২-৩৪ সালে লন্ডনে কয়েকজন ভারতীয় চিন্তাবিদ প্রথমে এ ধরনের একটি আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। তারাই প্রথম প্রগতি লেখক সংঘের প্রস্তাবক। তাদের মধ্যে ছিলেন সাজ্জাদ জহির, আবদুল হালিম, মূলকরাজ আনন্দ, ইকবাল সিং, রাজা রাও, মুহম্মদ আশরাফ প্রমুখ। লখনউ সম্মেলনের আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন ইউরোপ থেকে ফেরা মার্কসবাদী চিন্তাবিদ সাজ্জাদ জহীর-হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
ইউরোপের প্রগতি লেখক সংঘ যেমন অকমিউনিস্ট উদার মানবতাবাদী লেখক, যথা রোমাঁ রোলাঁদের মতো মানুষদের কাছে রাখার চেষ্টা করেছে, সমর্থন এবং সহযোগিতা লাভ করার চেষ্টা করেছে তেমনি ভারতের প্রগতি লেখক সংঘও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নন্দলাল বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রেমচন্দ, সরোজিনী নাইডু প্রমথ চৌধুরীরর মতো লেখকদের সাথেও। লখনউয়ের সর্বভারতীয় সম্মেলেনে বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী। ১৯৩৬ সালের জুন মাসের শেষের দিকে কলকাতায় ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামীর প্রভাবে এই সংঘের মুখপত্র হয়ে ওঠে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ পত্রিকা। যদিও সুধীন নিজে মার্কসবাদী ধারার লেখক ছিলেন না। এই পত্রিকাতেই হীরেন্দ্রনাথরা তাদের বক্তব্য ছাপাতে থাকেন। তবে সুধীন্দ্রনাথের অভিজাত সাহিত্য পত্রিকা ‘পরিচয়’-এর পাঠকস্বল্পতা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
বিষ্ণু দে এই সংগঠনে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন। রামানন্দ চট্টোপধ্যায়ের সভাপতিত্বে ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় উক্ত সম্মেলনে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয় তাতে বিষ্ণু দে যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এর পরে স্বাভাবিকভাবেই বিষ্ণু দে সংগঠনের পক্ষে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
এর মধ্যে ইউরোপে বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে হিটলারের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন স্তালিন। কিন্তু হিটলার চুক্তিলংঘন করেই সোভিয়েতে আক্রমণ করেন। ভারতবর্ষে এবং বাংলায়ও ঘটে গেছে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম। ১৯৪২ এর আগস্ট আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশত্যাগ, দেশভাগের আয়োজন, তেলেঙ্গানা আন্দোলন, বাংলার তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি বড় ঘটনা বিষ্ণু দে’র মনে গভীর রেখাপাত করে। ‘সন্দ্বীপের চর’ কাব্যে সেসব ঘটনার কাব্যিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৪৩ সালের মে মাসে বোম্বাইতে সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘে’র সম্মেলনেও অনুষ্ঠিত হয়। বিষ্ণু দে সেখানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৫ সালের মার্চে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে’র ছয়দিনব্যাপী সম্মেলন হয় সেখানেও বিষ্ণু দে অংশগ্রহণ করেন। এর মাঝে ‘গণনাট্য সংঘে’র প্রতিষ্ঠার সাথেও জড়িয়েছেন ১৯৪৩ সালে। একই বছর ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র সাথেও যুক্ত হন। দেখতে পাচ্ছি বিষ্ণু দে ধীরে ধীরে কাব্যপ্রতিভা নিয়েই সংগঠনের সুড়ঙ্গে প্রবেশ করছেন।
সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। অনেক শত্রু রেখে আসতে হয়। বিষ্ণু দে’র তখন দিনের বেলা সভা-সংগঠন আর রাতে মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের চিন্তা নিয়ে ভাবনা। সমকালীন কাছের লেখকদের রচনার সাথে ইউরোপের মার্কসীয় তাত্ত্বিক, ব্যাখ্যাকারদের লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। গিওর্গ লুকাচ, আন্তোনিও গ্রামসি, পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ, ইলিয়া এরেনবুর্গ প্রমুখ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এর পরিণতিতে তাকে অনেক দুঃখভোগ করতে হয়েছে। কারণ, সংগঠনে জড়িত হলে সেখানে অবিরাম সময় দিতে হয়, সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। পদ-পদবি নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারি হয়। সেসবে অংশগ্রহণ করতে হয়, নিজের স্বার্থে না হলেও।
বিষ্ণু দে’র কাব্যপ্রতিভা ছিল সংগঠনের আয়তনের চেয়ে বড়। সংগঠন সবাইকে ড্রেসকোডে দেখতে চায়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ আত্মসচেতন হলে তাকে সৃজনশীল সাধনাতেই আত্মমগ্ন থাকতে হয়। বিষ্ণু দে আত্মসচেতন ছিলেন বলে এক সময় টের পেলেন তাঁকে কবিতায় মনোযোগী হতে হবে। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, বিষ্ণু দে সভাসমিতির ব্যাপারে হয়ে ওঠেন উদাসীন কিন্তু সাহিত্যকর্মে সযতœপ্রয়াসী। সাহিত্যমজলিসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। সৃষ্টিশীল রচনার নানা গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা রচনায় ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা যা মার্কসীয় বিবেচনায় বুর্জোয়া স্বভাব। সেদিনকার সাংগঠনিকদের অভিযোগ ছিল তিনি সংগঠনের ক্ষতি করছেন, আর আজকে পাঠক হিসাবে আমি অভিযোগ করতে পারি তিনি সংগঠন-ফংগঠন করে কবিতার এবং প্রতিভার ক্ষতি করেছেন।
দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েন বিষ্ণু দে। সংগঠন এবং কাব্যপ্রতিভা কাকে বেশি সময় দেবেন। কবিপ্রতিভা বিকাশের নান্দনিক বিচ্ছিন্নতাকে বুর্জোয়া বলে অভিহিত করা হলে কবি ব্যথিত হন। দোলাচল থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের মধ্যেই খুঁজলেন। তাঁর কাছে লুকাচকে একটু বেশি আপন মনে হল। বিষ্ণু দে লুকাচের মতোই সাহিত্যের অনেকটা সার্বভৌমত্বে আস্থা রাখেন। তিনি গ্রামসির চিন্তা দ্বারাও প্রভাবিত হন। ‘সাহিত্যের সেকাল থেকে মার্কসীয় কাল’ নামক প্রবন্ধে তিনি গ্রামসিকে নিয়ে আলোচনা করেন। গ্রামসি মনে করেন শুধু বাহ্য দৃষ্টি নয়, দীর্ঘ দৃষ্টিরও প্রয়োজন আছে। বিষ্ণু দে’র মানবমনের চিরকালের সংকটগুলো মহাকালের আবেদনের কাব্যভাষায় সৃষ্টি করার প্রয়াস মাঝে মাঝে কোনো কোনো কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাকে নানা দিকের চাপে সমকালের সংকট নিয়ে লিখতে বাধ্য করে। সংগঠনের দাবি সাহিত্য হবে সবার মধ্যে বিতরণযোগ্য খাদ্য। পানি মিশিয়ে তরল করে চুঙি দিয়ে মেপে মেপে সবার পাতে দেওয়ার বিষয়।
বিষ্ণু দে বেঁচে যান নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য পত্র’ প্রকাশ করার কারণে
সংগঠনে যথেষ্ট সময় দিয়ে, শিল্পীর দায়িত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখার পরেও চল্লিশের দশকে বিষ্ণু দে’কে নিয়ে সংগঠনে কথা উঠতে থাকে। বামপন্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতারা বিষ্ণু দে’র কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধ রচনা আরো বেশি আশা করেন। ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায় জানান, বুদ্ধির অতিরিক্তি চর্চা, আঙ্গিকসচেতনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ইত্যাদির জন্য বিষ্ণু দে-কে সমালোচিত হতে হয়। ভবানী সেন তীব্র ভাষায় আক্রমণাত্মক লেখায় তাঁকে অমার্কসীয় বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। বিনয় ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, সুধী প্রধান, অনিল কাঞ্জিলাল প্রমুখ বিষ্ণু দে’কে আক্রমণ করে লিখতে থাকেন। (আরো কয়েকজনের কথা এই লেখার প্রথম কিস্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।)
সাহিত্য নাকি সংগঠন এই দ্বন্দ্বে বিষ্ণু দে সাহিত্যের দিকেই ঝোঁকেন। ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে “ক্রমশ সমালোচনা ও তীব্র ব্যক্তিগত আক্রমণে বিষ্ণু দে-র মানসজগতে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং তিনি একটি স্বকীয় শিল্পবোধের জগতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন”। বিষ্ণু দে কোণঠাসা হতে হতে প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। বয়সে আট-নয় বছরের ছোট-বড় হলেও সুধীন্দ্রনাথের সাথে ছিল সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা। সুধীনের ‘পরিচয়’ পত্রিকার শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন বিষ্ণু দে, সেই ‘পরিচয়’ পত্রিকা বিষ্ণু দে-র বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ সময় বিষ্ণু দে ‘অরণি’ পত্রিকায় লেখা বেশি দিতে থাকেন।
পার্টি বনাম সাহিত্যের দ্বন্দ্বে ইউরোপের মার্কসবাদী লেখকদের মধ্যেও দোদুল্যমানতা দেখা দেয়। পরে তা স্থায়ী বিভজনে রূপ নেয়। রুশ সমালোচক আন্দ্রে ঝদানভ ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ নামে মতাদর্শ প্রচার করেন। তার মূল কথা সমাজতন্ত্রই সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করবে। উল্লেখ্য যে, এই ঝদানভ স্তালিনের মদদপুষ্ট এবং স্তালিনের শাসনকাল পর্যন্ত তাঁর মতাদর্শের প্রবল আধিপত্য ছিল। অন্য দিকে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য রজার গারোদি মনে করেন শিল্প-সাহিত্যের সৃজনশীলতায় পার্টির মাতুব্বরি অস্বীকার করেন। তিনি এবং তাঁর দলের চিন্তাবিদেরা মনে করেন, “কমিউনিস্ট শিল্পতত্ত্ব বলে কিছু নেই—শিল্পবিচারে কোনো পার্টিলাইন বা মার্কসীয় নিয়ম-কানুন প্রযোজ্য নয়”। এর বিপক্ষে যোগদান করেন কবি লুই আরাগঁ। তিনি মনে করেন, “সাহিত্যশিল্পকলা হবে পার্টিলাইন নিয়ন্ত্রিত”। পশ্চিমের এই দ্বন্দ্বের ঢেউ ভারতবর্ষে এবং বাংলায়ও এসে যায়। ১৯৪৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা ‘অরণি’ পত্রিকায় রজার গারোদির ‘আর্টিস্ট উইদাউট ট্রাউজারস’ নামের প্রবন্ধটি বিষ্ণু দে’র অনুবাদে ‘উর্দিহীন শিল্পী’ নামে ছাপা হয়। এখানে লেবাসধারী শিল্পীদের চেয়ে লেবাসবিহীন শিল্পীদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রবন্ধটি ছাপার পরেই শুরু হয়ে যায় তীব্র বাদ-প্রতিবাদ। এক্ষেত্রে গারোদি মতবাদের অর্থাৎ লেবাসবিহীনদের সমর্থনে তাদের পক্ষে এসে দাঁড়ান হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখ। প্রতিপক্ষে, আরাগঁবাদীদের দলে যোগদান করেন নীরেন্দ্রনাথ রায়, রাধারমণ মিত্র, গোপাল হালদার, সরোজ দত্ত, মঙ্গরাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরা। এই বাদ-প্রতিবাদ চলতে থাকে।
এরই মধ্যে ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের শারদীয়া সংখ্যা ‘পরিচয়’ পত্রিকায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কথাসাহিত্য আলোচনা করে ‘গল্পে উপন্যাসে সাবালক বাংলা’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন বিষ্ণু দে। উক্ত পত্রিকার পরের সংখ্যা (অগ্রহায়ণ) বিষ্ণু দে’কে তীব্রভাবে এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ‘শারদীয় সাহিত্যে ছোটগল্প’ নামে আরেক প্রবন্ধ লেখেন নীহার দাশগুপ্ত। ফাল্গুন সংখ্যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিষ্ণু দে’কে আক্রমণ করে এক প্রবন্ধ লেখেন। (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘লেখকের কথা’য় “পাঠকগোষ্ঠীর আলোচনা নামে আছে রচনাটি।)
বিষ্ণু দে ‘পরিচয়’ পত্রিকার শুরু থেকেই জড়িত ছিলেন, সুখ-দুঃখের সাথী ছিলেন। সাম্প্রতিক আচরণে প্রবল মনোকষ্ট পান বিষ্ণু দে; তিনি পরিচালকমণ্ডলীর পদ থেকে লিখিতভাবে পদত্যাগ করেন। ফাল্গুন সংখ্যা থেকেই পরিচালকমণ্ডলীতে তাঁর নাম ছাপা বাদ দেওয়া হয়।
পরের বছর শ্রাবণ মাসে চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বিষ্ণু প্রকাশ করেন ‘সাহিত্য পত্র’। এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় তিনি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। প্রবন্ধটি ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থে “রাজায় রাজায়” নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ প্রবন্ধে বিষ্ণু দে বাংলা সাহিত্যের অতি বাম এবং অতি ডানপন্থীদের সমালোচনা করেন। বিষ্ণু দে বুদ্ধদেব বসুর ইংরেজি প্রবন্ধগ্রন্থ An Acore of Green Grass-এ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, তারাশঙ্কর প্রমুখের সাহিত্যের যে সমালোচনা করেছেন তার তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলীয় মনোবৃত্তির সাহিত্যদৃষ্টিরও সমালোচনা করেন। পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পরেই দুই দিকের দুই দিকপাল বিষ্ণু দে’র বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধে নামেন। এক দিকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু। পুরনো শত্রুরাও দুই শিবিরে ভাগ হয়ে বিষ্ণু দে’র বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন। বিষ্ণু দে এ সময় প্রবলভাবেই কোণঠাসা হয়ে পড়েন। পরমবন্ধু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পর হয়ে যান। (রিপন কলেজের)এক কালের সহকর্মী ও সাহিত্যসখা বুদ্ধদেব বসুর সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে বিষ্ণু দে বেঁচে যান নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘সাহিত্য পত্র’ প্রকাশ করার কারণে। না হলে তাঁর কথা বলা ও মত প্রকাশ করার সুযোগ থাকত না। চল্লিশের দশকের এসব ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত তাঁর সমকালের এবং পঞ্চাশের দশকের অনেক কবিতায় প্রত্ননিদর্শন হিসেবে লুকিয়ে আছে। হতাশা, নিসর্গপ্রেম, নেতিবাচকতা ইত্যাদি রূপেও উৎকীর্ণ হয়ে আছে।
তবে বিষ্ণু দে নিজের পত্রিকায় নিজের মনের কথাগুলো, মার্কসবাদ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব এবং সাহিত্য সম্পর্কে ভাবনাগুলো নিয়মিত প্রকাশ করে যেতে থাকায় বাম শিবিরে তার প্রতি পুনঃসমর্থন প্রতিষ্ঠিত হয়। ভবানী সেন স্বয়ং উপস্থিত হয়ে বিষ্ণু দে’র কাছে ক্ষমা চান এবং বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু সে দায়িত্ব নেন নাই।
এই সবই হলো কবিতার প্রতি বিষ্ণু দে’র ভালোবাসা। বিষ্ণু দে যদি সেসময় সব পাঠকের উযোগী করে, তরল করে কবিতা লিখতেন ত হয়তো কৃত্রিম এবং প্রচারমূলক সাহিত্য হয়ে থাকত। এখন আমরা যে সাহিত্য পেয়েছি, এত প্রজন্ম ঘুরে আমাদের হাতে এসেছে তাতে তাঁর ব্যক্তিত্বই প্রতিষ্ঠিত আছে। তিনি যেন অল্পের জন্যই ব্যক্তিত্বহীন কবি হওয়া থেকে বেঁচে গেছেন। তাঁর কবিতা বোঝার জন্য এইসব ঘটনা মনে রাখা প্রয়োজন।
(চলবে)