॥পর্ব-২॥
‘সাত ভাই চম্পা’তেই দেখি বিষ্ণু দে বিষয়বৈচিত্র্যে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছেন। প্রথমে ছিলেন নিজের কিশোর মনে, তারপরে দেহজুড়ে, তারপরে দেশ ও সমাজ ঘিরে। এবার দেখি বিশ্বজুড়ে নানা সংকটের কথা তাঁর কবিতার খাতায় পাখির মতো উড়ে এসে বসছে। প্রজাপতি হয়ে ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিশ্বরাজনীতির নানা ঘটনা এবং মতবাদগুলো কাব্যরূপ লাভ করছে। কিশোর উপযোগী ছড়াগুলোও জাপানি বোমার প্রত্যুত্তর হয়ে বাজছে। স্তালিনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি, হিটলারের রণহুঙ্কারও উঠে এসেছে। এখানেই তিনি ভেঙে পড়া বুর্জোয়া সমাজের স্থানে নতুন সমাজ নির্মাণের আভাস দেখতে পান। নতুন সমাজের ইশারার কথা তিনি প্রিয়তমাকেও জানান। ‘সংসার’ কবিতায় লিখেছেন,
বন্ধন নয়, বিশ্বব্যাপ্তি তোমার টানে,
ভাবী সমাজের অজেয় ইশারা তোমার গানে॥
ভাবী সমাজের ইশারা পাচ্ছেন প্রিয়তমার গানের ভেতরেও। ‘আত্মজিজ্ঞাসা’ কবিতায়ও নবজগতের নির্মাণে অকুতোভয় থাকার আহ্বান জানান। ‘এক বিবাহে’ কবিতায় বিষয়টি আরও সুরেলা ভাষায় লিখেছেন,
যখন পৃথিবী প্রাণের দুর্বিপাকে
দুই হাতে আজ আমাদের সব ডাকে
তখনই জেনেছি রচনার প্রয়োজন।
তাই তোমাদের ঘর আমাদেরও ডাকে।
এই যে একের ঘরে অন্যের ডাক এই স্বপ্ন সহসা পূরণ হবে না বলেই জানেন কবি। কিন্তু একেবারে মিথ্যা হয়ে থাকবে না। ‘৭ই নভেম্বর’ কবিতাটি যেন একটি মার্কসবাদী প্রবন্ধ। শব্দবুননে ঠাসা, অর্থঘনত্ব সব কিছু মিলিয়ে অনেকের অভিযোগে অভিযুক্ত বিষ্ণু দে’র কবিতার ভেতর থেকে যে অর্থ বের করে আনা যায়, তার মর্মার্থ হলো, অর্থব্যবস্থার উৎপাতে শ্রেণীবিভক্ত সমাজে যেখানে অর্থ দিয়েই পুরুষার্থ নির্ণয় করা হয়, সেখানে জুয়াড়ি ও স্বার্থসঞ্চয়ীদের ভিড়ে মানুষকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলে। কড়ি দিয়ে মানুষ বেচাকেনা চলে। যুগে যুগে ইতিহাসের এই নিষ্ঠুর ভ্রান্তির অপচয়ে অন্ধকার সমাজে বৈভবের কাছে মনুষ্যত্ব একেবারেই তুচ্ছ। সেই সাম্রাজ্যও ধূলিসাৎ হয় প্রাণের বিপ্লবে। লেনিনের নাম উল্লেখ করে রুশ জনগণের বিপ্লবের সাফল্যগাথাই কবি এখানে গেয়েছেন। কবিকে সরাসরি কমিউনিজমে পাওয়া যাচ্ছে এই কবিতায়। মার্কসীয় রাজনীতির বিশ্ব অঙ্গনে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে কবি শুধুই প্রচারমূলক কবিতা লিখছেন না। ‘কোডা’ কবিতায় সেই বিষয়টি ধারণ করেছেন। দ্বন্দ্ব-সংঘাত ভুলেই সমাজের জন্য কাজ করতে হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, এর মধ্যে শুরু হয়েছে দুর্ভিক্ষ। কলকাতার পথে পথে লঙ্গরখানায় ক্ষুধার্ত মানুষের ভিড়। শীর্ণকায় অস্থিচর্মসার মানুষের লাশ পড়ে আছে। এই সব দৃশ্য তিনি ‘এক পৌষের রাত’ কবিতায় লিখেছেন। প্রথম দিকে যখন বিষ্ণু দে নিজের সীমিত জগত নিয়ে লিখেছেন, তখন ছিল বিদেশি মিথের ছড়াছড়ি। এবার এই কাব্যে বিদেশি রাজনীতি আর অর্থনীতির কথাই বেশি। সেখানে তিনি মিথের রাজ্যের উল্টাপথে হাঁটা শুরু করেছেন। বাংলার রূপকথার সাত ভাই চম্পাকে নতুন করে সৃজন করেছেন।
‘সন্দ্বীপের চর’ কাব্যের নাম কবিতাটির শুরুতেই কবি পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন সমুদ্রতীরে। কিন্তু এই কবিতা বুদ্ধদেব বসুর ‘চিল্কায় সকাল’-এর মতো রোমান্টিকতামুগ্ধ নয়। বিষু দে’র সেই বয়স এবং মানসিকতা কোনোটাই নেই এখন আর। সমুদ্রতীরের প্রকৃতিতে যা দেখছেন, তাতে মুগ্ধতা থাকতে পারে, মানুষ প্রকৃতির অংশ হতে পারে কিন্তু মানুষ শুধু প্রকৃতি নয়। আগের বইয়ের কবিতায় বিশ্বরাজনীতি এবং আর্থসামাজিক পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাবে কবির মনে ক্লান্তি এসে গেছে। সেই ক্লান্তির সুর লক্ষ করা যায় ‘সন্দ্বীপের চরে’র কবিতাগুলোতে। এখানে তিনি ক্লান্ত পথিকের মতো নতুন পথ সন্ধান করছেন। যদিও তিনি মার্কসবাদকেই পথ হিসেবে জানেন। কিন্তু যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ইত্যাদি মানুষকে মূলচিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে কিছু সময়ের জন্য। তারই লক্ষণ দেখা যায় এখানে। তাই তিনি লেখেন, ‘শান্ত হোক রঙ্গমঞ্চ, ক্ষান্ত হোক কাজির বিচার।’
না, সন্দ্বীপের চর বিষ্ণু দে’র ময়নাদ্বীপ না। এলডোরাডো তিনি সৃষ্টি করেন না। কারণ বিষ্ণু দে এই জটাজটিল সমাজ থেকে পালিয়ে সমুদ্রতীরের স্বচ্ছজলে সিক্ত কোনো সমুদ্রউত্থিত দ্বীপে পলায়ন করবেন না। তিনি এই সমাজের ভগ্নস্তূপেই নতুন সমাজ নির্মাণ করবেন। বিপ্লবী চেতনায় কবিকে প্রেমের নতুন সংজ্ঞা সৃষ্টি করতে দেখি। রোমান্টিকতার রাজ্যে প্রেম মানেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে কাছে আসা। হৃদয়ে হৃদয়ে, দেহে দেহে মিলেমিলে একাকার হয়ে যাওয়া। কিন্তু কবি বিষ্ণু দে এখানে নতুন সংজ্ঞা উচ্চারণ করেন, যা প্রচলিত ধারণার ঠিক বিপরীত,
তোমার আমার মিল, সেই সত্যে জীবনের ঝোঁক
প্রেম সে তো দ্বৈতের বিস্তার
বিষ্ণু দে সেই কবি যিনি পরস্পর বিপরীত দুই মহান ব্যক্তির দর্শন একত্রে ধারণ করেন। তাঁর এক হাতে টিএস এলিয়টের বই অন্য হাতে কার্ল মার্কসের রচনাবলি। এলিয়ট ক্যাথলিক খ্রিস্টীয় আস্তিক্যবোধের কবি। চেতনার জগতে আস্তিক হলেও বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ঘাত-প্রতিঘাতে হতাশ এবং চরম নেতিবাদী। অন্য দিকে মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী নাস্তিক্যবোধের দার্শনিক। চেতনার জগতে তিনি নাস্তিবাদী কিন্তু সমাজচিন্তায় তিনি আশাবাদী। সাম্যবাদী বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণীহীন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা তাঁর চর্চায়। বিষ্ণু দে এই বিপরীত আদর্শ সমানভাবে ধারণ করেন। তাঁর কবিতার ইতিবাচকতা মার্কসীয় এবং নেতিবাচকতা এলিয়টীয়। এই পর্বে তিনি এলিয়টের চিন্তা দ্বারা প্রবলভাবেই প্রভাবিত। ‘বন্ধ্যা সন্ধ্যা’ কবিতাটি তারই প্রমাণ। এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কাব্যের বিশ্বযুদ্ধপোড়া বন্ধ্যা ভূমির কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই বন্ধ্যাত্বের কারণ এলিয়টে নেই; মার্কসের কাছ থেকে বিষ্ণু দে বের করে এনেছেন সেই কারণ। এখানে তিনি একই কবিতায় দুটি চিন্তার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। লিখেছেন,
বসুন্ধরা সে বিচিত্রা, বন্ধ্যা
নয় সে প্রবল শতধারা,
সে জানে না শৃঙ্খল বা কারা,
কয়েকটি ছড়ায়ও কবি শোষণ ও বঞ্চনার কথা লিখেছেন। সমকালীন নাগরিক জীবনের সংকটগুলো এখন আরো প্রকটভাবে এসেছে। হয়তো কবি সমাজের শ্রেণীচরিত্র জেনেই নতুন করে বিষয়টা তুলে আনছেন কারণ নির্ণয়ের নতুন সূত্রে যাচাই করার মানসে। বাজারের মজুতদারি, কালোবাজারি, ঘুষের প্রবলতা, দলাদলি, বুর্জোয়া রাজনীতির ফাঁপা বুলি কখনো সরাসরি কখনো আকারে ইঙ্গিতে কাব্যরূপ লাভ করেছে। দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষের কারণগুলো কবিতায় লিখছেন উচ্চস্বরে; যা আগে বলতেন সংশয় নিয়ে। ‘ভিড়’ কবিতায় লিখেছেন,
নানা মুনি দেয় নানাবিধ মত মন্বন্তর আসে!
তবুও শহরে ওসারে বহরে জড়কবন্ধ ভিড়!
বহু সাপ্লাই উঠে গেল মুনি, তবু আজো লাগে চিড়!
পদাতিক পথে, ট্রামে বাসে কারে ট্রাকে করে বিড়বিড়
দরকারি বিনাদরকারি কেউ সরকারি চোরাকারবারি ফড়ে
. আমির ওমরা মজুতদারের পাশে
আমরা সবাই—তুমি আর আমি মৃত্যুর প্রতিভাসে
মিশে যাই,
ধর্মঘট, গান্ধীর ভারত ছাড়ো আন্দোলন, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দাঙ্গা, দেশত্যাগসহ বাঙালির নানা সংকট এ বইয়ের কবিতায় উঠে এসেছে। ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা কিছু কবিতাও আছে। যেগুলো কবির মন্ময় গীতিকবিতা নয়, অনেকটাই তন্ময় ধরনে লেখা। উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কথাই প্রাধান্য পেয়েছে।
যা কিছু অন্বেষণ করছেন কবি তাই তো তাঁর অন্বিষ্ট। এ বিষয়টি অতি স্পষ্ট এনেছেন বিষ্ণু দে ‘অন্বিষ্ট’ গ্রন্থে। প্রথম কবিতাটিই রাজনৈতিক ইশতেহারের মতো ঘোষণাকাব্যরূপে লেখা হয়েছে। কবিতাটির নামও অন্বিষ্ট।
আমার অন্বিষ্টও তাই
আমি চাই সূর্যাস্তে ও সূর্যোদয়ে
প্রত্যহের ইন্দ্রধনু ভেঙে যাক স্তরে স্তরে
বাঁচার বিস্ময়ে ছড়াত রঙের ঝরনা
সহাস জীবনে এনে দিক
সহজ আনন্দ দিক মানবিক দুঃখের করুণা
এভাবে দীর্ঘ বক্তব্য কাব্যশক্তির ইটের গাঁথুনিতে শক্তিশালী এক স্তম্ভ এই কবিতা। সমাজ ও প্রকৃতির কাছে কবির চাওয়াগুলোই এখানে সারিবদ্ধভাবে শিলালিপিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে। সেই অশোক স্তম্ভের পরে এটি যেন আরেক নতুন স্তম্ভ। এটি অতীতমুখী নয়। এই স্তম্ভকে মাইলফলক ধরে এখান থেকেই কবি যাত্রা শুরু করবেন আমাদের এই চেনা ও পুরনো সমাজকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবেন। কবিতাটিতে পুরনোকে ভেঙে ফেলারও কথা আছে। কবি বলেন, তাঁর কাজ দিন আনা আর দিন গুনে যাওয়া। সোনা সোনা ধান ভানা আর সাইরেনের গান শুনে যাওয়া। শিল্পের কথাও কবি বলেছেন কিন্তু বাংলার কৃষিকে গুরুত্ব দিয়েছেন আগে। কৃষিকে স্থির রেখেই শিল্প উন্নয়নের কথা সাইরেনের প্রতীকে বলেছেন। সমাজ থেকে শ্রেণীবৈষম্য দূর করার পরে কী হবে? কবি বলেছেন,
আমার হৃদয় এক আকাশের একটি হৃদয়
অনেকের এক পরিচয়
সবাই মিলে এক। এখানেই ব্যক্তিসত্তার লোপ ঘটিয়ে সামাজিক সত্তার বিকাশের কথা বলা হয়েছে। অনেক পৃষ্ঠার দীর্ঘ এ কবিতায় কবির প্রতিশ্রুতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ঘোষণা অনেক। একাধিক বার জানিয়েছেন ‘নরকের পরে এ রচনা’। ‘জীবন তো সেকালের কড়িকেনা দাস কারো নয় কেউ’। এখানেই মানবমুক্তির কথা বলেছেন। একদা কবি নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছেন। এখানে দেখছেন বিপরীত দৃশ্য। লিখেছেন,
নিঃসঙ্গতা জানি আমি দেখেছি তো ভিড়
আপিসে বাজারে ভিড় সোফায় চেয়ারে ভিড়
চশমে শেয়ারে ভিড়
এই ভিড় আগে কোথায় ছিল? এখানেই ছিল। তখন কবির এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না বলে দেখেন নাই। আত্মকেন্দ্রিকতায় আবর্তিত দৃষ্টিতে নিজের মনের মতোই দেখেছেন। এখন দেখছেন পরিবর্তিত মানসিকতার এবং নতুন স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার চোখ দিয়ে। কবিতার তৃতীয় পর্বে বলেছেন, হাতুড়ি সংঘাতে নিজেরাই নিজেদের স্থান আর কাল রচনা করেন। এ তো বিরাট কথা। বিজ্ঞানেরও নতুন ব্যাখ্যা যেন। মানুষ বা যে কোনো প্রাণীই চলমান কাল আর নির্দিষ্ট স্থানজুড়ে থাকে। সচেতনভাবে স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কালের বাইরে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কবি এখানে নিজেরাই স্থান আর কাল রচনা করে নেবেন। শ্রমের মাধ্যমেই সেই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। নতুন যুগ আনা সম্ভব। ইতিহাসের ভেঙে পড়ার দৃশ্যও কবি ধারণ করেছেন এই কবিতায়। ঐতিহ্যগর্ব মানুষকে সামনের দিকে যেতে দেয় না, পেছনের দিকেই টেনে রাখে। ইতিহাসের সেই সব নির্বাচিত অধ্যায় ঘিরেই মন-মানসিকতা আবর্তিত হতে থাকে। বিষ্ণু দে শুধু বিজ্ঞানের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাই না, ইতিহাসের মৃত্যুদৃশ্যও আঁকতে চেষ্টা করেছেন। গৌরবজনক নগরী এখন ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। এ কথার মানে কী? আজকের বুর্জোয়া সমাজও এভাবে ভগ্নস্তূপে পরিণত হবে। মানুষের জন্য আসবে নতুন সমাজ।
এখন সাপের বাসা ঐশ্বর্যের গৌরব গৌড়
কিংবা ফতেহপুর হরপ্পার বিস্তীর্ণ প্রাসাদ
ভূমিসাৎ ভগ্নস্তূপ, শিল্প আজ দুস্থের সংবাদ।
আঠারো পৃষ্ঠার এই বিশাল কবিতা ‘অন্বিষ্ট’ই যেন বিষ্ণু দে’র মাস্টার পিস। এই কবিকে চেনার জন্য এই একটি কবিতাই যথেষ্ট বলে মনে করি। এই বইয়ের অন্য কবিতায়ও আছে রাজনীতি, আছে পাশ্চাত্যের অনুপম চিত্রকলা, আছে পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মূর্চ্ছনা। কবির ছেলে জিষ্ণু দে জানান, তার পিতা ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চেয়ে পাশ্চাত্যের ক্লাসিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তুলেছিলেন কান। শোনামাত্রই ধরতে পারতেন। ভারতীয় রাগ-রাগিণী সহজে চিনতে পারতেন না।
কলেজে পড়ার সময় বিদেশি শিক্ষকের কাছেই শিখেছিলেন পাশ্চাত্য সঙ্গীত চেনার এবং বোঝার উপায়। ক্রিস্টোফার একরয়েডই তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মার্কবাদের। আর পাশ্চাত্যের ক্লাসিক চিত্রকলার। চিত্রকলা নিয়ে তাঁর অনেক চিত্রকথা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পাবলো পিকাসোসহ দেশি-বিদেশি অনেক শিল্পীর চিত্রকলা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। যামিনী রায়কে নিয়ে তাঁর চার-পাঁচটি প্রবন্ধ আছে। আছে বাংলা এবং ইংরেজিতে লেখা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। অ্যালবাম এবং সংকলিত গ্রন্থও। অন্বিষ্ট গ্রন্থের অনেক কবিতায় সেই সেব অর্জনগুলো দিয়ে কাব্যপ্রাসাদের দেয়ালের অলংকরণ করেছেন।
বিষ্ণু দে’র এ সময়ের কবিতায় বিদেশি কবিদের প্রভাবও আছে। তিনি তখন পল এলুয়ারের কবিতা পড়ছেন এবং অনুবাদ করছেন। সময়ের কাজগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে সহজ হয়। অনুবাদ কবিতাগ্রন্থ ‘সমুদ্রের মৌন’ এবং প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুচি ও প্রগতি’ ১৯৪৬-এ প্রকাশিত হয়। মুশকিল হল বিষ্ণু দে’র কবিতা সহজপাঠ্য নয়। পড়ায় স্বাদ নাই, আনন্দ নাই, সহজ ইন্দ্রিয় সংবেদনাও নাই। তাঁর কবিতা পাঠ করতে হলে ব্যাপক পূর্বপ্রস্তুতি লাগে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ার জিভ এবং শোনার কান নিয়ে বিষ্ণু দে’র কবিতা পাঠ করা যাবে না, শোনাও যাবে না। এখানেই স্বতন্ত্রতা। শুধু বিষ্ণু দে কেন? অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং বুদ্ধদেব বসুর কবিতারও পৃথক সুর আছে, তাল, লয় এবং রুচি আছে। শরবতের জিভ নিয়ে যেমন মদিরা পান করা যায় না, বিবমিষা জাগে অস্বস্তিকর লাগে ঠিক তেমনি জীবনানন্দযোগ্য ইন্দ্রিয় দিয়ে বিষ্ণু দে’র কবিতা পাঠ করে লাভ হবে না। বিরক্তি লাগবে, একঘেয়েমি আসবে, হতাশা জাগবে মনে। নতুন প্রস্তুতি নিয়েই তা পড়তে হবে। এই বইয়ের আরেক দীর্ঘ কবিতা ‘জল দাও’ ১৯৪৬-৪৭ সালের দাঙ্গা ও রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির সাক্ষ্য হয়ে আছে।
‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ গ্রন্থের কবিতাগুলোর মধ্যে প্রথমটি ‘২২ শে শ্রাবণ’ আর শেষেরটি ‘পঁচিশে বৈশাখ’। এবিষয়টি সচেতন কিনা কে জানে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিবস দিয়ে শুরু করে জন্মদিবসে এসে শেষ করেন। এ গ্রন্থের কবিতাগুলো অনেকটা শান্ত রসের। অনেকদিন ধরেই তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ-দার্শনিক চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন, এবার তাকে একটু শান্ত হতে দেখা গেল। প্রায় কবিতায় সঙ্গীতের কথা আছে। পাশ্চাত্যসঙ্গীতের, দেশি লোকসঙ্গীতেরও। ‘আশ্বিনে’ কবিতায়
আশ্বিন আসে নির্বাক প্রতিবাদ
মুকুরিত হাসি তার
সোনালি ধানের হালকা হাওয়ায় আলোকিত প্রতিকার
এ যে এক ভিন্ন বিষ্ণু দে। প্রতিবাদের ভাষা নির্বাক। আবার প্রকৃতির আলোতে অনুসন্ধান করছেন প্রতিকার। এ বইয়ের কবিতাগুলো ভারতের স্বাধীনতার সময়ের এবং বেশির ভাগই সদ্য স্বাধীন দেশের। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে ও সমাজে কি কবির স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে? না হলে এমন ঘুরে যাওয়া কেন? প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া, সুরের তরঙ্গে ভেসে যাওয়া যেন রাজনীতির ময়দান থেকে ক্লান্তি নিয়ে সরে যাওয়া। যদি বিষ্ণু দে এ সময় ভিন্ন দিকে ধাবিত না হতেন তাহলে তার কবিতায় আরো একঘেয়েমি চলে আসত। নতুনত্ব আনতে পারতেন না কবি। আর সবচেয়ে বড় কথা এ সময় তাঁর মানসিকতায় পরিবর্তন চলে এসেছে।
এ সময়ের কবিতায় সঙ্গীতের সাথে চিত্রকলারও মিশ্রণ দেখা যায়। এর মধ্যে ১৯৪৪ সালে জন আরউইনের সাথে যৌথভাবে যামিনী রায়কে নিয়ে একটি ইংরেজি গ্রন্থ রচনা করেছেন। শিল্পের নতুন ভুবনে তাঁর পদচারণা বেড়ে যাচ্ছে। তার স্বাক্ষর আছে কবিতায়ও। প্রকৃতি থেকে রঙ নিচ্ছেন কবি। ‘আমার স্বপ্ন’ কবিতায় প্রকৃতির কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের দৃশ্য দেখি।
কতো দুর্যোগ, কত দুর্ভোগ হায়!
বিরাট কালের বিপুল তেপান্তরে
হাতছানি দেখি তোমারই বটের ছায়ে,
তোমার হাজার ঝুরির প্রাণের বরে
প্রাণ পায় মৃত আমাদের যৌবন।
কবিতাটির পরবর্তী পঙক্তিতে অবশ্য লেনিনের অনুপ্রেরণার কথাও বলেছেন। ‘কালের রাখাল শিশু: ২১ ডিসেম্বর’ কবিতায় ক্লান্তিকাল অতিক্রম করে পাহাড়ের পরপারে চলে যাওয়ার কথা আছে। পাহাড়, নদী, সমুদ্র, গ্রামের নিসর্গ, পিয়াল, কিংবা শাল-বটের চারা কিংবা বনস্পতির কাছে যাওয়ার কথা বলেছেন কবি। ইতিহাসের নানা ঘটনা, সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম, বিপ্লব, বিদ্রোহ, জেল-জুলুম-ফাঁসি-দ্বীপান্তরের কথা স্মরণ করেছেন কবি, সবখানেই হিন্দু-মুসলমান যুগ্মশব্দ একস্বরেই উচ্চারণ করেছেন। এই বিষ্ণু দে যদিও কলকাতার তিন পুরুষের বাসিন্দা। উনিশ শতকেই যাঁর প্রপিতামহের নামে বিখ্যাত শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট নামাঙ্কিত হয়ে আছে। যাঁদের পরিবার শতাব্দীকাল আগে থেকেই এটর্নি, উকিল ইত্যাদি পেশায় সমাজের উঁচুতলায় প্রতিষ্ঠিত। সেই পরিবারের সন্তান কবি বিষ্ণু দে’র মধ্যে পারিবারিক আভিজাত্য থাকার কথা, যেমন ছিল সুধীন্দ্রনাথে। যিনি কলকাতাতেই নাকি ইংরেজিতেই কথা বলতেন। বিষ্ণু দে’র পারিবারিক পরিবেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল আগে থেকেই। কবি নজরুলের যাতায়াত ছিল। ছোটবেলা থেকেই বিষ্ণু দে নজরুলকে দেখেছেন নিজেদের বাড়িতে। বাড়ির গম্ভীর প্রকৃতির গুরুজনের হুকা টেনে নিয়ে নজরুল ধোঁয়া টানছেন, মনে কোনো ঘৃণার ভেদ নাই, ধর্মের সীমা নাই। যার-তার পাত থেকে নলাভরে ভাত গিলে খাচ্ছেন কেউ কিছু বলছে না। এসব নজরুল করেছেন এই পরিবারে। নিশ্চয়ই করার সুযোগও ছিল। অতি সুদর্শন এবং উচ্চবিত্তের মেধাবী সন্তানের মধ্যে যে ধরনের আভিজাত্য থাকার কথা তা বিষ্ণু দে’র মধ্যে ছিল না। তাই তিনি হিন্দু-মুসলমানকে এক চোখেই দেখতেন।
‘অন্ধকারে আর’ কবিতায় দেখি বিপ্লবের কথা যেন ভুলে গেছেন, তার পরিবর্তে বাহু পেতে ভালোবাসা দিতে প্রস্তুত হয়েছেন। যে সন্দেহটা ছিল আমার মনে, হঠাৎ কবির এই পরিবর্তন কেন? স্বপ্নভঙ্গ? অনেকটা তাই। পেয়ে গেলাম ‘প্রচ্ছন্ন স্বদেশ’ কবিতায়।
চেয়েছি অনেকদিন
আজো তাকে খুঁজি সারাক্ষণ
এ কবিতায় কি কবির বয়সের প্রভাব আছে? বস্তুবাদী, দ্বান্দ্বিকতাবাদী, মার্কসবাদী, বিপ্লবপন্থী কবির মধ্যে অতনু প্রিয়তমার অনুসন্ধানের কথা উঠে এল যে! এ কি আধ্যাত্মিকতা! ‘ত্রিপদী’ কবিতায় দেখি আছে আত্মবিচার আর নিসর্গে সমর্পণের কথা।
আমি তো যাইনি রঙ্গিলা কারো নায়ে
আমি এ মাটিতে, তোমাকে দেখেছি প্রভাতে পিয়াল ছায়ে
জীবন যেখানে আকাশে জমাট একটি নিকষ পাহাড়।
‘শীতের শরতে এসো’তে প্রকৃতির কাছে মিশে যাওয়ার আহ্বানও করেছেন কবি।
চলবে…
বিষ্ণু দে: একালের চোখে-১॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ