॥পর্ব-১॥
কবিতার ক্ষেত্রে মনে হয় বাঙালি একেশ্বরবাদী। রবীন্দ্রনাথকে পেয়ে বহুকাল আর কাউকে সম্মান জানানো প্রয়োজন মনে করেনি। বাঙালি মুসলমানেরা আবার নজরুলকে পেয়ে রবীন্দ্রনাথকে ছোট করার প্রচেষ্টা করেছে। এরপরে জীবনানন্দকে পেয়ে তো রবীন্দ্র-নজরুল সবাইকে ভুলে গেছে। এখন পর্যন্ত চলছে জীবনানন্দপূজা। বৈচিত্র্য মানতে না পারার মানসিকতার এই দেশে অন্য যারা কবিতা রচনা করেন, তাদের জন্য অবশ্যই এটা দুঃসংবাদ। কারণ, পরমপূজ্য প্রধান প্রতিমাকে অপসারণ করতে না পারলে আপনি নিজেই জায়গা পাবেন না। জানি না ইংল্যান্ডে মিলটনের প্রশংসা করার জন্য শেক্সপিয়রের দোষ তুলে ধরতে হয় কিনা। শেলির গুণকীর্তন করতে হলে বায়রনকে গালি দিতে হয় কি না!
জীবনানন্দ অবশ্যই রবীন্দ্র-নজরুল উত্তরকালের বড় কবি। কিন্তু তিনিই একা কবি নন। তাঁরই কথা, ‘সকলেই কবি নয়; কেউ কেউ কবি।’ আবার নিজেই বলেছেন, ‘কবিতা অনেক রকম।’ কিন্তু আমরা অনেকেই শুধু জীবনানন্দ দাশের কবিতাই চিনি, অন্যদের না চেনার ভান করে থাকি। অথবা সত্যিই চিনি না। কারণ চেনার যোগ্যতা আমাদের নেই।
কথা সত্য যে, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাষা সহজ, অনেকের ভাষা দুরূহ। তবে জীবনানন্দের কবিতা একেবারেই সহজবোধ্য নয়। তাঁর ভাষায় চমক আছে। সুধীন্দ্রনাথ, অমিয় চক্রবর্তী বা বিষ্ণু দের কবিতায় পাঠকপ্রিয়তার উপকরণ নেই। আসলে ওই যে কবিতা অনেক রকম, এই কথাটা মনে রাখলেই বুঝতে সহজ হয়।
খ.
বিষ্ণু দে (১৯০৯—৮২) জীবনানন্দ দাশের সমকালের কিন্তু বয়সে অনুজ একজন আধুনিক কবি। তাঁর কবিতার প্রধান সমস্যা বিদেশি মিথ। তিনি এলিয়টীয় আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টায় অল্প বয়সে পশ্চিম থেকে আধুনিকতার নানা কাব্যসূত্র আমদানি করতে গিয়ে এই কাজটি করেছেন। সময়কে চিহ্নিত করার জন্য জীবনানন্দকে কেন টেনে আনলাম? বিষ্ণু দে’র কবিতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কি জীবনানন্দকে মান ধরে নিচ্ছি? না, তুলনা করতে চেয়েছি, জীবনানন্দ দাশের কবিতার অর্থগভীরত সহজ কিংবা সরল না কিন্তু পাঠকপ্রিয়। জীবনানন্দ দীর্ঘকাল গ্রামে বাস করে, লোকায়ত জীবনের বৃত্তে অবস্থান করেও নিঃসঙ্গতাপ্রিয় ও বিচ্ছিন্নতাবাদী। কিন্তু তিনি নিজে পাঠকের কাছে বিচ্ছিন্ন নন। এটা তাঁর কাব্যকৌশলের ফল। সমকালীন প্রায় সবাই বিচ্ছিন্নতাবাদী কবিতা রচনা করেছেন। সুধীন্দ্রনাথের কবিতা বিচ্ছিন্নতাবাদী; তাঁর বিচ্ছিন্নতা ধ্রুপদী দার্শনিক চিন্তার। অমিয় চক্রবর্তীও বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাঁর বিচ্ছিন্নতা ভৌগোলিক অবস্থানগত এবং ভাষা, পেশাও নেপথ্য কারণ। বুদ্ধদেব বসুও বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাঁর বিচ্ছিন্নতা মতাদর্শগত এবং স্বভাবগত। তাঁর নিজের মতে, ছোটবেলা থেকে তোতলা হওয়া এবং উচ্চতায় খাটো হওয়ার কারণে। বিষ্ণু দে’র মতে ব্যক্তিগত অহঙ্কারের কারণে। বুদ্ধদেবের নাটকগুলোয় বিষ্ণু দে’র মতের সত্যতা পাওয়া যায়। বিষ্ণু দে’র কবিতা ভালোভাবে না পড়ে, শুধু অন্যের ভাষ্য এবং মন্তব্যধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ পড়লে মনে হবে বিষ্ণু দে বুঝি সাম্যবাদী সমাজের গণঐক্যের কবি। কিন্তু বিষয়টা তা নয়। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা জনতামুখী। সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরও তাই। যদিও সুকান্তে আবেগ আছে, সুভাষে আছে পার্টির পক্ষে লোকদেখানো, পাল্লা ভারী করার কৃত্রিমতা। কিন্তু বিষ্ণু দে’র কবিতায় সেই কৃত্রিমতা নেই। তিনি অবস্থাপন্ন পরিবারের বাম চিন্তাবিদ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে নিজের শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নেমে এসে কুবের-গণেশদের শ্রেণীতে অবস্থান নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না; ছিল যথেষ্ট আন্তরিকতা। সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাত্ত্বিক ঝগড়াঝাঁটি করে বিষ্ণু দে সমকালে নিজের ‘সাহিত্যপত্র’ এবং বন্ধুর ‘পরিচয়’-এর শক্তিতে কিছুটা বিজয়ের আনন্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু আজকে বিষ্ণু দে’র মৃত্যুর পঁয়ত্রিশ বছর পরে একজন পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, বিষ্ণু দে আসলে জেতেননি। যদিও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অল্পায়ুর জীবনের শেষের দিকে যথেষ্ট ভাববাদী হয়ে পড়েছিলেন এবং শ্যামাসাধনা করেছেন; এটাকে অসুস্থতাজনিত বিকার ধরে নিয়েই বলতে পারি জনগণের প্রতি, শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির তত্ত্বে মানিকই আন্তরিক। বিষ্ণু দে’র মার্কসীয় চেতনা কৃত্রিম না হলেও বিলাসিতাপূর্ণ। এ নিয়ে তাঁকে মাথার ওপরের জ্বলন্ত রবি থেকে শুরু করে অনেক তরুণ এমনকি মরণোত্তর পাঠক-সমালোচকেরও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ‘নিরুক্ত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘তুমি’ কবিতায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিষ্ণু দে’কে খোঁচা দিয়েছিলেন,
শুঁটকি মাছের যারা রাঁধুনিক
হয় তো সে দলে তুমি আধুনিক।
তব নাসিকার গুণ কী যে তা,
বাসি দুর্গন্ধের বিজেতা
সেটা প্ররিটেরিটের লক্ষণ,
বুর্জোয়া গর্বের মোক্ষণ।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। তিনি ‘নিরুক্ত’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় লেখেন, “কিন্তু এই অর্থহীন শব্দসমষ্টি যদি নতুন আঙ্গিকের নিদর্শন হয় তাহলে ‘ক্রস ওয়ার্ড পাজল্’ শ্রেষ্ঠ কবিতা। দুটো ‘লাল’ বুলি কপচান যদি বিপ্লবী কাব্য হয়, তাহলে তোতাপাখীর কৃষ্ণনামও ভগবদ্গীতা।”
প্রথম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য লেখেন, “বাংলাদেশে আবার এমন কয়েকজন কবিও আছেন, যারা বামপন্থী নামে কীর্তিত অথচ যাদের কবিতার অর্থ ‘বিদগ্ধ’ জনেরও বিদ্যা-বুদ্ধির অগোচর। যে আদর্শ বামপন্থায় প্রেরণা দেয়, তাতে সমাজের মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকমাত্র সংশ্লিষ্ট নয়, জনগণই তা লক্ষ্য— বামপন্থী রচনা তাই জনগণের অগম্য হয়ে উঠলে তার আর কোনো প্রয়োজনই থাকে না। দুর্বোধ্যতা আর বামপন্থা বিরোধাত্মক কথা।” অজিত দত্ত ‘বদ্যিনাথও পদ্য লেখে’ নামে একটি ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু দে’কে নিয়ে। পরিমল রায় লেখেন,
উদিনবাবুর কঠিন পদ্যের
জুটলো এসে অনেক খদ্দের।
বুদ্ধদেব বসু চল্লিশের দশকে এসে প্রগতি লেখক সংঘের ‘ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্য’ আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার কারণে তার সাথে বামপন্থী লেখকদের দূরত্ব রচিত হয়। এর পরেই সম্ভবত বিষ্ণু দে আর বুদ্ধদেবের ‘কবিতা’য় লেখেন নাই। নিজেই সম্পাদনা করেন ‘সাহিত্যপত্র’।
গ.
বিষ্ণু দে’র গদ্য ও কবিতার বইয়ের সংখ্যা প্রায় সমান। শুরু থেকেই তিনি গদ্য এবং কবিতা সমানভাবে লিখে চলেছেন। চৌদ্দটি প্রবন্ধগ্রন্থ, সাতটি অনুবাদ, দুটি সম্পাদিত সংকলন ও উনিশটি কাব্যগ্রন্থ। তবে তাঁর কবিতার বই আসলে আঠারোটি। ‘রবিকরোজ্জ্বল নিজ দেশে’ বইটি বিলুপ্ত করে ‘ঈশাবাস্য দিবানিশা’ নামে পরের বছর আরেকটা বই প্রকাশ করা হয়। প্রথম গ্রন্থ ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩২) অল্প বয়সী প্রেমের কবিতা হলেও এত বিদগ্ধ পাঠকের কাছ থেকে আসা দুর্বোধ্যতার অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয়। প্রথম কবিতা ‘পলায়ন’ উনিশ শ আটাশ সালে লেখা বলে কবিতার নিচে উল্লেখ করা আছে। তখন কবির বয়স উনিশ-বিশ। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এই বয়সে যে একেবারে হাবামার্কা কিশোর ছিলেন, তা তো না। বুঝতেন জীবন এবং জগতের অনেক কিছুই। তার স্বাক্ষর কিছু কবিতায় আছেও। কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত অন্যদের প্রকাশিত বইগুলোর নাম মনে রাখলে আলোচনা করতে সুবিধা হয়। কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), অমিয় চক্রবর্তীর ‘খসড়া’ (১৯৩২) এবং বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩০)। ‘প্রেম’ নামের কবিতাটিতে প্রেমিকাকে বলছেন, চোখ নামিয়ে রাখতে। কারণ ওই চোখে চোখ রাখলে বিপ্লবের নৃত্য জাগায়। এই কথাটি আমাদের মনে রাখবে হবে। হয়তো এখানে উঠতি বয়সের ভাবাবেগই কাজ করেছে। সমাজের অনাচার, অবিচার ও অসঙ্গতি দূর করে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই বয়স উন্মুখ হয়ে থাকে। এ কবিতা যখন লেখেন, তখনো বিষ্ণু দে মার্কসবাদের সান্নিধ্য লাভ করেননি। ১৯৩০—৩২ খ্রিস্টাব্দে সেনট পলস কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক ক্রিস্টোফার একরয়েডের কাছ থেকে তিনি মার্কসবাদ এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গীত সম্পর্কে জানাশোনার সুযোগ লাভ করেন। আবার মার্কসবাদের ঠিক বিপরীত টিএস এলিয়টের কবিতা অনুবাদ শুরু করেন ১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এ কবিতা রচনা করার সময় তিনি মার্কস কিংবা এলিয়ট কারও দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন না।
প্রিয়াকে বক্ষে আঁকড়ে রাখার কল্পনাও আছে ‘বজ্রপাণি’ কবিতায়। নারীসঙ্গ কাতরতা তরুণপ্রাণে কান্না আনে, কবিতায় সেই আবেগও ধরা আছে। ‘সমুদ্র’ কবিতায় লিখেছেন,
আমার হৃদয়ে আজ প্রেম নেই— লবণাক্ত জলে
আমার হৃদয় ভাসে— অন্ধকার জনহীন রাতে।
সময়টা কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’র। এই বন্দিত্ব শুধু একজন কবির নয়, বয়সেরও। এই বয়সে প্রেমের বন্ধনে জড়ানোর আকুতি প্রবল হয়। বিষ্ণু দেও লিখেছেন:
আজ আমি মাগি তাই বন্দীর বন্ধন
আজ আমি ছেড়েছি আমাকে।
গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘সোহবিভেত্তস্মাদেকাকী বিভেতি’ কবিতায় নিঃসঙ্গতার এক প্রবলতর রূপ দেখা যায়।
মানুষের অরণ্যের মাঝে আমি বিদেশী পথিক
মুখোমুখি কথা বলি— চোখে লাগে অটল প্রাচীর
বিদেশী পথিব আমি — এসেছি কি বিধাতার ভুলে?
পৃথিবীর সভাগৃহে, বুঝিনাকো ভাষা যে এদের।
দ্বিতীয় কবিতার বই ‘চোরাবালি’তে কবির ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা, কাতরতা, হতাশা সংক্রামিত কয় কবির জগৎজুড়ে। ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। ভদ্রলোকের ছেলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে অনুভব করেন কিশোর হৃদয়ের যন্ত্রণা ক্রমশ বেড়ে তা দেহজ রূপ লাভ করেছে। যন্ত্রণার উৎস শুধু তরুণহৃদয়ই নয়, দেহের মধ্যেও লুকিয়ে আছে যন্ত্রণার আধার। বয়সজনিত এই অনুভব রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং বুদ্ধদবে বসুর কবিতায়ও দেখেছি। ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায় সেই দেহজকামনা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমকালের পাঠকের কাছে লজ্জায় নগ্নরূপটি লুকিয়ে কবি শব্দের ক্যামোফ্লেজে তা লুকাতে চান। বিষয়টি জটিল করে মহাকালের বিদগ্ধ পাঠকের জন্যই যেন রেখে দেন কবি। কবিতার শেষের দিকে দুটি স্তবক পড়লেই একথার সত্যতা পাওয়া যায়। এ বইয়ের অনেক কবিতায় প্রিয়াকে শারীরিকভাবে কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। ‘গার্হস্থ্যাশ্রম’ কবিতায় কবিমন গার্হস্থ্যজীবনকেই খুঁজে ফেরে। কবিতাটির ‘বেতাল’ অংশে দেখা যায় প্রেমিকা লেকের পারে ঘুরতে গেলে কবিমনে ঈর্ষা জেগে উঠছে। জীবনানন্দ দাশের ‘সুরঞ্জনা’ কবিতায় যেমন ঈর্ষা প্রকটিত হয়েছে, এখানেও তাই। তবে জীবনানন্দ যতটা অকপট বিষ্ণু দে ততটা নন। তিনি মার্কসীয় তত্ত্ব দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছেন।
লেকে আজকাল সকলেই যায়!
সকলের মতো ম্লান সন্ধ্যায়
তুমিও যাচ্ছ! কী বুর্জোয়া!
নিজের সঙ্গে না গিয়ে অন্যের সঙ্গে গেলেই তা বুর্জোয়াপনা! তরুণ মার্কসবাদীর এ যেন তত্ত্বের অপপ্রয়োগে ব্যক্তিগত ঈর্ষাকে লুকানোর প্রয়াস। ‘উভচর’ কবিতায়ও দেখি বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে।
পাখির আবেগ জাগাবে কি শরীর মনে?
পাখার ঝাপটা দিনরাত যাব শুনে?
এখান থেকে নারীদেহের বর্ণনা বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নাম আসতে শুরু করেছে কবিতায়। ওষ্ঠ, অধর, ঠোঁট, স্তন, আঁচিল, তনু, দেহ, শরীর ইত্যাদি। সংসারপ্রত্যাশী মন শহরে ছোট্ট ফ্ল্যাট বাসায় ঘুঘু ও ঘুঘুনীর মতো বাস করার বাসনাও প্রকাশ করেছেন। প্রেমিকা তার খাণ্ডবদাহন মিটিয়ে গেল না বলে হতাশাও ব্যক্ত করেছেনন। ডলু, মৈত্রেয়ী, লিলি নামধারী প্রেমিকাদের কথা বলা শুরু করেছেন কবি। বিষ্ণু দের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে গেলে জানা যায় সমকালীন কবিদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন এই কবিকে দেখার জন্য কলেজে ও পাড়ায়-মহল্লায়-গলিতে তরুণীদের ভিড় জমত। অনেকে ঠাট্টা করে নাকি বলতেন, ‘বিষ্ণু বাবু, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় নাকি দোতলার বেলকনি থেকে মেয়েরা ঝুঁকে থাকে আপনার দিকে?’ হাসির এই কথাটা প্রসঙ্গক্রমে চলে এসেছে, বাচালতা হিসাবে নয়। ‘মন দেওয়া-নেওয়া’ কবিতায় বিষয়টির উল্লেখ দেখা যায়।
দিব্যি মহৎহৃদয়— দিব্যি ভালোই ছেলে—
অনেক মেয়েই চায় তো আমায় তাদের স্বামী!
এত নারী যাকে যাঞ্ছা করে, তার হৃদয়ে এত হাহাকার কেন? উত্তরটা একেবারেই সহজ। ওই যে ভদ্রলোকের ছেলে, মেয়েরা চাইলেই কি তিনি ধরা দেবেন সামাজিক রীতির বাইরে গিয়ে? অনুমান করা যায় তখনো কবি কোনো নারীদেহের স্পর্শ পরিপূর্ণভাবে লাভ করেননি।
‘উর্বশী ও আর্টেমিসে’র উঠতি তারুণ্যের মনোজ আবেগ, ‘চোরাবালি’র দেহজ যন্ত্রণা ও লিবিডোতাড়না ‘পূর্বলেখ’তে এসে পরিণতি লাভ করে। এর মধ্যে কবির জীবনে নারীশূন্যতা পূর্ণ হয়েছে। উনিশ শ চৌত্রিশে প্রণতি দে’র সাথে বিষ্ণু দে এমএ পরীক্ষা দেন। পাস করার পরে তাদের বিয়ে হয়। এর মধ্যে রিপন কলেজে অধ্যাপনার চাকরিও নিয়েছেন। পেশাগত নিশ্চয়তা লাভ এবং সংসারপাতার পরে একজন পুরুষ মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই পরিবর্তন আসে। যেমন আসে শরীরে। ‘পূর্বলেখ’ কাব্যের প্রথম কবিতা ‘বিভীষণের গান’-এ তিনি স্বধর্মে আস্থাহীনতার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছন। বুদ্ধদেব বসুকে উৎসর্গ করা চৌদ্দটি চতুর্দশপদী কবিতার ছয় নম্বর কবিতায় লিখেছেন,
বিজ্ঞের দুরাশা রাখো— কর্তব্যের ছলনা
জ্ঞানের সোপানমার্গে বৃথা আরোহণ
চতুর্দশপদী এই কবিতাগুলো অবশ্য অনেক আগে লেখা, ১৯২৭ সালের দিকে। চিন্তাজগতে কিছু উৎকর্ষ দেখা দেওয়ায় সম্ভবত কবিতাগুলো পরিণত বয়সের কবিতার সাথে জুড়ে দেওয়ার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। ১৯৪১ সালে ‘পূর্বলেখ’ গ্রন্থে জুড়ে দিয়েছেন। ‘মুদ্রারাক্ষস’ কবিতায় সমকালের বন্ধু-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় চাইতে দেখা যায় কবিকে। তিনি নিকটজনদের চেড়ে নিজের পথ সন্ধানে নেমেছেন। মার্কস-নাকি মথি এই প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতে চান। ব্যক্তিমনের দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব এতদিনে একটা বৈশ্বিক রূপ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ যেমন মহাবিশ্বে আস্তিক্য ঐক্য দেখতে পেতেন, এখানে এসে বিষ্ণু দে সংশয়ের বিশ্বময়তা খুঁজে পেলেন। এ ধরনের কথা অন্যের কাছে শুনে শুনে কবিতায় আনা যায় না, বয়সের ভার এবং বিদ্যার ভার লাগে। ‘রসায়ন’ নামের কবিতায় লিখেছেন, ‘দেহ ও মনের দ্বন্দ্ব— এই দ্বিধা ব্যক্তি ও বিশ্বের’।
অনুষঙ্গক্রমে এ কবিতায় মালার্মে, মাতিস এবং হেগেলও এসেছেন। তাত্ত্বিক দিক থেকে যাঁরা বিষ্ণু দে’কে ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনি মার্কসবাদের বাস্তবায়নে শিল্পমাধ্যম উৎপাদনে মানুষের অভাব দূর করে শ্রেণীব্যবধান দূর করতে চান, তা তত্ত্বই। বাস্তবে কবির মনে যন্ত্রণা আছে কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পসমাজে উত্তরণের পথেও। ‘ বৈকালি’ কবিতায় লিখেছেন,
প্রকৃতির কোলে আর শান্তি নেই, পাটকলে যায়!
দূর থেকে নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
ক্ষমা কোরো কোরো তুমি দুর্মর জীবন ভরো গানে:
গান আমার ছড়ায় মাঠে ধানের ক্ষেতে বর্ষাজলে
আউশের বীজবপনের উতোল হাতে ছন্দে চলে
এ দীর্ঘ কবিতার শেষের দিকে কবি নিজের জন্মঋতু নিয়ে সময়ের পরিবর্তন, নতুন দিনের আহ্বান ইত্যাদি লিখেছেন। নতুন কালের সূর্য হাসি-কান্নার আলোয় হাসছে। মুক্তিপ্রবল তুর্যও হাসিকান্নায় ভাসছে। এসময়ের কবিতায় নতুন দিনের কথা আছে, সম্ভাবনার কথা আছে, কিন্তু কবি যে একেবারেই আশাবদী, ইতিবাদী হয়ে উঠেছেন, এ কথা মিথ্যা। নগরজীবনের নানারকম নেতিবাচক পরিস্থিতির উল্লেখ করেছেন। জীবনে জীবন যোগের মাঝে হতাশাও দেখতে পাচ্ছেন, পাঠকের জন্যও সেই হতাশার শব্দচিত্র রেখে যাচ্ছেন। এই হতাশার শুধু শব্দচিত্র আঁকাই কবির কাজ না। বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে কারণ অনুসন্ধানও করেছেন। অশোক মিত্রকে উৎসর্গ করা দীর্ঘ কবিতা ‘চতুরঙ্গ’-এর একেবারে শেষ পঙ্ক্তিতে লিখেছেন
তুমি ভেসে যাবে কালের তুচ্ছ সচ্ছলতায়।
তবুও তুষারহ্রদ উচ্ছল তোমার গানে
চিরকাল, জেনো, শ্রেণীস্বার্থের অতীত কথায়॥
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শ্রেণীস্বার্থের আড়ালেই আছে আমাদের স্বকালের অনেক সমস্যার মূল কারণ। এখান থেকেই কবির পরবর্তী কালের গতিপথ দেখা যাচ্ছে। ‘স্পেন-১৯৩৭’ কবিতায় কবির আশাবাদী মন দারুণভাবে প্রত্যাহত হয়। পাবলো পিকাসোর সেই বিখ্যাত চিত্রকর্ম গোয়ের্নিকার যে পটভূমি, স্পেনের গোয়ের্নিকা শহরে বিমান হামলার ক্ষয় ও ক্ষতি। সেই ঘটনা নিয়েই বিষ্ণু দে রচনা করেন এই কবিতাটি। তবে প্রচণ্ড মারের পরে মানুষের বিহ্বল মন সাময়িক স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠে যখন চিন্তা করতে শুরু করে তখন যদি দেখে শত্রুর বা ক্ষয়ক্ষতির কারণ দূর করার মতো শক্ত হাত নেই, তখন প্রকৃতির প্রতিশোধ বা বিচারের আশা জাগে মনে। যদিও এই আশাবাদ এক সময় কেটে যায়। পরবর্তী কয়েকটি কবিতায় বিষ্ণু দে’র মধ্যেও এমন আশাবাদী উক্তি লক্ষ করা যায়। তবে গ্রন্থের শেষ কবিতা সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে উৎসর্গ করা অনেক পর্বের দীর্ঘ কবিতা ‘জন্মাষ্টমী’তে আবার হতাশা, নেতিবাদ, আশাহীনতা সব একত্রে যেন নেমে এসেছে।
চলবে…