॥ ১৭॥
ভাবি—এবার সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। দূরত্বই সব সমস্যার সমাধান করবে। চলে যাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। হলে থেকে পড়তে হবে। ওর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না হয়ে ভালোই হয়েছে। ধীরে ধীরে যোগাযোগ কমে আসবে। কাজে ডুবে যাব। পড়ায় মন দেব। ধীরে ধীরে প্রথম প্রেমের কিংবা প্রথম প্রতারণার যাতনা ভুলতে-ভুলতে একদিন তা ইতিহাস হয়ে যাবে। আমি একা, নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে প্রস্তুত হতে থাকি। এমনিতেই ইথিক্যালি আমি আমার এই নিষিদ্ধ প্রেমকে মেনে নিতে পারছিলাম না। নিষিদ্ধ এই অর্থে যে—সে তো আগে আমাকে বলেনি। বলেছে আর এক নারীকে।
প্রথাগতভাবেই তারা যুগল। তারা প্রেমিক-প্রেমিকা। আমি কেন মাঝখানে! আমি আমার দুর্বল মানসিক অবস্থান থেকে সরে আসতে পারছি না। কিন্তু সেও তো তারই কারণে। আমি তো তার কাছে যাই না। সেই বা কেন ওই মেয়েটির সঙ্গেও প্রতারণা করছে! কেন সে আমার কাছেই ছুটে-ছুটে আসবে? কেনই বা সে একজনকে ভালোবেসে আর একজনকে ফুল দেবে? ভীষণ বিষণ্ন মন। খুব ছটফটে অস্থির দিন-যাপন। ভাবি সব সমস্যার সমাধান দেবে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসাটা। এই ভেবেই খানিক স্বস্তি পাই, খানিক নিজের যাতনা থেকে বাঁচার একটা আশা বুকের ভেতর বেঁধে রাখি। না সে আশায় গুড়ে বালি। দেখা হয়। তবু কথা হয়। তখন কোচিং নেই। ক্লাস নেই। কোথাও চান্স হবে কি হবে না, শঙ্কা নেই্। বুকের ভেতর তীব্র বিষের আগুন নিয়ে একা একা বের হই একদিন। মনে পড়ে বাসন্তী রঙ শাড়ি। মনে পড়ে ঘন সবুজ ঘাসের মতো চিকন ছিল পাড় তার। সত্যিকার অর্থে একেই অভিসার বলে কি না—তখনো জানি না। যদি বলে, তবে এটাই আমার প্রথম অভিসার। আমার মনে ভয়। আমার মনে শঙ্কা। আমি প্রাণমন ঢালতে পারি না তবু। সেই মেয়েটির ছবি ভেসে থাকে মনের মাঝে। সেও ওই মেয়েটির কথা আর তেমন বলে না। রেললাইনের ধারে চলে যাই। রেললাইনের ধার ঘেঁষে দুজনে হাত ধরে হাঁটি। ময়মনসিংহ থাকার সময়ে এই প্রথম ব্রহ্মপুত্র নদীতে নামি। এই প্রথম নৌকার চড়ে ব্রহ্মপুত্রের জলের বুকে ভাসি। এই প্রথম ছেঁড়া পালে প্রাণের দোলা লাগে। এই প্রথম খোলা মুক্ত জীবনের পরশ বুঝতে পারি। নদী পার হয়ে ওই পারে চলে যাই। এত বছর এই ময়মনসিংহ শহরে আছি। কোনোদিন বের হয়ে দেখতেও ইচ্ছে করেনি। কোনোদিন নদীর ধারে যাইনি। কোনোদিন নদী পার হয়ে ওই পারে কাশফুল দেখা হয়নি। কোনোদিন নৌকায় চড়ে ওপরে তাকালে আকাশ আরও কত নীল তা দেখার অবকাশ পাইনি। কোনোদিন নদীর জলে ভেসে ভেসে আকাশে স্বপ্ন আঁকার ইচ্ছে হয়নি। সেদিন আমার একটা নতুন নাম হয়। প্রকারান্তরে আমার নামেরই অর্থবোধক অন্য আর একটি শব্দ যোগ হয় জীবনে, এর বেশি কিছু নয়।
তুমি হলে জলের কুসুম।
মানে কি?
শাপলা জলে ফোটে। আর ফুলের আর এক শব্দ কুসুম। দুইয়ে মিলে জলকুসুম। মানে তুমি হলে জলকুসুম।
আমি বেশ খানিকটা লজ্জা পাই। এত সুন্দর শব্দও হতে পারে। জলকুসুম। আমাকে কেউ জলকুসুম নামে ডাকবে? আমার চোখ তার খুব প্রিয়। আমার নাম তার খুব প্রিয়। সে কবি মানুষ। তার কবিতা অসাধারণ। তার রক্তে-স্নায়ুতে প্রাণে-মনে আর কলমে কবিতা। মনে পড়ে, প্রথম যেদিন মুকুল নিকেতনে তার সঙ্গে আমার পরিচয়, তখন আমার প্রথম কবিতার বই ‘এই দেশ এই পৃথিবী’ বের হয়ে গেছে। প্রথম সাক্ষাতেই ও বলতে শুরু করলো:
তুমিই শাপলা? তোমার কবিতার বইটি আমি পড়েছি। বইটি আমাদের বন্ধু মহলে খুব প্রশংসিত হয়েছে।
মনে আছে আমি খুব বেশি কিছু বলতে পারিনি। আমি জানি না, তার বন্ধুমহল বলতে কাদের বোঝায়? আমি জানি না এখানে কারা তেমন করে কবিতা পড়ে। আমি জানি না আমার কবিতাও আসলে পড়ার মতো কিংবা প্রশংসা করার মতো হতে পারে কি না! আমি খুব অবাক হই। শুধু বলি, তাই?
হুম। আমি তোমাকে খুশি করার জন্য মিথ্যে বলছি নাকি? তার এই ধরনের কথায় আমি বেশ অপ্রস্তুত হই। বলি, আসলে কবিতাগুলো কেমন জানি না। তবে ঘটনাটা বেশ। সে বলে, মানে কী?
সেদিন বেশ কিছু লোক আমার বাসায় এসেছিল।
কেন?
আমাকে দেখতে।
মানে?
এত অল্প বয়সে একজন মানুষের কবিতার বই বের হয়েছে। সে কে? এটা দেখতে। একজন ব্যক্তি আমার মাকে বলছিলেন, খালাম্মা আমরা আপনার মেয়েকে দেখতে এসেছি। কে সেই কবি। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই বই বের করার মত লেখা…।
আরও আরও যেসব কথা হলো, আজ আর মনে পড়ে না। তবে আজ এত বছর পর সেই বইটি হাতে নিলে কবি শামসুর রাহমানের কথাটি মনে পড়ে—‘প্রায় প্রত্যেক কবিই তার জীবনের প্রথম বইটি অস্বীকার করার চেষ্টা করেন পরিণত বয়সে এসে।’ সেদিনের বইয়ের কথা মনে হলে ভাবি দুঃসাহস ছিল বটে! সময়-অবস্থান-পরিপ্রেক্ষিত আর যোগ্যতা বিচারের কোনো দায় কিংবা বোধ কোনোটাই সেদিন কাজ করে, এমন বয়স ছিল না। বোধ ছিলনা। যা আজ প্রতি পদক্ষেপে বাধ্য করে নিজের লেখা নিয়ে ভাবতে। বাধ্য করে নিজের ভেতর কেবলই গুটিয়ে যেতে। কিন্তু সেদিন জলকুসুমের লেখার হাত খুলে গেছিল সত্যি বলছি। দারুণ যাতনায় মরে যেতে যেতে একদিন আমি ক্ষেপে উঠে লিখে দিয়েছিলাম।
ওই যে দেখা যায় সমুদ্রের আহ্বান
আমি যাব
আমি যাবই
সমুদ্রে গাঙচিল বলেছে ডেকে
দেবে সে নির্মল প্রশান্তি আমারে
তারপর আরও আরও কত কত যে কবিতার প্রহর। কত যে নদীর জলে ভেসে বেড়ানো। কত যে ভালোবাসা কত যে দিনরাতের যাতনার মন্থন—সব একাকার হয়ে মিশে গেছে কালের অতলে কী করে বলি! তখন ময়মনসিংহ শহর থেকে শম্ভুগঞ্জ যাওয়ার ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সেতুটা মাত্র খুলে দেওয়া হয়েছে। বন্ধুরা দল বেঁধে দেখতে যায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা যায়। বড় বোন তার বন্ধুদের সঙ্গে সেতু দেখতে যায়। আমার কখনো আগ্রহ জাগেনি। একদিন আমাকে জোর করেই বের করে আনে সে বাড়ি থেকে। আমি নানা অজুহাত দিতে হবে বাড়িতে, মা’র সামনে মিথ্যে কথা বলতে গিয়ে ধরা পড়ব, এ সব ভেবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস করতে পারতাম না খুব একটা। বের হতে বললেই ‘না’ বোধক একটা শব্দ প্রথমেই আসতো। আমি তবু সেদিন বের হয়ে নদীর বুকে পালতোলা নৌকায় ঘুরে বেড়ালাম। নদী ধরে একবারে শহর থেকে শহরের অন্য মাথায় শহরতলীতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অবধি—যতদূর যাওয়া যায়, ততদূর গেলাম। ভেসে বেড়ালাম হাওয়ায়-হাওয়ায় জলে-জলে আর গভীর কান্নায়। আসার পথে বিকেলে পার হয়ে সন্ধ্যে লাগো-লাগো। শম্ভুগঞ্জ সেতুর ওপর হালকা কুয়াশার চাদর। হালকা শীতের আমেজ। দুর্গা পূজার আবাহন। সেতুর জলে অনেক্ষণ দু’জনে তাকিয়ে ছিলাম। অনেক্ষণ ধরে সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিল। নদীর জলে ছায়া লিখেছিলাম দু’জনে। নদীর জল গাঢ় হয়েছিল আধো অন্ধকারে।
কুয়াশার জাল আরও তীব্র আর প্রগাঢ়। মনে পড়ে খুব আবেগঘন সময়, জীবনের প্রথম এমন। সব ভুলে গেছিলাম সেদিন সারাটা দিন। কোথায় যেন শরতের মেঘের মতো উড়ে উড়ে হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল সেই মেয়েটি। সারাটা দিন আমি আর সে। দু’জনে কত যে মধুর, কত যে তীব্র, কত যে মুখর কত যে আদর আর কত যে পাওয়া, এই প্রথম প্রগাঢ় দু’জনে। গভীর করে জড়িয়ে ধরেছিল সে আমায়।
চলবে…