রাত সাড়ে চারটা। নিস্তব্ধ তক্তার মতো শুয়ে আছে শহর। কে যেন আকাশ থেকে কুয়াশার স্প্রে মারছে অবিরাম। ঘাসের পাশে আরেক লম্বা প্রতিবেশী ঘাসের মতো বিল্ডিংগুলো গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। মাড়াইয়ের মতো কোনো মানুষের কিংবা দানবের পা নেই। খুব নির্ঝঞ্ঝাট লোকালয়। এই নৈঃশব্দ্যই এ নিরালা রাতের গর্ব। তা চুরমার করে একটু আগে একটা ভুমিকম্প হালকা নাড়িয়ে দিলো এই ঘুমন্ত শহরকে। আর সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের ছোবলে ছুটন্ত বুনো বাসিন্দাদের ত্রস্ত চিৎকারের মতো শোরগোলে ভরে গেল শহর। তাতেই গভীর সেই রাতে, যে যে-ই পজিশনে ছিল রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। মৃত্যুর দাবড়ানি বলে কথা! কি সেই দৃশ্য! বয়সন্ধির গ্যাঁড়াকলে পড়া ছেলেগুলো কিংবা মন্নাফের মতো কিছু ব্যাচেলর মরদ ভূ-কম্পনের এই উত্তেজনা ফেলে আবছা বাতির আলোয় গলিতে নেমে আসা এলোমেলো কাপড়ের শিপু ভাবির দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তাদের মস্তকে তখন রিখটার স্কেল ছিল না, ছিল বক্ষ ও নাভির মাপ।
এই অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্য পুরো শহরের সমস্ত ঘুম পথে নেমে আসে। গলিগুলোতে এত ভিড় যেন সবাই রথের মেলায় রওয়ানা দেওয়ার অপেক্ষায়। এরপর ভয় আর উৎকণ্ঠা মিইয়ে গেলে মানুষগুলো আবার তাদের খোপে খোপে ঢুকে দরজা লাগায়। কেউ কেউ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলতে থাকে, মইষ একবার শিং লাড়া দিলেই সব রং শেষ রে বেডা, এই সব চিপা দিয়া কোনেনা গাড়িই ঢুকবার পারব না মিয়া, পইচা গইলা ভাগাড় অইব, হুদায় বেকতে টাইলসের, মার্বেলের মহল বানাইতাছে।
আধঘণ্টা পর।
মন্নাফ টের পায় তার পায়ের গোড়ালির দিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কি যেন একটা জ্বালাপোড়া করছে। এই জ্বলুনিটা ওর পরিচিত। একবার সে তার গ্রামে ইন্দির বিলে মাছ ধরতে গিয়ে তার বুড়ো আঙুলের চিপা শামুকে কেটে গেলে এমন জ্বলুনি ওঠেছিল। রক্ত ও পানির কাদায় অন্য একটা রঙ ধরেছিল পায়ের পাতায়। মন্নাফের মনে পড়ে। ব্যথাটা মৃদু যন্ত্রণার কিন্তু বিরক্তিকর ছিল। কিছু ব্যথা পরিমাণে হালকা কিন্তু স্বভাবে বেশ বিরক্তিকর ও মনোযোগ নষ্টকারী হয়। যাই হোক—এই অবস্থায় আরও দুই-এক মুহূর্ত পার হলে মন্নাফ তার চারপাশে কালো আলোর ব্যাপারটা ঠাহর করতে থাকে। ধুলার মতো কিছু তার নাকে এসে লাগে তখন। নাসারন্ধ্রের চারপাশে জমা ঘামবিন্দুতে এই উড়ন্ত ধুলা লুটিয়ে ভিজে যাচ্ছে। ধুলা ভিজে গেলে ঘ্রাণ হয়। মন্নাফ খেয়াল করে এই ধুলার ঘ্রাণ গ্রামের মেঠোপথের ধুলাভেজা ধোয়াটে ঘ্রাণটার মতো নয় বরং এটাতে সিমেন্ট-কংক্রিটের একটা ঘ্রাণ বোঝা যাচ্ছে। হাত-পা নাড়া দিলে এই ধুলাঘ্রাণ আরও তীব্র হচ্ছে। পায়ের গোড়ালির দিকে যেদিকে জ্বলছে সেখানে বালির আস্তরণে শরীর কিটকিট করছে, যন্ত্রণাটা বিদঘুটে আকার নিচ্ছে। মন্নাফ এবার চুলে হাত দেয়। ভারী ধুলার ঝুল চুলে। চারদিকে আঁটসাঁটো সীমানা, সংকীর্ণ আলো-স্থান-বাতাস। মন্নাফ এবার সত্যি সত্যি মনোযোগ দেয় মানে স্মরণ করার চেষ্টা চালায়। সে কেন এখানে? চারদিকে কালো আলো কেন? যতটুকু তার মনে পড়ে সে ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে মহল্লার গলিতে নেমে এসেছিল শেষবার। তার কিছুক্ষণ পর আর সবার মতো উৎকণ্ঠাসহ ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল। ঘরে এসে ভাবছিল রাস্তায় নেমে আসা আলুথালু বেশের ভয়ার্ত দৃষ্টির শিপু ভাবির কথা। তার পেট ছিল উদোম, অবিন্যস্ত ব্লাউজের নিচ দিয়ে দু’দিন বয়সী জোড়া চাঁদের মতো স্তনদ্বয় বন্ধনিচ্যুত হয়ে বেরিয়েছিল। মনে পড়ে সব।
ঘ্রাণেন্দ্রিয় সচল হওয়ার পর ধীরে ধীরে এবার মন্নাফের শ্রবণেন্দ্রিয় সচল হতে থাকে। সে শুনতে পেতে থাকে আশপাশের রোদনকাণ্ড। অনেক দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্স আর ফায়ার সার্ভিসের পরিচিত ইমারজেন্সি হর্নের আওয়াজ কানে এসে লাগে।
আমারে পানি দেন একটু, আমার মানিকটা কই?—বলে একটা ব্যথাভারী চিৎকার তখন ভেতরের এই আঁধারকে হঠাৎ লজ্জায় ফেলে দেয়। মন্নাফ তার একটা হাতের কনুই দিয়ে কয়েক ইঞ্চি নড়ার চেষ্টা করে, পারে না। চিৎকারটা তার পরিচিত। তৃতীয়তলার শিপু ভাবির। বাচ্চাসহ সে গলিতে নেমে এসেছিল শেষবার। কাপড়ের ঠিক ছিল না। পিচ্চি ছেলেটা মায়ের কোলে ঝুলে ছিল। ওর বাবা আজ বাড়িতে ছিল না। মন্নাফের সব মনে আছে।
পানি দেন—বলে চিৎকারটা দিয়েই বেচারী চুপ করে গেল। মন্নাফের মনে হলো তারও তো এতক্ষণে একটা চিৎকার দেওয়ার কথা। সেও তো এই ভূমিকম্পের শিকার। তার মতোই তো চাপা পড়ে আছে সব। আশেপাশে, কিছু দূরে, খুব দূরে পুরো নগরীর নিচে তার মতো চাপা পড়ে আছে নাগরিকগণের এলোপাথাড়ি অসহায় চিৎকারসমূহ। শিপু ভাবি আবার হঠাৎ অস্ফুট গোঙ্গানি ছাড়ে—এবার মন্নাফ খুব কষ্টে আবছা খেয়াল করে তার সামনে একটা দেয়ালের বিম বাঁকা হয়ে আছে এবং এই বিমের শেষ মাথার দিকে শিপু ভাবির গোঙ্গানিটা বোঝা যাচ্ছে। মন্নাফ ভাবে, এই শিপু ভাবি কত দিন যে তার ঘুম হারাম করেছে তার হিসাব নেই। ওপরতলায় মন্নাফের রুমের বরাবর ঠিক ওপরের রুমে থাকতো এই ভরাটদেহী মহিলা। শিমুল নামের মাঝবয়েসী একটা লোক যখন তার বউকে নিয়ে তিনতলায় রুম ভাড়া নেয়, সেদিন সন্ধ্যায় মন্নাফ ছাদে গিয়েছিল। লম্বা-চওড়া দিদিদের মতো সুন্দর-মাথাভরতি চুল-দুধের সরের মতো গায়ের রঙ—মন্নাফের এই প্রায় পঁয়ত্রিশের অবিবাহিত জীবনের জন্য ফ্যান্টাসি নিয়ে এসেছিল। কত না চেষ্টা করা হলো ভাবির সুনজর পাওয়ার, কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। ইচ্ছে করে ইলেকট্রিক সার্কিট ডাউন করে ভাবির ঘরে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে সে। গিয়েছেও কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। পানি খেতে চেয়েছে এমনি, তার ছোট পিচ্চিটাকে আদরের ছলে ঘরে ঢুকতে চেয়েছে কিন্তু আখেরে কাজ হয়নি। অথচ আজ এই শিপু ভাবিই অসহায়ের মতো আজ পানি চাচ্ছে। আর কাকতালীয়ভাবে আজ মন্নাফ তারই পাশে। উভয়েই ঘোর বিপদগ্রস্ত।
এবার মন্নাফের সব ভালোমতো মনে পড়ছে। প্রথম ঝাঁকুনির সময় রাত বাজছিল ৩ টা। তার মানে এখনও আলো ফোটেনি আকাশে। তার মানে ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি। ঘটনা হলো, মাথায় বাড়ি খেয়ে ও কিছুক্ষণ অজ্ঞান ছিল। চিৎকারে অতিরিক্ত ভারী হতে হতে, এই গভীর রাত এখন কিছুটা শান্ত হয়ে ভোরের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। অথচ এখনো ভয়ের প্রথম চিৎকারটাই দেয়নি মন্নাফ। সে দীর্ঘকালের বেকার। তার কাছে বিয়ে, বেঁচে থাকা বিস্বাদেরই আরেক ঢং। শিপু ভাবির গোঙ্গানি এতক্ষণে থেমে এসেছে। এখন আর তিনি পানি দেন— বলে চিৎকার করছেন না। শক্তিতে বোধ হয় আর কুলচ্ছে না। মন্নাফ এবার প্রস্তুতি নেয়। ঠোঁটের ওপর থেকে গেঞ্জির হাতা দিয়ে ধুলো মুছে নেয়। এই বিপদের ঘোর ক্রান্তিকালে মন্নাফের কোনো কিছু আসে-যায় না যেন। মন্নাফের চোখে কেবলই অস্বাভাবিকভাবে ভাসে ভরাট শরীরের এক শিপু ভাবি।
ভাবি, আমি মন্নাফ, দু’তলার। ভয় পাইয়েন না ভাবি। সকাল হোক, ধৈর্য ধরেন। রাবিশ সরায়া আমগোরে বাইর করব তিন বাহিনীর লোকজন। হেলিকপ্টারের আওয়াজ পাইতেসেন তো?—বলতে বলতে ধূলা ঢোকে তার মুখে।
শোনে একটা অস্ফুট স্বর জোরালো হওয়ার চেষ্টা করে তখন। জোরালো হয়ে আওয়াজ আসে—একটু পানি দেন। এবার মন্নাফ আর ভোরের অপেক্ষা করে না। মন্নাফের সব মনে পড়ে। ভ্রূ-কুঁচকে সামনের বিমের পাশে আটকা ভাবির অবয়ব পরিষ্কার দাঁড়া করাতে চায়। তার মাথায় একটা প্রশ্নই জোশ ভালো—পানি কোত্থেকে পাবে?
মন্নাফের খুব মনে চায় এই সুযোগে ভরাট ভাবিকে সে পানি দেবে। পানির এক ঢোক খেয়ে ভাবি শক্তি ফিরে পাবে। শক্তি পেলে হয়তো সে নড়াচড়া করে তারই মতো করে বীরের মতো বেরিয়ে যাবে এই ধংসস্তূপ থেকে। তারপর তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর ছেড়ে পালাবে অরণ্যময় গ্রামের দিকে। ধসে পড়া ইমারতে আটকে থেকে এসব এলোমেলো ভাবতে থাকে মন্নাফ। ভাবতে ভাবতে ততক্ষণে তার পরিবারের অন্য সদস্যদের কথা মনে পড়ে। তার বাবা বৃদ্ধ মানুষ। ভাইয়েরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মনে মনে তার গ্রামের বাড়ি চলে যায় মন্নাফ। সবার কথা ঘুরে ঘুরে খেয়াল করতে থাকে সে। আচ্ছা, গ্রামে তো একচালা টিনের ঘর আছে তাদের। আজকের এই ভূমিকম্প কি সেই ঘরকে আস্ত রেখেছে? তার বাবা, বৃদ্ধা দাদি আর তার ভাইয়েরা কেমন আছে, কে জানে?
ড্রিল মেশিনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। সঙ্গে মানুষজনের চিৎকারও। মন্নাফ বুঝতে পারে, সে কোনো রকমের জখম পায়নি। দিব্যি আছে, শুধু একটু নিঃশ্বাসে ঝামেলা হচ্ছে, এই যা। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটিয়ার কথা মন্নাফের মাথায় আসছে না এখন, হয়তো তার আশেপাশেই সবাই মরে আটকে আছে, কেউ কেউ হয়তো অজ্ঞান হয়ে আছে, আবার অনেকেই হয়তো তার মতো উদ্ধারের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এতকিছু ছাপিয়ে মন্নাফের কেবল শিপু ভাবির দিকেই মনোযোগ বাড়ছে। যেন সমগ্র দুর্ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিকার এই শিপু ভাবি।
মন্নাফ ঘাড়ের চটচটে ধূলা মুছে দুই আড়াই গজ দূরের ভাবিকে ডাক দেয়। ভাবি, কিছুক্ষণ কষ্ট করে থাকেন, শোনেন বাইরে হেলিকপ্টারের আওয়াজ সঙ্গে ড্রিল মেশিনের শব্দ, পাইতাছেন না?
এতক্ষণ বাঁচমু না মনে হয়, একটু যদি পানি পাইতাম রে ভাই! আমার বাচ্চাটা কই? আমার বাবাটা কই?
মন্নাফের খেয়াল হয় শিপু ভাবির পিচ্চি ছেলে জিয়নের কথা। ওকে কোলে নিয়েই তো সে আলুথালু নেমে এসেছিলেন বাসার নিচে গলিতে। আহা, বেচারী! মন্নাফ ব্যাগ্র হয়ে ভাবীকে সান্ত্বনা দেয়— ভাবি, পুরো শহর বিপদে পরছে, ধৈর্য ধরেন। যারা বাঁইচা আছে, তারা নিশ্চয়ই আমগোরে উদ্ধার করনের চেষ্টা করতাছে।
আরে মিয়া, পিচ্চিটার কোনো কান্দনও হুনি না, ও তো আমার সঙ্গেই আছিল, কৈ গেলো জান আমার, ওর বাপরে আমি কী কমু? হাই আল্লাহ!
এই করুণ আর্তনাদে মন্নাফ এবার চুপসে যায়। একদম চুপসে যায়। খুব চুপসে যায়।
অনেকক্ষণ হলো অনেক দূর থেকে কেবল অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজই কানে আসছে কিন্তু তা তীব্র হচ্ছে না। এর মানে কী—মন্নাফ ভাবে। গাড়িগুলো কি তাহলে ঢোকার মতো পরিষ্কার পথ পাচ্ছে না? মন্নাফের এবার হালকা দুশ্চিন্তা লাগে। শরীরে শক্তি নেই তেমন। বিমটা পার হয়ে শিপু ভাবির কাছে কি যেতে পারবে ও? গেলে কী হবে? তার সৌন্দর্য সৌষ্ঠব কি ঠিক আছে? না কি বিপদগ্রস্ত পরিবেশ তার আগুনধরা রূপে ধস নামিয়েছে শহরের মতো? তার পিচ্চি ছেলে জিয়ন কি বেঁচে আছে, বেচারী কি ওর নাড়িকাটা ছেলেকে ফিরে পাবে?
এগুলো ভাবতে ভাবতে ওপরে সামান্য আটকে থাকা পিলারটা সজোরে ধসে পড়ে মন্নাফের মাথায়। পাকা কদবেল ফাটার মতো একটা আওয়াজ হয় এবং একদম সঙ্গে সঙ্গে একটা বাচ্চাকণ্ঠ প্রচণ্ড শব্দে কেঁদে ওঠে। এই কান্না শুনে শিপু ভাবি সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলেন—ও আমার মানিক ধন, আমার বাবা কই রে? ও মন্নাফ ভাই, কই আপ্নে? আমার কলিজাডা কই কান্দে, একটু দেহেননা! আমার এহন আর পানি লাগব না।