॥ ১২॥
এক ছুটির দিনে বাতিল ট্রান্সফর্মারের কিছু বাতিল ফিনের টুকরো, টেপ মুড়িয়ে রাখার চাকা আর কিছু তার দিয়ে সমীর একটা হরিণ বানিয়ে ফেলল। সেটাকে চোখের সমানে ধরে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হেলিয়ে দুলিয়ে দেখল হরিণটিকে। হয়েছে বেশ। ঘরের আলোয় তার রূপালি ধাতব শরীরটা ঝিকিয়ে উঠছে। চোখের জায়গায় ছোট ডায়োডবাতিটাও জীবন্ত যেন।পাগুলোয় কোনো ভাঁজ না থাকায় দেখাচ্ছে ভারি যান্ত্রিক, কিন্তু তাতে পৃথিবীতে একটি নতুন হরিণের আবির্ভাবকে স্বীকার করে নিতে মুগ্ধ দর্শকটির কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। হরিণ বালিশের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকলো, বেরিয়ে এসে মেঝেতে পড়ে থাকা জল থেকে তৃষ্ণা মেটালো, খেলো একটা দুটো ভাত, জানালায় দাঁড়িয়ে কারখানাও দেখল। সমীরের চোখ সারাক্ষণ জ্বলজ্বলে করছিল এই হরিণের সৃজনগৌরবে।
দারুণ হরিণটিকে তারেকও উল্টে পাল্টে দেখল। দারুণ হয়েছে রে। তুই তো বিজ্ঞানী হয়ে গেছিস। তবে এর শরীরে চিত্রা হরিণের মতো বুটি থাকলে ভালো হতো। সমীরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,থাক, কী আর করা যাবে। যা পেয়েছিস তা দিয়ে বানিয়েছিস। বেশ বেশ, দারুণ হয়েছে। এটা আবার কাউকে দেখাস না, দেখালে নিয়ে যাবে। আবার এতো বড় একটা জিনিস বানালি, না দেখিয়েও তো পারবি না। দেখ কী করবি।
তারেক উল্টো দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল বটে, কিন্তু যে স্বপ্ন সে সমীরের চোখে মেখে দিয়েছিল তার জ্বলুনিতে কিশোরের চোখের পাতা আর এক হলো না। তাই তো, কথা অতি সত্য। চিত্রা হরিণের মতো ফুটকি কেন থাকবে না এর গায়ে? হরিণটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে সমীরের চোখে এই প্রশ্ন ফুটে উঠলো। ফুটকি থাকলে যে আরো ভালো হতো এটা, এ নিয়ে তো কোনো বোকাও সন্দেহ করবে না। তাহলে আরো নিখুঁত হরিণের মতো দেখাবে এটাকে। পায়ে কোনো ভাঁজ নেই, সেই দুঃখও ভুলে থাকা যাবে! কিন্তু কোথায় মিলবে ফুটকি আঁকার উপায়? হরিণের যান্ত্রিক অবয়বটিকে বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে দেখতে সমীরের চোখে বিষাদ জমা হতে থাকলো। খানিক আগের সন্তোষ তার চাওয়া পাওয়ার বড় ঘরের একটি কোণে এখন বুঝি লুকিয়ে পড়তে চাইলো টেঁসে যাওয়া প্লাস্টিকের বলের মতন। তার চোখের জ্বলজ্বলে আভা এলো কমে। থেকে থেকে ভুরু কুঁচকে উঠতে থাকলো আর কপালে পড়লো ভাঁজ। চোখ দুটি বার বার চলে যেতে থাকলো ছাদে, মণি দুটি ঘন ঘন করতে থাকলো এপাশ-ওপাশ। হঠাৎ সমীর অস্থির হয়ে বসে পড়ল,এরপর আবার পড়ল শুয়ে। তারেকের পিঠের দিকে পিঠ পেতে শুয়ে সমীর বুকের কাছে হরিণটিকে ধরে ঘরের হাঁড়িকুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলো। পাত্রগুলোর রূপালি রঙ থেকে থেকে ঝিকিয়ে উঠছিল জানালার কপাটের চিড় গলে ঘরে ঢুকে পড়া আলোয়।
কয়েকবার পাশ বদল করলো সমীর, তার শ্বাসপ্রশ্বাসের হারও গেল বেড়ে। আর এভাবেই এক পর্যায়ে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার বুকের ওপর ওঠানামা করতে থাকলো রুপালি হরিণ।
পরদিন সকালে বারোয়ারি স্নানঘর থেকে এসে তোয়ালে ছেড়ে পোশাক পরার ফাঁকে তারেককে বললো সমীর, হরিণটির গায়ে ফুটকি আঁকা থাকলে ভালো লাগতো, তুমিও তো বললে। সাদা রঙ এনে দাও না। ওই কলমের কালি ঢেকে দেওয়ার রঙ আছে না? ওগুলো হলো সবচেয়ে ভালো হয়। অফিসে তো আছে মনে হয়। কিন্তু কে আনবে। এনে দিতে পারো? দেখো না।
ভেজা তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে স্নানের পর পরার জামাগুলো বাহুতে পেঁচিয়ে নিচ্ছিল জ্যেষ্ঠ। বললো, তুই রোবট বানালি আর আমিও ভাবলাম বুঝি বড় হয়েছিস। এখন দেখি যা ছিলি তার চেয়েও নেমেছিস। ফুটকি আঁকাতে ব্যস্ত। তারেকের কণ্ঠে উষ্মা। কাপড়গুলো অকারণে আবার হাতবদল করে সমীরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বললো, অফিসে হয়ত আছে, কিন্তু কে আনবে? ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। কারো সঙ্গেই ভালো লাগে না। কাকে বলব? সলিলকে বলতে পারি। কিন্তু সে তো তুইও পারিস। দরজার দিকে এগোনোর পথে পেছন ফিরে বললো, বলে দ্যাখ দেখি? দিতেও পারে। তোর ভাগ্য ভালো থাকলে তারও একটা থাকতে পারে। ঢাকা থেকেই তো এসেছে। যাক।
তারেক বেরোনোর সময় দরজার কাছে এসে মেঝেতে রাখা সাবানদানিটা তুলে নিলো হাতে। তাতে গোলাপি সাবানের গায়ে অনিয়মিত ছোট ছোট বুদবুদ। এরপাশে হেলে আছে শ্যাম্পুর কালো ছোট প্যাকেট, এক কোণ ছেঁড়া। ছেঁড়া অংশ দিয়ে খানিকটা তরল বেরিয়ে এসে সাবানদানির জালকে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের বাইরে একটি জ্বলজ্বলে দিন। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছপালায় আলোর ঝিলিক, সেই সঙ্গে মানুষের সুরেলা আলাপ, কুকুরের ডাক, কাপড় ঝাড়ার শব্দ, কোরান পড়া কণ্ঠের সুরেলা ওঠানামা, শব্দ করে হিসেবগুলো সব নিকেশ করতে থাকা দম্পতির বচসায় রৈ রৈ বাতাস। উঠোনের ওপর এখানে ওখানে রাতের উচ্ছিষ্ট ছড়ানো। সেসব খেতে এসেছে হরেক পাখির দল। দোয়েল আছে, আছে দোয়েলের দূর সম্পর্কিত ভাই শ্যামা, আছে কালো কাক, চড়ুই,দূরে ক্ষেতের কাছাকাছি জোড়ায় জোড়ায় শালিক। স্নানঘরে যাওয়ার পথে একাধিক বিম ছাদের সঙ্গে যে কোণ করেছে, সেখানে সুখের নীড় বেঁধেছে পেটমোটা মাকড়শার দল। জালের ভেতর সবুজ সবুজ পুটুলির সারি, তার ভেতর একটা কেমন যেন নড়া-চড়াও করছে। খানিক দূরে সতর্ক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে কৃশকায় আটপায়ী।
সারি সারি বিষণ্ন দেয়াল, খোলা দরজার ওপারে ক্লিষ্ট মানুষজন পেরিয়ে, মেঝেতে গড়ানো জল ডিঙিয়ে, গাড়িতে বসে প্রাতপুরিষ ত্যাগরত শিশুটিকে এড়িয়ে স্নানঘরে পৌঁছুলো তারেক, ভেতরটা অন্ধকার আর শীতল।
কারখানায় যেতে যেতে সমীরের কণ্ঠে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। ভাই, তুমি বললে রোবট, কিন্তু রোবট তো ওটা এখনো হয়ে ওঠেনি। রোবট করে তুলতে কতক্ষণ। ওই যে বইগুলো নতুন স্যার দিয়েছে, তার ভেতর অনেক কিছু লেখা। কিছুই এখনো বুঝি না যদিও। তোমাকে দেখাব। তুমি না বুঝলে স্যার তো আছেই। আঙুলে বানানো হরিণ বাতাসে খেলিয়ে বললো,ওটাকে আমি নাচাব কেমন দেখো। আর নতুন বুদ্ধি পেয়েছি। সমীরের চোখজোড়া হয়ে উঠলো বড় আর উজ্জ্বল। ওপরে রঙ দেব না। কাগজে ছবি এঁকে জামার মতো পরিয়ে দেব। এমনভাবে, যেন চললে ফিরলেও খসে না পড়ে। পারব না?
তারেক কোনো উত্তর না করে একটিবার শুধু হেসে ওর পিঠ চাপড়ে দিল।
দুপুরে মধ্যবিরতিতে সলিলের সঙ্গে বসল আলাপসভা। সভার সভ্য মোটে দুজন, একজন প্রশ্নকারী, অন্যজন উত্তরদাতা। সলিল বললো,মানুষ যেভাবে হাঁটাচলা করে, সেভাবেই, ওই নীতি মেনেই চলে এসব। শুনে সমীরের পছন্দ হলো না কথাটা। পাল্টা বললো, মানুষকে চালায় তো আত্মা। এসবের ভেতর তো আর মানুষ আত্মা পারে না দিতে। মানুষ তো আত্মা দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে না তাই না?
শুনে ভাবার ভান করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো সলিল। নিচের ঠোঁটটা উল্টে তাকিয়ে থাকলো সমীরের চোখে। দেখে সমীর ঘাড় কাত করে দুলে দুলে হাসতে থাকলো খানিকটা অপ্রকৃতিস্থের মতো। মুখের ভঙ্গিতে বিজয়ীর ছাপ। সলিলের মতো একটা মানুষকে ভাবনায় ফেলে দেওয়ার তৃপ্তি। কথা শুরু করার আগে সলিল একটিবার চা দোকানির দিকে তাকালো, চায়ের কাপ পরিষ্কার করার ফাঁকে তাদের ওপর ঘন ঘন চোখ বোলাচ্ছে চাওয়ালা। মুখে আলোচনার শোনার জন্যে পর্যাপ্ত গাম্ভীর্য। নাকের নিচে কালোয় সাদায় মেশানো পুরু গোঁফ, মাথার চুল পেছন দিকে আঁচড়ানো। তামাটে কপালটা তেল চকচকে আর গোঁফের আড়ালে থেকে থেকে একটা চাতুরি মাখা হাসির ভঙ্গি তরঙ্গ খেলিয়ে যাচ্ছে। তবে এটির ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলেও মনে হচ্ছে না। লোকটির গলায় একটা বড় তাবিজ মোটা কালো সুতোয় বাঁধা। যখন ঝুঁকছে তখন এদিক ওদিক দুলছে রূপালি তাবিজ। এদিক ওদিক দোল খাওয়ায় দুপাশের মোমগালা অংশ দুটিও হলো বেশ দৃশ্যমান। একটা নিসিন্দা গাছ তার দোকানের ওপর ছায়া বিস্তার করে আছে। গাছের ছায়া পাতাজাল রচনা করেছে লাল ধুলোয় ঢাকা মনময়পুরী মাটিতে। থেকে থেকে ছোট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সঙ্গে সরব সাইকেলের শেকল টানার মতো শব্দ একটানা করে চলা ঝিঁঝিঁরা। মৃদুমন্দ বাতাসে চায়ে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে চলেছে দুজন।
অবশেষে মেরুদা সোজা করে বেঞ্চিতে বসলো সলিল, তাকালো সমীরের দিকে। সমীরের ঈষৎ লালাভ চোখ কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে চোখবদল করতে থাকলো একবার সলিলের চোখে, আরবার ঠোঁটে; এদিকেসলিলের ঠোঁট নড়ে আর আর সমীরেরও ঘটতে থাকে দৃষ্টিবদল। প্রথম প্রথম পায়ের নখে মাটি খুঁড়লেও ধীরে খোঁড়া বন্ধ হয়ে গেল।
সলিল বললো, আসলে আত্মা ব্যাপারটা কী বলতো? মানুষ যখন মারা যায়, তখন তো তার এইসব অঙ্গপ্রতঙ্গ থাকে, কিন্তু সে নড়তে চড়তে কেন পারে না? মানুষের ভেতরে যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলো ক্রমে নষ্ট হতে থাকলে কেন মানুষ অথর্ব হয়ে বিছানায় পড়ে যায়? আগের কথা আসি, মন দিয়ে শোনো। মানুষ যখন স্বাভাবিকভাবে মারা যায়, তখন কী হয় তার ভেতর সেটা আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। হৃদপিণ্ডটা শক্তি হারাতে থাকে, লক্ষ কোটিবার ধুকপুক ধুকপুক করতে করতে এক পর্যায়ে সে শক্তি হারায়। তোমার হৃদপিণ্ড এখন যেভাবে চলছে, একইভাবে কি চলছে এই কারখানার যে কয়েকজন বুড়ো মালিক আছেন তাদেরটাও? উঁহু!
এ কথায় সমীরের কিশোর মন বেশ একটা আমোদ পেল, চঞ্চল চোখ জোড়ায় ফুটল তার আভাস।
অনেক দিন ধরে ধুকপুক করতে করতে এখন তাদের হৃদপিণ্ডের শক্তি কমে এসেছে। ওটা আর আগের মতো ছোট ছোট শিরা-উপশিরা দিয়ে রক্ত, মানে খাবার পৌঁছে দিতে পারছে না। তাই তারা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে এসেছে, তাদের চামড়া কেমন কুঁচকে এসেছে, ঝুলে পড়েছে, দেখ না? আর তোমার কেমন টানটান। কেন? কারণ তোমার চামড়ার লক্ষ কোটি কোষগুলো ঠিকমতো পুষ্টি পাচ্ছে। তাই তুমি চট করে বুড়ো হয়ে যাচ্ছ না। তুমিও একদিন বুড়ো হবে, যখন ব্যবহার হতে একসময় একসময় তোমার কলকব্জাগুলোর ক্ষমতা কমে যাবে। মানুষ তখনই মরে যখন তার হৃদপিণ্ড আর এসব কলকব্জাকে টানার মতো খাবার দিতে পারে না। মগজে রক্ত পাঠানোর মতো শক্তি তার থাকে না। মরণের সময় সবার আগে কানে শোনার ক্ষমতা চলে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে সব কলকব্জা যখন শক্তি হারায়, তখন কী হয়? তখন আসলে সব মিলে কাজ করছিল, সেই কাজটা বাধা পায়। এর মানে, এই কলকব্জাগুলোর যে সাজ, যে নকশা, ওগুলো নষ্ট যায়। নষ্ট হয়ে যায় বলে, মানুষটা আ-স্তে শেষ হয়ে যায়। একটা ট্রান্সফর্মার যেভাবে একদিন যায় টেঁসে। অনেক মানুষ যে দুর্ঘটনায় মারা যায়, তাদের ক্ষেত্র কী হয় কখনো ভেবেছ? ধরো, একটা লোক বুকে ব্যথা পেয়ে মারা গেল, বুকে সে এমন চোট পেল যে বুকের কটা হাড় ভেঙে গেল। ভেঙে গিয়ে ধরো একটা একেবারে গিয়ে বিঁধলো হৃদপিণ্ডে, দিলো হৃদপিণ্ডটাকে নষ্ট করে। তখন তড়পাতে তড়পাতে সে কেন মারা গেল? তার এদিকে হাত পা চোখ কান, মগজ, যকৃত, বৃক্ক সবই তো ঠিক আছে? এরপরও কেন সে মরে গেল বলো? কারণটা সহজ! তার শরীরের বিশেষ সজ্জাটা, সুন্দর সজ্জাটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটা ট্রান্সফর্মারে সব দিয়েচালানোর পর এরপর আবার নামিয়ে কোর থেকে তারগুলো খুলে নিয়ে আবার চালালে যেমন সেটা চলবে না, তেমনই এই লোকটিও আর চলবে না, ফিরবে না কথা বলবে না। কিন্তু ট্রান্সফর্মারটাকে যদি আবার নামিয়ে কোরে তার পেঁচিয়ে আবার ঠিকমতো তুলে দেওয়া যায়, সে আবার তো চলবে! তেমনই ওই লোকটিকে যদি তখনই হাসপাতালে নিয়ে তার হাড়গুলো ঠিক করে দিয়ে একটা ভালো হৃদপিণ্ড বসিয়ে দেওয়া যায় সে দিব্যি বাঁচবে। অনেকের বৃক্ক নষ্ট হয়ে যায়, তারা মারা যায়, কিন্তু ডাক্তাররা অস্ত্রোপচার করে আর কারও বৃক্ক নিয়ে ওখানে লাগিয়ে দেয়, তখন সে আর মরে না। এমন তো আমার প্রতিনিয়তই দেখি। কী—দেখি না? পুরো ব্যাপারটা ওরকম। আসলে আত্মা হলো একটা শরীরের সব কলকব্জার সর্বোত্তম সজ্জা, তা সেই সজ্জা মানুষেরই হোক, আর রোবটেরই। মানুষ একসময় অনেক মূর্তি বানিয়েছে, কিন্তু তার ভেতর সর্বোত্তম সজ্জা দিতে পারে নাই, তখন সেই মূর্তি আর নড়াচড়াও করে নাই। এই যে দেবদেবীর মূর্তি, এরা কি নড়তে চড়তে পারে? পারে না কেন, কারণ ওসবের ভেতর পোরা থাকে খড়। কিন্তু এই যে রোবট, এটাও কিন্তু একটা মূর্তি। কিন্তু এটা দেখ হাঁটছে, একটা পানির মগ তুলে নিচ্ছে, চেয়ার টানছে, কেন? কারণ এর ভেতর খড় ভরে দেওয়া না, অনেক জটিল যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা উত্তম সজ্জা তৈরি করে দেওয়া। এই সজ্জা যখন আরও ভালো করে তৈরি করা যাবে, তখন আরও ভালো মানুষের মতো রোবট বানানো যাবে। একসময় মানুষ এমন রোবট বানাতে পারবে বলে মনে হচ্ছে যখন সে মানুষ না রোবট তার আর বাহির থেকে দেখে চেনা যাবে না। মানুষ এটা ভেবে খুব ভয় পাচ্ছে।
সমীরের ঝিকমিকে কিশোর চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেল। মানুষের ওই ভয় বুঝি সঞ্চারিত হলো তার ভেতর। তার কল্পনাপ্রবণ মন ভেবে তটস্থ হয়ে পড়ল, সত্যিই তো, যদি মানুষ আর রোবট চেনা না যায়, তাহলে তো মানুষ ভীষণ ধোঁকা খাবে!
যখন কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে রক্তের বদলে ধোঁয়া, লতানো প্যাঁচানো তার-টার বেরিয়ে পড়বে তখনই শুধু বোঝা যাবে, আরে, এটা তো মানুষ ছিল না!একটা রোবট!
সমীর না হেসে পারল না সলিলের কথায়। সলিল বলে গেল, তো, রোবটের জন্য এই সজ্জাটা বানাতে অনেক পড়াশোনা মানুষেরা অনেক খেটেছে। বহু খাটাখাটুনির পরই তারা গবেষণা করে এরকম এক জিনিষ বানাতে পেরেছে।
সলিল দুহাত নেড়ে আদকা বলে উঠলো বললো, আমি পারব না বাবা, আমাকে দিয়ে হবে না!
নিশ্চয়ই পারবে! ওই বিজ্ঞানীদের মাথায় যে মগজ আছে, তোমার মাথায়ও ততটুকু মগজ আছে। যদি মন দিয়ে পড়াশোনা করো, বিজ্ঞান পড়, পরীক্ষায় পাসের জন্য না, জানার জন্য পড়, তাহলে চেষ্টা চেষ্টা করতে তুমি একদিন ওদের চেয়েও আরও দারুণ রোবট বানাতে পারবে!
আশায়, স্বপ্নে সমীরের চোখের মনি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কিন্তু মনির ওই ঔজ্জ্বল্য সলিলকে দেখাতে চাইলো না সমীর। মুখটা প্রথমে নিলো ফিরিয়ে, এরপর এদিক ওদিক ঘুরে এসে আরেকবার সলিলের চোখ কেটে নেমে এসে দেখতে থাকলো পা জোড়া। ঠিক এই সময়ে বেজে উঠলো কারখানার বাঁশি। চারপাশে সবাই যখন খাওয়া গপ্পো সেরে দ্রুত কারখানার দিকে পা চালালো, যারা সিগারেট ফুঁকছিল, আধফোঁকা সিগারেট সেভাবে জুতোয় মাড়িয়ে কারখানার দিকে ছুটল,তখন তাদের সেই অস্থিরতা সমীর-সলিল দুজনকেও আক্রান্ত করলো। সমীর ঘন ঘন পা বদল করতে থাকলো অস্থিরতায়।
তো কথাটি এই। সলিল শেষ করে এনেছে। তুমি এটা ওটা দিয়ে যে বিভিন্ন ভাস্কর্য বানাও, এগুলো ভাস্কর্যই থাকে। এগুলো আলাদা শিল্প, দেখতে ভারি সুন্দর, সে ব্যাপারে বলছি না। তবে এগুলো শেষমেষ পুতুল। তাই নড়ে চড়ে না। এগুলোতে আত্মা দিতে হবে। এর মানেটা কী।
এ পর্যায়ে সমীর বোকার মতো চেয়েই রইল শুধু। সলিল তাতে হতাশ হলো না। হাত নেড়ে না বোঝার জড় ভূতটাকে যেন সরিয়ে দিতে চাইল ত্বরিৎ। এর মানে হলো, তোমাকে ওই পুতুলের ভেতর আত্মা দিতে হবে। কী, ভয় পেয়ে গেলে? মানে ওই পুতুলের ভেতরে সর্বোত্তম সজ্জা দিতে হবে। আজ আর না, যাও যাও ছেলে। আমি আরেকটু পর আসছি। আর তোমার জন্য আরেকটা বই আছে আমার কাছে, আমার আর অল্প পড়া বাকি আছে। কারখানা ছুটি হলো এসো, নিয়ে যেও, কেমন তো স্যার?
বাড়িতে ফিরে স্নানাহার সেরে দরজার ছিটকিনি লাগাতে গিয়ে না-লাগিয়ে ফিরে এলো সমীর। এরপর বই আর একটা খাপহীন নীল কালির কলমনিয়ে আলোর দিক মেপে বসল। বইয়ের অক্ষরগুলোয় আগে যেন ঘুম পোরা থাকলেও এখন বুঝি পুর বদলে গেছে। সমীরের মুখচোখ বইয়ের পাতার আয়নায় যতোই দৃষ্ট হতে থাকলো ততোই ঝলমল করে উঠলো। মনে মনে পড়া এগিয়ে নিতে নিতে কখনো সে ঝুঁকে একেবারে নিচু হয়ে পড়ল, একবার পড়ল শুয়ে, পরক্ষণেই তড়াক করে উঠে বসল, একেকবার বাক্যগুলোর নিচে লাইন টানার সময় অজান্তেই দুটি ঠোঁটের মধ্যে চাপা পড়ল লাল জিভ। ভেজানো দরজা দিয়ে কখন ঘরে এসে ঢুকল তারেক, সমীর তা টেরও পেলো না। ছোটনকে এমন মগ্ন দেখে তার মনোযোগটিও আর ভাঙাতে সে চায়নি।ঘরের কোণে তাকিয়ে দেখল কালো আর রুপালির মিশ্র রঙা ধাতব পাত্রে ছোট করে দিব্যি একজনের হয় মতন ভাত আর তরকারি বাকি পড়ে আছে। মুখহাত ধুয়ে এসে তারেক কড়াইয়ে ভাত নিয়ে বসে পড়ল। ততোক্ষণে সমীর তাকে খেয়াল করেছে বলে জানান দিলো হাত আর চোখের ইশারায়।
এভাবেই বেশ অনেকটাসময় কেটে যাওয়ার পর সমীর শেষবার স্নানঘর হয়ে এসে বিছানা নিলো। আর তারেক দিনের শেষ সিগারেট ধরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ঘরের করিডোর বারান্দায়। কোমর সমান কিনারবন্ধন, এর ওপর একটি রেখে তাতে শরীরের ভর দিয়ে দাঁড়াল তারেক। সিগারেট প্রেমিকা প্রতিপন্ন করে সামনের বাড়িগুলোর ছাদের ওপর দিয়ে তাকাল গাছপালা জংলাটির দিকে। দূরের কারখানা থেকে আসা নীলচে সাদা আলো ওই জংলার মাথায় পড়েছে। এছাড়া এ ঘরের চৌকো উঠোনের কোণে একটি বাঁশদণ্ডের গায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে বিদ্যুতের তার, তারই কাছ থেকে পুষ্টি নিয়ে একটা হলুদ বাল্বও জ্বলছিল। ছোট এক সূর্যের মতো ভারি ঔদ্ধত্য তার, জোর দেখিয়ে চলেছিল পতঙ্গগুলোর সঙ্গে। সিগারেটের ধোঁয়া মেঘের মতো দলা পাকিয়ে ক্রমে হালকা হয়ে মিলিয়ে গেল। সশব্দে হিসেব নিকেশ চালানো দম্পতির ঘর থেকে নারী কণ্ঠ ধরে ভেসে এলোঅসন্তোষ। বিড়ি না খেলে তা ভাত হজম হয় না! গন্ধে কেমন লাগে মানুষের তা ভাবেও না একবার! ঘুমটা ভেঙে দিলো, এখন?
সিগারেট নিভিয়ে ফিল্টারটিকে এক টোকায় দূরে পাঠিয়ে স্নানঘরের দিকে চলে গেল তারেক। দ্রুত ফিরে এসে দরজা দিয়ে পোশাক ছেড়ে বিছানার দিকে এগোল। সমীর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিল, কোনো শোথ নেই। তোষকের বাইরে গড়াতে থাকা সিংহভাগ কাঁথার এক কোণ ধরে তারেক ওটা তুলে দিলো বিছানায়,এরপর নিজেও বিছানায় উঠে বসে ছোটনকে ঠেলে ঠুলে শুয়ে পড়ল পাশে। কালো টিনের ঢেউগুলোতে তখন বাইরের আলো প্রতিনিয়ত কেমন তরঙ্গিত সব রহস্য তৈরি করছিল। চোখের মণি দুটো তার গন্তব্য মেপে ঘুরল কেবল এদিক সেদিক।
হঠাৎ খুট্ করে ছোট এক শব্দ পেয়ে মুখ তুলে তাকাল দরজার দিকে। জানালাটা কি শোয়ার আগে বন্ধ করা হয়নি? বাতাসে একটি কপাট সরে আসায় দেখা গেল, ছিটকিনিটা নেমে বেকার হয়ে আছে, মেঝেতে ধীরে অর্ধবৃত্তাকারে স্থানবদল করছেকপাটের ছায়া।তারেক চোখে ভয় নিয়ে একবার দরজা আরবার জানালার দিকে তাকিয়ে শব্দের উৎসটা খুঁজে বেড়াতে থাকলো।
হঠাৎ দেখা গেল জানালার ঠিক পাশে অন্ধকারে একটি অবয়ব নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে। দেখবার পর মুহূর্তেই সে নড়ে উঠে ধীরে এগিয়ে এলো। ওদিকে খোলা জানালাপথে কারখানার নীলচে সাদা আলো তীর্যকভাবে ঘরে ঢুকে পড়ছিল, সে আলো আড়াআড়ি পেরিয়ে গেল নারী অবয়ব। দেখে তারেক অস্ফূটে উচ্চারণ করলো—মা।নারী অবয়বটি ধীর পায়ে বিছানার অংশ পেরিয়ে চলে গেল ঘরের কোণে। বিনা প্ররোচনায় স্টোভ জ্বলে উঠলো এবার। মা খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়াল জ্বলন্ত তেপায়া চুলোর সামনে। তার কালো স্ফীত চুল আপসেআগুনের ওপর ঝুলে পড়ল। তারেক হাত বাড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকাল সেদিকে, কোনো স্বর বেরোল না। এ সময় ঠিক পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে তাকাতেই দেখতে পেল মধ্যবয়েসী একটি লোক শুয়ে আছে। বাহুতে আর পায়ে ত্বক থেঁৎলে গেছে লাঠির ঘায়ে। মাথার চুলগুলো ভেজা ভেজা, সান্দ্র তরলের সরু রেখা কানের পাশ গড়িয়ে পড়ল বিছানার ওপর। মুখ ধীরে তারেকের দিকে ফিরিয়ে লোকটা কিছু বলতে চাইলো, পারল না।মায়ের চুলের সরু ডগাগুলো কুঁকড়ে ওপরে উঠে যেতে থাকলো উত্তাপে। পুড়তে ভীষণআগ্রহী আঁচলটাও খসে পড়ল চুলোর ওপর, আর মুহূর্তে তাতে আগুন ধরে গেল। আড়ালে বেজেই চলল শান্ত রাতের স্বর। নিঃশব্দ দহনযজ্ঞসহ সব যেন ধীরে বাতাসেমিলিয়ে গেল, বন্ধ হলো জানালা।
চোখের জলের একটি হিসেবি ফোঁটা তারেকের বালিশে এসে পড়ল। অকালে কড়া পড়া আঙুলগুলো থেকে কোমল প্রচ্ছদের বইটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাকলো সমীরের বুকের ওপর।
চলবে…