॥এগার॥
পায়ে ফিতে ভেতরে গোঁজা পুরনো সাদা কেডস, দুপাশে নীলের নকশা। গ্যাবার্ডিনের মলিন ধূসর প্যান্টের কোমরে গোঁজা আকাশরঙা সুতির শার্ট। বুকপকেটে সিগারেটের প্যাকেট। গলায় মাফলার জড়ানো, তাতে বর্গাকৃতির নকশা। দুচোখের কোণে ভাঁজগুলো স্পষ্ট; কোনো গোপন দুঃখে বুঝি কাঁদছে। আর ওই কান্নাকে সমীকৃত করতে হাসছে তার আধগোলাপি ঠোঁট। নিচের ঠোঁটের ঠিক মাঝখানটা সিগারেটের আঁচে কালো।দাঁতের সারি কিছুটা হলুদাভ। মুখের হাসির দিব্যি প্রতিফলন রয়েছে চোখে। উজ্জ্বল সেই চোখজোড়ায় কদিন আগের প্রচ্ছন্ন সেই তাচ্ছিল্যটি অনুপস্থিত।
দুজনার মূর্তিই যার যার চোখে এবং মনে পুরোপুরি মূর্ত হয়ে উঠতে কিছুটা সময় হয়ত ব্যয় হলো। বড় করে একটিবার শ্বাস নিয়ে সলিলই প্রথম বলে উঠল, আরে, তারেক যে!
কণ্ঠ অনুচ্চ হলেও আন্তরিক উচ্ছ্বসিত ভাবটি চাপা থাকল না। সবুজাভ কালো ঘাসের ওপর মৃদু চাপড় দিয়ে মুখ তুলে আহ্বান করল সলিল। বসুন না। হাত দুটোর ওপর থেকে শরীরের ভর সরিয়ে নিলো এরপর, ওদের জায়গা হলো নৌকার খোলের মতো কোলের ওপর। আরও খানিকটা সরে ভালো ঘাসে তারেকের বসার জায়গাটি বাড়িয়ে দিলো সলিল। তারপর? বলুন, কী খবর আপনার।
সলিলের কাছ মেপে খানিক দূরত্ব রেখে বসল তারেক। শরীরের ভাষায় জড়তা, হাত-পা ছড়ানোর ভেতর সাবলীলতা নেই। ঘামে ভেজা প্যান্ট হাঁটুর সঙ্গে সেঁটে থাকায় চিমটে তুলে বাতাস খেলালো কয়েকবার। সলিল লক্ষ করছে কিনা, বিব্রত মুখে সেটিও একবার দেখে নিলো। তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরও খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে উঠল তারেক। অস্বস্তিতে ঠোঁটজোড়া আগেই ছিল খানিকটা বেঁকে, এবার নিজের ওপর ব্যাখ্যার অতীত রাগে ভুরুজোড়াও হয়ে উঠল চাবুক। চোয়াল হলো শক্ত। বসতে গিয়ে পিঠে পড়ল টান। এ অবস্থায় শার্টের গোঁজ টেনে তুলে ফেলা ছাড়া আর উপায় কী। আসন পেতে সলিলের দিকে মুখ কোণ করে বসল তারেক। এভাবে বসার অভ্যেস যাদের নেই, তারেককে দেখে মনে হলো সে তাদেরই দলে। মনে হতে থাকল বুঝি এখনই সে উঠে যাবে অথবা ওঠার সময় এসেছে বুঝতে পারামাত্র আর মুহূর্তকালও দেরি করবে না।
আমার নাম মনে রেখেছেন আপনি স্যার। কথাটা হাসিমুখে বলা হলেও স্যার শব্দটি বলার আগে সেকেন্ড খানেকের মগ্ন বিরতি কান এড়ানোর মতো ছিল না। যেন নিজেকে তৈরি করা হলো প্রথমে, এরপর বলা হলো শব্দটি এবং না বলতে পারলেই ছিল বাঁচোয়া।চোখের নিচটা এমনভাবে কেঁপে উঠল যে, স্যার শব্দের প্রতি সূক্ষ্ণ ঘৃণাটুকু তার চাপা থাকল না। কথায় মনময়পুরের মৃদু টান।
ওদিকে বলার অনুষঙ্গ তৈরি হওয়ায় চোখ থেকে শুরু হয়ে কাঁধজোড়াও বুঝিউৎফুল্ল হয়ে উঠল সলিলের। আমি এখানে আছি আজ কদিন, সপ্তাহ দুয়েক তো হতে চলল, কী বলেন। এর মধ্যে আপনার নাম আমার কানে তো আর কম বার আসেনি। আর শুধু নামই বা কেন। ছোট খাটো আরও বেশ কিছু ব্যাপার আমি জানি, আপনার বিষয়ে।
হাসির জবাব হাসিতেই দিল তারেক। কণ্ঠে কৌতূহল নিয়ে সেও প্রশ্ন ছুড়ল,যেমন? কথার সরল স্রোতে তখন ওর বাঁকা শরীর অনেকটাই সোজা হয়ে এলো। কথা আর অঙ্গ সঞ্চালনেও ক্রমে ফুটে উঠতে থাকল দিব্যি স্বতঃস্ফূর্তভাব। আমুদে মুখচোখ। চারপাশে আলোর স্বল্পতা তখন চোখে পীড়া দেওয়ার মতো স্তরে নেমে চলেছে। তবে বাতাসটি বইছে বেশ আলাপবান্ধব। চারদিকে সবুজ অন্ধকারের দেয়াল রেখে মধ্যখানে ক্ষেতের আলে বসে থাকা দুজন যেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সহজ স্বতঃস্ফূর্ত সঞ্চালনে তারেকের হাতটি হঠাৎ চলে গেল বুকপকেটে, যেখানে স্ফীত হয়ে আছে সিগারেটের প্যাকেট। পরমুহূর্তে সরেও এলো তা। দৃশ্যটা চোখ এড়ালো না সলিলের। শান্ত কণ্ঠে বলল, অসুবিধা কী? আমরা তো বন্ধুই। নই?
তারেক অপ্রস্তুত। হাসল মৃদু শব্দে। সন্ধ্যার আলো এবং আঁধারের মধ্যবর্তী নন্দনটুকু তখন বাতাসের কণায় কণায় ভর করেছে। সলিল তারেকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের আশায়। মুখে কোনো কথা যেমন নেই, তেমনই নেই একটি শলাকা নেওয়ারও কোনো লক্ষণ। সলিল চোখ সরিয়ে নিলো দূরের মাঠে, বনের রেখা ওখানে দিগন্তের ভূমিকায় স্থির।
আমার সঙ্গে এতখানি বিনয় দেখালেন। খুব বিব্রত হলাম তারেক। আজকের পর থেকে আর কোনোদিন এমন বিপাকে ফেলবেন না দয়া করে। আর বনের রেখার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে এনে আবার তারেকে নিবদ্ধ হলো; আমাকে স্যার নয়, ভাই বলতে পারেন। আমিও তাই বলব। ওই স্যার শব্দটায় এক প্রভুত্বের গন্ধ আছে। খুব অপছন্দ আমার।
খানিক আগের সহজ তারেক আবার ফিরে এলো আর বাতাসও হয়ে উঠল চঞ্চল।তারেক নিচু অথচ পরিষ্কার কণ্ঠে কথা বলে উঠল, অনেকেই এসব খুব মানে এখানে। তাই আর কি, মৃদু হেসে; এসব নিয়ে একটু ভাবনায় থাকি। অনেক সময় তো—অসমাপ্ত কথাটিকে এক চাপড়ে উড়িয়ে দিলো যেন, যাক। ঠিকাছে। তাহলে একটা ধরানোই যাক। আপনি আমার কথা বলছিলেন বড় ভাই। আরও কিছু ব্যাপার জানেন বলে বলছিলেন। খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সলিল তখনো কথা শুরু করেনি। তারেক সিগারেটের প্যাকেটটি বের করে একটা শলাকা তুলে নিলো। তাতে আগুন ধরার পর বুকের ছোট ঘর থেকে বিশাল পৃথিবীতে আসা ধোঁয়াগুলো একটা সরু সরলরেখা তৈরি করে কিছুদূর এগিয়ে গেল। নীলচে ধূসর ধুলোর মেঘের মতো পাক খেতে অন্ধকারে খেতে মিশে গেল—যেন ভানুমতির রুমাল।
আপনি তো বেশ কর্মী, সলিল বলে চলল, আমি যেদিন প্রথম এসেছি এখানে, সেদিনই দেখেছি। সবাই শেষ করে চলে যাওয়ার পরও আপনি দিব্যি কাজ করছেন। আপনার চোখ মুখে অন্য একটা আলো ছিল, যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল, তখন মনে হয়েছে। সে আলো আমি পরেও আরো দেখেছি। আর দেখি কিংবা না দেখি, আপনার কাজে তো আপনি অটল ছিলেন, অনেক প্রমাণ আছে তার। দিনের পর দিন—আচ্ছা, একটা প্রশ্ন, এর জন্য অফিস কোনো মাসোহারা দেয়?
নাহ, তারেক নিঃশব্দে হাসল। অফিস তো আমাকে বলেনি বাঁধা সময়ের পরও কাজ করতে। আমি নিজ থেকে করি। যদিও এতে ওদেরও কাজ এগোয়, কিন্তু এ নিয়ে আর ভাবিনি খুব একটা। কী দরকার। জীবনে কত কিছুই তো করলাম বিনিময় ছাড়াই। আর এখানে তো ওই কাজটুকু আমার কাছে একটা আশ্রয়ের মতো। উল্টো আমার কাছেই মাসোহারা চেয়ে বসলে অবাক হব না, হাহা!
বাতাসে তার চুলের পাট গেল বদলে। ঘাসের ভেতর একটা রঙিন পালক খুঁজে পেয়েছিল তারেক, সেটাই চোখের সামনে ধরে এদিক-ওদিক ঘোরালো কয়েক বার। আঙুল তুলে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টোকা দিয়ে ফেলে দিলো দূরে।নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বলল, আমার কাজের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে ভাই। ওই পরিমাণ কাজ যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ পিঠ হাল ছাড়ি না। এ-কভাবে লেগে থাকি। নিচের ঠোঁট উল্টো একবার ওপর-নিচ দোলালো মাথাটা। এরপর চোখ দুটো বড় করে সলিলের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু, কিন্তু মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম ঘটে যায়। সেদিন কাজ শেষ না হলেও চলে আসি।
সলিল হেসে বলল, যেমন আজ। কী—ঠিক বলেছি?
শব্দ করে হেসে উঠল দুজনই। আলোর শেষ মুকুটটিও বুঝি খসে পড়ল তখন। দূরে কারখানার রাস্তায় সার দেওয়া দোকানগুলোয় জ্বলে উঠল নীল-সাদা আলো। মাঠে নাড়ার সমুদ্র চারদিকে রেখে আলের ওপর বসে থাকল দুজন, নিশ্চুপ। খানিক উত্তর-পশ্চিমে ঝুরি পুষ্ট হয়ে ওঠা এক বয়েসী বট। তার নিচে বিষয়ের বিষ নির্ণয়ী সেই বৃদ্ধ একটা ছেড়া মাদুর পশ্চিমে বিছিয়ে সান্ধ্য প্রার্থনা শেষ করল। থুতনিতে দোল খাওয়া খয়েরি দাড়ির গোড়া একবার নখে আঁচড়ে মাদুরটা গুটিয়ে কাঁধের নোংরা ঝোলায় ভরল লোকটা। মাথায় তার টুপি ছিল না। কপালেও ওপর চলে আসা চুলগুলো পেছন দিকে একবার চাপিয়ে বটের ছাদে চোখ রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। সেখানে জমাট অন্ধকারে কী দেখল, সেই শুধু জানে। যেন সেখান থেকেই কোনো সংকেত পেয়েছে, এমনভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তরুণ দুজনের দিকে তাকালো করুণার চোখে। ঠোঁটে একটা অবজ্ঞার হাসি চাপিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে উঠে এলো সোজা পশ্চিম দিকগামী পায়ে চলা পথে।খসে পড়া শুকনো পাতা, বেওয়ারিশ পলিথিন কারখানার আলোর ছিন্ন টুকরাংশ সন্ধ্যার সেই আত্মার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করল। বাতাসে উড়ছিল গাঢ় খয়েরি রঙা দীর্ঘ ফতুয়ার ঝুল। সরু পায়ের আকৃতি স্পষ্ট করে দিয়ে বাতাসের চাপে সেঁটে ছিল পরনের লুঙি। বাতাসের বেগ ঠেলে এগোতে বেশ বেগ পেতে হলো বুড়োকে।
বহুক্ষণ আগে ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নটা কুড়িয়ে নিয়ে তাকে উত্তরে মেলাল তারেক। ঠিক ধরেছেন। আজই হয়েছে এমন।
যেন আরও কিছু বলবে—এমনভাবে মুখ খানিকটা ফাঁক করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল তারেক। কিন্তু বলল না কিছুই। ধীরে নক্ষত্র তার বিমূর্ত ভাবের মধ্যে পশে দিলো ভাষা। আরেকটা কথা বলি আপনাকে ভাই। আসলে কাজের পরিমাণের কথা বললাম না? ওখানে আরেকটু কথা যেন আছে, বলা দরকার। এই পরিমাণটার হিসেব আরও খানিকটা দেওয়ার অবকাশ আছে। আমি আমার একদিনের কাজের পরিমাণটাকে পরদিন ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করি। মানে একদিন যা কাজ করি, খুব চেষ্টা থাকে, খুবই চেষ্টা থাকে, পরদিন তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। সবসময় পারি না। কিন্তু মাঝে মাঝে পারি। সেদিন আমি রাজা! তারেক হাসল। রাজাদের তো আবার ঘুম নেই। আমার কিন্তু তা নয়। সেদিন আমার সবচেয়ে ভালো ঘুমটা হয় ধরুন। খুব শান্তি পাই। ভীষণ শান্তিতে ঘুমাই।
একবিন্দু পরিমাণ আলোও যতক্ষণ থাকবে, ছেলেদের পণ ছিল, ততক্ষণ তারা মাঠ ছাড়ার নাম করবে না। অবশেষে ওদের পণ ভাঙার সময় চলে এলো।সামনে খেলতে থাকা ছেলেদের অপর দলটা বৃত্তে আটকা পড়েছিল অনেক আগেই। সব দিক থেকে এবার যুদ্ধে সন্ধি করার সময় এসে গেল। সরঞ্জাম সব গুছিয়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ করল ওরা। আলোকচিত্রীটি আরও অনেক আগেই উধাও হয়েছে।
ধানের নাড়াগুলোর শক্ত অবয়ব অন্ধকারে নিয়েছে বেশ সাদাসিধে কোমল রূপ। দেখে মনে হতে পারে উর্বর কালো মাটির ওপর এক বিঘত ঘাস বুঝি গজিয়েছে, স্বাস্থ্যে ঝলমল। পেছনে মেহগনির কৃত্রিম অরণ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা এসে বসছিল তখনো। আরও পশ্চিমের কুঁড়েঘরগুলোর কোনও কোনওটিতে মাটির চুলো জ্বালানো হয়েছিল সবে। পরের বেলার খাবারের যোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেল বুঝি। বাড়িগুলোর রান্নাঘর থেকে লাকড়ির ধোঁয়া ছাদের জানালা পথে ক্রমে ষড়যন্ত্রের মতো দলা পাকিয়ে উঠে এলো।
তা আজ চলে এলেন কেন? রাতের ঘুম নষ্ট করার ঝুঁকিটা কেন আপনাকে নিতেই হলো? প্রশ্ন সলিলের।
আপনাকে একা বেরোতে দেখে আর লোভ সামলাতে পারিনি, সত্য কথা।মনে হচ্ছিল আপনি বুঝি অনেক কিছু জানেন। আপনার কাছে এলে কিছুও যদি জানতে পারি মন্দ কী। এই ভেবে এসেছিলাম। এসে বুঝলাম ভালোই করেছি।
তাই বুঝি! একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন? নিজ হাত শরীরে বোলালে কিন্তু শিহরণ জাগে না। শিহরণ জাগাতেঅন্য কারো হাতের প্রয়োজন পড়ে। আপনার কথা শুনে কিন্তু বেশ লাগছে আমার। সুতরাং বলে যান দাদাভাই—আমি শুনছি। কেন মনে হচ্ছে ভালো করেছেন, বলুন।
এই যে, আপনার সঙ্গে আলাপ না হলে বুঝতেই পারতাম না আপনি মানুষ এমন। অবশ্য আমি আগেও বেশ কটা ব্যাপার দেখে আঁচ করেছিলাম। কিন্তু আঁচ করা আর সত্যিই বুঝতে পারার মধ্যেপার্থক্য অনেক।
যেমন? সলিলের কণ্ঠে আমোদ। পরমুহূর্তে হঠাৎ যেন প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলো, যেন এখন শুনতে চাইছে না আর, এমন ভাবে ঠেলে দিলো একটি মন্তব্য, সঙ্গে একটি প্রশ্নও। আপনি কিন্তু বেশ গুছিয়ে কথা বলেন তারেক। কোথায় বড় হয়েছেন আপনি?
তারেক হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। বাতাসে অন্য এক প্রসঙ্গের শিমুল ফুল উড়ছিল তখন। মধ্যখানের ফাঁকটা ভরাতে ওটাকেই লাগাল কাজে।খুব সাবধানে খুললো মুঠো।আপনি বোধয় জানেন না, সমীর আমার ভাই।
সলিল খুব অবাক হয়ে তাকাল। তাই নাকি! দারুণ ব্যাপার! খুব ভালো ছেলে সমীর।
তারেকের হাতে পাখির ছিন্ন পালক। ওটা ছুড়ে ফেলে দিয়েকটা ঘাস ছিঁড়ে নিলো আনমনে। মুহূর্তে হয়ে উঠলসচেতন। আহ্হা, ঠিক হলো না। অনুতপ্ত স্বগোতোক্তি।
কী ঠিক হলো না।
ঘাস ছিঁড়েছি।
মাটির খানিকটা নখে খুঁড়ে ওখানে ফের ঘাসের গোড়াটা পুঁতে দিতে চাইল তারেক। সেদিকে তাকিয়েসলিল বলল, আজ আগেই শেষ করেছেন—ব্যাপারটা এক দিক থেকে কিন্তু ভালো হয়েছে। কাল এটাকে টেক্কা দেওয়া হয়ত সহজ হবে আপনার, কী বলেন।অবশ্য আপনি তো আর আমি নন। সহজ হবে এমন বলাটা আমার ঠিক হয়নি। আপনি একটা অভ্যাস গড়ে তুলেছেন। অভ্যাস মানুষকে ঈশ্বর বানায়, আবার শয়তানও বানায়। আপনি নিশ্চয়ই ঈশ্বর হয়েছেন।
শেষ কথা কটা তারেক ভ্রূকুটির সঙ্গে নিলো। সলিল একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল তাতে। কথা টেনে নিয়ে যাওয়াতেই পেল মন্দের ভালো। বলল, আপনি যে কাজটা করেন তার একটা জাপানি পরিভাষা আছে। তা জানেন?
কী পরিভাষা?
একটা জাপানি শব্দ আছে, কাইজেন। আগেরদিনের কাজকে পরদিন ছাড়িয়ে যাওয়া।
আমি কোনও কাইজেন বুঝি না স্যার। ভালো লাগে তাই করি এইতো। না করলে মনে শান্তি পাই না, তাই করি। কাইজেনও বুঝি না, কোনো টাকাও পাই না।
হঠাৎ যেন মেজাজ হারালো তারেক। কারণটা নিজের কাছেও অজ্ঞাত হয়ত, তাই ক্রমে শক্ত হয়ে ওঠা মুখচোখে একটা শ্রমক্লান্ত বিভ্রান্ত ভাব ফুটে উঠল। মনে হলো জোর করে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। প্রথমবারের মতো সলিলের চোখে ফুটে উঠল তার সহজাত সংযত ভাব। এক ধরনের আহত আত্মসম্মানকেও ছায়া ফেলতে দেখা গেল চোখের ওপর। ওদিকে তারেক কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে নেই। তবু তার উদ্দেশে একমনে বলে চলেছে: বাসায় যদিও ভাই আছে তবু খুব খা খা,ভালো লাগে না ফিরতে। ঘুরব ফিরব যে সেটাও ভালো লাগে না। আসলে নিজের ভেতর এই পরিবর্তন এনেছি বেশিদিন হয়নি আমার। আগে আমি কাজ করতাম না এভাবে। হঠাৎই পরিকল্পনাটা এলো। বাসায় ফিরব না যখন কী করি? নিজের মতো থাকতে পারি যতক্ষণ, ততক্ষণ অতীতের অনেক কিছু আমার মনে আসে না। নয়তো খুব পোড়ে। কাজ ছাড়লেই সব একসঙ্গে মাথায় এসে ভিড় করে। এটা আমি চাই না।
খানিক বিরতি। দূরে গাড়ির ভেঁপু, রিকশার অনিয়মিত টুংটাং। পাখির শব্দ কখন কমে এসেছে লক্ষ করল না কেউ।
কাজের ভেতর থাকলে সব ভুলে থাকা যায়। আগের দিনের চেয়ে বেশি কাজ করলে কেউ পয়সা দেয় না। তো?সময় শেষ হওয়ার আগেই যদি কাজ শেষ করি কোনও আলাদা উপকার নেই, প্রশংসা নেই, অবসরও নেই।ঠিকই নতুন কাজ হাতে নিতে হয়। কিন্তু নিজের মনের ভেতর একটা কিছু ঘটে যায়, ঠিক ঘটে যায়। একটা কেমন ভরাট ভরাট অনুভূতি হয় আমার। ওই যে আলাদা কোনও উপকার নেই, টাকা নেই, তাই কেউ আমার মতো কাজ করে না। ধীরেসুস্থে করে, সময় মেপেই শেষ করে। এতে করে অনেক সময় খুনসুটি বাঁধে আমার সঙ্গে ওদের। কেন? কারণ এতে করে ওরা বিপাকে পড়ে। এই পথেও যে বিপাকে পড়া যায় আমি নিজে কাজে নামার আগে ভাবিওনি। কর্তারা এসে বলে, তারেক পারে তোমরা কেন পারো না! আমাকে এক কথার প্রশংসাও করবে না, কিন্তু ওদের ঠিকই ঠেসে গাল দেবে। তো আমার ওপর ওরা কেন চটবে না। কিন্তু কী করার আছে আমার?
তারেকের শেষ কথার বিপরীতে নিঃশব্দে হাসল সলিল।
কিন্তু আমি একদিন পল্লব ভাইকে সব বুঝিয়ে বলার পর কর্তারা ওদেরকে অমন আর বলে না। সেদিক থেকে একটু হলেও এখন শান্তি হয়েছে।
তারেকের কণ্ঠে বিষাদ দপ্তরির ঘণ্টার রেশের মতো বাতাসে ঝুলে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। সলিল একবার মুখ খুলতে গিয়েও সংবরণ করে নিলো নিজেকে।
অনেক হলো। আজ উঠি স্যার।
বেশ, উঠুন। ক্লান্ত আপনি। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিন।
এবার সলিলের কণ্ঠে খানিক রূঢ়তা। তারেক ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিল। রূঢ়তার আঁচ পেয়ে তাকাল সলিলের চোখে। খানিক থেমে বলল, আপনি একদিন বাসায় চলুন স্যার। আমাদের সঙ্গে চা খেলেন।
সলিল কোনো উত্তর দিলো না। তারেক কাপড়ের মাটি ঝাড়তে থাকল সশব্দে। সলিল খানিকটা সময় নিচের দিতে তাকিয়ে থেকে একসময় ধাতস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, বেশ, আপনি যখন উঠেছেন আমিও উঠি। দেখি, বাকি সময়টা কী করে কাটানো যায়। এরপর আর না দাঁড়িয়ে মেহগনি বনের পথ ধরল। পেছনে তারেক তখনো দাঁড়িয়ে। এরপর বাড়ির দিকে ফিরল সেও।
ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল তারেক।খালি পায়ে ঘরটা বালু-বালু ঠেকল ভীষণ। রঙ না করা দেয়ালের ঘরে নেভানো ষাট ওয়াটের বাল্ব। দরজার অপরদিকে জানালা দিব্যি খোলা। ঘরে দেয়ালের ভাগটাই বেশি বলে বদ্ধ গুমোট একটা জলহাওয়া সারাক্ষণ ছাদ থেকে মেঝে অব্দি ঝুলে ছিল। দরজা খোলায় বাতাস খেলার যতোটাই বা পথ পেল, তাতে গুমোট ভাবটা কেটে গেল খানিকটা। বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের আরও দুটো পথ আছে বটে, সরু করে কাটা দুটো ভেন্টিলেটর। একটা আছে আলোহীন স্নানঘরে। অপরটার বাসস্থান সংকীর্ণ রান্নাঘর।
আধাপাকা ঘরটা টানা আরও বেশ কটি ঘরের একটি সন্নিবেশ। ঘরগুলোর সামনে দুই মানুষ গড়াতে পারে মতন চওড়া এক বারান্দা। কালো মেঝে গরমেও দিব্যি শীতলতা ছড়ায়।
জানালাটা খুললে দূরের কারখানাটিকে এক কোণ থেকে দেখা গেল। পুরো দুই মানুষ সমান উঁচু দেয়ালে গোটা কারখানাটা ঘেরাও হয়ে আছে। দোতলার হলুদ উঁচু অফিস ঘরটা আশপাশের গাছগুলোর চেয়ে মাথা উঁচু রাখে নিত্য। চার কোণে ফ্লাডলাইট লাগানো বিশাল দণ্ড চারটি চোখে পড়ল ঘর থেকেই। আলোর খানিকটা ওপরে উঠে গিয়ে কারখানার ওপরকার চৌকোণা আকাশটাকে সারাটা সময় বিবর্ণ করে রাখল, দেখা গেল যতক্ষণ। স্তম্ভ থেকে নিচেও নেমে আসছে আলো। ভেতরসহ বাহিরের অনেকটুকু ভাসিয়ে দিয়ে তরল অন্ধকারে ভিজিয়ে রেখেছে কারখানার দেয়াল।
আলোকস্তম্ভের আলো তারেকের বাড়ি অব্দি আসার বহু আগেই বাতাসের পরতে খোয়ালো তার জীবন। খোলা মাঠের আল ঘেঁষে প্রাণ ধরা ঝোপঝাড়গুলো আলোর গমনে দীর্ঘ ছায়ার অধিকারী হয়ে উঠেছিল। ছায়াগুলো তারেকের বাড়ির দিকে ক্রমশ সূঁচালো হয়ে কী যে নির্দেশ করছে সারাক্ষণ তা কে বলতে পারে।
মেঝেতে পাতা পুরু বিছানা, রঙ ওঠা গোলাপ ফুলের ছবির ওপর শুয়ে আছে সমীর। ঘুমিয়ে পড়েছে। একেবারে আঠালো নিদ্রা। ঘরের ভেতর এখানে ওখানে দলা পাকিয়ে শয়তান পড়ে আছে। আলো জ্বালানো হলো। তাতে দেখা গেল সমীরের দুই পায়ের ওপর বেশ কটা মশা ফুলে রক্তের ডিবে হয়ে আছে।
চৌকো কাঠামোর ওপর টিনের পাত দিয়ে তৈরি জানালা। এর ওপর কমলা রঙ করা কপাট দুটো ভেতরের দিকে টেনে বন্ধ করার সময় আঙুলে বেশ লাগল। শব্দ তুলতে গিয়েও সামলে নিল তারেক। আধখোলা জানালা দিয় কারখানার আলো এসে তার মুখের ওপর পড়ছিল। কৌশলে কপাটের মধ্যখানের কাঠামোটা ধরে ভেতরের দিকে টানলো তারেক। নিচের অংশের ছিটকিনিটা সুট করে ঢুকে পড়ল গর্তে।
একটা মরচে ধরা কালো ধাতব তেপায়ার ওপর রাখা ভাতের রূপালি হাঁড়ি।ভেতরে সকালের চড়ানো ভাত, খানিকটা ভিজে উঠেছে। একটা কালচে হয়ে আসা ছোট কড়াইয়ে সকালের রান্না সবজি নীল ঝাঁঝরি দিয়ে ঢাকা। ভাত আর সবজির হাল দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনও ওলটপালট চলেনি। দেখা হলো, শোঁকা হলো, ভাবাও হলো। এরপর যেভাবে যা আছে সেভাবেই তা রেখে দিয়ে বিছানায় সমীরের পাশে শরীর এলিয়ে দিলো তারেক। পেছনের চুলগুলো হাতের তালু দিয়ে ওপরের দিকে তুলে দিয়ে বালিশে রাখলো মাথা।
এমন সময় কানে কানে বলে উঠল সলিল, অভ্যাস কাউকে ঈশ্বর বানায়। আর কাউকে শয়তান। তারেকের চোখজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে উঠল। তুমি ঈশ্বর হয়েছ। পান থেকে চুনটা খসলেই শয়তান হয়ে যেতে। বড় বাঁচা বেঁচেছ বলতে হবে।
কথা কটা বলেই দরজাপথে মিলিয়ে গেল সলিল। তখন জানালাপথে এসে ঢুকল কাজের লোক—মালেকার মা। পেছন পেছন এসে ঢুকলো এক বর্ষাও টিকতে না পারার মতো একটা ছনের ঘর। মালেকার মা যেদিকে যায়, তার আঁচলে বাঁধা ঘরটিও যায় সেদিকে। তারেকের ঘরের এটা ওটা ভেঙে পড়তে থাকল। মালেকার মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার হাত তুলেই চলল ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে। চোখ দুটো তার কোটরগত, চোয়াল ভেতরে ঢুকে গেছে। হাসার সময় তার মাথাটা অবিকল এক ত্বকহীন খুলির মতো তাকে দেখালো। মাথায় কাঁচা পাকা চুল আজো পেছন দিকে লেপটে রাখা। কখনও সিঁথি নেই। প্রিয় শাড়িটা উল্টো করে পরে এসেছে। শাড়িটা বাংলা জলো মাটিতেচলার উপযোগী করে একটু উঁচু করে পরা। কালো থেকে ক্রমশ মেটে হয়ে আসা পুরনো পেটিকোটটা শাড়ির নিচ দিয়ে বেরিয়ে আছে। হঠাৎ মালেকার মা ঘর মুছতে শুরু করল। তখন চোখে পড়ল একটা নর্দমার মতো টানা গর্ত চলে গেছে তার ঘাড় থেকেকোমর অব্দি। মনে হয় যেন ওখানটায় মেরুদণ্ড নেই। সারা শরীরের কাঠামো ঠিক রেখে শুধু মেরুদণ্ডটা কেউ আলগোছে তুলে নিয়েছে। তারেক উদ্বেগ্ন স্বরে বলল, এই এই! তোমার মেরুদা কই? জবাবে পান খাওয়া কালচে চিরল দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করল মালেকা মা। তার পাশে এসে দাঁড়াল সলিল।
মালেকার মাও কাইজেন জানে। আর তুমি জানো না। মূর্খ! এই একটু আগেই তো কথা হলো তার সঙ্গে। কী মালেকার মা, তুমি তো কাইজেনের ব্যাপারে জানো, তাই না?
মালেকার কোনো কথা না বলে হাসিমুখে শুধু মা ওপরনিচ মাথা দোলালো।
সলিল তখন তারেকের দিকে আঙুল তুলে বলল, আমার কথাটা লোম দাঁড় করিয়ে দিয়েছে না? যদি দেয় তো তুমি ঠিক পথে আছো। আর পথে থাকাটাই আসল, বুঝলে? পথে যদি থাকো তো পথই তোমাকে পথ দেখিয়ে দেবে।
হঠাৎ সলিলের মুখটা হয়ে উঠল ঠিক যেন অপুর মুখ। অপুকে দেখে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল তারেক। অপু বলল, তারেক, আপনাকে কী বলেছিলাম মনে আছে তো? বলেছিলাম মানুষ নিজেই নিজের ঈশ্বর! একজন কোনও সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরের অস্তিত্ব কল্পনা করাটা একেবারেই আদিম স্তরের ধর্মবোধ, এটা মনে রাখবেন। যে মানুষ চিন্তার স্তরের যতো ওপরে উঠে আসতে পারে ওই আদিম স্তর থেকে সে তত দূরে সরে যায়। আমরা কেউই এখনও জানি না কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু আমরা জানতে চাই। আর চাই বলেই তো এতো সংগ্রাম! যাচাই করে জানার আগেই শোনা কথায় বিশ্বাস করা কোনও বুদ্ধিমান মানুষের কাজ না। আপনার বোকামোর সুযোগ নিয়েই কিন্তু খাবার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব নিজ শক্ত হাতে গড়াপেটা করে ঠিক করে নিতে হবে। আপনি পারবেন। আপনার ভেতর আগুন আছে।
অপু দরজা পথে মিলিয়ে গেল। ঘরমোছা শেষে জানালা পথে বেরিয়ে গেল মালেকার মা। পেছন পেছন গেল তার ঘর।
ঘণ্টা খানেক পর তারেককে ডেকে তুলল সমীর। এরপর ঠাণ্ডা সবজি মেখেই আধনরম ভাত গলধঃকরণ করল দুটি ভাই। রূপালি কলস কাত করে ভরপেট জল খেয়ে জানালাটা খুলে দাঁড়াল তারেক। একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে থাকল নির্বিকার। কারখানার নীলচে সাদা আলোর বিপরীতে ধোঁয়াগুলো মেঘজমাট থেকে কিচুক্ষণ আপসে মিলিয়ে গেল। ওর বড় চোখজোড়া দেখাতে থাকল কালো দুটো ভেজা পাথরের ন্যায়।
ষাট ওয়াটের বাল্বের নিচে সমীর একটা খাটো বইয়ের পাতা উল্টে চলল। নানা রকম যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মজার সব গল্প আর ছবিতে ভরপুর ওই বই।
সিগারেট শেষ করে সমীরের হাত থেকে বইটা নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখতেই চোখে পড়ল বাংলায় সলিলের স্বাক্ষর। একহাতে বইটি ধরে আর হাতে সলিলের আঠালো চুলে আঙুল চালিয়ে তারেক বলল, ঠিক ধরতে পেরেছি, দুজনের মিলটা কোথায়।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-১০॥ হামিম কামাল