সেলিনা শেলী আশির দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন। দেখতে দেখতে কবিতা লেখার কাল পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেল।
শেলীর কবিসত্তার উন্মেষকালে দেশ স্বৈরাচারের দুঃশাসনে রুদ্ধ। আদতে শৈশব থেকেই সে তো দুঃশাসনই দেখে আসছিল। স্বপ্নের জলাঞ্জলি, সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখতে হয়েছে তার প্রজন্মের অন্য সবার মতো। তবে সচেতন, সংবেদনশীল ও স্বভাবত প্রতিবাদী মানুষ হিসেবে তার পক্ষে বাস্তবতা মেনে চুপচাপ থাকা সম্ভব ছিল না। প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, প্রতিবাদী কর্মসূচিতে বরাবর সামনের কাতারে থেকেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছে, মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছে।
এক সময় শেলী প্রতিবাদী রাজনৈতিককর্মী হিসেবেই পরিচিত হয়েছিল। স্বৈরাচার আর মৌলবাদ এমন এক তরুণীকে সহজে হার মানাতে পারেনি। ফলে তার সংগ্রাম যেন হয়েছে বারংবার চ্যালেঞ্জ ও পরীক্ষার সম্মুখীন। দিনে দিনে তা কেবল বেড়েছে, তীব্র হয়েছে।
বাংলাদেশে ও বাংলাভাষায় রাজনীতি আর কবিতা অনেক সময়ই একাকার হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেলী পথটা ভালোই চেনে। তবে প্রথম থেকেই সে সাবধান ছিল এই দুটি বিষয়ের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে। কবিতাকে শেলী রাজনীতির বক্তব্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করেনি। কবিতার শৈলী ও রস দুটোই তার জানা আছে ভালো।
রাজনৈতিক সচেতনতা আর আদর্শিক অঙ্গীকার তার চেতনায় বদ্ধমূল এবং এর একটা ভূমিকা থাকে লেখায়। কিন্তু তার কবিতা ব্যক্তিমানুষের জীবন, এমনকি শরীর ও হৃদয়ের ভাব ও অন্যান্য অনুষঙ্গকে চাপা দেয় না। যা পাঠকের জন্যে তৈরি হয়ে ওঠে সেটি কবিতাই, রাজনৈতিক বক্তব্য বা বিবৃতি নয়, বরং আবেদনে মহত্তর অর্থেই মানবিক। কখনো স্পষ্টই বলছেন কবি, কিন্তু তবু কবিতার হানি হয়নি তাতে–
কোথায় দাঁড়াবো তবে?
প্রত্যেকের ছায়ার নিচেই যদি থাকে
এক একটি বিষাক্ত প্রত্যেক?
এ ক্ষরণ উন্মুখ মূর্তিমন্ত্র স্বদেশ–আমার নয়।
(যখন বিভীষণ বড়ই ভীষণ: নিভে আসে সূর্যকাল)
তবে শেলীর প্রস্তুতিটা আরও ব্যাপক। কেবল পরিচিত রাজনীতির গণ্ডি নয়, বরং সাহিত্যের সচেতন ছাত্রী হিসেবে জীবনের নানান রঙ, রস আর রূপকে সে জানে, আবিষ্কারের নেশাও আছে। এটিই তার শক্তির মূল উৎস। একদিকে রাজনীতির আদর্শ ও অঙ্গীকার অন্যদিকে মধ্যবিত্ত জীবনের সমস্যা-সীমাবদ্ধতা মিলে ক্ষুদ্র কোনো মানসবৃত্তে আটকে পড়ার বিপদ ঘটতে পারত। সে ভয় কেটে গেছে তার সাহিত্যবোধের পুষ্টিতে জীবনবোধের উন্মেষ ও বিকাশে।
বাংলাভাষার কবিদের আরেকটি সাধারণ প্রবণতা হল প্রথম জীবনের রোম্যান্টিক ভাবালুতার গণ্ডিতে ঘুরপাক খাওয়া। আমাদের সমাজে নারীর জীবন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এভাবে এক নিজস্ব অন্দরমহলেই কেটে যায়। প্রায়ই দেখা যায় বিষয়, ভাষা আর আঙ্গিকের পুনরাবৃত্তিতে নারী-কবির সকল লেখনি বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়ে। শেলীকে সম্ভবত এক্ষেত্রে তার রাজনীতি-সচেতনতা আর সাহিত্যবোধ সহায়তা করেছে। খোলা চোখে এবং অনেকটাই মুক্তমনে শেলী জীবনের কথা বলেছে কবিতায়। তার ভিতরে যে নারী সত্তা আছে তাকে সে উপেক্ষা করে না। তার ভাষ্যও কবিতায় পাই আমরা–
যে চোখে তোমাকে দেখি শব্দের কানাই
সে চোখে দেখি না আর কোনও রোশনাই।
মানুষেরা কাঁটাগাছ, তাড়া করে আসে
আমাকে ওড়াও ঘুড়ি–তোমার আকাশে।
(জীবনের জিভে তুমি/ নিভে আসে সূর্যকাল)
অন্য কবিতায়–
কুমারী কালের মেঘ ভার হয়ে জমে ওঠে চোখে
যতটা লাজের রঙ তার চেয়ে বেশি বোবা ভাষা।
(বয়ঃসন্ধি: চিতাচৈতন্যের গান)
আবার কখনো শুনি নারীর, যে কিনা প্রকৃতি, তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সে-ই বক্তা, অতএব কর্তা, তাই প্রথম পুরুষ–
বলো কী জমাট তবু? আলিঙ্গনে লীন?
মারছ তো বহু আগে–বাকলে কফিন।
যে প্রাণের কড়া নেড়ে দূরে চলে যায়
কী মেঘ ছড়িয়ে রাখো তার আঙিনায়!
শরীরে সুষমা আছে, মহিমা মহিম
এখনও নেতিয়ে পড়া, আলিঙ্গনে হিম?
আশরীর রৌদ্র-জ্বালো, কৃষ্ণ ও কামে
বেনামী প্রেমের মড়া বাঁচুক স্বনামে।
(আশরীর রৌদ্রজ্বালো: চিতাচৈতন্যের গান)
শেলীর পরিণত মনের পরিচয় এখানেই মেলে যে সে জোর করে নারী-পরিচয় ঘুচিয়ে নারী-নির্বিশেষ বা নারী-নির্বিচারী হয়ে একটি স্বতন্ত্র মানুষ সত্তা নির্মাণ করতে চায়নি। ওটা হত কৃত্রিম এবং ওতে ছাপ থাকত জবরদস্তির। শেলী সে ফাঁদে পা দেয়নি। সে তার নারীত্বকে উপভোগ করতে জানে–এর সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে। এ মেয়ে তো আর বড় লোকের সৌখিন ঘরনী-কবি নয়। সে প্রতিনিয়ত জীবন-সংগ্রামে লিপ্ত এক মানুষ–যে নারী এবং কবিও বটে। রাজনৈতিক সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে সেলিনা শেলী উচ্চকণ্ঠ, প্রবল, কখনো হয়ত অসহিষ্ণু, সমালোচনামুখর ভাষণে ক্ষোভ-ক্রোধ তীব্রভাবে প্রকাশ পায়, সে তার আবেগকে সামলে নিতেও জানে কবিতায়। এখানে সে ভাবুক, হাতিয়ার তার কবিতা। কখনো ক্বচিৎ হয়ত উপচে পড়েছে ক্ষুব্ধ আবেগ, কিন্তু প্রায়ই সে সামলে নিয়েছে নিজেকে।
আর কেবল সমকালেই বাস করে না কবি। তার উত্তরাধিকার তো চর্যাপদ অবধি, সে ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পরিচয়ও তার কিছু জানা আছে। নানা অনুষঙ্গ কবিতায় এসে যায়, যা কবিতাকে নানা মাত্রা দেয়, কবিতার ব্যঞ্জনা বাড়ায়। ‘ভোরের গাড়িতে চেপে জীবিকানিবাসে’ যেতে যেতে ‘সীতার পাহাড়’ দেখা হয় যেখানে ‘ওঠে কামাখ্যার ঝড়’–এমন পঙ্ক্তি সেলিনা শেলী অনায়াসেই লিখতে পারে।
তার ছোট্ট একটি লিরিক উদ্ধৃত করি যেখানে নারী লিঙ্গ-নিরপেক্ষভাবে মানব, আরও সঠিক হয় যদি বলি, যুগপৎ মানব-মানবী হয়ে ওঠে
সে যখন ডাকে
দ্বিধা আমি–দুধদাঁতে লজ্জাপাতা কাটি
যখন ডাকে না
আশরীর চিতা আমি–ভস্ম হয়ে উড়ি।
(দ্বিধা)
যথার্থ কবিই বলতে পারে ‘আশরীর চিতা আমি–ভস্ম হয়ে উড়ি’।
কবিতাতেই তার লেখনি ক্ষান্ত নয়। সেলিনা শেলী তার সমকালীন পাঁচজন কবিকে নিয়ে আলোচনা লিখেছে। তাতে তার মধ্যেকার বোদ্ধা পাঠক ও সহৃদয় সমালোচকের সাথেও আমাদের পরিচয় হয়। আমরা সংবেদনশীল কবি-নারীর হৃদয়-মননের পর্যবেক্ষণ পড়ে চট্টগ্রামের সমকালীন পাঁচ জন কবি – ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, শাহিদ আনোয়ার, হাফিজ রশিদ খান এবং আসাদ মান্নানকে আরও নিবিড়ভাবে জানার সুযোগ পাই।সেই সাথে কবি আবু হাসান শাহরিয়ার এর কবিতাবিষয়ক গদ্য সর্ম্পকেও পাঠক জানতে পারেন। তিনি কবিতা-বিমুখ একালে নির্বাচিত পাঁচ জন কবির প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে সমকালীন সাহিত্যের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।