॥১৩॥
তারপর কোনো কথা নেই। অনুভবের অতলে তখন অচেনা বুদ্বুদ। আমি যেন ওই বালুকা চরের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে একসময় দুপুর হয়ে যাই। দুপুর হাঁটতে হাঁটতে একসময় খুলতে থাকে বিকেলের ভাঁজ। বিকেলের ভাঁজ থেকে নেমে আসে গোধূলিমাখা অরণ্য। তখন ঘড়িতে ঘড়িতে শুরু হয়ে যায় অন্ধকারের খেলা। অন্ধকার ঘণীভূত হয়। অন্ধকার ঘণীভূত হতে থাকে ধীরে ধীরে। যেন কোথাও কোনো এক পাথরে আগুন লাগে। পাথরে আগুন লাগায় পাথরও সূর্য হয়ে যায়। পাথরে পাথরে ঘর্ষণ লাগে। পাথরে পাথরে ঘর্ষণ লেগে সৃষ্টি হয় নীলাভ আগুন। পাথরে পাথরে ঘর্ষণ লেগে সৃষ্টি হয় লালাভ আগুন। সূর্য-পাথর লালাভ আগুনে নীলাভ আগুনে একসময় রোদ হয়ে যায়।
সেই রোদ বোধহয় আমার চোখে এসে লাগে। আমি বোধহয় একটু জেগে উঠি। আমি একটু জেগে উঠে বুঝতে পারি বোধহয় আবারো তন্দ্রায় চলে গিয়েছিলাম। রোদের ঝিলিক লাগায় আমার তন্দ্রা ছুটে যায়। রোদের ঝিলিক লাগায় আমার তন্দ্রা টুটে যায়। আমি বাসের জানালা দিয়ে আবার বাহিরে তাকাই। এখন অন্ধকার নেই। এখন আলো-আঁধারী।
বাইরের আলো-আঁধারীর ভেতরে যেন তাকে দেখতে পেলাম আবার। গাছের সবুজ পাতার ওপরে চাঁদের আলো, গাছের সবুজ পাতার ওপরে নক্ষত্রের আলো, গাছের সবুজ পাতার ওপরে কৃত্রিম আলো পড়ায় গাছের সবুজ পাতা থেকেও যেন এক ধরনের আলো বিচ্ছুরিত হয়। মাঝে মাঝে সাইনবোর্ডের আলো এসে পড়াতে তাকে বেশ উজ্জ্বল দেখায়। বিনোদন পার্কে দেখা সেই শার্ট। বিনোদন পার্কে দেখা সেই ভঙ্গি। বিনোদন পার্কে দেখা সেই চাহনি। বিনোদন পার্কে দেখা সেই বয়স। বিনোদন পার্কে দেখা সেই গন্ধ। বিনোদন পার্কে দেখা সেই সুবাস। বিনোদন পার্কে দেখা সেই পদক্ষেপ। বিনোদন পার্কে দেখা সেই পদছাপ।
আমি সিটে ভালোমতো বসি। কারণ তন্দ্রা আসায় আমার বসার ভঙ্গি যথার্থ ছিল না। তখনই বাসের ভেতরে সবগুলো আলো জ্বলে ওঠে। কেউ কোনো কথা বলে না। একবারে এত আলো জ্বলে ওঠাতে কারো কোনো ভাবান্তরও হলো না। যেন এরকমই হওয়ার কথা ছিল। আমার কাছে তা মনে হলো না। সেই শিশুর অমন পদক্ষেপ যখন বাইরের আলো-আঁধারীতে দেখছিলাম; তখন সকল অস্পষ্টতার অবসানের জন্য আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসেছিলাম। তখনই এতো এতো আলো জ্বলে উঠল যে ওই শিশুটি হারিয়ে গেল। হারিয়ে গেল আলো-আঁধারী। হারিয়ে গেল চাঁদের আলো। হারিয়ে গেল এই গতি।
বাসটি থেমে গেল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন এরকমই হওয়ার কথা ছিল। আমিও তা-ই ধরে নিলাম। কারণ আমি যখন তন্দ্রায় অথবা ঘুমে ছিলাম তখন হয়তোবা সবাই বলাবলি করে এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথবা এটাই এই রাস্তার নিয়ম। দীর্ঘ যাত্রায় সাধারণত ব্রেক দেয় বাসগুলো। আমি সেটাই ভেবেছি। তবে ব্রেক দেয় কোনো হোটেলের সামনে এসে।
সবার নেমে পড়া দেখে আমার আর কোনো সন্দেহ রইলো না। আমিও নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। ততক্ষণে সবাই নেমে পড়েছে। আমিও নেমে পড়লাম। আমি নামতে পারলাম সবার শেষে।
নেমে একটু অবাক হলাম এজন্য যে, এরকম জায়গায় বাস হল্ট করানোর কী কারণ হতে পারে? কোনো হোটেল নেই, রেস্টুরেন্ট নেই। অথচ বাসটা এখানে এসেই থামলো। যাত্রীরাও হুড়মুড় করে নেমে পড়লো। আমি নামতে নামতে সবাই একেবারে উধাও হয়ে গেল! তাহলে এখানে থামার কারণ কী? জায়গাটা মোটামুটি অন্ধকার। আলোর ছোঁয়াও আছে একটু একটু। আমি তখন আমার সহযাত্রীদের কাউকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করতে চাইলাম। কিন্তু কাউকে দেখলাম না আশেপাশে। ভাবলাম তারা হয়তোবা ওই পাশে আছে। মাঝখানে বাসটি থাকায় আড়াল হয়েছে মাত্র। আমি বাসটির সামনে দিয়ে ওই পাশে এলাম। কিন্তু কেউ নেই। এতগুলো লোক এরকম এক জায়গায় থামলো আর নিমিষেই সবাই নিখোঁজ! তাহলে কী আশেপাশে কোনো হোটেল আছে; যেটার আলো নেভানো! সবাই বোধহয় সে-হোটেল সম্বন্ধে জানে। সচল অভ্যস্ততায় ঢুকে পড়েছে সেখানে। কেবল আমিই জানি না বলে এখানে ছাড়া পড়েছি। যদি সেটা হয়ে থাকে, তাহলে তারা তো আশেপাশেই আছে। তাহলে একটু ঘুরে দেখা যাক, তাদের আশেপাশে পাই কি না।!
একটু হেঁটেছি। অন্ধকারকে আরো ঘণীভূতরূপে পাচ্ছি। মনে হয় রাস্তার দুই ধারে বাঁশঝাড়। সেখানে জোনাকি পোকা সমস্ত অন্ধকারকে ফুলেল করে তুলছে। আমি কী মনে করে আকাশের দিকে তাকাই। দেখি মেঠোচাঁদ। ‘মেঠোচাঁদ রয়েছে তাকায়ে, আমার মুখের দিকে।’
আমি এ দৃশ্য দেখে আমার সহযাত্রীদের কথা ভুলে যাই। তারা কোথায় গেল সেটা খুঁজতে বের হয়েছি, সেটাও ভুলে যাই। তাদের কাউকে পেলে, বাসটি এখানে কেন হল্ট করানো হলো এ জিজ্ঞাসা করব, তা-ও ভুলে যাই। আমি শুধু তাকিয়ে থাকি মেঠোচাঁদের দিকে। মেঠোচাঁদ রইলো তাকায়ে আমার মুখের দিকে। ঘড়িতে কত বাজে জানি না। বোধ করি ঘড়িতে এখন বাজে মধ্যরাত্রির সমস্ত অন্ধকার। আমার সামনে দুঃখ-মাঠ। মাথার উপরে মেঠোচাঁদ। পায়ের নিচে দুর্বা ঘাস। তারসঙ্গে হালকা শিশির। বাতাসে সামান্য কুয়াশার সাঁতার। মনের ভেতরে মেঘ-জোসনার অশ্রু নিবাস।
মেঘ-জোসনার ভেতরে মেঘ ভারি হতে থাকে। আমি কিসের আহ্বানে যেন রাস্তা ছেড়ে মাঠের ভেতরে চলে যাই। এখানে মেঠোচাঁদের অস্পষ্ট আলো। কিন্তু রাস্তায় দেখা আলোর চেয়ে অনেক পরিষ্কার। দিগন্ত বিস্তৃত এ মাঠ। আমাকে কে যেন ডাক দেয়। আমি মাঠের ভেতরে চলে যাই। সেখানে অনেক নক্ষত্র। আমার মনের মেঘ ঘণীভূত হতে থাকে। তারা বৃষ্টি হতে চায়। বৃষ্টি হতে হতে তারা কথা বলতে চায় নক্ষত্রের সঙ্গে। আমার ইচ্ছে করে শুধু এদের সঙ্গেই জীবনটা কাটিয়ে দেই, একাকিত্বকে সঙ্গী করে। বিবর্ণ চাঁদ বোধ হয় আমাকে আহ্বান করে। আমি যে ভালোবেসেছি অস্ত চাঁদ। আমি যে ভালোবেসেছি ক্লান্ত শেষ প্রহরের শশী। আমি যে ভালোবেসেছি অঘোর ঘুমের নদী। আমি যে ভালোবেসেছি অঘোর ঘুমের নদীঢেউ। আমি যে ভালোবেসেছি ঢেউয়ের কলসি।
এভাবে একা একা হেঁটে হেঁটে আমি নক্ষত্রের সঙ্গে চলে যাই। এভাবে একা একা হেঁটে হেঁটে আমি চাঁদের অস্পষ্ট আলোর সঙ্গে চলে যাই। এভাবে একা একা হেঁটে হেঁটে আমি মেঠোচাঁদের গভীরে চলে যাই। এভাবে হেঁটে হেঁটে আমি কুয়াশার সঙ্গে চলে যাই। যখন অনেক দূরে চলে যাই; তখন মনে হয় সামনে কোনো স্বপ্ন-গ্রাম। আমি হাঁটতে থাকি। কিন্তু সে স্বপ্নগ্রামের নাগাল পাই না। আমি হাঁটতেই থাকি। আমি হাঁটতেই থাকি। আামার একটুও পেছনে ফিরতে ইচ্ছে করে না। আমার একটুও পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করে না। আমি যে পায়ে পায়ে চলে এসেছি বহুদূর। দূরে কোথাও দেখা যায় জ্যামিতিক আলো।
আমি বোধহয় স্বপ্নগ্রামে চলে এসেছি। কিন্তু এই প্রাকৃতিক আলোর ভেতরেই হালকা কৃত্রিম আলোর আয়োজন দেখা যাচ্ছে। যেন কোনো স্বপ্নপুরী। যেন কোনো কল্পপুরী। পায়ে শীতল শিশিরের ছোঁয়া। আহ! এই আামার ঘাস! আহ! এই আমার শিশির! আহ! এই আমার শিশিরের ছোঁয়া! আহ! ওই আমার চাঁদ! আহ! ওই আমার চাঁদের আলো!
আমি কত দূরে চলে এসেছি! আমি আসলে বহুদূর চলে এসেছি। মানুষ যেমন জীবন থাকতেও জীবন থেকে বহুদূর চলে আসে!
প্রাকৃতিক আলোর ভেতরে কৃত্রিম আলো একটু করে স্পষ্ট হয়। আমি একটু কোলাহলের শব্দ পাই। দেখি অনেক মানুষ। দেখি সেগুলো মানুষ নয়। সেগুলো মানুষের মতো অনেকগুলো প্রাণী। সেগুলো বাঁদরের কাছাকাছি। এতগুলো বাঁদরমুখো প্রাণী এখানে! এর ভেতরে একজন মাত্র মানুষ। সব বাঁদরমুখো প্রাণীগুলো বৃত্তাকার হয়ে ঘিরে আছে। মাঝখানে এক বাঁদরমুখো প্রাণী মানুষটিকে কী যেন আদেশ করছে। মানুষটি বিচিত্র সব অঙ্গভঙ্গি করছে। তা দেখে অন্যসব বাঁদরমুখো প্রাণীগুলো হাসতে হাসতে এর ওর গায়ের ওপর হেলে পড়ছে। সব উপমাই এখানে তাৎপর্যহীন। হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়। হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়। হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়। হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়।
আশিক একই কথা বারবার বলে যাচ্ছিল। আমি খুব কৌতূহল নিয়ে তার কথা শুনে যাচ্ছিলাম। এরকম এক জায়গায় যখন অনেকগুলো বাঁদরমুখো প্রাণীর দেখা পেলো আশিক; তখন তাঁর কী করতে ইচ্ছে করল! তাঁর কী ওই আসরে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করল! না কি তার বাসের কাছে ফিরে আসতে ইচ্ছে করল! না কি অন্যদিকে যেখানে পৃথিবীর গভীরতর আলো, সেদিকে যেতে ইচ্ছে করল! না কি যেখানে পৃথিবীর বিস্তৃততর আলো, সেদিকে যেতে ইচ্ছে করল! কিন্তু আশিক আর এগুচ্ছে না। শুধু বলছে, হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়। হাসির শব্দ কখনো বাড়ে কখনো মিলিয়ে যায়।
আমি বললাম, আশিক এরপর কী হলো বল! তোর কী ইচ্ছে করল তখন? তোর কি ওখানে থেকে যাবার ইচ্ছে হয়েছিল!
আশিক বলল, আমার ওখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে করবে কেন? তুই বুঝতে পারিসনি যে আসলে ওই বাঁদরমুখো প্রাণীগুলো মানুষকে বশ করে খেলা দেখাচ্ছিল। আমরা যেমন বাঁদর খেলা দেখাই তেমন। আমরা যেমন বাঁদর খেলা দেখি তেমন। ওটা ছিল বাঁদর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত মানুষ-খেলা।
আমি বললাম, যেখানে খেলা থাকে; সেখানে সমাজও থাকে। সেখানে সভ্যতাও থাকে।
তাই বলে তুই আমাকে বাঁদরের রাজ্যে থাকতে বলিস?
তোর তো ভুলও হতে পারে। চাঁদের আলোয় ভুল দেখেছিস। মানুষগুলোকে তোর বাঁদর মনে হয়েছে।
একটুও না। আমার একটুও ভুল হয়নি।
তারপর নীরবতা। তারপর নীরবতা। তারপর আমাদের নীরবতা।
প্রথমে অপেক্ষা করলাম, আশিক নীরবতা ভাঙবে। আশিক ভাঙলো না। আমিই নীরবতা ভাঙলাম। বললাম, জানিস আমার জীবনের এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমি বাঁদরদের রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম।
আশিক বিস্মিত হলো খুব। চিৎকার দিয়ে উঠল। মানে কী? তুই কী বলছিস এসব? তুই বাঁদরদের রাজ্যে চলে গিয়েছিলি মানে? আমি ছোট্ট করে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ। আশিক খুবই কৌতূহলী-উত্তেজনা প্রদর্শন করে বলল, তাহলে বল সে কাহিনী। আমি শান্ত কিন্তু ধীর কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বললাম, সেটা পরে। আগে তুই বল বাঁদরমুখো প্রাণীগুলোকে দেখার পর তুই কী করলি?
চলবে…
মিথ্যামানব: পর্ব-১২ ॥ এমরান কবির