শিরোনামটি একটি কবিতার পঙ্ক্তি। কবির নাম সেলিনা শেলী। শেলীর মনোরাজ্যের সঙ্গে পঙ্ক্তিটির নিবিড় আত্মীয়তা আছে। পাখির ডানা-ডানা উড়াল আর নদীর ঢেউ-ঢেউ প্রবহমানতার মতোই শব্দকে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যঞ্জনা দিতে জানেন এই কবি।
কবিতাকে যারা একার সন্ন্যাস বলে জানেন, সেলিনা শেলী তাদেরই একজন। স্বরের স্বর ভঙ্গিতে ইতোমধ্যেই সমসাময়িক অন্য কবিদের থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছেন আশির দশকে আবির্ভূত এই কবি। কবি হওয়ার জন্য দশকের লাঠিতে ভর করতে হয়নি তাকে। শব্দকে ব্রহ্ম জেনে কবিতার পথ কবিতার পায়েই হেঁটেছেন।
সেলিনা শেলী জানেন শব্দই ব্রহ্ম; তবে, শব্দসমবায়ই কবিতার মূলমন্ত্র। শব্দকে ছত্রিশ ব্যঞ্জনে বাজানোর দক্ষতা রাখেন তিনি। ফলত ‘মনেরেখো, সিডরের ত্রাণে ভরা রণতরী ওরা/ যতটুকু হাত, দ্যাখো নখ বড় তারও চেয়ে বেশি’ বা ‘তোমাদের শহরে বুঝি বেদনাও বেচাকেনা হয়?/ যেইভাবে প্রত্নরত্ন…/ স্মৃতিও কি সেইভাবে বিক্রি হয় রাষ্ট্রীয় গোপনে?’ বা ‘লিখবো কবিতা, কবিতা আমার/ তেভাগার রোশনাই’-এর মতো প্রতীক-চিত্রকল্প গুঁজে দিয়ে প্রেমের কবিতায়ও জমা রাখতে জানেন বিপ্লবের দুধধান।
একদিকে উচ্ছ্বাসী সমুদ্র অন্যদিকে ধ্যানী পাহাড়; এদুই বৈপরীত্যের মধ্যবর্তী জনপদ চট্টগ্রামকে সেলিনা শেলী ‘জন্মশহর’ সম্বোধন করেন। চট্টগ্রামের পাহাড়-নদী-সমুদ্র অধ্যুষিত অপার প্রকৃতির কাছ থেকে নেন স্বচ্ছতার পাঠ। চর্যার কবি কাহ্নপার স্মৃতি বিজড়িত চট্টগ্রামের মাটি সূর্যসেন, প্রীতিলতার মতো বিপ্লবীদেরও লালন করেছে। দুই ধারারই সার্থক উত্তর সাধক এই কবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কবিতা চর্চার পাশাপাশি তিনি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এজন্য তাকে মৌলবাদী অপশক্তির রোষানলে পড়তে হয়েছে একাধিকবার। শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাস হাসপাতালেও থাকতে হয়েছে। তবু, কবিতার পথ একা হাঁটলেও, জীবনের পথ মানুষকে পাশে নিয়ে চলতে ভালোবাসেন শেলী। কোলহলের মধ্যেও কবিকে একা থাকতে হয় এবং জীবন ছেনে তুলে আনতে হয় মহাজীবনের সূত্রাবলি, একথা তিনি সর্বমনে জানেন—
বেদনার শিয়রে তোমাকে রেখে দেখি
তুমিও আমার মতো
একা
দিনানুদিনের ভিড়ে, জীবিকার একঘেঁয়ে দৌড়ে
তুমি একা…
অর্থশাস্ত্র ভেদ করে হাওয়ার একটানা কান্নার মতো
কবিতার শব্দরাজি নিজের রঙ থেকে, স্বাদ ও সাধ থেকে
মুছে ফেলে বিভা,
তবু জেনো
‘নিঃসঙ্গতা’ তোমাকে সঙ্গ দেয় বলে
তুমিও আর একা থাকো না।
তুমি কবি।
[জীবিকাজটিল জঙ্গমে/ (অগ্রন্থিত কবিতা)….]
ম্যাকলিশের সেই বিখ্যাত উক্তিটি সেলিনা শেলীর অজানা নয়, ‘কবিতা কিছু বলে না, কবিতা হয়ে ওঠে।’ শেলী জানেন, জীবনের কোনো ঘটনাই তুচ্ছ নয় এবং আপাত তুচ্ছ বিষয় নিয়েও মহার্ঘ কবিতা হতে পারে। আরও জানেন, অভিজ্ঞতা ও জীবনের আশপাশেই ছড়িয়ে আছে প্রতীক চিত্রকল্পসহ কবিতার তাবৎ মালমশলা। সেখান থেকেই তিনি কবিতার উপাদান কুড়ান; শব্দের ব্যঞ্জনায় জীবনকে মহাজীবনের সঙ্গে বাঁধেন।
আত্মপ্রকাশের একযুগপর ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘অন্ধকার হে অন্তর্গত’ নামে প্রথম কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয় শেলীর। প্রথম বইয়েই দীক্ষিত পাঠকের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছেন এই কবি। পরিণত যাত্রার সাক্ষ্য দেয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘নিভে আসে সূর্যসকাল’ (২০০৫) ও ‘চিতাচৈতন্যের গান’ (২০০৮)। তৃতীয় বইটির অনেক কবিতা আমার প্রিয়।
শেলীর গদ্যও প্রশংসার দাবি রাখে। তিনটি বইও আছে গদ্যের, ‘কতিপয় কবিতার কথা’, ‘সেদিন কী দিন ছিল এদিন কী দিন’ ও ‘কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’। যখন শেলী কবি, তখন স্বরের স্বর ভঙ্গিতে সমসাময়িকদের থেকে আলাদা। যখন গদ্যকার, তখন গুণবিচারী কাব্য সমালোচক। কিন্তু লেখেন কম। আরও বেশি লিখলেই যে ভালো করতেন, সে কথা বলব না। কবি তো আর হাওয়া খেয়ে বাঁচেন না। সমাজের আর দশ জন মানুষের মতো তাকেও জীবিকার পেছনে ছুটতে হয়। জীবিকার ছোটাছুটিতে কবিদের এত আয়ুক্ষয় হতোনা, যদি কবিতার বিস্তর পাঠক থাকত দেশে। কিন্তু, কথা এই যে, কবিতাচর্চাকারীরাই কবিতার বই কেনেন না। বই বিক্রি হলেও প্রকাশকরা সম্মানী দেন না কবিকে।
কবিকে উত্তমরূপে একজন মানুষ হতে হয়।যখন মানুষ, সেলিনা শেলীর আছে স্বচ্ছ ও সুন্দর একটি মন। ওই মনে একবার পরিচ্ছন্ন একটি কবিতাসন্ধ্যা আয়োজন করেছিলেন তিনি তার জন্মশহর চট্টগ্রামে। বাঙ্ময়’-এর ব্যানারে। ওই শহরের কবিরা ছাড়াও ঢাকা ও কলকাতার বেশকজন কবি তাতে কবিতা পাঠ করেছিলেন। আমারও সুযোগ হয়েছিল সশরীরে উপস্থিত থাকার। কবিতা নিয়ে এমন বৈদগ্ধ্যপূর্ণ আয়োজন আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না। শেলির কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তির মতো উজ্জ্বল ছিল সেই সন্ধ্যাটি—
এ বড়ো সবুজ শহর, সমুদ্রপ্রবণ
পাহাড়ি স্তন চিরে বয়ে যায় স্বচ্ছতোয়া
নৈঃশব্দ্যই কবিতা বলে এ শহরে সকলেই কবি।
[এবড় জন্মশহর/(অগ্রন্থিত কবিতা)….]
জীবনানন্দ দাশের ‘সকলেই কবি নয়, কেউ-কেউ কবি’র বিপরীতে অবস্থান নিয়ে ‘এশহরে সকলেই কবি’ দাবি করার মধ্যে যে-দার্ঢ্য আছে, সেখানেই সেলিনা শেলীকে তার কাব্যিক উচ্চতায় পাওয়া যায়। বজ্জাত সময়কেও এভাবে শিল্পিত করে-তোলা শুধু জাতকবির পক্ষেই সম্ভব। সেলিনা শেলী একজন জাত কবি।