॥১৬॥
এরপর পার হলো দীর্ঘ দিনরাত্রির পালা। যাতনার প্রহরগুলো প্রখরতর হতে হতে কিভাবে যে ভেসে চলে যায় কালের অতলে, কী করে বোঝাই সে কথা! মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা সামনে। বাবার খুব ইচ্ছে—ছয় সন্তানের একজন ডাক্তার হোক। বড় ভাই বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় স্কলারশিপ পেয়ে চলে যায় রাশিয়ায়, মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে গিয়ে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করে। মেজ ভাই এপ্লাইড ফিজিস্ক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ে।
সেজ ভাইও ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। পড়ায় তার মন বসে না। দুর্দান্ত রেজাল্ট করা আমার (ছোট ভাইয়া ডাকি যাকে) সেজ ভাই মেডিক্যাল কলেজের ক্লাস বাদ দিয়ে বন্ধুর ছোট ভাইদের পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্রের উত্তর লিখে দেয় বাইরে বসে। বন্ধুরা তাদের ভাইদের সেগুলো পরীক্ষার হলে সা্প্লাই দেয়। বন্ধুরা বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। তাকে সামনে-পেছনে রেখে ফর্ম ফিলআপ করে যেন মাঝখানে বসে সে দুজনকেই পরীক্ষার হলে সাহায্য করে বুয়েটে চান্স পাওয়াতে পারে। কিন্তু বন্ধুরা চান্স পায় না। সে নিজেই চান্স পেয়ে বসে থাকে। মা চিন্তায়-চিন্তায় অস্থির হয়ে তাকে রাশিয়া পাঠাতে মনস্থির করেন। একসময় সেজ ভাইও রাশিয়ায় পাড়ি জমায়। বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকবে না বলে মস্কোর বদলে মিনস্কে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়। আর সেও বেছে নেয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং। আপা ইকোনোমিক্সে অনার্স ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। বাকি থাকি আমি বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য। ছোট ভাই পড়াশোনায় খুব একটা মতি নেই। কোনোমতে পাস করে। আর মা কান্নাকাটি করে—লোকে বলবে, এতগুলো ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছে, শেষটাকে যত্ন করতে পারেনি। তাই পড়াশোনায় এত খারাপ! অতএব মেডিক্যাল কলেজে ওর চান্স পাওয়ার কোনোই আশা নেই।
আমি কেমন যেন একটা দায়িত্ব অনুভব করতে থাকি। আমার যে করেই হোক মেডিক্যালে চান্স পেতেই হবে। কোচিংয়ে যাই জীবনে প্রথমবারের মতো। কারণ বাইরে গিয়ে কিংবা গৃহ শিক্ষকের কাছে আলাদা করে পড়তে বসা আমার চিরকালই অপছন্দ। কোচিং সেন্টার তো দুই চক্ষের বিষ। তবু যাই। আজকাল খুব মনোযোগ আমার। খুব উৎকণ্ঠিত থাকি—কখন বিকেল তিনটে বাজবে। ময়মনসিংহের মহাকালী বালিকা বিদ্যালয়ে অনুশীলন কোচিং সেন্টারে ক্লাসে যাওয়ার সময় হবে কখন। সেই মনোযোগে জমে ওঠে প্রেম। প্রথম জীবনের প্রদোষবেলার স্পর্শকাতর প্রেম কেমন করে যে ভেসে চলে যায় কেউ জানি না। চার তলার ক্লাস রুমে দুপুরের পর কোনো ক্লাস নেই। ক্লাস রুমগুলো তালা মারা। বিকেল তিনটে বাজে। ছাত্রছাত্রী নেই। একদম ফাঁকা। সেই ফাঁকা জনমানবহীন তালা দেওয়া ক্লাস রুমের সামনে দাঁড়ানো দু’জন মানুষ। দু’জন প্রেমিক-প্রেমিকা। কি জানি কি সব! দুজন মানুষ ভালোবাসে—মাঝখানে একজন নারী। দু’জন মানুষ কাছে আসে। মাঝখানে একজন নারী। দুজন মানুষ, না কি তিনজন? তবু চোখের পাতায় ঘন হয়ে আসে প্রেম, ঠোঁটের স্পর্শ। পরদিন চিঠি পাই—‘গতকাল এত কাছে ছিল তোমার শরীর, ইচ্ছে ছিল খুব চোখের কোমল উপত্যকায় ছুঁয়ে দেই দুই ঠোঁট আমার…।’
বাড়ি ফিরলে মা দেরির কারণ জানতে চাইলে তার চোখে-চোখে তাকাতে পারি না। মনে হয় মায়ের চোখে তাকালেই অন্তরাত্মা থেকে শুরু করে সব দেখে নেবে। মিথ্যে বলার সাহস হয় না। চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাই। মা ঠিক কিছু একটা ঠাহর করতে পারে। আর তাতেই সেই মা-হারা ছেলেটি ধীরে-ধীরে আমার মায়ের কাছে উড়নচণ্ডী হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করে। বাড়িতে তার আসা-যাওয়া আর সহজভাবে দেখতে পারে না মা। যোগাযোগ করার উপায় বের করতে পাগল হয়ে যাই দুজনে। বাড়িতে এলেই আগে যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা হতো, ঘরে বসে নানা গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতো, এখন আর সেটা অত নির্বিঘ্নে হয় না। প্রায়ই বাড়ির বাইরে কলিং বেল বাজলে দৌড়ে যাই। দরজা খুলে দিলে মাথা নিচু করে ঘরে ঢোকে সে, ড্রয়িং রুমে বসে থাকে। হঠাৎ যাওয়ার আগে শাদা শার্টের ভেতর থেকে বের করে দেয় তাজা গোলাপ। কালচে গোলাপি রং। আমি তার নাম জানি না। নাম জানতে চাই গোলাপের। বলে পাপ্পা মেলোন। প্রায়ই এমন। জিজ্ঞেস করি খেয়েছ? মাথা নাড়ে—না।
আমার বুকের ভেতর কেমন যে একটা জোর কষ্ট হাহাকার করে ওঠে। আহা ছেলেটির মা নেই! বাবা খুব বয়স্ক। একাই থাকেন ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটি দারুণ মেধাবী। দারুণ কবিতা লেখে। দারুণ রাজনীতি বোঝে। খুব গল্প কবিতা-উপন্যাস পড়ে। খুব জানে। কিন্তু কোথায় কোথায় সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। কে বলবে ওকে খাওয়ার কথা! কে দেবে ওকে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা? কে দেবে ওকে ভালোবাসা? আচ্ছা সেই মেয়েটি কী করে? এতবেলা খায়নি। কিন্তু ওই মেয়েটি কি ভাবে না ওর কথা! শুনেছি ওর বাবা অনেক সম্পদের মালিক। বাবার একমাত্র ছেলে। মা নেই। তাই যত্ন করার কেউ নেই। পথে-পথে এখানে- সেখানে ঘুরে বেড়ায়। আমি ভয়ে বসতে বলতে পারি না। মাকে বলতে পারি না ওকে খেতে দিতে। যাওয়ার আগে একটা কবিতা দিয়ে চলে যায়:
একখণ্ড আগুন
খড়ের গাদায় মুহূর্তে ঘটায় প্রলয়
তুমিও আগুনের স্বরূপে
নিশিদিন দগ্ধ করো আমায়
আমার দ্বিবিধ যাতনার কালগুলো দীর্ঘ হতে হতে তার দীর্ঘ দীর্ঘ শরীর বিছিয়ে প্রথম প্রেমের দারুণ যাপনকে অবসন্ন করে দিয়ে সম্মুখের ঝাপসা আলোয় শুয়ে থাকে চেতনার আদিগন্ত পথ। আমি মেডিক্যাল কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলাম, সে কথা ভুলেই গেছি। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি কিংবা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো নয়ই আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি আর ভর্তি পরীক্ষা দেইনি। এমনকি বন্ধুরা ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে, শেষ অস্ত্র হিসেবে হাতে রাখার জন্য। মা এত করে বলেও আমাকে সেখানে পরীক্ষা দেওয়াতে পারেনি। সেও দিয়েছিল জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরই মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্ট বের হলো। আমি খুব একটা আশায় ছিলাম না। কারণ ঘ ইউনিট দিয়ে ঢাকা ব্শ্বিবিদ্যালয়ে ঢোকা দারুণ প্রতিভার বিষয়। আমাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ একদিন এসে সে মাকে বলল, খালাম্মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো রেজাল্ট দিয়েছে। শাপলা তো মেধাতালিকায় এসে গেছে। তোমার কী খবর বাবা? আমার মায়ের কথায় মাথা নিচু করে থাকে। বলে আমার হয়নি খালাম্মা। আমার মা খুব একটা রাগত ভঙ্গি করে চলে যান। আমি আনন্দের চেয়ে ব্যথিতই হই বেশি।
সব আনন্দ আজকাল কেমন যেন পানসে হয়ে যাচ্ছে। কেন? কেন এমন হবে? একটি মা হারা ছেলের সঙ্গে ঈশ্বরের এমন বিরূপ আচরণ কেন? কেন তাকে খাবার রেঁধে খেতে বসার জন্য কেউ ডাকে না। কেন তার মা ওকে ছেড়ে চলে গেল? কেন সে আর এক নারীকে বৈশাখী মেলা থেকে রিনিঝিনি কাঁচের চুড়ি কিনে দেয়? কেন সে তাহলে আমার কাছে আসে? বিধাতা আমার সঙ্গেই বা কেন এমন ক্রুর? আমিই বা কেন ওকে ঘৃণা করতে পারি না। জীবনের শুরুতেই এমন বিশ্বাসঘাতককে কেন এড়াতে পারি না? কেন ফেরাতে পারি না? কেন ওই মেয়েটি ওকে ডেকে খাওয়ায় না? তাহলে কেমন ভালোবাসে ওকে! আর সেই বা কেন আমাকে এমন সব কবিতা লিখে দিয়ে যায়? শাদা শার্টের ভেতরে বুকের গভীর উত্তাপে সঙ্গোপনে সুগন্ধী গোলাপই বা কেন সে বয়ে বেড়ায় গোপনে আমার জন্য।
কী আসল? কী নকল? কোনটা ভালোবাসা, কোনটা প্রেম? কী যাতনা, কী নিঃসঙ্গতা, কি শূন্যতা আমি আর আলাদা করতে পারি না। বয়স আঠারোতে পড়ে। আর ক্রমবিভ্রান্ত অবসন্ন সময়গুলো কেবলই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। বিষাদপূর্ণ মন নিয়ে মেজ ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসি।
চলবে…