॥১২॥
সে হাসতে শুরু করলো। হাসির রিনিঝিনি শব্দে ভরে গেলো চারপাশ। যেন সঙ্গীতের টুংটাং। যেন নিস্তব্ধ রাতে নদীর পাড়ে, বিশাল প্রান্তরে একসঙ্গে আছড়ে পড়লো হাজারো কাঁচের চুড়ি। সে-শব্দ সুরের ঢেউ তুলে মিলিয়ে গেল ইথারে। আবারও কাঁচের আছড়ে পড়া রিনিঝিনি। আবারও ইথারে সুরের ঢেউ তুলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া হাসির মূর্ছনা।
আমি বোধহয় তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম। একসময় তার দিকে তাকালাম। দেখি তার শরীরে কোনো বস্ত্র নেই। সোনালি শাড়ির ঝিকিমিকির পরিবর্তে তার গোপন সৌন্দর্যের লীলা-ঢেউ। আমি চোখ ফিরিয়ে নেব কি নেব না ভাবছি। কারণ শাড়ি ভেদ করে বেরিয়ে আসা মসৃণ সৌন্দর্য যতটুকু দেখেছি তাতে যেকোনো পুরুষের আগ্রহ ও কামনা জেগে উঠতে বাধ্য। চোখ ফিরিয়ে নিলে তো আর ওই সৌন্দর্যে অবগাহন করা সম্ভব না। আবার চোখ রাখাটাও বেহায়াপনার মধ্যে পড়ে যায়। কী করব ভেবে কূল কিনারা পাই না। তবু সব দ্বিধাদ্বন্দ্বকে পাশে রেখে তার দিকে তাকাই। তখন নিমিষেই তার কোমর থেকে নিচের অংশটুকু মাছের মতো হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নৌকার ওজন যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। এতই বেড়ে যায় যে, নৌকা একটু একটু করে ডুবতে থাকে। আমি দেখছি নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়ছে লেকের পানি। আমি দেখছি নৌকা আরও দ্রুত ডুবতে শুরু করেছে। লেকের পানি দিয়ে আমার পা ভিজে যাচ্ছে। লেকের পানি দিয়ে আমার পা ডুবে যাচ্ছে। লেকের পানি নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়ায় আমার হাঁটু ভিজে যাচ্ছে। লেকের পানি নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়ায় আমার উরু ভিজে গেলো একসময়। এভাবে একসময় আমার কোমরও ভিজে গেলো। লেকের পানি দিয়ে একসময় আমার বুক ভিজে গেলো। লেকের পানি দিয়ে একসময় আমার গলা ভিজে গেলো। আমি পানির গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমি পানির অতলান্ত গভীরতা নিজের উচ্চতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছি। পারছি না। আামার শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে। একসময় মনে হলো আমার অন্যের সাহায্যের দরকার। আমি উচ্চারণ করতে চাইলাম কিছু। আমি চিৎকার দিতে চাইলাম। আমি চাইলাম বাঁচাও শব্দটি উচ্চারণ করতে।
কিন্তু আমার মুখ থেকে কোনো শব্দই উচ্চারিত হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু হচ্ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার। কিছুই করতে পারছি না আমি। ঘুমের ভেতরে কি আর চিৎকার দেওয়া যায়!
জাগা পেলাম একসময়। বুকের ভেতর অনেক ধড়ফড়ানি। জাগা পেলাম একসময়। দেখি, খুব ঘেমে গেছি। জাগা পেলাম একসময়। কিন্তু নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত বেগে। জাগা পেলাম একসময়, দেখি, বুকের ছাতি ওঠানামা করছে। ধাতস্থ হতে সময় লাগলো। তারপর মনে পড়লো একটি বিশেষ কথা। মনে পড়লো মাছের স্বপ্ন দেখলে আমি অসুস্থ হয়ে যাই।
আজ এখন পায়ের কাছে এই ঘাসের ভেতরে মাছ দেখে আমার কী ভাবা উচিত, সেটাও ভাবতে পারলাম না। সবকিছু শূন্য শূন্য লাগছে। কিছুই যেন ভাবতে পারছি না। নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা সারাদেশে এত এত জায়গা থাকতে আমি কেন দিনাজপুরে এই বিনোদনপার্কে এলাম? স্বপ্নপুরীতে স্বপ্ন দেখতে? না-কি স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে। নাকি…। ভাবলাম এই ভাবনাগুলো নিছক মামুলি হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখনই ওই দৌড় দেওয়া ছেলেটিকে দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে সে মাথা নিচু করে। ছেলেটির দিকে চোখ পড়তেই আমি যথারীতি মাছের কথা ভুলে গেলাম। আমি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকতে যাব। ঠিক তখনই দৌঁড় দিলো সে। আমি একটু দ্রুত পায়ে তার দিকে হাঁটতে থাকলাম। দ্রুত হাঁটলে যদি তাকে ধরা যায় তখন তার সঙ্গে একটু কথা বলো যেত। কিন্তু না। মুহূর্তেই আমি ভিড়ের মধ্যে তাকে হারিয়ে ফেললাম।
বাসে করে ফিরছি। ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। ক্লান্ত অবসন্ন মনও। অজ্ঞাত কারণে এখানে এসেছিলাম। ভাবছিলাম আমার প্রচলিত জীবন থেকে একটু দূরে থাকতে পারব। কিন্তু না। জীবন তো মনের সঙ্গেই থাকে। মন থাকে শরীরের সঙ্গে। তাইতো শরীরটা নিয়ে আসাতে মনটাও চলে এসেছে। আর এ দুটো এসছে বলে জীবনটাও এসেছে। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। প্রচলিত জীবন থেকে একটু দূরে থাকা হলো না। তাইতো বিনোদনকেন্দ্রের ভেতরেও একাকী বেঞ্চের কাছে মাছ পাওয়া যায়। আনন্দ নিতে আসা হাজারো মানুষের ভেতরে একাকী শিশুকে অর্থময় অথবা অর্থহীন চক্রাকার দৌড়াতে দেখা যায়। স্বপ্নে দেখা মাছ বাস্তবে এসে চোখের ভেতরে ঝাপটানি দেয়। হঠাৎ হঠাৎ আঁশটে গন্ধে ভরিয়ে দেয় চারপাশ।
এসবই বোধ হয় ভাবছিলাম। ক্লান্ত শরীর। অবসন্ন মন। সারাদিনের অসহ্য গরম ছাপিয়ে চলন্ত বাসের বাতাস গায়ে এসে লাগছে। ঘুম লেগে গেল। যেন ঘুমের ভেতরেও বাইরের আলো-আঁধারির মতো মনের ভেতর এক বিশেষ আলো-আঁধারি খেলা করতে লাগলো।
একটু তন্দ্রা এসেছিল বুঝি। ফলে ক্লান্তিভাব দূর হয়ে গেছে। আবার সুন্দর লাগতে শুরু করেছে। অন্ধকার রাতের ভেতরে হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানি। তার ভেতর দিয়ে শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। গাড়ির ভেতরেও মৃদু আলো। মনে হচ্ছে যেন কোনো অলৌকিক যানে চড়ে পাড়ি দিচ্ছি দেবালয়।
জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাই। অন্ধকার। কালো অন্ধকার। অন্ধকার, কালো অন্ধকার।
অন্ধকার। কালো অন্ধকার।
আশিক এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল। আমিও তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলাম। সে এমন গুছিয়ে কথা বলছিল আমি বিমুগ্ধ না হয়ে পারছিলাম না। আমার কৌতূহল বেড়েই চলছিল। আমি অপেক্ষা করছিলাম আশিক কোথায় গিয়ে তার গল্প শেষ করে। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে আশিক শুধু অন্ধকার, কালো অন্ধকার বলে যাচ্ছে। আর কিছুই বলছে না। পরের ঘটনার দিকে যাচ্ছে না তার কথাসকল।
আমি বললাম, আশিক শুধু একই কথা বলে যাচ্ছিস কেন?
আশিক বলল, একই কথা বলে যাচ্ছি মানে?
হ্যাঁ, তুইতো শুধু বলে যাচ্ছিস, অন্ধকার , কালো অন্ধকার।
হ্যাঁ অন্ধকার, শুধুই কালো অন্ধকার।
শুধু অন্ধকারই ছিল ওখানে। শুধুই অন্ধকার।
অন্ধকারই বেশি ছিল। সামান্য কিছু আলো। তারও দেখা মিলত অনেকক্ষণ পর পর।
আমি আবারও চুপ করলাম। কারণ আশিক আবার বলা শুরু করেছে। তার প্রবাহ হোঁচট খাক তা আমি চাই না।
আশিক আবার বলা শুরু করল।
অন্ধকরাই বেশি ছিল। মাঝে মাঝে আলোর দেখা মিলত। কী যে অদ্ভুত লাগতো! সবুজ গাছপালাগুলোও কালো কালো লাগতো। অন্ধকার এমনই এক জিনিস যা সবকিছুকে কালো করে দেয়। যে রঙই হোক না কেন তা কালো হয়ে যায়।
এই কৃষ্ণআাঁধারের ভেতরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। একসময় সৃষ্টি হলো আলো আঁধারি পরিবেশ। কী যে অদ্ভুত! আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে আকাশ দেখার চেষ্টা করলাম। কিচ্ছু নেই। কোথায় যে হারিয়ে গেছে তার সবটুকু নীল! হারিয়ে ফেলেছি এই নীল। কিন্তু কেন যে এই সময় আকাশের নীল দেখতে ইচ্ছে করল! কিন্তু অন্ধকারে হারিয়ে ফেলেছে আকাশ তার সবটুকু নীল। আমরাও তো দিনে দিনে কতদিন হারিয়ে ফেলি! মনের খাতায় কিংবা পৃথিবীর পৃষ্ঠায় এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। হারিয়ে ফেলি সেই দিনের রোদ। হারিয়ে ফেলি সেই দিনের বাতাস। হারিয়ে ফেলি সেই দিনের গন্ধ। তুই কি জানিশ এক দিনের রোদ আরেক দিনের মতো নয়! একদম আলাদা। তুই কি জানিস একদিনের বাতাস আরেকদিনের মতো নয়! একদম আলাদা। তুই কি জানিস একদিনের গন্ধ আরেক দিনের মতো নয়! একদম আলাদা। এভাবে কত দিনের রোদ আসে। এভাতে কত দিনের রোদ চলে যায়। এভাবে কতদিনের বাতাস আসে। এভাবে কত দিনের বাতাস চলে যায়। এভাবে কত দিনের গন্ধ চলে আসে। কত দিনের গন্ধ চলে যায়! এভাবে কত ঢেউ আসে। কত ঢেউ চলে যায়! কত ঢেউ আছড়ে পড়ে। কত ঢেউ নিঃস্ব করে দেয়। এভাব কত ঢেউ বেদনা জাগিয়ে দেয়। এভাবে কত ঢেউ বিপন্ন করে। এভাবে কত ঢেউ নিঃস্ব করে। এভাবে কত ঢেউ হৃদয় খুঁড়ে চলে যায়! এভাবে কত ঢেউ মনের ভেতরে মেঘ জমায়। এভাবে কত ঢেউ মনের ভেতরে বৃষ্টি নামায়!
নিজেকে প্রশ্ন করি। বারবার। বহুবার। নিজেকে প্রশ্ন করি আবার। আচ্ছা! আমার এরকম হয় কেন? কেন আমার তন্ত্রীতে খেলে যায় নিগুঢ় সব বিষয়! পৃথিবীকে আমার কেন এরকম লাগে। কত প্রশ্ন চলে আসে লক্ষ্যে। কত প্রশ্ন চলে আসে অলক্ষ্যে। কত প্রশ্ন চলে আসে সচেতনভাবে। কত প্রশ্ন চলে আসে অচেতনভাবে। কত যে মেঘ জমে এই মনের ভেতরে! পকেটে হাত দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ কেন যে বের করে আনি বিপন্ন কুয়াশা! বিপন্ন কুয়াশা কেটে যায় একসময়। রোদ ওঠে। রোদ উঠতে উঠতে পৃথিবীটা হয়ে যায় ঝকঝকে। আমার চোখ দুটো যেন হয়ে যায় ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার। ফিউ ফাইন্ডার দিয়ে আমি কী যেন খুঁজি। ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে আমি কাকে যেন খুঁজি। চারিদিকে বালুকারাশি ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। তারাও রোদের পরশে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। আমার মনে হয় এ তো ঝিলিক নয়। মৃত নদীর কান্না। কারণ এই চরের চরাচর মৃত নদীর শব। এখানে নেই আনন্দের ঢেউ।
এর ভেতরে মনে হতে থাকে কে যেন আমাকে ডাকে। বোধকরি মনের ভেতরে জমা হতে থাকে মেঘ। মেঘ ঘণীভূত হয়। যতই ঘণীভূত হতে হতে বৃষ্টি হয়ে ওঠে ততই কে যেন আমাকে ডাকতে থাকে। সে-ডাকে আমি বিহ্বল বোধ করি। বুঝতে চেষ্টা করি কে আমাকে ডাকছে। একসময় বুঝতে পারি আমাকে ডাকছে এই চিকচিক কান্না। একসময় বুঝতে পারি আমাকে ডাকছে নদীর চরের এই বালুকা-দুঃখ। তারা আমাকে বলে, তোমার মেঘগুলো আমাকে দাও।
আমি বলি, না, আমারই থাক।
তারা বলে, আমরা শোষণ করে নেব যাবতীয় দুঃখ-মেঘ।
আমি হেসে উঠি। আমার অট্টহাসিতে বালুকাসকল বিস্মিত হয়। একসময় হাসি থামিয়ে বলি, তোমরা আসলে কোনো দুঃখ-মেঘ নিতে চাও না। তোমরা চাও এই বালুকা-জীবনের সমাপ্তি। তোমরা চাও নদীর ঢেউ হয়ে যেতে। তোমাদের দরকার ঝুম বৃষ্টি। আমার কাছে কোনো ঝুম বৃষ্টি নেই।
চলবে…