জাকির জাফরানের কবিতা
চিঠি
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন— ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেল,
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি।
অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেল
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে,
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
অশ্রুলীন
তুমি আসবে না জেনেও বৃষ্টি হল সারারাত,
আকাশটা নেমে এল জানালার ধারে
বকুল ফুলের ঘুম ভেঙে গেল খুব ভোরে,
তুমি আসবে না জেনেও বিশটি রাতের পর এসেছিল
একটি প্রভাত।
তুমি ভালোবাসবে না জেনেও এক উদ্ভ্রান্ত বালক
প্রণয়ের পতাকা ওড়ালো কাল সারাটা বিকেল
আর সূর্যাস্ত-টেনিসের পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে
ছিঁড়ে ফেলল সে সন্ধ্যার পালক।
তুমি ভালোবাসবে না জেনেও একটি শালিখ
খড়কুটো কুড়ালো সারাটি সন্ধ্যা,
কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো ভীষণ রক্তিম হল সারারাত,
খুব ভোরে বকুল ফুলের ঘুম ভেঙ্গে গেলে
দেখা গেল তুমি আমি একই—
আমাদের মধ্যে শুধু
পাশাপাশি জেগে থাকা গাছের তফাৎ।
পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম
নিচু এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন।
বিস্তৃত অনাগ্রহের প্রতি উড়ে আসে মেঘ
তোমাকে জড়িয়ে ধরে মনে হলো ধান
মনে হলো উৎসব
জন্ম ভেঙে
দূর দূর অন্ধ দ্রাঘিমায়
নিচু ক্লাসে পড়! আহা!
চুলে এত রৌদ্র-কুমকুম, চোখ যেন সমুদ্রপৃষ্ঠা
টেনে নাও আমাকে তোমার ছত্রে ও ছায়ায়
পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম, পাখি উড়ে যায়
চন্দন চৌধুরীর কবিতা
প্রকাশ
রাগিও না, নক্ষত্র ছেপে দেব।
সেই যে মিনুদি, কৈশোরের গল্পচ্ছলে
দেখিয়েছিলেন দুধাল কোমর
এর আগে বুঝিনি
মানুষের শরীরে যে নদী বাস করে
শোনা যায় ঢেউয়ের আওয়াজ।
রাগিও না, বলে দেব সেই কথা।
স্বাধীনতা
করিনি হাড়ের চাষ, মাটিতে মুণ্ডুর বীজ পুঁতেছে রাক্ষস।
গোপনে দিয়েছে জৈবসার। শস্যের বয়স অস্থি-মজ্জাভারে
কী বীভৎস উর্বর! সৌন্দর্য এখানে বরং উজ্জ্বল অহঙ্কারে
মরেছে শ্যামল রাজ্যে; মৃত্যুতন্ত্রে গর্ভঋতুতে নেমেছে ধস।
দীপান্বিতার গলার স্বর্ণচেইন, চলার ঘোষক ঘুঙুর,
মাটির ব্যাংকে জমানো কিছু মুদ্রা পড়ে আছে খনির খননে।
সংগ্রামী কোরাস জন্মে শজারুর কাঁটা হয়ে বিদ্রোহী মননে।
কান্নারুদ্ধ বুকের বলয়ে গাজলিক উৎরোলের সমুদ্দুর।
দীপান্বিতা, কোথায় কলঙ্ক তোর! জ্যোৎস্নাময় সুবর্ণের দানা
হীরাদামি ত্যাগে, ভস্মস্তূপে বস্ত্রহীন স্পৃহার দ্রৌপদী তুই,
স্তব্ধতার মেঘে চেতনামুক্তোয় চিরায়ত রঙধনুর ভুঁই,
লখিন্দরের ভাসন্ত ভেলার বেহুলা, বাংলাদেশ নামখানা।
জোতের জমিতে কঙ্কালের কবি, পাই প্রচণ্ড স্পৃহার বোধ;
আক্রোশী টঙ্কার ধমনীতে শিরায় শিরায়, চাই প্রতিশোধ।
কবিসন্তরণ
জুতার তলাকে আগেই উৎসর্গ করেছি রাস্তার নামে
ফিতা ছিঁড়ে পা ঘষছে
নাকে এসে সুখ তুলে চিট-মিঠাইয়ের ঘ্রাণ
ডাকনামে কড়া নাড়ে শৈশবের দিন
আলখাল্লা খুলে ওড়ে প্রজাপতিমন
দুয়ারে মায়ের ডাকবড় বেশি অন্তঃক্ষরা হিমশৈলপুর
সম্মুখে প্রবল প্রাণ, গেয়ে ওঠে ধূলিমাখা অক্ষরের গান
মামুন রশীদের কবিতা
প্রবাস
মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না
তবু সেই সত্যে আস্থা রাখি বারবার।
সীমান্তঘেঁষা শরণার্থী শিবিরের দূর ভূমি থেকে অস্পষ্ট
নিভু নিভু আলোররেখার দেখানো পথে
চৈত্রের হঠাৎ দমকা হাওয়ায়
গাছের পাতায় লিখে রাখা প্রিয় মুখ
ঝরে যায়, শিবিরে হুটোপুটি করা শিশুর সরল চোখে
দুপুরের আলস্য ভেঙে নামগুলো মাথা গাঁথে।
কোনো দুঃসংবাদ নয়, বরং প্রতিদিন ডানাগজানো ঘুড়ি ওড়ে
মুকুরে প্রতিফলিত মিথ্যে মুখের মতো, বদ্ধ কুঠুরিতে।
সময়
সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।
এ এক শরীরী ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে, চক্রাকারে।
শূন্যতায় কোলাহল—বোবা অনুভূতি—দিনমান অস্থিরতা
শূন্যতায় ফিসফিস—কলকল ছলছল—স্বপ্নময় স্পর্শ।
একাগ্রতায়, আনমনে শুধু ঘুরিয়ে দেখানো নয় নিজেকে।
প্রতিবিম্ব অশরীরীর মতো চলমান।
অভিমান—অনুরাগ—ভালোবাসায় দীর্ঘ দিবস।
এ শুধু ভ্রমণ নয়। এক শরীরী যাপন।
প্রিয়তমেষু
এ ঘোর অরণ্য তীরে একা বসে ভাবে প্রেমদাসে।
প্রতিধ্বনি তুলে পাখি উড়ে যায় দূরের আকাশে।
প্রকাশিতে আজ তার বড় কৃপণতা—
মেঘের আড়ালে যথা ঢাকা পড়া চাঁদের কিরণ।
গোধিকা তালাশে গিয়ে ব্যাধবেশে, ব্যর্থ
ঘরে ফিরে ভাবে—
চকিতের ভ্রমে, পলকের ফাঁকে
পিঞ্জিরার পাখি উড়ে গেছে বুঝি সুদূরে, তিলকপুরে।
কী পাপে কল্পনাতাপে হইনু বন্দি ফাঁদে
আমি ব্যাধ আজি এ প্রবাসে।
করো অধিষ্ঠান দেবী, এ ভাঙা মন্দিরে—
মুক্তাবিন্দু হয়ে বেড়ে ওঠো ক্রমে আমার এই ঝিনুক শরীরে।
যেমতি ফুল্লরা যাপে মধুঋতু কালকেতুসনে অরণ্যনগরে।
চাণক্য বাড়ৈ-এর কবিতা
প্রকৃত ঈশ্বর
বাড়ছে চন্দ্রকাতরতা—আমরা চলেছি মঘা-অশ্লেষার রাতে—গন্তব্য জানি না বলে
খুঁজে ফিরছি সপ্তর্ষিমণ্ডল—গুরু নানক, এই তো সেই পথ, যে পথে ফিরে এসেছিল
ভাওয়াল সন্ন্যাসী—
পেরিয়ে যাচ্ছি ঘন কুঁচবন—কেউ কেউ বলে, যেতে হবে বিশাখাপত্তম। করোটিতে
প্রশ্ন-পিপাসা—অথচ বিস্ময় ছাড়া আর কোনো যতিচিহ্ন নেই। কেউ কেউ বুঁদ হয়ে
আছে পাণিনি ও চার্বাকে, কেউ সাংখ্য বা যোগে—অথচ আমরা যেতে চাই, যেখানে
শূন্যই প্রকৃত ঈশ্বর।
সঙ্গে নিয়েছি উইকিপিডিয়া আর মহান ঘড়ি—সূর্য ও চন্দ্রের যিনি নির্ভুল অনুবাদক।
মহাশূন্যে কেউ নেই—শুধু ঊষার ইশারা—ভোর হলো—আমাদের চারপাশে
ক্রুশকাঠ, শিবলিঙ্গ; সারি সারি ভেজাবুদ্ধের দল…
প্রতিতুলনা
মাছরাঙা, কনিষ্ঠ আঙুলের মতো কঞ্চিতে বসে টলটলে জলের পুকুরে প্রতিবিম্ব আঁকছে,
আর তার চোখের সরোবরে সাঁতরাচ্ছে আঁশটে স্বপ্নের কতগুলো মাছ
তুমি, গায়ে গোধুলি-চাদর জড়িয়ে রূপালি আয়নায় আত্মপ্রতিকৃতি আঁকছ,
আর তোমার চোখের চৌরাস্তা বরাবর হেঁটে আসছে নোনা স্বপ্নের শিব
আমি, তুমি-বিষয়ক শব্দাবলি নিয়ে তোমার বিমূর্ত মুখাবয়ব আঁকছি,
আর আমার চোখের চা-চামচ উপচে পড়ে যাচ্ছে ঘিয়ে-রঙ-রোদে তোমার চুলের নস্টালজিক দ্রবণ
পড়ে যাচ্ছে …
কীর্তন
‘হায় হায় ওরে…ওপারেতে শিমুল গাছটির ঝিকমিক করে লতা
হায় হায় ওরে…সকল লতা বয়ে গেছে কৃষ্ণ গেছে কোথা?’
খোল করতাল বাজে। দূর হতে আসে মগ্ন কীর্তন। ওখানে ব্যাকুল বৃন্দাবন— ওখানে বিষণ্ন মাথুর—
. কেমনে বঞ্চিবোঁ রে বারিষা চারি মাষ।
. এ ভর যৌবনে কাহ্ন করিলে নিরাস
এমনি প্রহর গুনে বেড়ে যায় সংক্রান্তির রাত। বেড়ে যায় রাধার বেদন। দূরারোগ্য বিরহে ভরে
চন্দ্রগ্রস্ত রাতের পেয়ালা। আসছে বরষার মাস। কণ্টকময় স্মৃতির আষাঢ়। চতুর কৃষ্ণের
ফাঁদে মূর্ছা যায় সরলিনী রাধা— কোথায় নিষ্ঠুর কালা, প্রাণের কানাই? কথকের সাথে সাথে
দুচোখের জল ঢালে অষ্টসখী-শ্রোতা। —ওখানে ব্যাকুল বৃন্দাবন —ওখানে বিষণ্ন মাথুর—
. কাহ্নাঞিঁ মোরে আণিয়া দে।
. আলো পরাণের বড়ায়ি।
. কাহ্নাঞিঁ মোকে আণিয়া দে।
বড়ায়ি রে! নন্দের নন্দনেরে ডেকে আন— বিধুর ব্রজধামে…
—ওই দূরে খোল করতাল বাজে
—ওই দূরে খোল করতাল কাঁদে।
মোহাম্মদ নূরুল হক-এর কবিতা
রোদের আঁচড়
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষের চোখ আঁকে ছাদের আকাশ
তারাগুলো মরে গেলে গলে যাওয়া রাতগুলো ঠিক জেনে যায়
একবার নদীদের ধর্মঘটে কবিতারা ঢেউ এনেছিল।
সেবার শিখেছিলাম—চূড়ায় উঠতে নেই; চূড়া খুব ছোট
আমি জানি মুঠোভর্তি নদীগুলো কোনোদিন চূড়ায় ওঠেনি।
সম্পর্কের বেণী ধরে পতনের পাণ্ডুলিপি পাঠ করো যদি
ইতিহাসে ধূলো জমে, বাতাসেও লাগে সেই রোদের আঁচড়
একঝাঁক অন্ধকার খুঁটে খায় চূড়োর উত্থান—
পতনের নীতি আছে—ঘৃণারও ইতিহাস।
হয়তো নিখিল নীলে ছবি আঁকে চিরঅন্ধ আলোর সন্ত্রাস;
আমাকে উন্মাদ ভেবে মাইল-মাইল রাত গিলে গিলে খায়।
প্রতারক চিত্রকর;
আমাকে পায় না খুঁজে মিছিলের আগে-পরে গোয়েন্দা বায়স!
এই নাও সান্ধ্যনদী; সূর্য মরে গেলে দিয়ো মাতাল চুমুক
আমার পকেটভর্তি তৃষাতুর চৈত্রের আকাশ
মগজে স্লোগান তুলে জেগে থাকে রাতগুলো আলোর কাঙ্ক্ষায়।
চূড়ায় ওঠে না নদী—যে ওঠে সে পুড়ে মরে তুমুল ঘৃণায়।
স্রোতের নামতা
ডালিম দানার মতো লাল-লাল কামুক সূর্যাস্তে
লাফিয়ে উঠুক মুঠোবন্দী রাধিকার স্তন। আর—
সমস্ত আকাশ সেই শিক্ষিত মন্থন দৃশ্য দেখে
নাক্ষত্রিক বেদনায় কেঁদে কেঁদে উঠুক এবার।
জ্বলন্ত সূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকেছি চণ্ডীদাস।
আয় রজকিনী ঘাটে—রসের দিঘিতে আমি ঢেউ।
নদী নদী জল এনে—আয় তৃষ্ণা মেটাবি দিঘির।
জানি তোর কোমরের কলসে প্রেমের বিষ নাচে
তোর চুলের বেণীতে ফণা তোলা সাপের নিশ্বাস
তোর চোখের তৃষ্ণায় পুড়ে খাক সহস্র সমুদ্র
চান্দের আন্ধারে নামে গেলাশ গেলাশ প্রিয়ঘুম
আমি ঘুম পান করি—রাত খাই কালান্ধসন্ধ্যায়
বয়স্করাতের দীঘি ঢেউ তোলে শরীরে আমার।
তোর গতরের নদী স্রোতের নামতা শেখে নাই?
লাল মাছি
একটি লাল মাছির গান শুনে জেগে উঠে দেখি
. আমার সামনে তুমি—
অন্ধনদীর সতীন হয়ে বসে আছ একা একা!
আমি স্রোতের নামতা ভুল করে গেয়ে উঠলাম
তোমার নামে নিটোল কোনও সন্ধ্যার স্বরলিপি।
আমাদের দক্ষিণের বারান্দায় নাকি বহুদিন
. ঘুমিয়েছিল সম্ভ্রান্ত রাত
অথচ রাত্রির গানে কোনোদিন সুর সাধিনি!
আমি বাউল ছিলাম; তেপান্তরে হাঁটিনি কখনো?
অথচ তোমরা শুধু শুনে গেলে তীব্র পদধ্বনি!
অন্ধ রাতের মগজে সূর্য ডুবে গেলে—
আমি একা পার হব লাল মাছি জেগে থাকা মাঠ?
কাউকে চাই না আজ সূর্যকান্ত রাতের শয্যায়!