চোখ ফেটে কান্না আসে। আশিককে বলি, তুই এই ছেলেকে চিনিস?
আশিক বলল, ঠিক চিনি না। কিন্তু চিনিও। তার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।
আমি বললাম, কোথায়?
আশিক বলল, সে আরেক কাহিনি।
আমি মনে মনে প্রত্যাশা করছি আশিক এখুনি তার আরেক কাহিনি বলতে শুরু করবে। কিন্তু আশিক শুরু করে না। আমি আশিকের দিকে তাকাই। তার কোনো ভাবান্তর নেই। সে শুরু করতে চায় এরকম কোনো লক্ষণও নেই। কারণ তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে সে স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। এবং স্মৃতিতে পেলেই সে বলা শুরু করবে। আমি তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ওই শিশুটির দিকে তাকাই। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ দেখে বুক ফেটে যায়। কি সুন্দর টানা টানা চোখ, কিন্তু সেখানে এখন বিষ-জর্জর নীলাভ আভা। কী সুন্দর টানা টানা চোখ, কিন্তু সেখানে এখন ঘোলাটে বাষ্পের ওড়াউড়ি। কী সুন্দর টানা টানা চোখ কিন্তু তা এখন পাণ্ডুর। কী সুন্দর টানাটানা চোখ কিন্তু তা এখন পাংশুবর্ণের। ওই চোখের দিকে তাকানোও এক বিশাল কষ্ট এখন। হাজারো বিবিধ কষ্টের মাঝে আমরা এখন আরেক কষ্টের মুখোমুখী। আমাদের বোধহয় কষ্ট থেকে নিস্তার নেই।
না থাক নিস্তার। কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে এমন অক্ষম হয়ে যাই যে, চোখের সামনে কত কিছু হয়ে যায় আমরা তার কিছুই করতে পারি না। অথচ আমাদের ইচ্ছের কোন কমতি নেই। এমনকি এমন কিছু ঘটে যায় যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এমনকি একটু চেষ্টা করলেই সে-ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। আমাদের ইচ্ছে থাকলেও সে-চেষ্টা করতে পারি না। এক অদ্ভুত অক্ষমতা আমাদের পেয়ে বসে মাঝে মাঝে। এক অদ্ভুত অক্ষমতা আমাদের মাঝে মাঝে নির্বাক করে দেয়। এক অদ্ভুত অক্ষমতা আমাদের মাঝে মাঝে নিস্পৃহ করে দেয়। এক অদ্ভুত অক্ষমতা আমাদের মাঝে মাঝে বাকরুদ্ধ করে দেয়। এক অদ্ভুত অক্ষমতা আমাদের মাঝে মাঝে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। সে শিকল কখনো দৃশ্যমান কখনো অদৃশ্য। আমরা বয়ে নিয়ে চলি সে দৃশ্যমান শিকল। আমরা বয়ে নিয়ে চলি সে অদৃশ্য শিকল। এতে আমাদের হাহাকার বাড়তেই থাকে শুধু। আমরা কিছুই করতে পারি না।
এই কিছুই না-করতে পারার মাঝে, এই অদ্ভুত অক্ষমতার মাঝে, এই নির্বাক বিহ্বল বিমূঢ় সময়ের মাঝে, এই বাকরুদ্ধকর পরিবেশের মাঝে, এই বিতৃষ্ণ শিকল যাতনাময় যাপনের মাঝে, এই বিষ-জর্জর নীলান্ত নীলের মাঝে আমি হঠাৎ এক নবজাতক শিশু অথবা শিশুর কান্না শুনতে পাই। এই বিহ্বলময় সময়ের ভেতরে থেকেও আমি খুবই তীব্ররকম অনুভূতিময় হয়ে উঠি। এই বিপর্যস্তকর সময়ের ভেতরে অবস্থান করেও আমি তীব্ররকম সচেতন হয়ে উঠি। এই বাকরুদ্ধকর পরিবেশের ভেতরে থেকেও আমার মস্তিষ্ক কথা বলে ওঠে। এই বিষ জর্জর নীলান্ত নীলের মাঝে আমার মনটা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। এই দুধেল বর্ণের জোসনার ভেতরে আমার মানব মন হাহাকার করে ওঠে ওই কান্নার জন্য। ওই কান্নার প্রতি আমি তীব্র টান অনুভব করি। আমি এক্ষুণি ওই কান্নার কাছে যেতে চাই।
তখন আমি শিশুটির দিকে আবার তাকাই। দেখতে থাকি কান্নার শব্দ তার কাছ থেকেই আসছে কি-না। না। কান্নার শব্দ তার কাছ থেকে আসছে না। বিষ-জর্জর মুখ নিয়ে করুণ চোখে সে তাকিয়ে আছে শুধু। সে-চোখে এত মায়া ভাবতেই বুক ফেটে যায়। তাহলে কোত্থেকে এই কান্নার শব্দটি আসছে! আমরা এমন এক অক্ষম সময় পার করছি যে কান্নার উৎস জানলেও সেখানে যেতে পারব না। কিন্তু মানব মন তো সব সময় সব যুক্তি গ্রাহ্য করে না। চোখ বন্ধ করলে না-কি কানের সূক্ষতা বেড়ে যায়। বোঝা যায় শব্দের প্রকৃতি। বোঝা যায় শব্দের উৎসের দূরত্ব। আমিও সে নিরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম। চোখ বন্ধ করে সমস্ত ইন্দ্রিয় কানের কাছে সোপর্দ করলাম। যতটুকু বুঝলাম তাতে মনে হলো কান্নার শব্দটা আসছে খুব নিকট থেকে। কিন্তু ঠিক কত নিকটে তা বুঝতে পারলাম না। যদি ঘাড় ঘোরানোর সামর্থ থাকত তাহলে এই দূরত্বের অনুমান আরো সহজতর হতো।
এমতাবস্থায় আমি আশিকের দিকে তাকালাম। তার অনুমানের সঙ্গে আমার অনুমান মেলাতে চাইলাম। তার মুখে আমার চোখ পড়তেই আশিক খুব চঞ্চল হয়ে বলল, জানিশ ট্রেনটা তখনই থেমে গেল!
আমি আশিকের এই কথার কোনো আগা মাথা খুঁজে পেলাম না। আমি এক শিশু-কান্নার উৎস সম্পর্কে তার সঙ্গে আমার অনুমান মেলানোর জন্য তার মুখের দিকে তাকালাম। আর সে বলে কি-না, জানিশ ট্রেনটা তখনই থেমে গেল।
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ট্রেনটা থেমে গেল মানে? কী বলছিস এসব!!
আশিক তখন আবারো দূরাগত কণ্ঠে বলল, জানিশ, ট্রেনটা না তখনই থেমে গেল।
আশিকের এই উদাস এবং দূরাগত কণ্ঠে এমন একটা কিছু ছিল যে আমি তার কথার গুরুত্ব না দিয়ে পারলাম না। এবং শিশু কান্নার কথা বোধ হয় ভুলে গেলাম। আমি তাকে আশ্বস্থ করার ভঙ্গিতে বললাম, তখনই ট্রেনটা থেমে গেল মানে কী, আশিক? আমাকে খুলে বল। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আশিক আবার বলল, জানিশ ট্রেনটা তখনই থেমে গেল। তার আগে কী হলো জানিশ? তার পরে?
আমি আশিককে খুবই শান্ত এবং আদরের কণ্ঠে বললাম, আশিক আমাকে খুলে বল, ট্রেনের প্রসঙ্গটা কেন বারবার আনছিস?
আশিক এবার ছেলেটার দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে। বলল, তুই না ছেলেটার কাহিনি শুনতে চেয়েছিস?
আমি চুপ করে থাকলাম। আশিক একটু থেমে বলল, এটা সেই কাহিনি।
আমি চুপ করেই থাকলাম। আশিক শুরু করল, ট্রেনটা তখনই থেমে গেল। কোন ট্রেন থেমে গেল? থেমে গেল আনন্দ করার ট্রেন। সত্যিকার ট্রেন নয়। বিনোদন কেন্দ্রে যে-সব ট্রেন থাকে আর কি। আমি এক বিনোদন কেন্দ্রে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। উত্তরাঞ্চলের এ বিনোদন কেন্দ্রটি বেশ বিখ্যাত। ঢাকা থেকে বাসে করে চলে গেলাম একদিন সেখানে।
সেখানকার বিনোদনের ট্রেনটি তখনই থেমে গেল।
তার আগে…
তার আগে ট্রেন চলছিল। ট্রেনে যাত্রীও ছিল। নিয়ম মেনেই চলছিল। আমিও চড়েছিলাম সে ট্রেনে। এই বিনোদন কেন্দ্রের ভেতরেই তৈরি করা রাস্তা ধরে বিশাল ডিম্বাকৃতি পথে সে-ট্রেন চলছে ধীর গতিতে।
ট্রেনটা কিছুদূর যাওয়ার পরই লক্ষ করলাম চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক আমার সমান্তরালে একটি আট-দশ বছরের ছেলে দৌড়াচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সে দৌড়াচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম নিছক ছেলেমানুষি কৌতূহল। কারণ সবার সঙ্গে নারী ও ছোট ছোট ছেলেমেয়ে থাকলেও আমিই এখানে একমাত্র মানুষ যার সঙ্গে কেউই নেই। সত্যিকার ট্রেন হলে বিষয়টা নিয়ে এরকম ভাবার কিছু ছিল না। বিনোদন পার্কের এই ট্রেনের মূল গ্রাহক তো ছোট বাচ্চারাই। তাদের সঙ্গ দিতেই মূলত বড়দের আসতে হয়, ট্রেনে উঠতে হয়। এরকম একটা জায়গায় যখন বড়দের কাউকে এই সেবা নিতে দেখা যায় তখন একটু সন্দেহ হয় বৈকি।
একটু পরেই লক্ষ করলাম সে তাকিয়ে আছে ঠিক আমার দিকেই কিন্তু আমাকে যেন দেখছে না। অথবা দেখছে। যদি না দেখে থাকে তাহলে সে কী করছে? এই চক্রাকার পথের সঙ্গে তার পায়ের পথ মেলাতে চেষ্টা করছে? এটা সম্ভব নয়। আমি জানি এরকম জীবনবাদী দর্শন নিয়ে ভাবার যোগ্যতা তার নেই। আমি জানি এরকম জীবনবাদী দর্শন নিয়ে ভাববার স্থান এটা নয়। আমি এও জানি এরকম জীবনবাদী দর্শন নিয়ে ভাববার বয়সও তার হয়নি। সুতরাং এ বিষয়টা এখানে অবান্তর বৈকি। ভাবলাম তাহলে কি তাল মেলানোর চেষ্টা? ছেলেটা এই চক্রাকার ট্রেনের গতির সঙ্গে নিজের গতির তাল মেলানোর চেষ্টা করছে? তাও হতে পারে। শিশুতোষ কারণে সে এটা করতে পারে। আর যদি দেখে থাকে তাহলে আমার দিকেই বা তার আগ্রহ কেন? আমার সঙ্গে কেউ নেই বলে? কেউ না থাকার জন্য যে ফাঁকা জায়গাটুকু তৈরি হয়েছে সেই আসনের জন্য? কিংবা কী হয় এমন, যদি আমি ওই ফাঁকা জায়গাটাতে থাকতে পারতাম, এরকম ভাবনা? না-কি এটা নিছক কাকতালীয়! সে আসলে দৌড়াবেই। কিন্তু কীভাবে কীভাবে যেন আমার দিকেই তার দৃষ্টি চলে এসেছে! এরকম? আমি তীক্ষè ও নিবিড় চোখে তার দৃষ্টি পাঠ করবার চেষ্টা করলাম।
তখনই ট্রেনটা থেমে গেল।
ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। সে এক হুলস্থুল কা-। ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা মায়ের আসন দখলের চেষ্টায় যেন এক বিশ্রি ব্যাপার। আসন থেকে নামার আগেই তারা ট্রেনে উঠতে চায়। ভিড় ঠেলে একটু সাইডে দাঁড়ালাম। যদি ওই ছেলেটাকে পাওয়া যায়! এখানে সেখানে তাকালাম। না কোথাও নেই। অনেক ছেলেমেয়ে। বিভিন্ন বয়সী। কত হই চই! কত আনন্দ! কত মজা! কত হাসি! কত সুখ! ধরে নিলাম সে সিট নেবার জন্য ওভাবে দৌড়াচ্ছিল। আর তাকিয়েছিল সিটটার দিকেই। শিশুসুলভ চিন্তা থোকেই সে এটা করতে পারে। এখন সিট পেয়েছে। মজা করে ট্রেনের সুখ নিচ্ছে। এবার আমি সিটগুলোতে দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করলাম। যদি খুঁজে পাওয়া যায়! খ^ুজতে শুরু করতে না করতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো।
আমি একটু বিস্মিত হলাম। ট্রেনটি একবার ঘুরে আসার পর আমি যখনই স্থানটি ত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছি, দেখি, ছেলেটি ঠিক আগের মতোই একই ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে। একটা সিটের দিকে তাকিয়ে একটু হেলে থেকে দৌড়াচ্ছে ঠিক ঠিক ট্রেনের গতির সঙ্গে সঙ্গে। এবার আমি আরেকটু ভালোভাবে লক্ষ করলাম। পুরোনো জিন্সের একটা প্যান্ট পরে আছে। গায়ে আধা পুরোনো একটা চক্রাবক্রি হাফ হাতা শার্ট। পায়ে সেন্ডেল। চোখে তার ভরসা হারা দৃষ্টি, বিহ্বল। সে ট্রেনটির দিকে অথবা সিটে বসা ওই ভদ্রলোকের দিকে, অথবা ওই ভদ্রমহিলার দিকে অথবা ওই ওড়না খোলা তরুণির দিকে, অথবা তার বয়সী কোনো ছেলের দিকে অথবা তার বয়সী কোনো মেয়ের দিকে অথবা বাবার মতো দেখতে কোনো বাবার দিকে অথবা মা মা লাগা কোনো মায়ের দিকে অথবা নিছক ট্রেনের ওই আনন্দদায়ী সিটটার দিকে হত বিহবল হয়ে তাকিয়ে থেকে দৌড়াচ্ছে। অনেকদিন না-কাটা চুল কপাল থেকে সে সরিয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। ঠিক একই ভঙ্গিতে একই গতিতে একই দৃষ্টিতে তার এই কার্যকলাপ চলছে।
আমি হয়তোবা সম্বিত নিয়ে অথবা সম্বিত ছাড়াই দৃশ্যটি দেখছিলাম। কিন্তু এই দৃশ্য কতক্ষণ এভাবে চলেছে জানি না। এই দৌড় কতক্ষণ এভাবে চলেছে জানি না। ট্রেনটি কতবার ঘুরে এসেছে জানি না। যাত্রীগণ কত আনন্দ পেয়েছে জানি না। আমি এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম তাও জানি না। একসময় দেখি ট্রেনটি থেমে গেছে। আবার দেখি ট্রেনটি চলছে। আবার দেখি ওই ছেলেটি একই ভঙ্গিতে দৌড়াচ্ছে। আবার দেখি ওড়না পড়া মেয়েটির লজ্জা রাঙা মুখ। কারণ তার ওড়না বাতাসে উড়ে যাচ্ছে খুলে যাচ্ছে। এভাবে এভাবে একসময় পায়ে পায়ে চলে আসি ওই জায়গা থেকে।
চলে আসি ঠিক, কিন্তু ঠিক ঠিক কোথায় যাবো, কোথায় আমার গন্তব্য, কোন আনন্দটি এখন আমার উপভোগের তালিকায় কিচ্ছু জানি না। কিন্তু চলে আসি। চলে আসি অন্য কোনো আনন্দ কেন্দ্রে। কারণ কোনো কেন্দ্রই তো চিরস্থায়ী নয়। কোনো কেন্দ্রই শেষ অব্দি ধরে রাখতে পারে না। মানুষ কেন্দ্রের দিকে যায় ঠিকই কিন্তু কেন্দ্রে থিতু হয় না। কারণ সে কেন্দ্র বিনির্মাণ করতে চায়। আবার কেন্দ্রাভিমুখীদের দাপটে আগের বিনির্মানিচ্ছুককে সরে আসতে হয়। এখানে তো কেন্দ্র খোলা হয়েছে নিছক আনন্দ দিতে। কিন্তু এর কেন্দ্রেও রয়েছে বিবিধ কেন্দ্র বিনির্মাণের পথ।
আমি সে পথ ধরে আগাইনি। হঠাৎ এসব দার্শনিক চিন্তা কেন যে মাথায় আসে তাও ঠিক জানি না। এখানে তো মানুষ আসে নিছক আনন্দ নিতে। আমিও এসেছি। ঠিক তাই।
ঠিক তাই?
হঠাৎ এই প্রশ্নটি মাথায় খেলে যায় বার বার। আমি কি এখানে আনন্দ নিতে এসেছি? হঠাৎ আমার ভেতর থেকে আরেক আমি আমার শরীর থেকে বের হয়ে এসে বলে, না তুমি এখানে শুধু আনন্দ নিতেই আসোনি।
আমার আরেক আমি তখন আমাকে প্রশ্ন করে, তাহওে তুমি ঠিক কী নিতে এখানে এসেছ?
চলবে…
মিথ্যামানব: ৮ম পর্ব ॥ এমরান কবির