বুকের পাঁজর ভেঙে উঠে আসে কবিতার পঙ্ক্তি। এ যেন বেদনার মন্থন, হৃদয় ছিঁড়ে উঠে আসা গোলাপ। কি যে সম্মোহন তার কালচে জামরঙে। কি যে বিধুর তার সুবাসের ভেতর বাস করা অপারগতা। কী করে বলি। এ সম্মোহন বলার নয়। এই যাতনা বোঝার নয়। এই ভার সইতে পারার নয়। তবু আসে বিষাদে প্রথম প্রেম।কি কালিতে কি অক্ষরে যে লেখা হয় নতুন এক অধ্যায়, যেখানে রং নেই ভাষাও নেই। তবু বোধের কাছে ঘুরঘুর করে সারাদিন কি এক সুগন্ধ যেন কেবলই যাতনা বিলায়। মন্থর করে তোলে বাতাসের প্রবাহ অথবা জীবনেরে। বয়স সাড়ে সতেরো। সুইট সিক্সটিনের ধারে কাছেই বিহার তার। তার জলজ প্রপাত। এ কেবলই অনুভবের। এ কেবলই ঘ্রাণ নেওয়ার। চোখে চেয়ে দেখার অপলকের। হৃদয় কাঁপানো প্রপাতে প্রহরে প্রহরে স্নানে জলে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠার যে সাধনায় সাধক নিমগ্ন চিরকাল, এ কেবল তারই শুরু। তারই শেষের কবিতা লেখার আয়োজন।অন্য কিছু নয়। মনে হয় এতকাল পরে বসেও একই কথা ভাবি। এই বুঝি ভাঙা প্রেম। এরই নাম বুঝি বিশেষ কিছু! এরই কিছু পড়ে থাকে জীবনের একধারে অশেষ হয়ে।বয়স পাক্কা সাড়ে সতেরো। চিঠি আসে বাতাসের খামে। তাতে লেখা কাব্যকথামালা। সত্যিই কি এরই নাম কবিতা? না কি কবিতারই আর এক নাম জীবন? না কি কবিতারই নাম প্রেম। না কি প্রেমেরই নাম কবিতা। না কি প্রেম আর কবিতাই জীবন, আমার জীবন! যে কবিতার কথা কইতে পারা যায় না সহজে। কিংবা সহজে যার আবরণ-আভরণ সবই লুপ্ত হয়ে যায়। সুপ্ত হয়ে পড়ে থাকে মুখোশের আড়ালে?
প্রেমের চিঠি পড়ি। প্রথম প্রেমের চিঠি—‘কোরআন তৌরাত ঈঞ্জিল দেব উপনিষদ/সর্বত্র এক ঈশ্বরের কথা বর্নিত/মন মনন ভাবনায়/আমার সমগ্র সত্তায়/পরাক্রান্ত অস্তিত্বশীল/একটি মানবীর মুখ/ সে মুখ তোমার।’
প্রাণের ঠাকুর বলেছিলেন—মানুষ সারাজীবন ধরে একটিই কবিতা লেখে। তা তার নিজের জীবন। এক জীবনেও কত যে জীবনের বাঁক ভাঁজ ফুটে উঠে রয়ে যায় বিনাশে-বিন্যাসে, কত রাখি তার খবর!তাই আমিও রাখি না বিনাশের খবর। কেবলই অর্ঘ্য বিন্যাস করেছি মহালয়া থেকে পঞ্চমী কিংবা ষষ্ঠী, সপ্তমী, নবমী আর দশমীতে। তারপর? তারও পর আছে। আছে এক পাতাল কৈলাশ। মেঘে-মেঘে অকাট ধুম্রজাল।সেদিন ব্রহ্মপুত্রের জলে মেঘেদের ছায়া পড়েছিল। সেদিন বর্ষা গাঢ় নেমেছিল এসে ব্রহ্মপুত্রেরই জলে। সেদিন কাশফুল গান গেয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের কিনারে। সেই যে লালমাইর সঙ্গে প্রগাঢ় এক বিরহ তারপর ময়মনসিংহে এঁদো গলির বাজে বাজে শিস দেওয়া ছেলেগুলোর তাণ্ডবে বিমর্ষ জীবন। তারও আকাশের কিনারে একদিন রোদ ওঠে। খুব বৃষ্টির পরে রঙধনুও দেখা দেয়। তার সাত রঙের কি যে মধুর আভা! আজও গহীনে ডুব দিলে টের পাই। অবিকল। অবিনশ্বর। এই নোংরা-ঘিঞ্জি ময়মনসিংহ শহর। তার চারপাশ আমার কাছে পুতিগন্ধময়। আমি ৭/৮ বছরে লালমাইয়ের কোলের কাছ থেকে যেন গড়িয়ে পড়ে গেছি নিচের কোনো আগ্রাসী গিরিখাদে। সেখানেই বিকশিত হয় প্রেম? অমর প্রেম? তখন প্রথম কবিতার বইটি বের হয়ে গেছে। ১৯৯১ সাল। এসএইচসি পরীক্ষা শেষ। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিংয়ে ভর্তি করে দিলেন মা জোর করে। খুব অনুশাসনের রাখা মানবজন্মের দারুণ এক জোরালো প্রবাহ যেন এসে গেল জীবনে আমার। প্রথম প্রেম ব্রহ্মপুত্র সাক্ষী। প্রথম প্রেম কবিতা সাক্ষী। প্রথম প্রেম বাসন্তী রঙশাড়ি সাক্ষী আর সাক্ষী রেললাইন। শাদা শার্টের বুকের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা প্রতিদিনের এক একটি জামরঙ গোলাপের অমর ঘ্রাণ।কি সুবাস ছড়ালো
জীবনের পরতে পরতে কী করে বলি। সারাদিন ঘরে বন্দি। বই পড়া কলম খাতা কাগজ। বাবার শখ ডাক্তার হই। মায়ের শখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমার শখ নদী হয়ে যাই। কবিতার পঙ্ক্তি হয়ে যাই। আকাশের পাখি হয়ে যাই। চারিদিকে এত রঙ এত মধুরীমার ছড়াছড়ি। এই শহর। এই কাশফুল। এত রঙ কোথায় ধরেছিল এতদিন!সেই লালমাইয়ের গান আজও বাজে এই শহরে! এও কি সম্ভব! এখানেই তবে আকাশেরও মরণ। না হলে কী কথা সুরে সুরে ছড়ায় সেই লালমাইয়ের নীল আকাশের মতো এই শহরের আনাচে-কানাচে। মনে মনে গভীর প্রেম। কোনো কথা নেই মুখে। কেবল কিছু কবিতা। কিছু শব্দের ঠাস বুনট। অক্ষরে অক্ষরে এর বেশি নয় কিছু আর। একা একাই প্রেমের বিহার করি জল-স্থল-সপ্ত পৃথিবী-পারাবার।মনে মনে জপি কত নাম তার।প্রেমে ভাসি প্রেমে ডুবি একা একা দিনমান। বুঝতে পারি না ঠিক। প্রথম প্রেমের এই ক্ষণ এই অনুরণন ঠিক মানবের না কি দেবদেবীরই অনুভব!খুব দেখি তার চোখ আমার চোখে পড়ে কেমন কেঁপে ওঠে হৃদয়ের মরণ।কিছু কথা কিছু সময়যাপন তাতেই মুখর হয়ে ওঠে না ফোটা ফুলের কলি। দিনে-রাতে কার যে আলতো মধুর গোপন বিহারে ঘুম ভেঙে যায় মাঝ রাতে। কি যেন মধুর কানাকানি বাতাসের পরশে। ভাবি আজ বলতেই হবে। তবু কেটে যায় দিন। কেটে যায় কত কত রাত। যখন নিশ্চিত বলবই আজ মনের সকল কথা, না হলে যে আর বাঁচার পথটি অবধি নেই, তখন নতুন কবিতা লেখা হয়—‘ভয়/প্রত্যাশার মাত্রাধিক্য যদি অনন্ত দুঃখের কারণ হয়…’
ধীর হয় গতি। থমকে পড়ে আকাশ। নিদ্রামগ্ন পাহাড়। হৃদয়ে কাঁপন। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ পৃথিবী। এ কি গ্রহণ? এ কি বর্জন! এ কি সম্মান এ কি অপমান? এ কি প্রেম, না কি প্রেমের হরণ!
চলবে…