॥ আট॥
শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ওদের কাজ লক্ষ করলো সলিল। রগ ওঠা পেশল হাতগুলো দ্রুত নড়ছিল। থেকে থেকে সলিলের দিকে ফিরে হাসছিল ওরা। কারও কারও চোখে সংকোচ ফুটে উঠছিল দেখতে পেয়ে সলিল হাসিমুখে সরে এলো।
কোর তৈরির বিশাল এ ঘরের টানা দরজাটি দুটো মানুষ পাশাপাশি আসা-যাওয়া করতে পারে এটুকু ফাঁক রেখে খোলা। রাতে আসা নতুন চালানের বড় অংশ তখনো বাইরে পড়ে ছিল। চলছে ওসব ভেতরে নিয়ে আসার কাজ। এরই ফুরসতে খোলা চৌকো অংশ দিয়ে থেকে থেকেই সলিলের চোখ চলে যাচ্ছিল বাইরের আকাশের দিকে। খানিকটা তার নীল, বেশিটা তার সাদা। বসন্তের প্রভাতী মেঘ আকাশের পর্দায় ক্ষণে আকার বদল করছে। নিচে দখিনা বাতাস কারখানাকে কেটে যাচ্ছে আড়াআড়ি। সীমানা-দেয়ালে মাথা কুটে তার টুকরাংশ ফাঁক বুঝে ঢুকে পড়ছে কোর তৈরির ঘরে।
সলিল অফিসঘরে উঠবে বলে সিঁড়িতে পা রাখলো, ধাতব হাতলে রাখলো হাত। এ সময় ওপরে দরজা ভেজানোর শব্দ পেয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলো, মেহেদি নেমে আসছে, মেঘ থমথমে মুখ। হাসির প্রত্যুত্তরে সে হাসলো না, মনের শীতলতার আভাস দিয়ে চলেছিল অবিকৃত ভুরুজোড়া। নিস্পৃহ গলায় প্রশ্ন করল কেবল, ভালো আছেন?
তা আছি। মুখে হৃদ্যের হাসিটুকু ধরে রেখে উত্তর দিলো সলিল—আপনি ভালো তো?
এই একরকম। কেমন গা-ছাড়া উত্তর মেহেদির। ওপরে উঠছেন না কি?
হ্যাঁ, ঢাকায় কী যেন হচ্ছে, কিছু জানেন? ভাবলাম পত্রিকাটা দেখি একবার।
ওপরে তো ওঠা যাবে না। মেহেদির মুখ আগের মতোই নিস্পৃহ, কণ্ঠেও তার স্পষ্ট ছাপ।
সলিল হেসে বললো, তাই বুঝি? তা গেস্টরুমে টিভির পাশে তো থাকে একটা সবসময়। আজ তো দেখলাম না। নয়তো কষ্ট করে কে আর সিঁড়ি বায় ভাই?
সত্যিই ওপরে ওঠা যাবে না সলিল। আপনার এখনো যখন-তখন ওপরে ওঠার সময় আসেনি।
সলিল স্তব্ধ হয়ে গেল। মেহেদির কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত এ রূঢ়তার বিপরীতে এতটুকু হয়ে গেল তার মুখটা। দুচোখের নিচটা খানিকটা কেঁপে উঠলো অপমানে। মেহেদি আর কোনো বাক্যব্যয় না-করে ওকে পাশ কাটিয়ে টানা দরজার ফাঁক গলে বাইরে বেরিয়ে গেলো। বাতাসে তার পরনের ফতুয়ায় ঢেউ খেলছে। মাথাটা একবার নিচু করে পেছনে তাকিয়ে হাতল থেকে দুর্বলভাবে হাতটি সরিয়ে কেমন ধীর পদক্ষেপে আগের জায়গায় চলে এলো সলিল। ঘরের একটি কোণে পেতে রাখা ছিল রঙজ্বলা প্লাস্টিকের চেয়ার। তাতে গিয়ে বসে রইলো চুপচাপ, ওদিকে শ্রমিকরা সশব্দে কাজ করছে। আর ফিতার মতো রূপার পাত স্বয়ংক্রিয় ধারালো যন্ত্রে আড়াআড়ি কাটা পড়ছে, শব্দ হচ্ছে ঘটাং-ঘট ঘটাং-ঘট। খোলা দরজা-পথে একটা পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া খবরের কাগজ বাহির থেকে বয়ে নিয়ে এলো বাতাস। সেদিকে তাকিয়ে থেকে, শার্টের বুকপকেট থেকে সর্পিল বাঁধাইয়ের ছোট লাল একটি নোটবই বের করে উরুর ওপর রাখল সলিল। প্যান্টের পকেট থেকে বের করল কলম। খাপ দাঁতে আটকেলিখতে শুরু করলো। মনে পড়তেই দাঁত থেকে নামিয়ে কলমের পেছনে নিলো সেঁটে। শান্ত মুখে এদিক-সেদিক তাকিয়ে দ্রুত পা নাড়াতে থাকল সলিল। ক্রমশ ভিজে উঠতে থাকা তার চোখ জোড়ার দৃষ্টি কোথাও স্থির নয়। ঘাড় নামিয়ে একটানা কলম চালিয়ে যেতে থাকল সলিল। হঠাৎ যন্ত্রের পর্যাবৃত্ত ধাতব শব্দকে ছাপিয়ে, কপট রূঢ় কণ্ঠস্বরে কে যেন বলে উঠলো, এ জন্যই কবিদের কাজে নিতে হয় না। এরা ভাব এলেই কবিতা লিখতে শুরু করে দেয়। এ দিকে হয় সর্বনাশ।
যত কবি এসে জুটেছে আমাদের কারাখানায়
তাকিয়ে দেখে সিনিয়র প্রকৌশলী পল্লব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। বলল, বাতিল চেয়ারে বসতে নেই। ঘরের এক কোণে দেখিয়ে—ওই যে টুলমতন আছে একটা? বসার হলে ওটায় বসবেন। আর যা ঘটেছে তাতে মন খারাপ করবেন না। হেঁটে সলিলের চেয়ারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো পল্লব। তার দুটি কাঁধে আলতো করে দুহাত রেখে বলে গেল পল্লব, দেখেছি, আমি সবই দেখেছি। চোখে কেমন অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছেন, দেখেছি আমি। আর এই দৃষ্টিটা কোনোদিন হয়ত ভুলব না। হাহাহা, যা হোক, শুনুন সলিল, এই আমাদের দেখছেন? আমাদেরও এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ওই যে আটকাল মেহেদি? ওই ওকেও। আপনাকে আটকে ওরও কম খারাপ লাগেনি—এটা নিশ্চিত জানবেন। ওর কাছে শুনে না-থামলে কী হতো জানেন? ভেতরে আরও খারাপভাবে শুনতে হতো। বিশ্বাস না হয় তো গিয়ে দেখতে পারেন। খানিক শ্বাস নিয়ে বললো,আমরা সবাই এখানে এসে অনেক বদলে গেছি। কিন্তু মেহেদির মন এখনো অনেক নরম। গিয়ে দেখবেন, ঘরে বসে চুপচাপ সিগারেট ফুঁকছে। ভেবে দেখুন, ওকে যদি জনৈক ক্ষমতাবান সিনিয়র এই নিষেধটুকু করতে বলে দিয়ে থাকে, আর এরপর কে বলতে বলেছে তা প্রকাশ করতেও বারণ করে দেয়, তো ও কী করবে? তখন আপনারও কোনো উপায় খোলা থাকছে না জানার—যে আসলেই কী ঘটলো।
কিছুটা বিরতি দিয়ে ঘুরে আবার সামনে এসে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো পল্লব। চোখজোড়া সলিলের দুচোখের দিকে। যাহোক, আপনি যেন তাকে ভুল না বুঝে আসল লোকটাকে চিহ্নিত করতে পারেন, সেজন্যেই এত কথা বলা। না-পারলে অসুবিধা নেই। কারখানায় এমন অনেক লোকই আছে, যাদের চেনা থাকলেও যা, না-থাকলেও তা। এখন সবার পিছমোড়া হাতে লুকোনো চাপাতি। কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করে না এখানে। কথা যত কম, ফাঁদে পড়ার আশঙ্কাও তত কম। যাই হোক, যত বাজে কথা। এই মেহেদিও কিন্তু অনেকটা আপনারই মতোই। চিটাগাঙের ছেলে, চিরকাল ঘর পালিয়ে সাগর-পাহাড় করেছে। হাহ্! যত কবি এসে জুটেছে আমাদের কারাখানায়। আমাদের ম্যানেজারও নাকি কবিতা লিখতেন, বুঝুন অবস্থা! ট্রান্সফর্মারের না, এটা আসলে একটা কবির কারখানা। এটা হলো সুরবঙ্গের একমাত্র কবি-পরিচালিত ট্রান্সফর্মার ফ্যাক্টরি! হঠাৎ স্বর বদলে বললো, শুনুন, মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলুন। আর আপনার জন্য একটা ছোটখাটো সুখবর আছে। ঘর পাচ্ছেন। আমার সঙ্গেই।
হাত দুটো পেছনে বেঁধে ফিরে যাওয়ার পথ ধরলো। খোলা দরজার কাছে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,আর মাথা ধরে এলে ডাকবেন। আমি কোথায় আছি তো জানেনই। আঙুল তুলে অনির্দিষ্ট কোথাও দেখিয়ে বললো,বাইরে, সিগারেট খাব দুজন। কেমন?
সলিল মৃদু হেসে সায় জানালে পল্লবও হাসিতে প্রত্যুত্তর দিয়ে নিজ জায়গায় চলে গেল।
দুপুরে খাবার টেবিলের পাট নিস্পৃহ নীরবতায় অতিক্রান্ত হলো। সবাই বাইরে চলে যাওয়ার পর সলিল গিয়ে বসলো খাটে। এই খাট তার রাত যাপনের বিছানা, ছারপোকা আর মশার অত্যাচারে আধো ঘুমে-আধো জাগরণে কাটিয়ে দেওয়ার সাক্ষী, আর কারখানার বাঁশি শুনে সকালে ধড়মড়িয়ে উঠে বসার পাটাতন। একটা বালিশ শিয়রের পৌরাণিক লতাপাতা খোদাই করা কাঠের ওপর ঠেস দিয়ে তাতে শরীর এলিয়ে বিছানার ওপর পা দুটো সবে তুলেছে সলিল, এমন সময় খোলা দরজা দিয়ে আসা আলোয় পড়লো ছেদ। বাইরে সূর্য তখন মধ্য আকাশ থেকে খানিকটা পশ্চিমে হেলেছে। কান পাতলে শ্রমিকদের কথার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ মিলছে না। একটি দুটি পাখির উদাস ডাক শুধু কানে আসছে। শিয়রের কাছের খোলা জানালা দিয়ে একবার-দুবার বাতাসের স্রোত এসে পায়ের কাছের জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল,কপাট উঠলো নড়ে। মেঝের ওপর বাতাসে জায়গা বদল করলো ঝাড়ুর একটি ফুল। লাল পিঁপড়াদের একটি সারি খাটের নিচ থেকে ওদের গোপন সুড়ঙ্গের দিকে পিঠে তেলাপোকার মড়ার ছিন্ন হাত-পা, মাথার খোলস, ভাতের টুকরো, বিস্কিটের গুঁড়ো—এসব নিয়ে চলেছে। এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলো তারেক। পেছন পেছন গর্বিত মুখভঙ্গিতে চিবুক উঁচিয়ে ঢুকল আরও দুজন—পান্না ও জন।
তারেক প্রথমেই বিছানার ওপর সলিলকে একবার দেখলো। কিন্তু পরিচিতির কোনো প্রমাণ তার দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো না। তার সঙ্গী দুজন তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো যেন দেখা একবার হয়েছে বটে কিন্তু বিরোধেরও কী এক কারণ যেন ঘটেছে। আর ওই কারণেই সলিলের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পাট এখনো মুলতুবি। থাকলে কী হবে, এ অবস্থায় মধ্যস্থতার কোনো ইচ্ছেই তাদের নেই।
বাক্যে স্যার যুক্ত করার দক্ষতায় দ্বিতীয়জনও কম গেল না
সলিলের দুটি ভুরুর মধ্যখানে পড়লো সেদিনের মতোই সূক্ষ্ম ভাঁজ। খাটের পায়ার কাছে মেঝেতে দেয়ালের দিকে ঠেলে রাখা ছিল তার ট্র্যাভেল ব্যাগ। ভেতর থেকে কালো মলাটের একটি বই টেনে নিয়ে বালিশে পিঠ এলিয়ে পাতায় চোখ বোলাতে থাকলো সে। ওদিকে শক্ত চোয়ালের অভিব্যক্তি নিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলে বসলো তিনজন। ঘরের ছায়ার অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা অংশটি পাওয়ার আশায় তারেককে মধ্যমণি করে টেবিলের বিশেষ এক কোণে বসলো ওরা। টেলিভিশনের দিকে পিঠ পেতে বসলো তারেক আর জন। সলিলের সঙ্গে ওদের অবস্থান কৌণিক হলেও মুখের ভাব লুকানোর মতো কোনো আড়াল কারও নেই। পান্না বসেছে ওদের সঙ্গে সমকোণে। সলিল দেখতে পারছে তার শরীর ও মুখের একটি পাশ, সঙ্গে অপ্রশস্ত পিঠের একাংশ।
ছোট দলের নেতাটির ডান হাত যে হয়েছে, সে থেকে থেকে তাকাচ্ছে সলিলের চোখে, আর সামনে পেছনে নাড়াচাড়া করছে খাবারের পাত্র। পান্নার মুখে কথার খৈ। তারেককে কারখানার এটা-ওটা নিয়ে কত কথা যে বলে চলেছে! সে সবের ভেতর আছে কারখানার কোনো একটি যন্ত্রের ত্রুটি নিয়ে আপত্তি, কোনো একটি নিয়ম নিয়ে অজ্ঞাত কারও নাম তুলে অভিযোগ, আসছে কোনো এক দিনে তার ছুটির অনিবার্যতা,কাজের বিষয়ে দিন কয়েকের ভেতর মনে জাগা কিছু প্রশ্নও। কৌতূহলী শিশুটির মতো তারেককে প্রশ্নগুলো করে যেতে থাকলো সলিলের দিকে পাশ ফেরানো পান্না। আর সুযোগ বুঝে প্রায় বাক্যেই জুড়ে দিতে থাকলো স্যার শব্দটি। কিছুক্ষণের ভেতর পান্নার কথায় জনকেও বেশ অনুপ্রাণিত হতে দেখা গেল। তারও যেন মনে পড়ে গেল অনেক কথা। চোখমুখে ধীরে ফুটে উঠলো প্রশ্ন। গভীর আগ্রহে উত্তর শোনার পূর্বাভাস হিসেবে মুখভঙ্গিতে ফুটল বেশ একটা ধৈর্যশীলতার ছাট, সঙ্গে ভুরু দুটোয় কৌতূহলী ভাব। সে ভাব এতটাই প্রকট যে, সলিলের ভেতরও তা সঞ্চারিত হলো। তবে হাসির রূপে। বইটি নাকের ওপর তুলে দিয়ে তা আড়ালও করতে হলো। বাক্যে স্যার যুক্ত করার দক্ষতায় দ্বিতীয়জনও কম গেল না। তার মনেও যে খেতে বসে করার মতো এত প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল নিজেও জানা ছিল না। বল, ভাগ্য ভালো যে আপনি পাশে থাকতে থাকতেই আমার মনে পড়েছে স্যার। নাহলে তো ভুলের ভেতর ডিগবাজি খেতাম, টেরও পেতাম না। তো, সেদিন তারের লাল কালো হলুদ দেখে হঠাৎ কী মনে হলো জানেন স্যার।
বড় বড় চোখে অনেক কথাই ওরা বলে চলেছে। সব কথাই বলার পর শুধু তারেকের উত্তরের দিকেই সে তাকিয়ে থাকছে না। সলিলের দৃষ্টির উপস্থিতিও যাচাই করছে। অনুক্রমে জন ও পান্না দুজনেই যখন চোরা চোখে বার বার সলিলের দিকে তাকানোর একটি পর্যায়ে হাতে-নাতে ধরা পড়লো,বিব্রত ভাবটি ঢাকা দেওয়ার জন্যে বানোয়াট আমুদে ভাবটি বেড়ে উঠলো আচরণে। হাসিতে একটা ঠা-ঠা-ঠা ভাব এসে যুক্ত হলো ওদের। তাতে কান পাতা হলো দায়।
তারেক বিষয়গুলো একইসঙ্গে লক্ষ করে আর না-করে, প্রশ্নগুলো আমলে নিয়ে আর না-নিয়ে একরকম নীরবে খেয়ে চলেছিল। শুধু স্যারের ব্যবহার অতিরিক্ত হয়ে পড়লে আড়চোখ সেও তাকাচ্ছিল সলিলের চোখে। সলিল তার ব্যাগ থেকে বের করা লরেন্সের বইটি চোখের সামনে ধরে থাকলেও ওদের কথা শুনতে সর্বদা উৎকর্ণ। ওদিকে বইয়ের দিকে তার চোখ জোড়া নিবদ্ধ থাকলেও, মন যেহেতু নেই, চোরা চোখের খেলায় সেও বেশ আমোদ কুড়োতে থাকলো। কিন্তু মুখচোখে তারই প্রতিক্রিয়া। তবে মলাটের আড়ালে। মনোযোগের কৃত্রিমতাটুকু ঢাকা দিতে বইয়ের পাতা দ্রুত এদিক-ওদিক হতে থাকলো।
একসময় চেয়ার ছেড়ে বিছানা পেরিয়ে ওরা একের পর এক বেসিনে হাত ধুতে এলো। পাশে রূপালি রিঙের ওপর ঝুলে থাকা আধময়লা তোয়ালের কাপড়ে হাত মুছলো পান্না। সেদিকে তাকিয়ে ভেজা হাত নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনের পকেটে রাখা রুমালের কথা মনে পড়ে গেল। হাত মোছার ধার না ধেরে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পেটে চালান দিলো তারেক। কী এক কথায় চেয়ারের হাতল ধরে পান্নাভেঙে পড়লো হাসিতে। জন আর তারেকও তাতে কিছুটা যোগ দিয়ে বাঁচলো। এর আগে ছেলেদুটো মধ্যখানে নিজ নিজ পিএফআই যন্ত্রের বেশ কিছু সমস্যা নিয়ে তারেকের সঙ্গে আলাপের উদ্যোগ নিয়েছিল কয়েকবার, কিন্তু তারেক ঠোঁটের বাঁ পাশ আর বাঁ চোখ একসঙ্গে কুঁচকে অনাগ্রহে এড়িয়ে যাচ্ছিল শুধু। বলছিল—নিজে নিজে এগো, সমাধান পাবি। ওটা মনেও থাকবে। আমি বললে থাকবে না।
কিন্তু পরে নিজেও কথার ফাঁদে পড়ে একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকলো নির্লিপ্তভাবে। এমন সময় তড়িচ্চালক কোষের প্রসঙ্গটা উঠলে হঠাৎ নামলো নীরবতা। এর আগে সলিল একবার দুবার করে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফাঁকে বেশ দেখতে পাচ্ছিল, তারেকের উত্তর দিতে পারার কৃতিত্বে জন আর পান্না কেমন ঝলমল করছে। আর চোখে সলিলের জন্য কী এক বার্তাও যেন ফুটিয়ে রাখছে। হঠাৎ নীরবতা টের পেয়ে বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে ওদের দিকে তাকালো সলিল। একটি প্রশ্নের বিপরীতে তারেক বুঝি আটকে গেছে।
সিড়িতে না খুলে দুজনেই অতিথি ঘরের ভেতর জুতাজোড়া খুলেছিল
এসিডের মধ্যে ডোবানো দুটো দণ্ড, একটি ক্ষয় পেয়ে আরেকটিতে গিয়ে ক্রমশ জুড়তে থাকে বলে আগেরটি হয়ে ওঠে সরু, আর অন্যটি হয়ে ওঠে মোটা। কী হচ্ছে বোঝা গেল বটে, কিন্তু কেন হচ্ছে তাতো জানা গেল না! এ নিয়েই প্রশ্ন। বার কয়েক আমতা-আমতা করে চুপ করে গেল তারেক। একবার ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। ওই সময় চেয়ারের হাতলে তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠলো আর পাকা মেঝের গায়ে আঁচড় কেটে চলল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ। তারেক চুপ করে গেছে দেখে ওদের দুজনের চোখে একটা চাপা উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেতে থাকলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো জন,আর পান্না টেবিলের তলে আঙুল দিয়ে গাট্টা মারতে থাকলো ঘনঘন। এদিকে সলিলও যে তাকিয়ে আছে, সেটিও এক ধরনের চাপা বিব্রত ভাব নিয়ে দুজনেই লক্ষ করে গেল।
তারেকের শান্ত মুখে উদ্বেগের সূক্ষ্ম একটি রেখা প্রথমবারের মতো ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্ত পরই তা অপরাগতার, লজ্জার রেখা হয়ে মুখে ফেরত এলো আবার। তারেকের মুখের ভাবটি দেখে তার সঙ্গী দুটির মুখ ততক্ষণে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ জন অযথাই হেসে হাতে তালি বাজালো। আর পান্নার অন্য এক প্রসঙ্গের কথা মনে পড়ে গেল।
আরে! বলাই তো হয় নাই একটা কথা!
দুজনের মধ্যে বেশ কথা চললো বটে। কিন্তু মুখের বিব্রত ভাবটি কাটা পড়লো না। এক পর্যায়ে তারেক লম্বা পা ফেলে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকে কারও সঙ্গে বিনা বাক্যব্যয়ে পিএফআই ঘরে ঢুকে যেতে দেখল সলিল। খানিকবাদেই বেরিয়ে গিয়ে চলে গেলে তড়িচ্চালক কোষের বিবর্ণ টিনের ছাদওয়ালা ঘরটির দিকে। তারেককে সব বিষয়ে অনুসরণ করলেও জুতো খোলার বিষয়ে করেনি দুজন। সিড়িতে না খুলে দুজনেই অতিথি ঘরের ভেতর জুতাজোড়া খুলেছিল। জন সেখানেই পরতে শুরু করলো। কিন্তু পান্না তা করলো না। মুখটা নিচের দিকে রেখে যেন সলিলকে দেখছে না এমনভাবে একটিবার দেখে নিয়ে পা দিয়ে জুতো জোড়া ঠেলে ঠেলে সিঁড়িতে দিলো ফেলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লরেন্সে ফিরে গেল সলিল, এক মুহূর্তের জন্যেই। এদিকে ডি এইচ লরেন্সেরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তিনিও অক্ষরের ভেতর দিয়ে কথা বলা বন্ধ করে অদৃশ্য হলেন।
ব্যাপারটা চুকে যেতেই বেজে উঠলো দুপুর-বিরতি শেষ হওয়ার বাঁশি। একটানা সেকেন্ড দশেক বাতাস অনুরণিত করে বেজে চলার পর যখন থামলো, দেখা গেল খাবারের ঘরটা খালি পড়ে আছে, আর ওদিকে ফটকের বাইরে শেষ মুহূর্তের ক্রিয়া আর শব্দ, শব্দ আর ক্রিয়া গলাগলি দিয়ে গড়াগড়ি যাচ্ছে। তার প্রাবল্যে ফটকের ছোট পকেট দিয়ে শ্রমিকরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ছে কারখানার উঠোনে। একে অন্যের সঙ্গে সজোরে সরোষে আলাপরত। এরপর সেকেন্ডের ভেতর লেগে পড়লো কাজে।
বন্ধ হয়ে থাকা যন্ত্রগুলো ফের শ্রমিকের বন্ধু হয়ে উঠল, তখন বন্ধুতে বন্ধুতে চললো সখ্য। তাদের আলাপে দুপুরের আলস্যের কিছুমাটির জঠরে লুকোলো, কিছু উড়ে গেলো আকাশে। পাকা মেঝের কারণে মাটির জঠরে যারা যেতে পারেনি,ছাদের বাধার কারণে যারা আকাশে উড়ে যেতে পারেনি, তারা কারখানার চার দেয়ালের ভেতর গুমরে-গুমরে ঘুরতে থাকল। কারও কারও বন্ধুত্বের প্রচণ্ড উত্তাপে আলো ঝলাসালো। কারও আবার বিদ্যুতের সঙ্গে আলাপ। কোথাও কোথাও সে আলাপ থেকে অবিকল বদ্ধ বাক্সের দেয়ালে মাথা কোটা সবল পতঙ্গের প্রবল ডানা নাড়ার শব্দ উঠলো। কারখানার ভেতরে একটা চাপা গরমে তদারককারীদের ঘাড় গলা ভিজে উঠছে বার বার। শ্রমিকদের ভিজে উঠেছে পিঠ। যারা চশমা পরে আছে তাদের চশমাটি ঘর্মাক্ত নাক গলে বার বার পড়ে যেতে লেগেছে। কারও কারও কপাল ভাসানো ঘাম ভুরুর বেড়া ডিঙিয়ে এসে পড়ছে চোখের ডোবায়। ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড় খুলে ফেলেছে কেউ কেউ। তাদের তামাটে শরীরে ঠিকরে সরে যাচ্ছে বৈকালি সূর্যের আলো। সবার পাশ দিয়ে ঘোরগ্রস্তের মতো হেঁটে গেল সলিল। জিভটা তার শুকিয়ে যাচ্ছে ঘনঘন। একবার অতিথি শালার পেছনে গিয়ে চাপকল থেকে পানি খেল, চোখে মুখেও নিলো খানিকটা। পানের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার খেসারত দিতে হলো বারকয়েক অতিথিশালার স্নান ঘরে গিয়ে।
বিকেলে শ্রমিকরা প্রতিদিনের মতো সারি তৈরি করে একে একে বেরোলো। রক্ষী আলমগীর প্রত্যেকের পকেট উল্টে শরীর হাতড়ে দেখে গেল, আর প্রতিদিনের মতোই কিছু না-পেয়ে মুখে একটা বিতৃষ্ণ ভাব ফুটিয়ে রাখলো, শেষতক তা বদল হলো না।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর চেঙ্গিস খানের বিজিত দেশের মতো পড়ে থাকলো কারখানা। কিন্তু কারখানার বাইরে শোরগোল শোনা গেল। সলিল অন্যদিনের মতো মুখহাত ধুয়ে কাপড় বদলে বেড়াতে বেরোলো। ফটকে পেরোনোর আগেই শুনতে পেল কাছেই কোথাও মেতেছে অনেকগুলো স্বর। পকেট দরজা গলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো শ্রমিকরা সব অন্যান্য দিনের মতো বাড়ি ফিরে যায়নি। প্রতিদিন ওরা পিঁপড়ার সারির মতো গুটি গুটি পায়ে মনময়পুরের মেটে, আধপাকা পথ ধরে এ-পথে ও-পথে আলো-আঁধার কেটে, পাখির ডাক উৎরে নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে যার যার বাড়ি ফিরে যায়। সলিল অনেকদিন ওদের এই চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছে। এই দৃশ্য থেকে সহজে সে চোখ ফেরাতে পারত না। আজ ফটক পেরিয়ে দেখল, কারখানার অন্য পাশে এক টুকরো পতিত যে জমিটি আছে, ওই জমির ঠিক মধ্যখানে অনেকে জড়ো হয়েছে। একটা বড় অংশ অবশ্য জড়ো হওয়াদের দেখছে আর নিজেদের ভেতর এটা-ওটা বলাবলি করছে, এগোচ্ছে না। কেউ কেউ আবার বিশেষ কাউকে জোর করে ওই জোটের দিকে ঠেলে পাঠাতে চাইছে। কেউ কেউ ওই জোটে গিয়ে আর ফিরছে না, কেউ পিঠের ওপর প্রবলের হাতের প্রভাব কাটতেই হাসতে হাসতে আবার পেছন ফিরে আগের নিষ্ক্রিয়ের দলে চলে আসছে। বেলাও পড়তে বেশ বাকি তখনো। সপ্তাহের শেষ দিন অর্থাৎ শুক্রবারের আগের দিনটি আজ বৃহস্পতিবার। জোটের ভেতর এর-ওর হাতে দেখা যাচ্ছে ক্রিকেট ব্যাট। একটা লাল বল নিয়ে লোফালুফি করছে নাকের নিচে হালকা গোঁফের আভাসওয়ালা এক কমবয়েসী কিশোর। একজন একটা স্ট্যাম্প নিয়ে সিন্দাবাদের তলোয়ারের মতো বাতাস কেটে সপাটে চালাচ্ছে যেন অদৃশ্য মানুষখেকো লতা তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কমবয়েসী ছোকরাগুলো ব্যাট বল নিয়ে রীতিমতো সার্কাস শুরু করে দিলো। আর থেকে থেকে দেখতে লাগল সলিলকে।
একজন অনেক উঁচুতে বল ছুঁড়ে দিয়ে তাকালো সলিলের দিকে। যেন বলছে, দেখো, তোমরা শহর-ফেরতা মানুষ। পারবে এত উঁচুতে বল ছুড়তে? আরেকজন দৌড়ে জায়গামতো দাঁড়িয়ে বলটাকে মুঠোবন্দি করে বিজয়ীর হাসি হাসতে হাসতে সলিলের দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা হাসি হাসলো, যেন বললো, দেখুন, কেমন জিতে গেছি!
হঠাৎ বিকালের লক্ষণগুলো কাটতে শুরু করলো। সূর্য কারখানার পশ্চিম প্রান্তের সীমানা দেয়ালের অর্ধেক নিচে চলে গেল কোনও পূর্বঘোষণা ছাড়াই। আর পাখিগুলোও ভীষণ দ্রুততায় পাতার খোপের ছোট্ট বাসাগুলো ক্রমে উপস্থিতিতে, কোলাহলে সরব করে তুলতে থাকল যেন এর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। গাছগুলো ক্রমে নড়নক্ষম জ্যান্ত হয়ে উঠলো। কারখানার সামনের মেটে পথ ধরে ফ্রক দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে। তার একটি হাতে বাবার হাত ধরা, আরেকটি হাতে তালপাতার হাতপাখার ক্ষুদে সংস্করণ। যেতে যেতে গাছগুলোর দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলো বারবার। তার বড় কালো চোখ দুটিতে বিস্ময়, লাল ঠোঁটের মুখটি ছোট্ট হাঁ তুলে রেখেছে।
ততক্ষণে কারখানায় চৌহদ্দিতে জ্বলে উঠেছে ফ্লাডলাইট
তরুণদের মধ্যে বয়সে যারা বড়,তারা নিজেদের ভেতর খেলোয়াড় ভাগ বাটোয়ারা করছে। হঠাৎ আলো কমে আসায় একটু ঘাবড়ে যাওয়া দ্রুততায় চালাতে শুরু করেছে হাত-পা, গলাটিও। হুড়োতাড়ায় খেলোয়াড় বাছার পাট চুকলো। আকাশে রূপালি মুদ্রা ছুড়ে দ্রুত হয়ে গেল ভাগ্য নির্ধারণ। তাড়াহুড়োয় ব্যাট করতে নেমে গেল এক দল। অন্য দল গোটা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল। সলিলের চোখ এড়ালো না, সবাই আনন্দে ঝলমল করছে।
একদল যখন ব্যাট করা শেষ করেছে, সূর্যের আলো তখন নিভেই গেছে প্রায়। খেলার সময় কমিয়ে বিপক্ষের সামনে আরও কম রানের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হলো। অন্য দলের ব্যাটসম্যানরা নেমেই এলোপাতাড়ি চালাতে শুরু করলো ব্যাট। বল আর ব্যাটে এমন সুসম্পর্ক আর দেখা যায়নি। মানুষের এত চেষ্টার পরও কেউ কারও সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে যেতে চাইলো না। বোলার তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বল করে, ব্যাটসম্যানও সপাটে ব্যাট চালায়, লাগলে হয় সমুদ্রপার, নয় পেছনে মুঠোবন্দি। দুটোর একটিও না হলে বল সোজা পেছনের বনে। এরও কিছু পর বোলারই হয়ে উঠলো সর্বেসর্বা। ব্যাটসম্যান বল লাগাতে পারছে না ব্যাটে, পেছনের কিপারও তালুবন্দি করতে পারছে না বল। আর কাকতালীয়ভাবে বলে ব্যাট যদি-বালাগছে, ফিল্ডারের প্রায় অন্ধ চোখের সামনে দিয়েই সীমানার দিকে ছুটেছে দুদ্দাড়। হঠাৎ তার প্রতি গালগাল বেড়ে গেছে দেখে আঁচ করতে পেরে যতোক্ষণে সে দৌড়ুতে শুরু করেছে,ততক্ষণে তার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।
এতো সাধ্যসাধনায় যে খেলা ছিল সচল হঠাৎ করেই তা ভেঙে গেল। এক পর্যায়ে বলটা মাঠের কোন ঝোপের ভেতর গিয়ে যে পড়ল আর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। আলো তখন পুরোপুরি নিভে গেছে। কালোমতনএক সদ্যতরুণ ঘুরে ঘুরে এ ঝোপ সে ঝোপ সে খুঁজে দেখছে, কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না বল। সাদা বলের ওপর লাল টেপ পেঁচিয়ে খেলা চলেছে। সে লাল এখন কালো অন্ধকারে দিয়েছে আলো নিভিয়ে।
একে একে সঙ্গীরা সব চলে গিয়ে বল খোঁজা ছেলেটা একা হয়ে গেল, তবু ফিরে গেল না। সলিলও তার হয়ে নেমে পড়ল বলের খোঁজে। এক পর্যায়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা ছেলেটার ঘন ঘন চোখ মোছা দেখে এগিয়ে গেল সলিল। বল তোমার? ছেলেটি সলিলের দিকে তাকালো না। কিন্তু মাথা ওপর-নিচ দুলিয়ে উত্তরটুকু দিলো ঠিকই। ততক্ষণে কারখানায় চৌহদ্দিতে জ্বলে উঠেছে ফ্লাডলাইট। তারই আলোর বন্যার কিয়দংশের ঢেউ সীমানা দেয়াল উথলে বাইরে এলে তাতেদেখা গেল ছেলেটার চোখ জোড়া ছল ছল করছে। খেলার সুখে যাদের মুখ ঝলমল করছিল তারা একে একে হেলে দুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ক্রমে, আনন্দের একটু অংশও এই ছেলেটিকে দিয়ে যায়নি। সলিল ছেলেটার ঢালু হয়ে আসা কাঁধে হাত রাখলো। পরনের শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। মুখের দিকে তাকিয়ে বন্ধুর মতো হাসতেই ছেলেটা চোখজোড়া সরিয়ে নিলো, যেন বলটা না পাওয়ার পেছনে সলিলই দায়ী। কী নাম তোমার? সলিলের কণ্ঠে সমবেদনা।
সমীর।
সমীর। সলিল একটিবার উচ্চারণ করল সদ্য শোনা নাম। বাহ, সমীর মানে কী জানো? হাওয়া। মানুষ বুকে হাওয়া টেনে বাঁচে। এই তুমি কিন্তু তোমার গুণে মানুষকে বাঁচাও। ছেলেটি নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের জল গড়িয়ে নাকের ডগায় জমাট বড় মুক্তোর মতো জমেছে। সলিল উৎসাহী হণ্ঠে বলে গেল,এই যে মানুষ তোমার বল দিয়ে খেলেছে, এটা কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার! অনেক বড় তুমি সমীর, অনেক বড় মানুষ, এতেই প্রমাণিত হয়। বুঝেছ?ছেলেটা কোনও কথা না বলে মাথা নিচু করে থাকলো। শরীরের ভর এ-পা থেকে সে-পায়ে বদল করে চলেছে। কিন্তু মুখটি এক মুহূর্তে জন্যে যেন কোমল হয়ে উঠলো। আবার পরমুহূর্তে কোমলতাকে দূর করে নিচের ঠোঁট কামড়ে উঠলো এবং আবার টলমল করে উঠলো চোখের জল। ছেলেটা একবার সলিলের হাতের সীমা থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেও ফিরে এলো স্বেচ্ছায়। কাঁধে সলিলের রাখা হাতটি তখনো সরেনি, কিন্তু নড়ে উঠেছে।
এমনভাবে দৌড়ুচ্ছিল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে এখনই
সলিল আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বললো, তোমার নাম আমার নামের খুব কাছাকাছি। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম কিনা আমার মনে পড়ছে না সমীর। আমার নাম হলো সলিল। দেখো, সলীল-সমীর, সমীর-সলিল। দারুণ না? আরও আশ্চর্য কী জানো? তোমার সঙ্গে আমার অনেক মিলও আছে। এই যেমন, ছোটবেলায় আমিও তোমার মতো হাজারবার বল হারিয়ে এখানে ওখানে খুঁজে সন্ধ্যাকে রাত বানিয়ে বাড়িতে ফিরে মার খেয়েছি। মায়ের হাতে। বাবা মারতো না। শুধু মায়ের সঙ্গে বসে দোর্রা পাকাতো। দোর্রা চেনো?
সমীর হ্যাঁ বা না কিছুই বললো না। শুধু সলিলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার শ্যামল মুখের ওপর নদীর রূপালি দাগ।
আচ্ছা, চেনো না বোধয়। যাহোক, ও ব্যাপারে পরে বলব। আগের কথাটাই বরং আগে বলি। মারতো আমাকে মা। একেকসময় বটিও নিয়ে আসতো, কী আর বলব। বলের জন্যও, আবার রাত করার জন্যেও। একেকসময় আমি তো ভাবতাম, আজই বুঝি পৃথিবীতে আমার দিন শেষ।
মনে হলো ছেলেটা হেসে ফেলবে। এই ভাবটুকু থাকতেই সলিল বলল, কাল তো কারখানায় ছুটি, তাই না? সম্ভব হলে তবু এসো। আমি তোমার জন্য একটা বল কিনে রাখব। আমি ভালো বল চিনি সুতরাং চিন্তা নেই। তবে এখানে কেমন-কী পাওয়া যায় আমি কিছুই জানি না। তবু দেখি। কাল দেখা হবে। কেমন তো?
ছেলেটা সলিলের চোখের দিকে একবার তাকিয়েই উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। তাতেই ওর কাঁধ থেকে আপনি খসে পড়ল সলিলের হাত। সমীর তখন একবার শুধু পেছনে বিভ্রান্ত চোখে তাকালো। তারপর চোখের ভরেই ফের নামিয়ে নিয়ে শুরু করল হাঁটা। পেছনে তাকালো না আর। কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পেল, সবাই যে তাকে ছেড়ে যায়নি। অদূরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেছে এতটা ক্ষণ কী ঘটেছে মাঠের ধারে। সমীর কাছে যেতেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকলো। সমীর একটিরও উত্তর দিলো না। ওদের পাশ কাটিয়েই হনহন করে এগোতে থাকলো সমীর, একসময় শুরু করলো দৌড়ুতে। পায়ে তার জোর ছিল না। এমনভাবে দৌড়ুচ্ছিল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে এখনই। সে-পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আধো অন্ধকারে তার বন্ধুরাও একসময় যার যার বাড়ির পথ ধরলো। ওদের পাশ কাটিয়ে এবড়ো-খেবড়ো পথে পড়ো-পড়ো হয়েও বেপরোয়া প্যাডেল চালিয়ে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরোলো প্রথম দিনের সেই সাইকেলারোহী। তার যাওয়ার পথ করে দিলো সলিল। ক্রমাগত ওঠানামায় টুংটাং শব্দে আপনা থেকেই বেজে চলেছে হাতলের ছোট্ট রূপালি ঘণ্টি।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-৭॥ হামিম কামাল