॥ সাত ॥
সলিল কারখানার প্রাঙ্গণে যখন পা রেখেছে, তখন সকাল আটটা। করখানার বাঁশি তখন বাতাস কাঁপিয়ে বেজে চলেছে। প্রাঙ্গণে পা রেখেই চোখাচোখি হলো সৌরভের সঙ্গে। হাসির ভেতর গতরাতের আলাপের ছাপ। আর যেন ভারি পরিচিত দুজনে, এমন হৃদ্য। হাসির জবাব হাসিতেই দিয়ে সলিল পশ্চিম দিকে এগোলো যেখানে পাশাপাশি দুটি ঘরের সামনে এসে দুই ছাউনির শেষ। অফিসঘরের সঙ্গে লাগোয়া যে যন্ত্রঘর আছে সেখানে ভোঁতা মুখে ট্রান্সফর্মারের কোর তৈরি করছে শ্রমিকরা। হাত দুটি পেছনে বেঁধে ধীরে ধীরে হেঁটে বেড়াচ্ছে পল্লব। দৃষ্টিবিনিময়ের আশায় তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সলিল, পল্লব তাকালো না। ওই ঘরের সঙ্গে একটুখানি ফাঁক রেখে দাঁড়িয়ে আছে, আরেকটি ঘর, তালাবদ্ধ, ঘরটার ওপর আকাশি নীল টিনের চালা। ওটাকে পাশ কাটিয়ে আরো সামনে গিয়ে জঞ্জালের স্তূপটির সামনে দাঁড়াল সলিল। তার দুচোখে বিস্ময়। বিড়বিড় করে বলল, কেমন একটা গোপন ভয় এখানে লুকিয়ে আছে।
কোনো কোনো ড্রামের ঠিক মাঝ বরাবর পড়েছে কাটা, ভূমিকাহীন। ভেতরে জমে আছে স্বচ্ছ জল, কালো জল। জায়গাটা মশা, মাছি, পিঁপড়াসহ লাখও কীটের আখড়া। সীমানা দেয়ালের আগেই চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে ওরা—এই ড্রামের দল, পিপের যোগান। আরও চিৎকাত হয়ে আছে একের ওপর আরেক সব শূন্য তারের রোল। ওগুলোকে রাস্তায় গড়িয়ে যেতে দেখেছে সলিল, যেন চাকা। কাত করে ফেলে শ্রমিকদের বসে থাকতে দেখেছে, যেন পিড়ি। বৃষ্টিতে ভিজে বা সীমানার শেষ প্রান্তের স্যাঁতস্যাঁতে বাতা সে রোলের পাতলা কাঠ নরম হয়ে গেছে। সুরবঙ্গের হাওয়ার উপহার সবুজাভ কালো শ্যাওলার আস্তর।
ফিরতি পথে মেহেদিকে পাওয়া গেল। তখন পেছনে অফিস ঘর, সামনে ফটক। দুজনে চলল অতিথিশালার দিকে। টানা ঘরগুলো যখন পেরিয়ে চলছে, ভেতরে আবার না তাকিয়ে সলিল পারল না। ভেতরে সৌরভ দাঁড়িয়ে। আবারো দুজন চোখাচোখি হলো। মানুষের রূপ ধরে কৌতূহল চিন্তিত মুখে একটা তারের রোলের ওপর বসে আছে। তারেককে দেখে আবার সৌরভের দিকে তাকালো সলিল। ঘরের বাতাসটা কেমন থমথমে।
অতিথিশালায় এসে বাহু-অব্দি শার্টের হাতা গোটানো হলো। টেবিলের ওপর স্বচ্ছ কাচের জলভরা জগ। সবুজাভ গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে ছলকে জলের কিছুটা পড়ে গেল। তৃষ্ণা মেটার পর গ্লাসটা প্লাস্টিকের ধারকের ওপর উল্টো করে রাখল সলিল। গ্লাসটি থেকে প্রথমে একটি সরু জলধারা, এরপর এক ফোঁটা দু ফোঁটা করে পানি ঝরে জমতে থাকল ধারকের মধ্যখানে ছোট্ট ডোবায়। পানির শেষ ফোঁটাটিও পড়ল, কারখানার বাঁশিটিও বাজল। মেহেদি গিয়ে বিছানায় বসেছে। পাখা ছেড়ে দিয়ে দুহাত পেছনে রেখে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। বাঁশি শুনে ঠোঁট ভুরু দুটো উঁচুতে তুলে ধরে রাখল ক মুহূর্ত। শিয়রের জানালা পথে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একবার। সলিল ছুটল বাইরে।
কী দেখতে চললেন?
এই বলার মতে কিছু না দাদাভাই।
শ্রমিকরা হাতের যন্ত্র ফেলে উঠে দাঁড়ালো। সবাই নয়। তারাই শুধু, যারা বসে ছিল। আর যারা দাঁড়িয়ে ছিল ওরা বসলো। যারা রোদে দাঁড়িয়ে টেপের জলে একটা কিছু পরিষ্কার করছিল, বা রঙ করার প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল আরেকটু খোলা জায়গায়, সবার চেয়ে দূরে, চলে গিয়েছিল রোদে, ওরা ছায়ায় ফিরল। আর যারা ভেতরে, দুই টিনের ছাউনির পর যে প্রায় অন্ধকার ওই লাল দেয়ালের ঘরগুলো, যেখানে লোহার পাত বাঁকিয়ে আংটা তৈরি করে, স্ক্রুর প্যাঁচ তৈরি করে, ওখানে ছিল, ওরা সবাই বেরিয়ে এল বাইরে। বলতে গেলেই সবাই। সবার শরীর ঘামে জবজব করছে। শুধু এই বিরতির সময়ে কিছুটা শুকোনোর অবকাশ পায়। এছাড়া বাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘর্মাক্তই থাকে। এদের জামা খুব দ্রুত বিবর্ণ হয়ে গিয়ে ছিতি পড়া ধরে যায়—এমন দেখেছে সলিল। ধোয়া পোশাক পরেও এলেও জমাট দুর্গন্ধ অনেকের কাপড় থেকে সে পেয়েছে, পাশ কেটে যাবার সময়। ওদের পরিধেয় কাপড় খুব সহজে ছিঁড়ে যায়, দেখেছে সলিল। প্রথমে ছেঁড়ে ওখানটায় যেখানে টান পড়ে ঘন ঘন, যেমন বাহুমূলের কাছটায়। এরপর যেখানে পেশির সঞ্চালনও বেশি, উঠতে বসতে টানও তেমনি, যেমন পিঠ। আর পায়ের কাছে হাঁটু। ওখানটাতেও ছেঁড়ে। কাজের সময় তো উরুর ওপর কাপড় ঘামে ভিজে আটকে যায়। তখন শ্রমিকরা আদকা বসতে গেলে সাবধান। কজন আছে কোমরের কাছে প্যান্ট ফাঁক করে আগে ভেতরে কবার হাওয়া খেলায়, আজও এমন করছিল একজন। তখন চারদিকে হাসির একটা রোল উঠেছিল। না হেসে বরং শিখে নে শিখে নে, কাজে না এলে বলিস। পরিবেশ এ-কথায় ও-কথায় হালকাই থাকে।
সলিল দ্বিতীয় টিনের ছাউনিটা আড়াআড়ি অতিক্রম করে একটি ঘরের দিকে গেল। ভেতরের দেয়ালটি লাল সে ঘরের। লোহার কতগুলো বাঁকানো রড একপাশে জড়ো করে রাখা। ঘরের অপর কোণে তাপ উৎপাদক চুল্লি। দোরে দাঁড়াতে মুখে আঁচ লাগল। ভেতরে মেঝেতে রূপালি ইস্পাতের গুঁড়ো ছড়াও পড়ে আছে কপার তার, স্ক্রু, হাতুড়, সিরিষ কাগজ, আরও কত কী। এখানেও জসিম নামে আরেকজন আছে। ভাঙা চোয়াল, সুপুরুষ অবয়বী একটি লোক বড় মনোযোগে কাজ করে, কোনোদিকে তাকায় না, কারো সঙ্গে কোনো কথাবার্তায়ও থাকে না, কী বাইরে কী ঘরে। কিছুটা একটা জিজ্ঞেস যদি করা হয় সে উত্তর করে না, চোখ দুটো লাল করে তাকায়। সারাক্ষণ তেতে থাকে খুব। ভারি এক মেশিনে চাপ দিয়ে লোহার পাত বাঁকায়। ছোট ছোট লোহার পাত ওসব, এক বিঘৎ লম্বা হবে আর দুই কর চওড়া। ওসবের শেষ মাথায় আবার ছিদ্র করা থাকে। এটা নিয়েই জসিমকে একটা প্রশ্ন করেছিল সলিল, কদিন আগে।
কোথায় বসে এটা দাদাভাই, বলবেন? দেখে বুঝতে পারছি না।
প্রশ্নটা করেই বুঝল সলিল—হয়েছে। এক জোড়া লাল চোখ যেন তাকে চিরে দিতে এলো। দূর থেকে মেহেদি কাউকে একটা কিছু বুঝিয়ে দিয়ে এটা ওটার জঞ্জাল এড়িয়ে লাফিয়ে ততক্ষণে এদিকটায় চলে এসেছে। জসিম তার দিকেও রক্ত চোখে তাকাল। যেন বলল, শিখিয়ে পড়িয়ে আনতে পারনি মূর্খটাকে? সলিলের বাহু ধরে মেহেদি টেনে সরিয়ে নিয়ে এলো তাকে। কী জানতে চাইছেন। সলিলের মুখের বিভ্রান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি আঁচ করে বলে দিলো ওটা কোথায় ব্যবহৃত হয়। সলিলের চোখে প্রশ্ন—কী সমস্যা এ লোকের। মেহেদি বলল, পরেই শুনুন। চলুন আপাতত।
লোকটিকে আজ অন্যদিনের চেয়ে অনেক নরম হয়ে থাকতে দেখেছে সলিল। তার হাত পায়ের সঞ্চালন বলে দিচ্ছিল অন্যদিনের চেয়ে বেশ দুর্বল আজ সে। তার ভীমবাহু চলছিল বেশ ধীরে, তাই কাজও এগোচ্ছিল ধীরে। কারখানার একটি দিকের ধীর গতি গোটা কর্মশেকলে ধীরতা এনে দেয় বলে তাকে কম কথা শুনতে হচ্ছিল না। কিন্তু না-তার কিছু করবার ছিল, না-আর কারো তার কাজ করে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল।
ঘরে ঢুকে দেখা গেল জসিম একটা তারের রোলের ওপর বসে আছে। ঘরটার চৌকো জানালা দিয়ে কারখানার বাইরে আকাশ দেখা যায়। চৌকো সেই আকাশটিকে তার দৃষ্টির যেন একতরফা অধিকার। ঘরে কেউ আসবার শব্দ পাবার পরও পেছন ফিরল না। দু হাত দিয়ে হাঁটু দুটি জড়িয়ে রাখায় ভারি পেশল দেখাচ্ছে। সলিল একটিবার পেছন ফিরে তাকাল। আসার পথে এ ঘরের দুটো লোক সলিলকে দেখিয়ে কী যেন বলছিল। তাদের দেখতে পাওয়া গেল। চোখ রাখার ইচ্ছেটা দূর করতে পারেনি বলেই চোরাচোখে তাকাচ্ছে বারবার। আঁচ করতে চাইছে—কী হতে পারে, আলাপ করছে নিজেদের ভেতর।
সলিল বসে থাকা জসিমের দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটু জড়িয়ে রাখা দুটি বাহুই প্রকট। কনুই অব্দি গোটানো হাতা ঘামে ভিজে আছে। কাঁধের কাছটাও ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে আছে লেপ্টে। পিঠের অংশে অসংখ্য কালো কালো শ্যাওলাবিন্দু। দুই হাতের পাতা যেখানে মিলে আঙুলে আঙুলে শেকল গড়েছে, সেখানে টাকাটা গুঁজে দিতেই ঝট করে চোখের দিকে তাকাল জসিম। লোকটির অভ্যস্ত রূঢ়তার অস্ত্র সেই ভুরু ও চোখ দুটি কোমল হয়ে আছে। আপনার শরীর তো বেশ খারাপ। পথ্য কেনার জন্যে এটা রাখুন, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সলিল বলল। লোকটির চোখজোড়া রক্তাভ হয়ে উঠল তখন, জল ফুটে উঠল সঙ্গে সঙ্গেই। কৃতজ্ঞতা আর প্রত্যাখানের ইচ্ছে মিলিত আলো ছড়াচ্ছে তার চোখ দুটো থেকে। যেন বলছে—খোকা, তুমি আমাকে দিতে যে চেয়েছ তাতেই আমি সব পেয়েছি, আর কিছুর দরকার নেই। হাত পেতে নেওয়ার ধাত আমার নয়। তুমি আমাকে টাকা সেধ না! সলিলের সহৃদয়তার চিহ্ন তার দুচোখে। একইসঙ্গে লোকটির ফরিয়াদ বুঝতে না-পারার মতোনির্বোধও সে হয়ে উঠল ইচ্ছে করেই। তবু ওই চোখজোড়া অবিরত পীড়া দিতে থাকায় বলল, ঘরে কেউ নেই এখন, আর সেজন্যেই আমি এসেছি। আমি জানি আপনি টাকা নেন না কারো কাছ থেকে। আর সেজন্যেই আমার কাছ থেকে নিতে হবে আপনার। এটা রাখুন প্লিজ, ভাই বলে দিচ্ছি। আর বন্ধু বলে। সামান্য। আরো বেশি প্রাপ্য আপনার।
বাড়ি থেকে যারা খাবার নিয়ে এসেছে, বেশ করে হাত ধুয়ে তারা জায়গাতেই খেতে বসল। আর যারা খাবার আনেনি তাদের একটি অংশ রক্ষীর কাছে কমুহূর্তের জন্যে শরীর হাতাতে দিয়ে ফটক পেরিয়ে চলে গেল বাড়ির দিকে, আরেকটি অংশ গেল সলিলের প্রথম দিনের সেই চায়ের দোকানে।
সলিল অতিথিশালায় ফিরে এলো।
টেবিলে খাবার সব পরিবেশন শেষের পথে, তাই সবাইকে ডাকল রবি। গরমেতেতে থাকলেও একমাত্র পল্লব ছাড়া আর কেউ গোসল করল না। পুরু একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে মাথাটা রগড়ে মুছতে মুছতে সলিলকে বলল পল্লব,এই যে কবি, এই গোসল আমাকে দর্শন শেখায়। কী করে তা জানতে চান? আর কাউকে বললে তো বুঝবে না এসব ব্যাপার। আমুদে চোখে মেহেদির দিকে তাকাল পল্লব। পরনের নীল গেঞ্জিটা শরীরের অবশিষ্ট পানির ছোঁয়াচে এসে ছোট ছোট মানচিত্রের মতো ভিজে উঠেছে। সলিলের দিকে ফিরে ফের বলতে শুরু করল,দেখুন এই একটা কাজ, শুরু করলে আপনাকে শেষ করতেই হবে। এমনকি আপনি খাওয়ায় অর্ধেক খেয়ে উঠে যেতে পারেন। আর তোমার যতো নাইট্রোজেনঘটিত বর্জ্য, ওগুলো নিঃসরণও তো তোমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না। বলতে পারো ওরা ঈশ্বরের আদেশের মতো আসে। অমোঘ। তখনই পালনীয়। বুঝলে না? তাই ওটাকে উদাহরণের মধ্যে আনলাম না। কিন্তু এই এক গোসল। ব্যাপারটা কিন্তু ইচ্ছাধীন। ইচ্ছাধীন কাজই তুমি করবে এবং শেষ করবে—এ হলো সাফল্যের মূলমন্ত্র। একমাত্র গোসলই আমাকে এই মূলমন্ত্র চর্চার অভ্যাসটা করায়।
বাহ, তা কেমন সাফল্য পেলে?
সেটা তো আলোচনাসাপেক্ষ বন্ধু! আর যেখানে সেখানে বলবই বা কেন? নির্জনে চলো। ওই যে তোমার ওই গাছটা আছে না? ভালো কথা। আমার নতুন ভাইটিকে নিয়ে গেছ নাকি এরই মধ্যে?
না এখনো নিয়ে যাওয়া হয়নি। বোধয় নীতুর সঙ্গে মিটমাট, ঠিক?
মেহেদির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সলিলের কৌতুহলী মুখটার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপল পল্লব। মধ্যবিরতির সীমিত সময়ে বাকি সবারই হাত পা চলছে দ্রুত, তাই মুখ আছে বিশ্রামে।
মেহেদি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা জসিমকে জানাল,বড়জোর মুখহাত ধোব এখন। গোসল করলে আবার ঘামবে, দরকার কী। আর সন্ধ্যায় দ্বিতীয়বারের মতো গোসলে যদি ঢুকি তো নিজের পায়ে বুলডোজার। বুকে ঠা-া বসে যাবে, সারারাত আপনারই ঘুম হবে না।
সৌরভও চলে এসেছে। বলল, অগ্রহায়ণের দোষ অনেক। শীতের সঙ্গে সম্পর্ক তার এই রাম-লক্ষণ তো পরমুহূর্তে রাম-রাবণ। হাত মুখ ধুয়ে ঘাড়ে মাথায় একটু পানি দিয়ে নিলো। খাটের শিয়রকাঠে রাখা তোয়ালেটা হাতে নিয়ে মুখ হাত ঘাড় মাথা চেপে চেপে মুছল। মেলে রাখল ফের। জানালা দিয়ে দেখতে পেল রান্নাঘর থেকে রবি হাতে কী নিয়ে যেন আসছে। রবি রুপালি বড় একটি বোলে গরম ডাল নিয়ে আসছিল। ছোট দুটো সিঁড়ি ভাঙলো নির্বিঘ্নে, বিপত্তি বাধলো ঘরে ঢুকবার মুহূর্তে। পায়ে স্পঞ্জ স্যান্ডলটার একটিপাশের ফিতা গেল খুলে, আর স্যান্ডেলটা পা থেকে এক পাশ গলে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করলো। মনের অজান্তেই যেন ওটাকে পায়ের তলায় রাখতে গিয়েই আদকা পা বেঁকে যাওয়ায় হাত গেল নড়ে। পাত্রের গরম ডাল ছলকে পড়ল জসিমের পায়।
জসিম তখন টেলিভিশন ছেড়ে এ-চ্যানেল ও-চ্যানেল করছিল।একটা জান্তব চিৎকার ওর গলা চিরে বেরিয়ে এলো। পা-টাএকপলক দেখেইসাদা ভারি হাতটি তুলে মারতে উদ্যত হল রবিকে। সলিল ভেতরে প্রস্তুত হয়ে উঠল, হাত যদি ওঠে তো সেও মুখ চালাবে। সৌরভ ব্যাপারটায় হতবুদ্ধি। আর স্নানঘরের দরজা খুলে মাত্র বেরিয়েছে মেহেদি। ভেজা মুখ, ভেজা দাড়ি, ভেজা চোখের পাতা। চুলের সামনের অংশ ভিজে একটা কালো লতার মতো বেঁকে কপালে পড়ে আছে। ঠিক এসময় একটা কালো প্রজাপতি ঢেউয়ের মতো একপাশের জানালা দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে কাপড় নাড়া শেষে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে পল্লব।উদ্যত হাতটি নেমে আসার উপক্রম করতেই চিৎকার করে বলল, রাখুন ভাই! ছেলেমানুষ!
___________________________________________________________________________________
দোকানির নাক বরাবর কতগুলো অর্ধস্বচ্ছ পলিব্যাগ ঝুলছে
___________________________________________________________________________________
জসিমের গোলাকার চোখ বেলালের ওপর থেকে পিছলে পল্লবের ওপর চলে গেল। মুখটা বিকৃত। সোজা হয়ে তাকালে আবার সাদাপ্যান্টটার দিকে। গরম ডালের ধোঁয়া উঠছে তখনও। লেগে আছে দানা দানা হলুদ অসংখ্য ডালসেদ্ধ। প্যান্ট ভিজে লোমশ পায়ের আভাস ফুটে উঠল।বিকৃত মুখটা থেকে বিকৃত কণ্ঠ বেরিয়ে ঘর কাঁপিয়ে দিল।
আরে ভাই! আপনি তো বলেই শেষ। কেমন লেগেছে জানেন?
সবই বুঝলাম। কিন্তু তারপরও এটা তো স্রেফ দুর্ঘটনা! ওকে মেরে তো বাকি ডালটুকুও পায়ের ওপর ফেলার ব্যবস্থা করছিলেন। দেখুন, ছেলেটার স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। এজন্যেই তো। এটা বুঝবেন না? রবি, আমার আরেক জোড়া স্যান্ডেল আছে মেহেদির ট্রাঙ্কে, ও দেবে পর ওটা পায়ে দিবি। আর এটার ফিতে লাগিয়ে লাভ নেই, ফেলে দিস। ঠিকাছে? আর ভাইকে স্যরি বল।
রবি মাথা কাত করে সায় জানিয়ে বোলটা টেবিলে রেখে প্রায় ফিসফিস করে বলল, স্যার ভুল হয়েছে আমার, মাফ করে দিন। আর হবে না এমন।কাঁপা কাঁপা স্বরে কথা কটা বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে। খাবার টেবিলে আর কারও মধ্যে কোনো কথা হলো না। শুধু চামচের টুংটাং আর কচি শসা চিবোনোর মুশ মুশ শব্দ। পরে প্লেট কাত করে ডাল খাওয়ার হুশহুশ, পানি ঢালার সরসর আর গ্লাস রাখার ঠক্। টেলিভিশন অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে কারখানা-ফটকের বাইরে, হাজির দোকানের সামনে ছোটমতোন জট। দোকানির নাক বরাবর কতগুলো অর্ধস্বচ্ছ পলিব্যাগ ঝুলছে, বাতাসে ঘুরছে, দুলছে। ওগুলোর ভেতরে সকালে পাউরুটি কারখানা থেকে আসা রুটি, কেক, সিঙাড়া, এটা ওটা আরও অনেক শুকনো খাবার। বাড়ি না যাওয়া শ্রমিকদের অংশ দোকানটার তিনদিকে ঘুরে এটা ওটা দেখল, যাচাই করল। কেউ বের করে শুঁকলো। সন্দিগ্ধ। দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে সকালে আসা তাজা পাউরুটি কিনা। কেউ আবার এসবের ধার ধারল না। পলিতে কবজি ঢুকিয়ে মুঠোর সামনে যা পড়ল, তাই নিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে শুরু করল। চিবোনোর সময় ওদের মুখ বন্ধ হয় না। যারা একটু সৌখিন, তাদের কেউ কেউ কলা ছিঁড়ে নিল।
কলাগুলো সবুজাভ হলুদ, লম্বাটে, কিন্তু ভেতরে নরম। যারা নিল তারা খোসা ছাড়ানোর সময় আড়চোখে দেখছিল অন্যদের। এক ধরনের দেখিয়েপনা চোখে মুখে স্পষ্ট। রুটির মতো কলার ভাগও একে অপরকে দিলো। খোসা ছিলে অর্ধেক ভেঙে আস্ত মুখে পুরে দাও, হয়ে গেল। পাউরুটি ছিঁড়ে খেতে খেতে কারও কারও সিঙাড়া ভালো লেগে গেল। সিঙাড়ার প্যাকেটে চ্যাপ্টা হয়ে কতগুলো তেলতেলে সবুজ মরিচ। খাবারের হলুদ রং আর রুচিবর্ধকের সবুজ, দুইয়ে মিলে হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য। ভরপেট রুটি, সিঙাড়া, কলা আর নরম ফোলানো কেক খেয়ে একে একে সবাই এগোল নীল একটা পিপের দিকে। প্লাস্টিকের পিপে। ওপরে কালো প্লাস্টিকের ঢাকনা। ঢাকনার ওপর পানি জমে আছে। সে পানিতে পথের দুপাশে দাঁড়ানো গাছগাছালির মায়াবী বিম্ব পড়েছে।
কালো ঢাকনা সরিয়ে বসার বেঞ্চের ওপর রাখলো কে একজন। ওপরে জমে থাকা জল ইতোমধ্যে মাটি ভিজিয়েছে। দোকানি চোখের বিরক্তি ঢাকার কোনো চেষ্টা করল না। শ্রমিকরা এদিকে হুলস্থুল বাঁধিয়ে ফেলছে। পিপের ভেতর থেকে পানি নেওয়ার জন্য একটা লাল মগ ছিল। ওটা কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানদারের কথা, এটা এখনই এখানে ছিল। কে কোথায় সরিয়েছ বল। কথায় মনময়পুরের টান। শ্রমিকরা উঠল ক্ষেপে।তোমার ওই ফাটা মগের ওপর কারও চোখ নেই। এ বাক্যটা ছুড়ে যে দিল তার কথায় দরিয়ারকূলের আভাস।
দোকানি বলল, সেদিন কিনেছি রে ফকির কোথাকার, ফাটা কোথায় পেলি? কখনো কিছু নাও না মনে হয়? কটা প্রমাণ চাও। তোমাদের জন্য একবারের জিনিস আমাকে একশবার কিনতে হয়। হাভাতে ঘরের সব। কারখানায় ঢুকতে বেরোতে সাধে এমন হাতাতে হয় নইলে?
শ্রমিকদের মধ্যে নবাগত একজন তুলনামূলক সুবেশি। একটা নীল হাফহাতা শার্ট আর নীল জিন্সের প্যান্ট পরে, পায়ে স্যান্ডেল সু গলিয়ে বেশ হেলেদুলে হাঁটছিল। শ্রমিকদের কাছ থেকে তুলনামূলক দূরত্ব রেখে হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর মুখ করে বলল, আছে, এমন লোক তো আছেই। এদের জন্যই সবার নাম খারাপ হয়। গোটা ব্যাপারটির জন্যে সে ভারি দুঃখিত—এমন ভঙ্গিতে ঠোঁট দুটি চেটে রেখে মাথা দুপাশে নাড়ল। এমনও হয়েছে, বাইরে গিয়ে বলতে লজ্জাই পাই যে। তার কথাটা শেষ করতে পারল না। শ্রমিকদের একজনই লাল মগটির একটি অংশ দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে!
জিনিষটা দোকানির পায়ের কাছেই এক জলচৌকির নিচে চলে গিয়েছিল। পান ধোয়ার জন্যই খানিক আগে তখন জল নিয়ে ঢেলেছিল। এরপর মনের খেয়ালে পায়ের কাছে নামিয়ে রেখেছিল। আর সেটিও সুযোগ বুঝে কাত হয়ে পড়িয়ে গড়িয়ে একটা জলচৌকির নিচে চলে গেল। মগটা পাওয়ার পর এক পশলা গালাগাল চলল দোকানির ওপর।
বেটা ছোটলোক। বখিলের ঘরের বখিল তুই। হজ করলেও আল্লা এতো পাগল না তোর হজ কবুল করবে। গজগজ করতে করতে বলল একজন।
পয়সা দিয়ে খেতে আসে সবাই ব্যাটা। আমরা না আসলে তো লাটে উঠত ব্যবসা তোর, আর আমাদের সঙ্গেই এমন ব্যবহার? চল একে ঠেঙিয়ে চাঙে তুলে দিই। বলে আরেকজন আশপাশে তাকাতে লাগল সমর্থনের আশায়।
নিজে ইচ্ছে করে রেখেছে যেন দোষ দিতে পারে। বলে মুখ লুকোতে চেষ্টা করল একজন।
সুবেশি ওই শ্রমিকটি বলল, কিছু মানুষই আছে এমন খারাপ স্বভাবের। ছোটলোক। আজকে মগ পাওয়া না গেলে তো নিজেই কিনে দিতাম এই ছোটলোককে। আর এরপর আর কোনোদিন আসতাম না এই ছাইয়ের দোকানে।
কী আছে তোর এখানে রে? বাসি সিঙাড়া, পচা কেক আর কার্বাইড দেওয়া কলা। রদ্দি মাল কারখানার সামনে সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে সস্তায় কিনে আনিস এসব, কেউ জানে না? কিছু বলি না দেখে! ষণ্ডাগোছের এক তরুণ বলে উঠল।
কিছু বলি না বলেই আমাদের ওপর মিথ্যা গরম দেখায়! বলে উঠল তার সাগরেদ।
আরও অনেক কথা উঠে এলো সুরবঙ্গের নানা প্রান্তের আঞ্চলিকতা মাখা বাক্যে। জায়গাটা সরগরম হয়ে উঠল। কেউ একজন দোকানির হাত থেকে মগটা ছিনিয়ে নিয়ে পিপেয় ডুবিয়ে দিলো। এরপর গলা ভরে পানি খেয়ে মগ তুলে দিলো পাশের জনের হাতে। সেও গলা অব্দি খেল। পেট ডাঁই করে দিলো পরের জনকে। এভাবে ধুলামাখা জায়গাটা কাদায় ভরে গেল। কাদায় ভরে গেল সবার পায়ের পাতা। ধুলো মাথা আঙুলে যেই পানি পড়েছে অমনি নতুন নদী-মানচিত্র এঁকে গড়িয়ে পড়েছে। আরও পানি পড়েছে যখন, পায়ের তলের আটকে পড়া ধুলো আর ঘামের সঙ্গে মিলে বিচিত্র আঠাল তরল তৈরি হলো। শ্রমিকদের পা পিছলে পিছলে যেতে থাকল। হাঁসের ডাকের মতো শব্দ ছেড়ে শ্রমিকরা দাপিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল।
শ্রমিকদের একজন খান সাহেব। লোকটার বয়েস হবে চল্লিশের কোটায়। গাল দুটো ফোলা, যেন তুলা ঠাসা হয়েছে। মাথার চুল কুঁকড়ে থাকা, লালচে। পরনে টিয়ে রঙা ময়লা ফুলহাতা শার্ট, কলারের দুটো বোতাম নেই। হাতা কনুই অব্দি গোটানো। কোমরে একটা গামছা বাঁধা। এতোক্ষণ চুপচাপ খেতে খেতে বিবাদ দেখছিল। বিবাদ ফুরোনোর আগেই তার খাবার ফুরোল। হাত দুটো ঝেড়ে পকেটে ঢোকাতেই যেন একের পর দুটো উরুই তার চুলকে উঠল ভীষণ। চুলকে উঠল বুকের কাছেও। কোথাও হাতড়ে কোনো টাকা যখন মিলল না তখন মুখচোখ কঠিন করে এগিয়ে গেল এক সহকর্মীর দিকে। তার কাছে বিমুখ হয়ে গেল আরেকজনের কাছে। বিমুখ হয়ে গেল আরো একজনের কাছে। দেখা গেল ওকে বাড়তি টাকা দেওয়ার মতো পরিমাণ কারও কাছেই নেই। চোখমুখ তার থমথমে হয়ে উঠল। এদিকে দোকানির সঙ্গে শ্রমিকদের বিবাদও ফুরোলো।
কারখানার বাঁশিটা বেজে উঠল এসময়। তারেক বাইরে বেরিয়েছিল সিগারেট খেতে। টিয়ে শার্টকে নাজেহাল হতে দেখে ডাক দিয়ে উঠল, খান সাহেব। তুমি আজকেও সমস্যায় পড়েছ? ভালো। কত টাকার খেয়েছ?
সলিমুল্লাহর চোখে আশার আলো জলে উঠল। টাকা ধার দেওয়া লাল দেড়ে শ্রমিকের কাছে মিনতি করছিল। হাতের তেলো ফিরে এলো স্বাভাবিক অবস্থানে। তারিকই তার টাকা দিয়ে দিতে চায় বুঝতে কিছুটা সময় নিল। যখন বুঝতে পারল, মুখটা ঝলমল করে উঠল তার। খুশির একটা দমক তলপেট থেকে ওপরে উঠতে চাইল। একজন বলল, খান সাহেবের কপাল খুলেছে। এ টাকা আর শুধতে হবে না।
এমন সময় দোকানিই কর্কশ কণ্ঠে বলল, বত্রিশ টাকার খেয়েছে স্যার। এদেরকে বাকিও কি কম খাইয়েছি! কমজাত!
বত্রিশ টাকা!
একটা শোর উঠে গেল। সলিমুল্লা ব্যাটা টাকাই আনেনি আর খেয়ে বসে আছে বত্রিশ টাকার! এই, এ টাকা কার বাড়িতে, একবার ভাবলিও না? এতক্ষণ যারা ওর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকছিল, না জানি আবার টাকা চেয়ে বসে, তারা ব্যাপারটা চুকে যাওয়া কাছে এসে শাসাতে লাগল। এতো টাকার খেয়েছ ফকির? তোমার ভাগ্য ভালো যে স্যার এসেছিল। না হলে তোমাকে এক সপ্তাহ এই পাজি হাজির ময়লা সাফ করতে হতো!
চতুর্মুখী আক্রমণে সলিমুল্লাহ যখন কেঁচো। কারখানার দীর্ঘ বাঁশি তখন বেজে শেষ। রোদটা আরেকটু খয়েরি হয়ে এসেছে শেষ আধাটি ঘণ্টায়। সিগারেটের নীল ধোঁয়া উড়িয়ে শেষ কটা টান—এরপর তারিকও ফটক গলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। সলিমুল্লাকে আরও কিছুক্ষণ ঠাসিয়ে সবাই একে একে ঢুকে পড়তে শুরু করল। সবার শেষে ঢুকলো সে।
বাঁশি বেজে ওঠার পর, ভেতরে যারা ছিল সবাই হাত ধুয়ে পায়ে স্যান্ডেল জুতো পরে নেমে পড়ল কারখানার উঠানে। বাইরের শ্রমিকরাও তখন একে একে ফিরে আসছে। আসার সময় ফটকে তল্লাশি নেই।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-৬॥ হামিম কামাল