॥ছয়॥
সন্ধ্যায় টেস্টিং রুমের দিক থেকে যে ছেলেটি বেরিয়ে এসেছিল, তাকে একটি ঝাড়ু হাতে অতিথির ঘরে ঢুকতে দেখা গেল। দরজাটি হাঁ করে খোলা। খাবার টেবিলে সকালের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ কিছু পড়ে আছে। তিনটি প্লেট আরো তিনটি প্লেটে ঢাকা। ছেলেটি চেয়ারগুলো খানিকটা পেছনে সরিয়ে এনে টেবিলের নিচের ময়লাগুলো ঝাড়ুর ফুল বুলিয়ে এক করতে শুরু করল। এভাবে একসময় দরজার কাছে একটি কোণে জড়ো করল গোটা ঘরের যতো ঝুল কুটো-ময়লা আছে তার প্রায় সবই। ঝাড়ুদেবার ফাঁকে নতুন মানুষটির ঘুমন্ত মুখটির দিকে থেকে থেকে তাকালো কয়েকবার। যেন বুঝতে চাইল মানুষটি কেমন হতে পারে। খাটের নিচে ঝাড়ু বোলাতে হাঁটু গেড়ে বিছানার নিচে তাকানোর সময়ই তার প্রায় নাকের সামনে স্যান্ডেলজোড়া আবিষ্কার করল সে, এর আগে দেখতেই পায়নি। সেখান থেকে ঘামের গন্ধ এসে থাকবে। তাতে ছেলেটিকে কিছুটা বিচলিত মনে হলো। আরো একবার সে ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকালো যেন গন্ধের যুক্তি ওই মুখটির ভেতর খুঁজে পেতে চায়। মনে হলো, যুক্তি খুঁজে সে পেল না। নিজ কাজ শেষ করে সরিয়ে রাখা চেয়ারগুলো আবার স্বস্থানে রাখতে গিয়ে বেশ শব্দ করে ফেলল। চট করে আবারো তাকিয়ে নিলো সলিলের মুখের দিকে। সেখানে কোনো রেখান্তর দেখতে না পেয়ে ঝুঁকে একটা ছোট প্লাস্টিতের বেলচায় কুটো-ময়লা কুড়িয়ে নিয়ে গেল বেরিয়ে। এরও বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালো সলিল। আর চোখ দুটির মেলার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার কানের ওপর থেকে এঁটে বসে থাকা কোনো অদৃশ্য ছিপি যেন সরে গেল। সইতে না পারার মতো শব্দের জগৎ তাকে এতো দ্রুত বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো যে সে একরকম ব্যস্ত হয়ে উঠে বসলো বিছানায়।
শিয়রের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল দিব্যি বেগে চলছে কর্মযজ্ঞ। জানালার বাইরে টানা তারের ওপর একটি হলুদ পাখি দুলছে। বিপুলা এ কাজের যজ্ঞে সেই একমাত্র থিতু যোগী। একটা করাতকল চালু হতেই উড়ে গেল পাখিটা। নিঃসঙ্গ ধাতব তারটি একাকী দুলতে থাকল। বিছানার নিচে পা রেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে স্যান্ডেলজোড়া খুঁজল সলিল, ওদুটো তো তখন খাটের নিচে অগম্য দূরত্বে লুকিয়েছে। সেখান থেকেই সলিলের কাছে গোপন বার্তা পাঠিয়ে থাকবে। মেঝেতে নেমে গিয়ে খাটের নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল একটি আরেকটির ওপর চড়ে বসে আছে।
টেবিলের ওপর খাবারের উচ্ছিষ্ট পড়ে আছে। মানে ওকে ঘুমন্ত রেখে চেনা-অচেনা মানুষ খেয়ে গেছে দেদার। টেবিলের তিনটি পাত্র ঢাকা। উল্টে দেখল একটিতে সাদা চিরল ভাত, আরেকটিতে হলদে সবুজ ডাল, আর শেষটিতে আলুভর্তার গোলরকম বল, কিছুটা থেবড়ে গেছে ওপরের অংশ। ভেতর থেকে উঠে আসছে পোড়া লাল মরিচ। তার পাশেই তিন কোণ করে কাটা একটা ডিমভাজি, পেঁয়াজে মরিচে তেলে ফুলে ফেঁপে ওঠা।
হাতমুখ ধুয়ে এসে চলল সকালের খাবার, এরপর পোশাক বদল। স্যান্ডেলজোড়া পরে বাইরে বেরিয়ে এলে দেখা গেল রাতের শীতলতার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সকাল সাতটায় কারখানার বাঁশিটা বাজে, এখন প্রায় নটা। সকালের কোমল আলোও স্মৃতি হতে চলেছে। চারপাশ তেতে উঠছে ক্রমেই। শব্দের বন্যা উথলে উথলে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো কারখানায়। এরপর চার দেয়ালে আছড়ে পড়ে আবার ফিরে আসছে। সবাই থৈ থৈ করতে থাকা অদৃশ্যমান শব্দ-জলাশয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আগের দিন সন্ধ্যায় খেয়াল করেনি, মূল ফটক থেকে অফিসের দিকে যাওয়ার পথে হাতের বাঁয়ে যে পাকা ঘরগুলো পড়ে সেগুলোরই একটির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পানির কল। বেরঙা ধাতব দ- মাথা তুলেছে, তার ওপর একটি সবুজ প্লাস্টিকের কল বসানো, সারাক্ষণ ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে। টেপের কিছু ওপরে দেয়ালের সঙ্গে পানির শুকনো দাগে ভরা একটা চৌকো আয়না সাঁটা। আয়নাটি ছায়ায়, আর সলিলের মুখটি রোদ পোহাচ্ছে। মুখের বিভিন্ন স্থানে গজিয়েছে ছোট ছোট পাহাড়। বীরপ্রসবা মশকীরা যে সারাটি রাত সলিলকে আদর করে গেছে, ওসব তারই চিহ্ন।
গতকাল সন্ধ্যায় যে জায়গা থেকে গোটা কারখানার ওপর একবার চোখ বোলাতে পেরেছিল সেখানে গিয়ে দাঁড়াল সলিল। সমান্তরালে থাকা দুটো লম্বা টিনের ছাউনির নিচে কাজ করছে অসংখ্য মানুষ। নোংরা সাদা শার্ট পরা মধ্যবয়েসী একটি লোক ভারি আর বিশাল এক যন্ত্র দিয়ে মোটা ধাতুর পাত কাটছে। মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। লোকটির হাত পায়ের নখ হলুদ আর অস্বাভাবিক রকমের বড়। বিশাল যন্ত্রটার লিভার ধরে প্রতিবার চাপ দিতেই ছেঁড়া শার্টের নিচে ফুলে উঠছে কালো মাংসপেশি। কপাল থেকে চুল সরাচ্ছে থেকে থেকে। চুলের রং রোদে পোড়া লাল। লিভারে চাপ দেওয়ার সময় মাঝে মাঝে তার হলদেটে দাঁতের পাটি বেরিয়ে পড়ছে। কখনও চেপে রাখতে হচ্ছে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট। ঠোঁট দুটি ফ্যাকাশে হয়ে পড়লে আবার বেরিয়ে পড়ছে দাঁত। পাতগুলো ধাতব শব্দ করে একপাশে স্তূপ তৈরি করে চলেছে। সেগুলো একটি ছোট বাকেটে সংগ্রহ করে ভেতরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে বছর বারোর এক কিশোর শ্রমিক। স্তূপের কাছে বাকেটটিকে আধশোয়া করে এক হাতে ভেতরে যতোগুলো পারা যায় কাটা ধাতব পাত চালান করে দিচ্ছে ছেলেটি। পাতগুলো কাটার পর খুব গরম হয়ে থাকে বলে ছেলেটির এক হাতে রাবারের গ্লভস। কালো গ্লভসের ওপর রূপালি রঙের গুড়ো যে লেগে রোদের আলো পড়ে ঝিকমিক করে উঠছে। ছেলেটা মাথায় একটা ক্যাপ পরেছে উল্টো করে। কপাল বেয়ে দরদরিয়ে নামছে ঘামের ধারা। হাফ হাতা একটা সাদা গেঞ্জি পরনে আর হাঁটু অব্দি গুটিয়ে রাখা একটা নীল জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কালো টায়ারের স্যান্ডেল। সলিল তাকে লক্ষ্য করছে টের পাওয়ায় চলাফেরায় বেশ একটা আলগাগাম্ভীর্য আরোপ করল।
ধাতব পাতের ওপর হাতুড়ি চালানোর শব্দ আসছে নিয়মিত বিরতিতে। হাতুড়িধর লোকটির পরনে বিবর্ণ কালো প্যান্ট আর মেটে-হলদে হয়ে ওঠা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। পাঁজরের কাছের সেলাইগুলো খুলে গেছে। খয়েরি রঙের ঘাড়, পিঠের কিয়দংশ আর দীর্ঘ পেশল হাত দুটি ঘেমে আলো ছড়াচ্ছে টিনসেডের নিচে। প্রতিবার হাতুড়ি চালানোর সময় একটা বুকচাপা জান্তব হুফ্-হুফ্ শব্দের সঙ্গে যেন প্রাণবায়ু একটু একটু করে বেরিয়ে আসছে লোকটির। ওর পাশে এসে জড়ো করা হচ্ছে বাতিল যন্ত্রাংশ থেকে খুলে নিয়ে আসা বাঁকাচোরা ধাতব পাত। ওগুলোকেই পিটিয়ে সোজা করছে লোকটা।
আরেকজন লোহার পাত ঝালাই করতে লেগেছে। ঝালাইকর ছেলেটি সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ তরুণ। হাতের রগগুলো ফুলে আছে তার। চোখের ওপর আয়তাকার কালো কাচ আঁটা একটি বোর্ড আঁকড়ে ধরা। বোর্ডটা দিয়ে মুখম-লের সবটা ঢাকা পড়ছে না। চোখ ঢাকলে চিবুক থাকছে অরক্ষিত, আর চিবুকের কাছে যখন ক্লান্ত হাতটা নেমে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সচকিত হয়ে তুলে নিতে হচ্ছে চোখের সামনে। হাতের যন্ত্রটা থেকে বেরিয়ে আসছে অক্সিএসিটিলিনের তপ্ত নীল শিখা। চিবুক বেয়ে ঘামের ধারা নামছে বিরতিহীন।
অপরদিকে প্রচ- শব্দ করে ঘুরছে ছোট ছোট দাঁতওয়ালা এক ধাতব চাকা। একটা সবুজ রঙ করা লোহার হাতল দিয়ে ঘুরন্ত চাকাটি ওঠানো নামানো যায়। নিচে লোহা ধরে কাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে একদিক থেকে। তীক্ষè শব্দ আসছে। প্রতিবার শব্দের সময় কানে হাত চাপা দিলো সলিল। লাল তারজালির মতো স্যান্ডো গেঞ্জি আর কালো মোটা গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট পরে পিঠ ফিরিয়ে কাজ করা ছেলেটি এদিক-ওদিক ফিরবার সময় দেখা গেল, তার কানে কোনো শব্দরোধী ছিপি আঁটা নেই।
আরও অনেক শ্রমিক মন্ত্রণা দেওয়া যন্ত্রের মতো এটা ওটা করে চলেছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই, হাসি ঠাট্টা নেই, সবাই নিজ কাজে একাগ্র। কারও কাজে কোনও হুড়োতাড়ার ভাব দেখা গেল না। প্রত্যেকে আলাদা করে লক্ষ করার মতো।
টিনসেডের টানা ছাউনি দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টিকে ডান পাশে রেখে হাঁটতে থাকল সলিল। ছাউনির শেষাংশের সঙ্গে লাগোয়া একটি খোলা করিডর। করিডরে দাঁড় করানো প্রায় আধশত ট্রান্সফর্মার সলিলের চোখে পড়ল। ট্রান্সফর্মারগুলোর মাথার অনেক ওপরে প্রশস্ত ছাদ। ট্রান্সফর্মারগুলোর পাশে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে, পর পর দুটো টিনের ছাউনি পেরিয়ে সলিল এসে দাঁড়াল প্রহরী ঘরের পর দাঁড়িয়ে থাকা সেই আধাপাকা ঘরগুলোর সামনে। সাদা চুনকাম করা প্রতিটির ঘরের ভেতর-বাহির। প্রথম দুটি ঘরে ট্রান্সফর্মারের পাওয়ার ফ্যাক্টর ইম্প্রুভার যন্ত্র তৈরির কাজ চলে। ওখানেই গতরাতে তারেককে কাজ করতে দেখেছিল সলিল, এ কথা মনে পড়ে যাওয়ায় একটিবার ভেতরে তাকালো। দিনের আলোয় দিব্যি কাজ করা যাচ্ছে বলে ভেতরে এখনও জ্বলেনি বিদ্যুৎবাতি। তাই ঘরের কোণগুলোয় ভারি রহস্য জঠরে নিয়ে অন্ধকার জমে আছে। ওই বিচিত্র আলো-আঁধারে তারেকের মুখ খুঁজে ফিরে সলিলের চোখ ব্যর্থ হলো।
এরপর আধাপাকা বাড়ির সারির শেষ দুটি ঘর। ঘর দুটো থেকে রাসায়নিকের ভারী গন্ধ আসছে বলে মানুষগুলো নাকে কাপড় বেঁধে রেখেছে। একটির ভেতরে ঢুকে এসিডের চৌবাচ্চা দেখে নীরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সলিল। চৌবাচ্চা বরাবর সোজা ওপরে টিনের ছাদ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। পরের ঘরে বিশাল বিশাল সব পাত্রে চলছে তড়িচ্চালক কোষ। দেখে শুনে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। শ্বাস পড়তে থাকলো ঘন ঘন, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া গেল বেড়ে, যার ছাপ পড়ল সলিলের চোখে মুখে। বিড়বিড় করে বলল, যুদ্ধক্ষেত্রে যখন নেমেছি, পিছু হঠব না। কোনোক্রমেই না।
এখানেও নাকে রুমাল বেঁধে কাজ করছে শ্রমিকরা। সে আসা মাত্রই কাজ থামিয়ে তাকিয়ে রইল, যেন তার উপস্থিতিতে কিছু করা নাস্তি। উপায় না বুঝে সলিল বেরিয়ে এলো। মুখে রুমাল বাঁধা থাকায় তাদের চেহারা বোঝা গেল না।
রাসায়নিকের ঘর থেকে বেরিয়ে আরও সামনে যেতে দেখা গেল একটুকরো ফাঁকা জায়গা যেখানে পরপর অনেকগুলো রঙের পিপে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মেঝেতে পড়ে আছে রূপালি রঙ। এখানে ওখানে রাঙিয়ে শুকোতে দেওয়া ছোট খাটো নানা যন্ত্রাংশ। দুজন লোককে দেখা গেল যারা ট্রান্সফর্মারের ফিন রঙ করছে। এদেরও নাকে এসিডধারীদের মতোই কাপড় বাঁধা। একজনের পরনে বেগুণী রঙের শার্ট অপরজনের হালকা গোলাপি। দুটো শার্টই রূপালি রঙের ছিটেয় ভরে আছে। এ রঙের ছিটে শুধু পরিধেয়তেই নয়, লেগে আছে তাদের লৌহকঠিন কালো ত্বকেও। বাহুতে, পায়ের পাতায়, এমনকি কপালে। রঙ লেগে চুলও জট পাকিয়ে আছে। এদের কর্মঠ রুক্ষ পায়ে মলিন কোমল স্পঞ্জের স্যান্ডেলের প্রাণ প্রায় যায়। নিজেদের ভেতর একটা কোনও আলাপে মগ্ন ছিল ওরা। সলিলকে দেখেই আলাপ থামিয়ে দিয়ে বেশ একটু দূরত্ব নিয়ে নিল দুজন, যেন কোনও কথা চলছিল না।
এমন সময় দূর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে উঠল, নতুন সাহেব!
পেছনে তাকিয়ে সলিল দেখে টিনসেডের প্রথম ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে মাহাদি হাত নাড়ছে। চোখাচোখি হতেই আবার বলল, কেমন দেখছেন!
সলিল পায়ের গতি একটুখানি বাড়িয়ে চলল সেদিকে। ঢালাই পথের মাঝখানে কোত্থেকে কটা সিরিষ কাগজ এসে পড়ে আছে, ব্যবহৃত। কারও পায়ের সঙ্গে এসে থাকবে। সলিল ওগুলো মাড়াল না। টিনসেডের ছাউনিতে ঢোকার আগে ঢালাই পথের ধার ধরে একটা নর্দমা চলে গেছে। স্বচ্ছ জল বয়ে চলেছে তাতে। দুধারের দেয়ালে পড়েছে পুরু সবুজ শ্যাওলা। একটা বল্টু পড়ে আছে, যেন পাহাড়ি নদীর প্রবাহপথে পাথর পড়ে আছে। তার ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলেছে জল। নর্দমাটা টপকে মাহাদির কাছে এল সলিল। মাহদির উজ্জ্বল চোখজোড়া তখনও বুদ্ধি বিতরণ করছে। সলিলের হাতটা ধরে অল্প একটু চাপ দিল মাহাদি। কণ্ঠে মাপা হৃদ্যতা নিয়ে বলল, এরপর? কেমন ঘুম হলো রাতে? ঢাকার মানুষ। মশার কামড়ে নিশ্চয়ই নাজেহাল হয়েছেন।
ঢাকার অভিজাত পরিবারে মানুষ আমি, কী করে বুঝলেন? ঠোঁট উল্টে আন্তরিক হাসলো সলিল, চোখে কৌতুক। জবাবে কৌতুক ধরতে পারা সমঝদারের মতো ঠোঁট চেপে হাসলো মাহদি। মাথা একপাশে হেলিয়ে বলল, না, তা তো গতকালই বুঝেছি, আমরা একই রকম প্রায়। মধ্যবিত্তের সেই ছেলেটি। যার স্বপ্ন থাকতে নেই। হাহাহা!
মাহদির দাঁতগুলোও বেশ গোছানো, সুন্দর। চোখের মতোই দ্যুতি ছড়ায়। সলিল বলল, আসলে রাতে কখন ঘুমিয়ে গেছি টেরও পাইনি। খুব ক্লান্ত ছিলাম, বোধয় সে কারণে। একেবারে মড়ার মতো ঘুমিয়েছি। এখন আপনাদের ওই আয়নায় তাকিয়ে তো অবাক।
হাহাহা! তাও বলা যায় অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। অবস্থা আরও খারাপও হতে পারত। আমাদের এখান থেকে শুধু মশার কামড় সইতে না পেরে চলে গেছে এমন লোকও আছেন। রাতে রবি এসে একটা কচুরিপানার কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আপনার বিছানার নিচে। মাঝরাতে পানি খেতে এসে দেখলাম। ওটার জন্য কিছুটা হলেও রক্ষা পেয়েছেন।
তাই নাকি! বাহ, ছেলেটা তো দারুণ! ও বলছিল অবশ্য রাতে মশার এমন উপদ্রবের কথা। আনমনে রোদের দিকে চোখ কুঁচকে তাকালো সলিল। দেখল এদিক ওদিক। খাওয়ারও আগে। বলছিল, ডাকাতে মশা সব এখানে। পাহাড় থেকে দল বেঁধে নাকি উড়ে আসে। বা এমন কী একটা যেন বলল। আমি ওর কাছে জানতে চেয়েছিলাম—আচ্ছা, ভালো কথা, এখানে পাহাড় কোনদিকে?
ওই উত্তরদিকে আরো।
হাতি আছে নাকি বেশ!
তা আছে। লোকজন তো মরতে শুনি প্রায়ই। হাতির জন্য বিদ্যুতায়িত তারও দেওয়া হয় ফসলের ক্ষেত বা কোনো বাড়ির চারদিকে। শুনেছি। গিয়ে দেখে আসা হয়নি এখনো। সে যাক, আপনাকেও পাহাড় টানে নাকি!
তা টানে।
মাহাদি হেসে বলল, আগের চেয়ে গাঢ় স্বরে বলে, আমি তো সমুদ্রের কোলে মানুষ। চট্টগ্রামে আমার বাড়ি। সামনে সমুদ্র, পেছনে সারি সারি পাহাড়। আমার দুর্দান্ত কৈশোর কেটেছে। আমাকে টানের ওপর রাখে। ঠিকাছে তাহলে? দুভাই সময় করে যাব নাহয়?
খুবই ভালো হয়।
রোদ আরও একটু চড়াও হওয়ায় টিনের নিচে টেকা দায় হয়ে পড়েছে। তেতে লাল হয়ে উঠেছে শ্রমিকদের কালো মুখগুলো।
আর মিনিট পনের আমি এখানে আছি। এরপর আপনাকে ঘুরে ঘুরে দেখাব সব, কেমন?
ঠিকাছে, কোনও হুড়োতাড়া করা দরকার নেই আবার জন্যে। আমি নিজেও দেখে নিতে পারছি। তবে আপনি থাকলে আরও ভালো হবে এটা তো বলার বাইরে। বেশ। আমি অপেক্ষা করি নাহয়। বা আশপাশেই আছি। আপনার হলে আমাকে ডাকবেন যেন।
ফোন নাম্বারটা দিন। আর নিজের মতো ঘুরে দেখতে থাকুন। কোনও প্রশ্ন জাগলে সেটা মনের ভেতর টুকে রাখলেন?
বেশ।
পাকা ঘরের সারি পেরিয়ে আসবার সময় ভেতরে তাকিয়ে দেখেছে সলিল। গতকালের মানুষটিকে দেখা গেল না। ফটকের সামনে গিয়ে গতকালের গার্ডের সঙ্গে দেখা। সলিল যেতেই আলমগীর টুল থেকে উঠে দাঁড়াল। বিব্রত সলিল তাকে হাত নেড়ে নিষেধ করতে থাকলো, এরপরও লোকটা বিনয় না দেখিয়ে ছাড়ল না। কাছে যেতেই দেখা গেল লোকটার পরনে নতুন ইউনিফর্ম। গতকালের চেয়ে আরেকটু পরিচ্ছন্ন, আরও একটু গাঢ় এর রঙ। সকালের স্নানের সিগ্ধতা তার ভাঁজ পড়া ত্বকে, যেন সকালের স্মৃতি শুধু এখানেই এখনো লেগে আছে। মাথায় থেবড়ানো টুপিটা নেই। পরিপাটি করে পেছনের দিকে আঁচড়ানো চুল, তাতে কালোর চেয়ে সাদার ভাগই বেশি। আলমগীরের মুখভঙ্গিতে একটু তটস্থতা, চোখজোড়ায় সতর্ক ভাব, হাতদুটো আড়াআড়ি রাখবার ভঙ্গিতে বিনয়। পকেটগেটের সামনে থেকে খানিকটা সরে এসে আগ বাড়তে জায়গা করে দিলো। সলিল বুঝতে পেরে বলল, আমি বেরুব না। আপনি ভালো আছেন তো?
জি, আছি। আপনি ভালো আছেন স্যার।
আছি। ঠিকাছে, তো আপনি থাকুন। ভেতরটা একটু ঘুরে দেখতে থাকি আমি, কথা হবে পরে, অবশ্যই। গতকাল আমাকে আপনি অনেক সাহায্য করেছেন।
বৃদ্ধ বিব্রত ভঙ্গিতে হেসে হাত নেড়ে বলল, ওটা কিছু না স্যার। আর আপনিও দাঁড়িয়ে থেকে কষ্ট করেছেন। আপনাকে আমি কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার মনেই আসেনি।
না ঠিকাছে। আর কত। সারাদিন তো কম খাটুনি যায় না। আমিও নতুন একটা ব্যাপার বিশেষ করে দেখতে পারলাম, শ্রমিকদের ওই বের হওয়ার ব্যাপারটা। এমন কিছু আমি দেখিনি এর আগে।
ও আচ্ছা, হাহাহা—এটা অনেক দিন ধরেই হচ্ছে। অনেকের অনেক আপত্তি আছে, এরপরও হয়। হওয়াটা ভালো।
তা একদিক থেকে ভালো। কিন্তু আরেক দিক থেকে একটু অস্বস্তিকরও, কেউ আমার গায়ে হাত রাখছে।
সলিল শেষ না করতেই আলমগীর মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে কেউ সার্চ করতে পারবে না। আপনাকে করবে না তো, আপনি তো এসবের ওপরে।
আমি বলিনি আমাকে সার্চ করবে। প্রয়োজনে করবেন, আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি যেটা বলছিলাম তা হলো, সবাই তো একরকম নয়। কেউ যদি আপত্তি করে তাকে কিন্তু দোষ দেওয়া যায় না। এজন্যে একটা অন্যরকম ব্যবস্থা করা যদি যেতো তো ভালো হতো। দেখি সম্ভব হলে বলব আমি। আলমগীর কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে রইল, কিন্তু প্রশ্নটি করল না। অপেক্ষা করে থাকল, সলিল নিজ থেকেই তা বলে কিনা। সলিল হাত নেড়ে একটা ধনুকের আকার দেখাল। ওই আর্চওয়েগুলো আছে না, এরপর মেটাল ডিটেক্টর। ওটার ভেতর দিয়ে শ্রমিকরা যাবেন। এরপর আপনার হাতে থাকবে মেটাল ডিটেক্টর। ওটার হাতলে ধরে শরীরের সামনে পেছনে বোলাবেন, বেশ। কেউ অপমানিতও হবে না, আপনারও অস্বস্তি কমবে। সলিল কথা কটা বলে থামল। তাকিয়ে রইল বৃদ্ধের চোখে। আলমগীর চোখ দুটো ক্ষণকালের জন্য নিচে নামাল। তা ঠিক স্যার। ওদের গা হাতাতে আমারো তো ভালো লাগে না। আপনি তাহলে সৌরভ স্যারকে বলুন সুযোগ করে। অবশ্য আপনি এলেনও নতুন। এখনই আবার কিছু বললে বলবে দেখো—মানে, আমি বলতে চাইছি, এই আর কি।
আলমগীর অস্বস্তিতে মাথাটা এপাশ ওপাশ নেড়ে অপ্রস্তুত হাসলো। সলিল হাত তুলে বলল, আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কথা। আপনাকে আমি ভুল বুঝিনি। আসলে এ কারখানার হালচাল অনেক কিছুই তো আমি জানি না। বুঝতে শুরু করেছি মাত্র। অনেক ধন্যবাদ। আমিও তাই ভাবছিলাম জানেন? এই আপনার মতোই, আমিও একটু সঙ্কোচে ছিলাম। প্রথমদিন ব্যাপারটা দেখেই আমার মনে এসেছে। আর কাউকে না বলে আপনার সঙ্গে ভাগ করলাম কারণ আপনি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত বিধায় পুরোপুরি বুঝতে পারবেন এই অবমাননার ব্যাপারটা। আমি কিন্তু অনেক শ্রমিকের চেখে অসন্তোষ দেখেছি। ওর মানুষ-সত্ত্বা আঘাত পাচ্ছিল এতো তো কোনো সন্দেহ নেই। আবার ধরুন, কারখানার অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা হয়ত মালিকপক্ষও ভাবছেন, পরিকল্পনায় আছে। হতে পারে কোনো জটিল কারণে বাস্তবায়িত হয়ে উঠছে না। তাঁরা আমার চেয়ে অনেকগুণে বিচক্ষণ, এ নিয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। যাক, আপনি আমাকে আপন জেনে যেটা বলতে চেয়েছেন, আমি ক- বলতেই কলকাতা বুঝে ফেলেছি। মানে এতোক্ষণের কথা থেকে হয়ত বুঝতে পারছেন আমি ভুল বুঝিনি। নাকি।
না আপনি ঠিকটাই বুঝেছেন। সবাই তো একরকম না, একভাবে সবাই সব নেয় না। বৃদ্ধ হাসতে থাকল। সাদা দাঁত আর কালচে লাল মাড়ি বৃদ্ধের, হাসির সময় যেন হৃদপি-টিও উন্মোচিত হলো।
সলিল গভীর শ্বাস বুকে টেনে বলল, সেটাই। কে জানে, আপনাদের এই কথাগুলো আমার জন্যে হয়ত খুব জরুরি এখন। এখানে অনেক কিছুই আমি বুঝতে পারছি না, আগেই বললাম। বেশ। ভালো থাকবেন তাহলে, আমি একটু ওদিকে যাই। কেমন?
অবশ্যই স্যার, আলমগীর মাথাটি একপাশে হেলিয়ে কয়েকবার বলে গেল। যান, ঘুরে দেখেন। আর বাঁশি বাজার বেরোনোর নিয়ম নেই, কিন্তু আপনার যদি দরকার হয়, আসবেন স্যার, আমি খুলে দেবো।
না তার দরকার নেই। কারখানার নিয়ম আমি মানতে চাই। স্মিত হেসে হাতটা শেষবারের মতো নেড়ে ঘুরে দাঁড়ালো সলিল। পেছনে বিব্রত চোখে দরদ নিয়ে তাকিয়ে রইল আলমগীর। ফটক থেকে খানিকটা এগিয়ে আসায় তার মুখের একটি পাশে আলো পড়ে আছে। আরপাশে ছায়া।
টেস্টিং রুমের দিকে এগোনোর পথে হাতের বাঁয়ে তাকালো সলিল। সারি দেওয়া পাকা ঘর শুরু। প্রথম ঘরে চোখ রাখল, যাকে খুঁজছে সে নেই। দ্বিতীয় ঘরেই পেয়ে গেল তাকে। চোখাচোখি হলো তারেকের সঙ্গে। একজোড়া চোখ অপর চোখজোড়াকে যেন বলল, ঠিকাছে, পরে আমাদের কথা হবে। প্রথমবার দৃষ্টি বিনিময়ের পর আরো বেশ কবার ওরা তাকালো একে অপরের দিকে। একে অপরের চোখে ধরা পড়ে গেল।
পকেটে ফোনটা নড়ে উঠল। মাহাদি বোধয় গুছিয়ে এনেছে। মোটের ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাহাদি তার হাতে ধরা সলিলকে দেখিয়ে বয়েস, গুরুত্ব ও আচরণবিচারে শ্রমিকদের কাউকে বলল, ইনি তোমাদের নতুন স্যার। সলিল নাম। তোমারা তাঁকে সাহায্য করবে। বুঝলে? স্যার, কারখানায় স্যার, নতুন এসেছেন। কাউকে বলল, কারখানার অনেক কিছুই হয়ত এখন তোমরা ভালো জানো—হয়ত নয়, এটা সত্যি, কিন্তু এ নিয়ে গৌরব কোরো না যেন। কারো সঙ্গে এটিও যোগ করল, আর এটাও মনে রেখ, স্যার খুব ভালো ফল দেখিয়ে এসেছেন। শিখতে পারেন ভয়ঙ্কর দ্রুত। আর সমস্যা সমাধান করে ফেলতে পারেন বুদ্ধি খাটিয়ে চোখের পলকে। অনেক পড়াশোনা। কী বুঝলে? বলল, তোমরা তাকে সাহায্য কোরো, আবারও বলছি। টেক্কা দিতে যেও না। বিশেষ বিশেষ কাউকে সব কথার শেষে বলল, আমি যেন কোনও বেয়াদবির অভিযোগ না পাই, ঠিকাছে? স্যার কিন্তু খুব ভালো। তোমাকের ভালো বন্ধু হবে। কাজের বন্ধু। কাঁধে হাত দিয়ে হাঁটা বন্ধু না আবার। ঠিকাছে তো?
শ্রমিকদের প্রতিক্রিয়া হলো মিশ্র। কেউ হলো বিরক্ত, শুনতে শুনতে পায়ের নখে ঢালাই মেঝের বালু সরাতে লাগলো। কেউ হলো বিব্রত। ওরা চারপাশে তাকাতে থাকল শুধু মেহেদি আর সলিলের দিকে ছাড়া। কেউ কেউ ঘাড় হেলিয়ে হাসলো, কেউ কাটল জিভ। সবাই সবার নাম বললো, কিন্তু সলিলের মনে থাকল কেবল লোহা কাটার ছেলেটির নাম। নয়ন। নয়নের চোখজোড়া সজল, আয়ত। এই ছেলেটি কানে খুব কমই শোনে। ওর সঙ্গে কয়েকবার করে সলিলের নামটি বলতে হলো। যেবার কথা বুঝতে পারছিল না সেবার চোখ দুটি কুঁচকে মাথাটি মাহাদির দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। শুনতে পেলে মাথা নাড়ছিল ওপরনিচ।
ওখান থেকে সরে এসে দুজনে পিএফআই ঘরের দিকে চলল। সলিল বলল, ছেলেটা কি বরাবরই কানে কম শুনতো? মাথা নেড়ে মেহেদি উত্তর দিলো, উঁহু। কারখানার আসার পর হয়েছে।
কানে ছিপি আঁটে না কাজের সময়, দেখেছি।
ওটা তো এখন দেখেছেন, আগে আঁটতো। কিন্তু ওর যে কাজ, যে তীব্র শব্দের ভেতর ওকে থাকতে হতো, তাতে ওই ছিপিতে পোষাতো না। কিন্তু ওটাই মেনে নিয়ে চুপচাপ কাজ করেছে, এসব ক্ষেত্রে যা হয়। কিছুই কিন্তু বলেনি তাছাড়া ছেলেটা, এখনো অব্দি না। ও যে কম শুনছে এটা আমাদের আবিষ্কার। ওর বাড়ি থেকেও কোনো অভিযোগ নেই। মেনে নিয়েছে। হয়ত ভেবেছে, ছেলে কাজ করে, একটু এমন তো হবেই। এটা ওদের কাছে অভিযোগ করার মতো বিষয়ও না।কতজনের তো হাতপা চলে যায়, জীবন চলে যায়। সে তুলনায় মাত্র শুনতে কম পায়—এ তো মামুলি ব্যাপার। হাহ্। যাক পিএফআই রুমে চলুন। সেখানে আর কজন আছে। এরপর শেষ। আর আপনি যার ব্যাপারে আগ্রহী, সেই তারেক, সেও আছে। চলুন।
পিএফআই রুমে যার যার কাজ করছিল সবাই। মেহেদি গিয়ে একবার গলা ঝাড়তেই সবাই একে একে ঘুরে দাঁড়াল। সলিলকে দেখিয়ে মেহেদি বলল, আমাদের মধ্যে নতুন একজন প্রকৌশলী এসে যোগ দিয়েছেন। ঢাকা থেকে এসেছেন তিনি। পড়াশোনাও সেখানেই। ওনার নাম সলিল মজুমদার। আমাদের সুখ দুঃখের নতুন সঙ্গী, কেমন তো? আসুন সবাই একটু এগিয়ে আসুন, হাত মেলানো যাক।
তারেক এগিয়ে এলো সবার প্রথমে। ঠোঁটে আর চোখে আন্তরিক হাসি। হাসবার সময় তারেকের দুচোখের কোণে বয়েসী লোকের মতো ভাঁজ পড়ে। তাকে হাত মেলাতে দেখে পরস্পরে চোখাচোখি করে এগিয়ে এলো আরো দুই তরুণ।তাদের ঠোঁটে হাসি ছিল বটে, চোখে তা ছিল না। এক ধরনের উপেক্ষা আর অহমে ওদের নাকের পাটা ফুলে উঠছিল। হাত মেলানোর সময় বাড়তি জোর ছিল কবজিতে।সলিলের ঠোঁটে হাসির শান্ত রেখা থাকলেও, দেখে শুনে ভুরু তার দুটোর মধ্যখানে ভাঁজ পড়ে গেল। ওই দুজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফাঁক করে একবার মেহেদির দিকে তাকিয়ে দেখল, ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁট দুটো চেপে রেখে ইচ্ছে করেই যেন অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। সবার সঙ্গে হাত মেলানো শেষে বিদায় জানিয়ে বাইরে চলে এসে প্রশ্ন না করে আর পারেনি সলিল।
ওরা এমন করল কেন?
কেমন?
কেমন যেন। ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। যেন কিছু নিয়ে ক্ষেপে আছে। আর আপনিও দেখলাম চোয়াল শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ব্যাপারটা কী?
বাহ, আপনার চোখ এড়ায়নি তাহলে। কী করব বলুন, মেজাজটা খিঁচড়ে যায় ও-দুটোকে দেখলে। ওরা না, কী বলব—নাক কুঁচকে বেশ একটা অবজ্ঞার ভাব ফুটিয়ে তুলে মেহেদি বলল,এক ধরনের মানসিক রোগে, জটিলতায় ভোগে মনে করুন। এ রোগের, এ জটিলতার শেকড় কিন্তু খুব গভীরে না। বরং একেবারেই ওপরে। অনেকটা পরগাছা ধাঁচের শেকড়, বুঝলেন? আর রাগটা আমার এখানেই। এ ধরনের রোগ যে কারো থাকতে পারে তা কাজে আসার আগে আমি বুঝতেই পারিনি, কল্পনাও করিনি। তবে ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কারণ কমবয়েসীদের ভেতরই এটা বেশি। বয়স হতে হতে এটা অনেকের কেটে যেতে দেখেছি। কেউ কেউ আবার শেষতক ভুলতে পারে না।
জটিলতাটা কী ধরনের আসলে, রোগটাই বা কী।
জবাবে হো হো করে হাসল কিছুক্ষণ মেহেদি। হাতুড়ির একটা শব্দের ভেতর কথা বলে যেতে হচ্ছিল। হেঁটে ফটকের দিকে যেতে শব্দের ঘনত্ব কমল খানিকটা। সলিল মাথাটি একপাশে হেলিয়ে কৌতূহলী কালো চোখে তাকিয়ে থাকল মেহেদির লালচে মণিজোড়ার দিকে। মেহেদি বলল, একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপার এটা, কিন্তু এটা খুব সত্যি! আর আপনার চিন্তায় যখন পরিষ্কার হয়ে ধরা দেবে আপনিও আমার এখন বলা কথাগুলো নিজের সঙ্গে মেলাতে পারবেন।আমি যখন নিজে আবিষ্কার করেছি, তখন প্রথমে অবাক হয়েছি, এরপর খুব পুলকিত হয়েছি, বুঝলেন? আমি চাই আপনিও সেই অদ্ভুত দোলার ভেতর দিয়ে যান।সবাই একভাবে একই জিনিষ পায় না তা সত্য। কিন্তু তবু ওই যে আবিষ্কারের কথা বললাম, ওটার একটা আনন্দ আছে না? সেটা অন্তত আপনার হাতছাড়া না হোক।
সলিল নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁধ দুটো মৃদু ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসল। তো বেশ, নিজেই না-হয় আবিষ্কার করব। দুবার ঘন ঘন মাথা নেড়ে মেহেদি সায় জানাল তার কথার। বলল, তবে হ্যাঁ, ছোট একটা সূত্র আপনাকে দিতে পারি আমি। ঠোঁটে দুষ্টুমিভরা হাসি নিয়ে চারপাশ একটিবার দেখে সলিলকে কাছে ডেকে বলল,আমাদের জসিম ভাই কিন্তু মানুষটা এমন নন, তাকে আপনি যেমন দেখছেন। তিনি অন্য অনেকের চেয়েই অনেক ভালো মানুষ। সৎ মানুষ। আপনি সময়ে টের পাবেন। কিন্তু তিনি এখন আপনার সঙ্গে যে আচরণ করছেন, তা ভেতরেলুকিয়ে থাকা ওই রোগটার কারণে। তার ভেতর এই রোগ আছে। এর ভেতর দিয়ে আমরাও গেছি। এই সেদিন আমি আর পল্লব সেটা নিয়েই কথা বলছিলাম। কী বলছিলাম সে কথা থাক।
নিচের ঠোঁট উল্টে সলিল বলল, বেশ।
সেরাতেখাবার টেবিল ছাড়ার পর সৌরভের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সলিলের। আপনার ওপর এখনো কোনো দায়িত্ব দেবো না। সলিলের কাঁধে একটি হাত রেখে বেশরকম ভরসা দেওয়া দৃষ্টি ফেলে কথা বলে চলেছিল সৌরভ। কারখানাটা পুরে ঘুরে দেখেছেন তো আজ?
জ্বি, দেখেছি। বিনীতকণ্ঠে প্রত্যুত্তর করেছিল সলিল। মেহেদি ভাইও সঙ্গে ছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সঙ্গে, দেখালেন সব, অবশ্য বাকি আছে আরো।
বেশ। শেষ করুন। সৌরভ কাঁধ থেকে হাতটি নামিয়ে এবার খানিকটা পিছিয়ে এসেছিল। সব বুঝে নিন। শিগগিরই আপনাকে দায়িত্ব দেবো। মাঝখানের ফাঁকায় আমরা নিজেদের মতো করে কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম তো, বেশ একটু মানিয়েও নিয়েছিলাম। আপনাকে কোথায় দেবো তা আমরা আরো একটু ভাববো। মুখটি নিচু করে ডান হাতের নখের ডগাগুলো বুড়ো আঙুলে ঘষতে ঘষতে বলেছিল, এর আগে যে ছিল, সে ছিল মান নিয়ন্ত্রণ বিভাগে। ও যাবার পর আমরা তখন ভেবেছিলাম নতুন যে আসবে তাকেও আমরা মান নিয়ন্ত্রণেই দেবো। কিন্তু মধ্যখানে ওটা এখন জসিম বেশ ভালোই বুঝে নিয়েছে। ভাবলাম, কারখানার সবচেয়ে সংবেদনশীল পাট, ও করছে করুক। আরো কিছু বিভাগ আছে যেমন—পিএফআই। সেখানেও লোক প্রয়োজন। একজনকে আমরা ছাঁটাইয়ের কথা ভাবছি। চোখের সুহৃদ হাসিটা বিদায় হয়েছিল। বেশ অনেকদিন ধরেই। দেখবেন, কারো সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপে যাবেন না যেন। তো, সেখানে একজনকে আমাদের তৈরি করা দরকার।
সলিলকে থেকে থেকে আগাগোড়া তাকিয়ে মেপে নিচ্ছিল সৌরভ কথার ফাঁকে ফাঁকে, কিন্তু চোখ দুটো ছিল সুহৃদ মানুষের মতো শান্ত, উৎসুক। সলিল তার কথায় সায় জানাতেই দুই পকেটে রেখে শরীরে একবার ঢেউ খেলিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সৌরভ খানিকটা এগিয়ে এসেছিল। সলিলের মুখটা তখন তার বুকের কাছে। সামনের দিকে একটুখানি ঝুঁকে এসে সৌরভ বলেছিল, আমি নিশ্চিত করছি না কিছুই এখনো। বলতে গেলে কিছুই। আপাতত নিজের মতো করে দেখুন আরো, টুকে রাখুন। সলিলের ভুরুতে ভাঁজ পড়েছিল। ঠোঁট দুটি চেপে বড় করে শ্বাস টেনেছিল বুকে। আর শুনে যাচ্ছিল, মেহেদি, পল্লব ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন, ভাগ করে নেবেন সব। ওরা যথেষ্ট সাহায্যপরায়ণ যদ্দুর আমি ওদের জানি। বেশ। তা এখানে খাবার কেমন লাগছে আপনার? প্রথমদিকে আমার তো একেবারে যাচ্ছেতাই হয়েছিল অবস্থা। শুনলেই বুঝবেন, খুলনা আমার বাড়ি। বাঘা ঝাল খেয়ে আমার অভ্যাস। এখানে তো সব মিষ্টি মিষ্টি ঠেকে, কোনো রকমে খেয়ে উঠে যাই। তবে কারো ভালো লাগছে শুনলে আবার ভালো লাগে। আপনি নাকি সেদিস বেশ প্রশংসা করছিলেন?
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-৫॥ হামিম কামাল