এক.
গল্পকার হাসিব জামিল কোনো একদিন গল্পচ্ছলে শৈলীকে বলেছিল, সে একজন মেয়ের নগ্ন শরীর দেখতে চায়। হাসিবের এই অদ্ভুত ইচ্ছার কথা শুনে শৈলী হাসিবের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য এক পায়ে খাড়া হয়ে গেছিল। একদিন ডেকেও ছিল নিজ বাড়িতে। কখনো কখনো কোনো কোনো সম্পর্ক হিসাবের ধার ধারে না, কোথায় লাভ, কিসে ক্ষতি? কিন্তু আজ এতদিন পর এসব পুরনো কথা ভাবছে কেন হাসিব? এসব ভাবার কথা তো তার নয়, নাকি আত্মন্মোচনের সময় এসে গেছে? না কি ‘ঈশ উপনিষদ’-র কথাই সত্য হতে চলেছে?—‘হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতিং মুখম। তত্ত্বং পৃষণ্নবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে’ অর্থাৎ—সত্যের মুখ উজ্জ্বল সোনার পাত্রের দ্বারা আবৃত। জীবন ও জগতের ধারক হে সূর্য, তুমি সেই আবরণটি দয়া করে সরিয়ে দাও যাতে সত্য জিজ্ঞাসু আমি, সত্যকে দর্শন করতে পারি।’ কফি কাপটা টেবিলের ওপর বসে আছে অনেকক্ষণ। ইতোমধ্যে ম্লান সূর্যের ছায়ার মতো হয়ে গেছে কফি, তবু ধূসর রঙা কাপটা সিগারেট বিরতিতে থাকা পুড়ে যাওয়া নিজের ঠোঁটে গুঁজে নেয় হাসিব, যেন এতক্ষণের মুখোশ পরা ভাবনাগুলোকে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফির ভেতর ডুবিয়ে মারতে চায় সে। কত লেখা বাকি? আসছে বইমেলাতে কয়েকটি বই বেরুবে, পাণ্ডুলিপি তৈরি করা, ঘষে মেজে সেগুলোকে ঈদের পোশাক পরিয়ে আনন্দিত মানুষের মতো করে প্রকাশকদের হাতে তুলে দেওয়া—অনেক, অনেক কাজ।
দুই.
দুঃখও তবে শিহরণ জাগায়! অতএব সময়ের শরীরে আরও পুরু হয় দুঃখের আস্তরণ। নিরুক্ত বিকেলে অলস ছায়া হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন রাতের সিঁড়ি বেয়ে সময় ঝাঁপ দেয় অগভীর জলের কারুকাজে। ইশারার ভেজা চুল এলোমেলো হয়ে উপচে পড়ে বুকপাঁজরে, তবে কি সবই ভ্রান্তিবিলাস! পৃথিবীর অন্যখানে অবরুদ্ধ শ্বাসাঘাতে কে মরলো অথবা অসাড় শব্দহীনতায় কতগুলো স্বপ্ন ঘোলাটে হলো তাতে শৈলীর কী? সব সময় পাওয়া না পাওয়া যদি ইচ্ছাধীন থাকত তাহলে শৈলী কি আর এখানে থাকতো? ভাবতে ভাবতে তার ভাবনারা কখনো কখনো বৈঠা খুঁজে পায় না, মাতাল নৌকার মতো গহীন জলের স্বপ্নে ঘোরপাক খেতে থাকে। ইউনিভার্সিটি থেকে এক্সসকারশনে একবার কক্সবাজার গিয়েছিলো শৈলীর সহপাঠীরা। সে দিনের সেই মেঘ নিরপেক্ষ রাতে সময় থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে শৈলী আর হাসিব সমুদ্র সৈকতে হেঁটেছিল, সেই মধ্যরাতে শৈলী হাত ধরেছিল হাসিবের—এক অদ্ভুত শিহরণ খেলা করেছিল তার মধ্যে কামোত্তেজনার শিহরণ নয়, এক বিনয়ী নিশ্চিন্তের শিহরণ। সে নিজের ভেতর থেকে নিরপেক্ষ নিজেকে বের করে তাকে মুখোমুখি বসিয়ে বহুবার জিজ্ঞেস করে দেখেছে, আসলে সে হাসিবকে কোন ভূমিকায় চেয়েছে, নাকি তার ভেতরে হাসিবকে নিয়ে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করত? মানুষের মনোজগতে কত কিছুই যে তার ইচ্ছার বাইরে ঘটে, তার খোঁজ মানুষ নিজেও রাখতে পারে না, রাখা সম্ভবও হয় না। হাসিবের কাছ থেকে নয় বরং নিজের কাছ থেকে পালিয়ে থাকার জন্য শৈলী একটা মুখোশ খুঁজছিল। ম্যানহাটান জায়গাটা মোটেও ভালো লাগেনি তার, ব্যস্ত, ত্রস্ত, চঞ্চল, যেন এক টুকরো বাংলাদেশ। শৈলী চেয়েছিলো নিশ্চুপ-স্নাত এক নিজেকে, সকলের থেকে আলাদা। নিজের অভিমান দিয়ে সে নিজেকে বারবার ধুয়ে নিতে চেয়েছিল। প্রত্যাখানের আগুনে পুড়তে থাকা শৈলী তাই এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলো। স্বামী হিসেবে মুম যথেষ্ট যত্নশীল, দায়িত্ববান, সচ্ছল। বুয়েট থেকে আর্কিটেক্টে অনার্স করে মাস্টার্স করার জন্য চলে এসেছিলো স্টেটস-এ। পাস করে কিছুদিন চাকরি করেছিলো, পরে চাকরি ছেড়ে আর্কিটেক্ট ফার্ম খুলেছিল। অল্প সময়ে খুব ভালো করেছে।
তিন.
দুই আঙুলের ফাঁকে আশ্রিত সিগারেটে একবারও টান না দিয়ে তিন তিন বার ঝেড়ে আশট্রেতে ছাই ফেলল হাসিব। সাধারণত কোনো গভীর ভাবনায় ডুবে থাকলে তার এমন হয়, আজও ঠিক তেমনই হচ্ছে। হাসিব কি তবে নিজেই নিজের কাছে নজরবন্দি হয়ে যাচ্ছে? অলক্ষ্যেই? অথচ অস্তিত্বের টানাপড়েনে সে কখনোই কাহিল হয়নি, মানুষকে সফল হতে হলে কি মুখোশ পরার বিকল্প কিছু নেই? কিন্তু হাসিব জামিল তো এসবের কিছুই চায়নি, অর্থ-বিত্ত-নারী; কিছুই না। চাইলে খুব সহজেই এগুলো করায়ত্ত করতে পারত সে, তার যে একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে খুব ভালো পজিশনে যাওয়া তার জন্য খুব মামুলি বিষয় ছিল। হাসিব জামিল মাথা ঝাঁকায়, যেন হিসাব না মেলা খাতার হিসাবরক্ষক সে। এই মুহূর্তে ভিক্টর হুগো-র ‘দি ম্যান হু লাফস’ উপন্যাসের সেই ছেলেটির কথা খুব মনে পড়ছে জামিলের, যার মুখটি এমনভাবে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছিল, যেন মনে হতো যে, ছেলেটি যেন সবসময় হাসছে, এমনকি মৃত্যুর সময়েও। আসলে সাফল্য-লাভ কি এক ধরনের বিকৃত আনন্দের উদযাপন? যতদূর শোনা, শৈলী স্টেটস এর বাসিন্দা, চকচকে আলোর মখমলে মোড়ানো জীবন। কিছু কিছু সময় মানুষের ভেতর জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে। কোনো নিদৃষ্ট কারণ ছাড়াই এমন হয়—কিন্তু হাসিব জামিল কেন ব্যক্তিগত স্তরে নিজেকে আবদ্ধ রাখবে? সে তো লেখক। আর শৈলী, যাকে দেখলেই পুরুষের মনে ভালোবাসা জেগে উঠতো শীত সকালের রোদ্দুরের মতো—শৈলী, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহপাঠী, সিনিয়র এমনকি অনেক জুনিয়র ছেলের একান্ত কামনার ছিল, অথচ সেই মেয়ে হাসিবের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেছিলো নির্দ্বিধায়!
কি অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর কথা! ডলি’কে, পলিদি’কে নিয়ে লেখা গল্প পড়ে সেকি অভিমান শৈলীর! মেয়েরা কি কোনোদিনই নিজেকে পূর্ণ মানুষ ভাবতে পারবে না? এ কথাই বা কেমন করে বলে হাসিব জামিল! এলোমেলো ভাবনারা উড়তে উড়তে চলে যায় দিগন্তের দিকে—দক্ষিণের জানালাটা হাসিবের ভাবনা এবং উবু হয়ে নেমে আসা আকাশের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে নিঃস্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে—কোনো কিছু দাবি না করেই। হাসিব ভেবে রেখেছে, জানালাটাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে, প্রতিদান হিসেবে। দোতলার এই ফ্লাটে, এই মধ্য সকালে এক অদ্ভুত ভাবনার জালে আটকে গেছে হাসিব জামিল। লেখার টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ায় সে, তাঁর নিজস্ব ‘চোখ-জানালা’র কাছে নিজের দৃষ্টিকে মেলে ধরে, দক্ষিণের জানালার আওতাভুক্ত আকাশে। ঢাকা শহরের কয়েকশ বর্গফুটের এই আকাশটুকুই হাসিবের পরিচিত। উত্তর-পূর্ব-পশ্চিমের আকাশ তার কাছে অচেনা। ঢাকা শহরে আকাশই-বা কোথায়? সবই তো ঢুকে গেছে উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এর ক্ষুধার্ত উদরে। আকাশ হারানোর বেদনায় সর্বক্ষণ মুখ ভার করে থাকে এ শহর।
চার.
দূরত্বের লেস বুনে ‘একটা গল্পের চরিত্র’ হওয়ার অতীত ইচ্ছাকে মন থেকে সরিয়ে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করে শৈলী, কখনো পারে, কখনো পারে না। না পারা সময়ে স্মৃতির তাবিজে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া তখন শৈলীর আর কিছুই করার থাকে না। আজও তেমনই এক বিকেল। পাঁজর ভাঙ্গা বেদনায় মুখ ভার করে আছে আকাশ। পালাবদলের রুপরেখা আঁকতে আঁকতে ম্লান বিকেলের তুলিও ক্লান্ত। কানাওয়াহ নদীর কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা, বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলা ভালো। ঐশ্বর্যের অহংকারে নিজের ছায়াকেও জড়িয়ে রেখেছে যেন। শৈলীর জেদেই সাইমুম ম্যানহ্যাটান থেকে সরে এসেছে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে। একাকীত্বের সঙ্গে নিঃসঙ্গতাকে পরিচয় করিয়ে দিতে খুব ইচ্ছা করছে আজ। ডকে বেঁধে রাখা নৌকায় বসে ক্ষীনাঙ্গী কানাওয়াহ নদীর বিশ্রামরত স্রোতে ভেসে ওঠা নিজের প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে খুব। এক পা দুই পা করে ডকের দিকে হাঁটতে থাকে শৈলী। কি ভেবে ঘুরে দাঁড়ায়, ফিরে আসে নিজ ঘরে। বাড়িতে আজ কেউ নেই। কেউ বলতে সাইমুম কি একটা কনফারেন্সে নিউইয়র্ক গেছে, তিনদিন পর ফিরে আসবে। শৈলীকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, শৈলী যায়নি। চিঠিটা বের করে সে- সযত্নে খুলে ধরে নিজের সামনে, হাসিবের লেখা এই একমাত্র চিঠি অন্তত কয়েক লক্ষ বার পড়েছে শৈলী। এ চিঠির প্রতিটি অক্ষর তার মুখস্ত। একা থাকার সময়ে এই চিঠিটার সঙ্গে কথা বলে সে। এখন আর পড়তে ইচ্ছা করছে না চিঠিটি। যেভাবে ভাঁজ করা ছিলো ঠিক সেভাবেই আবার ভাঁজ করে রেখে দেয়, রেখে দেওয়ার আগে ইচ্ছাভরে ঘ্রাণ নেয় চিঠিটার।
হ্যালো।
হ্যাঁ, বলো।
ক্যামন আছো?
এইতো, একা একা ভালো লাগছে না।
কী হলো আবার?
এই তো আমি আসছি।
আসো।
একটা সারপ্রাইজ আছে।
কী সারপ্রাইজ?
ধারণা করো?
না… করেই দ্যাখো না।
না।
চেষ্টা করেই দ্যাখো।
না।
আমরা বাংলাদেশ যাচ্ছি।
না।
এই শৈলীকে অপরিচিত লাগছে শৈলীর নিজেরই। অন্য সময় হলে দেশে যাওয়ার কথা শুনে আনন্দে উথলে উঠতো মন। আজ এই আনন্দের সংবাদ শুনেও কোনো আনন্দ হচ্ছে না। তার চেয়ে মুমকে বলে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। কিন্তু কোথায়? সাইমুম ফিরে আসুক, দুই জনে মিলে প্লান অরে ঠিক করা যাবে কোথায় যাওয়া যায়। শৈলী নিজের দৃষ্টি সীমানাকে ছুঁড়ে মেরেছে বাইরের দিকে। এখানকার এই সময়টা খুব সুন্দর। মৌনতার সঙ্গে সুন্দরের মিল হলে সেই সৌন্দর্য অন্য মাত্রা পায়। ঠিক তেমনই এক অসম্ভব সুন্দরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শৈলী। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার এই ছোট শহর কানাওয়াহ। শৈলী আর সাইমুমের বাড়িটার একদিকে ছোট ছোট পাহাড়, অন্য দিকে নদী, কানাওয়াহ নদী, নদীর ধার ঘেঁষে একেকটা প্রাসাদপম বাড়ি, বাড়ির সীমানা নেমে গেছে নদী অবধি। ডকে বাঁধা থাকে নৌকা। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত সুন্দরও মন খারাপ করে দেয়, এখন যেমন শৈলীর।
পাঁচ.
সারাজীবন যা কিছু অতিরিক্ত সুন্দর, তা সযত্নে এড়িয়ে গেছে হাসিব। সুন্দরের ব্যাপারে তার ভেতরে এক ধরণের ‘না’ বোধক অবজ্ঞা আছে। হাসিবের মনে হয়, সুন্দরকে ছুঁয়ে দিলে সুন্দর নষ্ট হয়ে যাবে, মনে হয় সুন্দরকে ছুঁয়ে থাকার অধিকার তার নেই, তার চেয়ে দেখা ভালো, ঘ্রাণ নেওয়া ভালো, সুন্দরের সামনে যুগ যুগ বসে থাকা যায় কিন্তু সুন্দরের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করতে চাওয়া অনুচিত, অন্যায়। তার চেয়ে বরং অসুন্দরের ভেতর সে সুন্দরের চাষ করে অসুন্দরকে ধীরে ধীরে সুন্দর করে তুলবে, পৃথিবীর সমস্ত অসুন্দর হাসিবের ছোঁয়ায় ক্রমান্বয়ে সুন্দর হয়ে উঠবে, হাসিবের পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা নতুন সুন্দরকে সে প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে দেবে। ঘুম থেকে উঠে গোসল করে স্কুল-কলেজ যাওয়া তার বিগত তিন দশকের অভ্যাস, এই অভ্যাসটা টিকে আছে আজ অবধি। লেখালেখির জন্য এই অভ্যাসটা খুবই উপকারী। সেই অভ্যাসের বশীভূত হয়েই আজও লিখতে বসেছিল হাসিব। কিন্তু কি হয়েছে আজ? আজ কেন শৈলীর কথা এত মনে পড়ছে। হাসিব আজকের গল্পটা কোথাও লিখে রাখছে না, ভেতরে ভেতরে গল্পটা বয়েই চলেছে—ইচ্ছা করলেই সে এই মুহূর্তেই এই গল্পে এক বা একাধিক চরিত্র ঢুকিয়ে দিতে পারে। যেমন, এখুনি যদি সে, ‘নীরা, নী-রা’ এই নাম ধরে ডাক দেয় তাহলেই কিচেন থেকে বের হয়ে আসবে এক নারী, সশ্রমে এক উচ্ছল চরিত্রের প্রবেশ ঘটবে এই গল্পের শরীরে। আপাতত এই ইচ্ছের মুখে যতি চিহ্ন বসিয়ে দেয় হাসিব জামিল, সে চায় না এখুনি কেউ এ গল্পের শরীর দখল করুক; কিছু কিছু গল্প নীরবতা দাবি করে, এ গল্প তেমনই এক গল্প হয়েই থাকুক না। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কেন শৈলী-স্মৃতির জালে এমনভাবে আটকে গেছে? না, এর ভাবনা-জাল থেকে বেরুতেই হবে। গল্পকার হাসিব জামিল আরেকটি নতুন মুখোশ খুঁজছেন, নিজেকে আরেকবার লুকিয়ে নেবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন; নতুন মুখোশে নিজেকে আড়াল করার প্রাক্কালে মুখোশের ভেতর থেকে হুবহু ‘হাসিব জামিল’ বের হয়ে আসে, মুখোশের আড়ালে নিজেকে লুকোনোর সব প্রচেষ্টা ধোঁয়া হয়ে গেল।
ছয়.
নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে শৈলী আর মুম দুই জনে মিলে ট্যুর প্লান পাকা করে ফেলে। শৈলী যেতে চেয়েছিল নিউজিল্যান্ড, মুম কানাডা। মুমের চাপাচাপিতে অবশেষে ঠিক হয় কানাডাই যাবে ওরা, কানাডা মানে মন্ট্রিল। অনেক বন্ধুবান্ধব আছে ওখানে, বেশ মজা হবে। বাংলাদেশে যেতে রাজি না হওয়ায় অবাক হয় মুম। কী ভেবে শৈলী এবার বাংলাদেশে যেতে চাচ্ছে না তা কি মুম জানে? শৈলী কি মুমের প্রতি কোনো অন্যায় করছে? সে তো কোনোদিনই নিজে মুখ ফুটে হাসিবকে কিছু বলেনি। হাসিব তাকে অবজ্ঞার চোখে দেখেছে, এ কথা শৈলী নিজে নিজেই ভেবে নিয়েছিলো। শৈলী হাসিবকে কখনো প্রপোজও করেনি—সেখানে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? শৈলী ভাবে তবে কি এই সবকিছুই তার নিজের বানানো। সম্পর্ক এক জটিল ধাঁধার মতো। শত চেষ্টা করেও উত্তর মেলানো যায় না। কিন্তু শৈলী তো শুধু হাসিবের গল্পের একজন নায়িকা হতে চেয়েছিল মাত্র, এতেই হাসিবের এত আপত্তি। নাকি হাসিবও ভয় পেয়েছিল শৈলীকে? জানা প্রশ্নের উত্তর মেলানো যায় না কিছুতেই। হুট করেই শৈলী বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, বিয়ে করেই চলে আসে আমেরিকা।
সাত.
মন্ট্রিলে এসে বন্ধু ডা. বিজয়ের বাসায় উঠেছে মুম আর শৈলী। বিজয় ওদের খুব ভালো বন্ধু। বেড়ানো মানে ধুন্ধুমার আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, কার্ড খেলা আর ঘুমানোর আগে গলা ডুবিয়ে ড্রিঙ্কস। আশপাশের আরও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এসে জুটে যাবে—হৈ চৈ। এতেই সবার আনন্দ, গতানুগতিক জীবনের ছাঁচ থেকে বেরিয়ে কিছুটা স্বাধীন সময় কাটানো। আজ রাতেই গ্র্যান্ড আড্ডা। আড্ডাটা জমবে দারুণ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আসা আরম্ভ করলো, বিজয়ের বাড়ির লনে আড্ডার বিশাল আয়োজন, খুবই আনন্দ লাগছে শৈলীর। অনেকদিন পর এমন একটা পরিবেশে এসে সে যারপরনাই আনন্দিত। একটা কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে শৈলী। পেছনে ফেরা মাত্রই বিজয় বলে, ‘ও হাসিব, হাসিব জামিল, আমার বন্ধু, এবার কানাডাস্থ বাংলাদেশি কমিউনিটি ওকে ইনভাইট করে এনেছে, বিশেষ সম্মাননা দেওয়ার জন্য, ওর আসার খবর আমিই জানিয়েছিলাম মুমকে, তারপরই না মুম রাজি হলো এখানে আসতে।’ শৈলী মুমের দিকে তাকায়, তাকিয়েই থাকে। তেরো বছর আগের হাসিব, যে হাসিব শৈলীকে তার গল্পের সামান্য একটা চরিত্র করতে রাজি হয়নি। এই মুহূর্তে দুই জন মানুষই প্রাণপণে নিজেদের চেহারার মুখোশটাকে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করছে, যেন কিছুতেই সেটা খসে না পড়ে, যেন মুখোশের ভেতর থেকে কিছুতেই বেরিয়ে না আসে তাদের প্রকৃত চেহারা, যেন তারা আজীবন পরস্পরের কাছে হয়ে থাকে ‘মুখোশমানুষ’…