॥৭॥
ঢেউগুলো ক্রমশ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকলো। আমরা আমাদের শক্তি হারাতে থাকলাম। এর ভেতরে দূরে দুজন ব্যক্তিকে দেখা গেলো। তারা রক্তের ওপর দিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে আসছে। একজন ক্রাচে ভর দিয়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তার এক হাতে একটা ছড়ি। আরেকজনের চোখে কালো রোদ-চশমা।
আশিক বলল, আমি এদের চিনি।আমি বললাম, কে এঁরা।
আশিক বলল, একজন সাবেক কর্নেল আরেকজন সাবেক মেজর জেনারেল।
আমি সতর্ক দৃষ্টি রাখলাম তাদের ওপর। এও ভাবতে লাগলাম আশিক এদের কিভাবে চেনে? যেভাবে বললো তাতে এরা সর্বজনবিদিত, কিন্তু আমি চিনতে পারছি না কেন? আমি আরও ভালোভাবে তাদের লক্ষ করতে লাগলাম। আমি আরও ভালোভাবে তাদের চেনার চেষ্টা করলাম। আমি আরও ভালোভাবে তাদের মনে করার চেষ্টা করলাম।
তাদের চেনা চেনা মনে হলো। কিন্তু ঠিক ঠিক চিনতে পারলাম না। মনে হলো একবার আমি এদের দেখেছি কোথাও। আরেকবার মনে হলে আমি এদের অনেকবার দেখেছি। কিন্তু কোথায় দেখেছি তা মনে করতে পারলাম না। কিংবা কিভাবে তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাও মনে করতে পারলাম না। কিংবা কেনই বা তাদের আমি দেখেছিলাম তাও মনে করতে পারলাম না। ফলে খানিকটা চেনা খানিকটা না-চেনা মনে হতে থাকলো। ফলে খানিকটা দেখা খানিকটা না-দেখা মনে হতে থাকলো। কিন্তু এখন তাদের চিনতে পারা না-পারাটাকে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না। এই দুধেল বর্ণের জোসনা বিধৌত চরাচরে নীলান্ত নীলের রক্তের ঢেউয়ের ভেতরে এরকম কাউকে দেখলে কৌতূহল জাগতেই পারে বৈকি। খানিকটা গুরুত্বপূর্ণও মনে হতে পারে। কিন্তু তাদের গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো না। শুধু কৌতূহল থেকে গেল।
সেই কৌতূহলের জন্যই কি না, জানি না। আমি তাদের বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম। এমনকি আশিককে জিজ্ঞেসও করলাম না তুই এদের কিভাবে চিনিস? তাহলে হয়তো একটা ক্লু পাওয়া যেত। তাহলে হয়তো আমি মনে করতে পারতাম তাদের আমি চিনি কি না। আমি এসবের কিছুই করলাম না।
আমি দেখলাম ডানহাতে ছড়িটি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা মানুষটা, আশিক যাকে সাবেক কর্নেল হিসেবে ইঙ্গিত করেছিল, সে খুবই অস্থিরভাবে বাতাসে ছড়িটি ঘোরাতে লাগলো। আমি তার এই কান্ড দেখবার পাশাপাশি রোদ-চশমা পরা লোকটার দিকে চোখ রাখলাম, আশিক যাকে সাবেক মেজর জেনারেল হিসেবে ইঙ্গিত করেছিল। তার সূক্ষ্ম গোফের নিচে পাতলা ঠোঁট দুটোর মাঝে জিহ্বার অগ্রভাগ দেখা গেল। সাবেক কর্নেল সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বার অগ্রভাগের দিকে তাকিয়ে তাঁর ছড়ি ঘোরানোর গতি একটু কমিয়ে দিলো। তা অবশ্য খুবই অল্প সময়ের জন্য। সাবেক মেজর জেনারেল এবার তার জিহ্বার অগ্রভাগ আরেকটু বের করল। সাবেক কর্নেল সে-দৃশ্য দেখে পাগলের মতো ছড়ি ঘোরানো শুরু করল। বাতাসের গায়ে সে ছড়ি সপাং সপাং শব্দ করে আঘাত করতে থাকলো।
আমরা লক্ষ করলাম ঢেউগুলো আর আগের মতো প্রবল বেগে আসছে না। একটু স্থিরভাব চলে এসেছে এই নীলান্ত নীল রক্তের সাগরে। আমরা আরও লক্ষ করলাম একটা বিশাল অসমাপ্ত ঢেউ-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন একজন সাবেক কর্নেল এবং একজন সাবেক মেজর জেনারেল।
সাবেক কর্নেল বাতাসে আরও জোরে ছড়ি দিয়ে আঘাত করতে শুরু করল। তার ছড়ি ঘোরানোর বেগ ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো। এদিকে সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বা আগের চেয়ে বৃহৎ হয়ে মুখ গহ্বর থেকে বাহিরে বের হয়ে আসতে থাকলো। একটু আগের হাসি হাসি মুখকে এখন খানিকটা কিম্ভুৎ লাগতে শুরু করেছে। সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বার সঞ্চালন আরও বেড়ে গেলো। সে-দিকে একবার তাকিয়ে সাবেক কর্নেল হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল যেন। বাতাসে তার ছড়ি ঘোরানোর বেগ আরও বেড়ে গেলো। সাবেক মেজর জেনারেল হঠাৎ জিহ্বা সঞ্চালন বন্ধ করে একটা বিকট অট্টহাসি দিলো। সাবেক কর্নেল সে-দিকে লক্ষই করল না। কিংবা লক্ষ করবার সুযোগই পেলো না। সাবেক মেজর জেনারেল এবার তার জিহ্বা ধীরস্থিরভাবে বের করতে লাগলো। বের হতে হতে সে-জিহ্বা এমন আতিকায় রূপ নিলো যে, এই চরাচরের ওপরে থাকা দুধেল বর্ণের সমস্ত জোসনা অন্ধকারে গ্রাস হয়ে গেলো। গ্রাস করা সে-জোসনার অন্ধকারে তার আতিকায় জিহ্বার ওপরে দেখা গেলো একটা পতাকা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। সাবেক মেজর কী যেন বললো ফিসফিস করে। তখনই সে-পতাকা আস্তে আস্তে নড়ে উঠল। তার নড়াচড়া ক্রমাগত বাড়তে থাকলো। বাড়তে বাড়তে একসময় পতপত করে উড়তে থাকলো।
আমরা লক্ষ করলাম তার জিহ্বার ওপরে উড়তে থাকা সে-পতাকা। চাঁদ আছে সে-পতাকায়। তারা আছে অনেকগুলো সে-পতাকায়। আমরা জোসনা পছন্দ করলেও এই চাঁদ-তারা পছন্দ করি না। আমরা পছন্দ করি সবুজের সমারোহের ভেতরে ভোরের উদীয়মান ও উদীত সূর্য। আমরা হতাশ হয়ে যখন মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি তখন দেখা গেলো তার জিহ্বার ওপরে উড়ন্ত পতাকার নিচে কতিপয় জানোয়ারের মুখ। তারা কথা বলছে। তারা কথা বলছে উর্দুতে।
সে-দিকে সাবেক কর্নেল তাকালো। তাকিয়ে স্থির হলো একটু। তখন আমাদের ভেতরেও যেন অলৌকিক কোনো ক্ষমতা বিরাজ করছিলো। আমরা সাবেক কর্নেল-এর চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। এবং এত দূর থেকে, জিহ্বার অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া চাঁদের আলোর ভেতর থেকে, কিম্ভুত হয়ে যাওয়া সাবেক মেজর জেনারেলের চেহারা ভেদ করে, সাবেক কর্নেলের ছড়ি ঘোরানোর চঞ্চলতা ভেদ করে তার চোখের ভেতরে আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হযে গেলো। আমরা জানতাম এত দূরে থেকে কোনোভাবেই এত সূক্ষ্মভাবে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা কিভাবে যেন এই ক্ষমতা অর্জন করে ফেললাম। তাতে আমরা আরেক দফা বিস্মিত হলাম কি? বোধ হয় না। কারণ আমাদের চারপাশে এখন এতই বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যে আমরা ক্রমাগত বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি। বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতাও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আমরা একটা জিনিস করতে পারছি, সেটাই যেন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে আমাদের কাছে। কিন্তু বাস্তবে এটা সম্ভব কি-না, বাস্তবে এটা যুক্তিগ্রাহ্য কিনা, এটা বিশ্বাস্য কি না সেগুলো খতিয়ে দেখছি না। সামনে কী ঘটছে সেটাই আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। এবং আমি সে দৃশ্য দর্শনের ক্ষমতা পেয়েছি এটাই যেন আমাদের পরম প্রাপ্তি হিসেবে হাজির হচ্ছে। ফলে কী দেখছি সেটাই এখন আমাদের কাছে মহৎ, কিভাবে দেখছি সেটা গৌণ।
আমরা দেখলাম, সাবেক কর্নেলের চোখের ভেতরে অনেক আনন্দ। কারণ সাবেক কর্নেলের চোখের ভেতরে দেখা যাচ্ছে লাল সবুজের পতাকা। দেখা যাচ্ছে সে পতাকাকে আরও সমুন্নত রাখার দৃপ্ত প্রত্যয়। দেখা যাচ্ছে সাবেক মেজর জেনারেলের জন্য তার গর্বিত উদ্ধত বুক। দেখা যাচ্ছে তার প্রবল উৎসাহ। দেখা যাচ্ছে তার চোখে অনেক আনন্দ। দেখা যাচ্ছে তার চোখে অনেক স্বপ্ন। দেখা যাচ্ছে তার চোখে অনেক প্রাপ্তির উত্তাপ। কারণ সাবেক কর্ণেল দেখছিল, জিহ্বার ওপরে যারা কথা বলছে তারা সব গাইছে, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
আমরা একবার সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বার ওপরে ঘটে যাওয়া কান্ড দেখি আরেকবার সাবেক কর্নেলের চোখের ভেতরে প্রতিফলিত দৃশ্যটি দেখি। যখন আমরা দেখি দৃশ্য এক কিন্তু প্রতিবিম্বিত চিত্র আরেক তখন আমাদের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। আমরা জানি পৃথিবীর হাজারো দীর্ঘশ্বাসের মতো এ দীর্ঘশ্বাসটিও হারিয়ে যাবে। এর কোনো পরিসংখ্যানগত মূল্য থাকবে না।
সাবেক কর্নেল এবার বাতাসে ছড়ি ঘোরানো বন্ধ করল। সে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই কয়েকটা জোরে আঘাত করল। ছলাৎ করে শব্দ হলো যেন। যেন ঝনাৎ করে শব্দ হলো। যেন হিশহিশ শব্দ হলো। যেন হাজারো পাহাড় ভেঙে পড়ার মতো শব্দ হলো। রক্তগুলো লাফিয়ে উঠল। বেড়ে গেলো ঢেউয়ের আনাগোনা। সাবেক কর্নেল আরো জোরে জোরে বাড়ি দিতে লাগলো রক্তের উপরে। তাতে বিবিধ রকমের শব্দের উৎপত্তি হতে থাকলো। রক্তের প্রবাহ বেড়ে গেলো দ্বিগুন। বাড়তে থাকলো ঢেউয়ের উচ্চতা। বাড়তে থাকলো রক্তোচ্ছাসের স্ফীতি। সাবেক কর্নেল আরো জোরে জোরে বাড়ি দিতে লাগলো। রক্ত তখন আরো তেজি হয়ে উঠল। তেজি হয়ে উঠলো শব্দে। তেজি হয়ে উঠল প্রবাহে। তেজি হয়ে উঠল ঢেউয়ে। তেজি হয়ে উঠল রক্তোচ্ছাসের প্রবাহে।
রক্তগুলো যেন উন্মাদ হতে থাকলো। রক্তগুলো যেন মেঘ হয়ে উড়তে চায়। রক্তগুলো যেন পাহাড় হয়ে উঠতে চায়। রক্তগুলো যেন রাক্ষস হয়ে উঠতে চায়। রক্তগুলো যেন রক্তাক্ত খেলায় মেতে উঠতে চায়। একসময় রক্তগুলো সাবেক মেজর জেনারেলের জিহ্বাকে ছুঁয়ে ফেলল। জিহ্বায় ছোঁয়ামাত্র সেখান থেকে বের হয়ে এলো শত শত মানুষ। তাঁদের কণ্ঠে একটাই কথা, জয় বাংলা।
আমরা লক্ষ করলাম এই মানুষগুলো সাবেক মেজর জেনারেলের পায়ের নিচে জড়ো হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার জিহ্বা আরো লকলকিয়ে উঠছে। দেখা যাচ্ছে তার জিহ্বার উপরের মানুষগলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে সাবেক মেজর জেনারেল এই মানুষগুলোকে খেয়ে ফেলল। দেখা যাচ্ছে সাবেক কর্নেলের চোখ এই দৃশ্য ঠিক ঠিকই দেখতে পেল। সাবেক কর্নেল এই ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে গেলো।
সাবেক কর্নেলের চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। সাবেক কর্নেলের বিস্ময় খুউব দ্রুতই রাগে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। ফলে তার বিস্মিত চোখ সহসাই রাগান্বিত চোখে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। তার চোখে এখন রাগের রক্তাক্ত ঝিলিক। সাবেক কর্নেল তার ছড়িটি তুলে নিলো। এবং অদ্ভুৎ ক্ষীপ্রতায় সাবেক মেজর জেনারেলের দিকে তাক করল। সাবেক কর্নেল সাবেক মেজর জেনারেলের কপাল বরাবর ছড়িটি ধরে মুখমণ্ডল বরাবর একটা বৃত্তাকার পথে ঘোরাতে চাইলো। সাবেক মেজর জেনারেলের কোনো ভাবান্তরই লক্ষ করা গেলো না এই ঘটনায়। সাবেক মেজর জেনারেলকে খুব ধীরস্থির মনে হলো। তাকে খুব শান্ত মনে হলো। তাকে খুব প্রশান্ত মনে হলো। তাকে খুব সন্তুষ্ট মনে হলো। তাকে খুব চিত্ত প্রসন্ন মনে হলো। বোঝা গেল খুব ধীর মস্তিষ্কের তিনি। বোঝা গেল তিনি সহজে অবসন্ন হন না। বোঝা গেল তিনি সহজে বিচলিত হন না। বোঝা গেল তিনি সহজে বিস্মিত হন না। বোঝা গেল তিনি সহজে বিহ্বল বোধ করেন না।
সাবেক কর্নেল তার ছড়িটি সাবেক মেজর জেনারেলের মুখ মন্ডল বরাবার একবারও বৃত্তাকার পথে ঘোরাতে পারলেন না। তার আগেই ধীর মস্তিষ্কের সাবেক মেজর জেনারেলের লকলকে জিহ্বাটি আবার আতিকায় রূপ ধারণ করল। সাবেক কর্নেলকে এক চুমুক শরাবের মতো করে গিলে ফেলল।
আমরা এবার সাবেক মেজর জেনারেলের মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেখানে আমরা কোনো মানুষের মুখই খুঁজে পেলাম না। সেখানে আসলে কিসের মুখ তাও আমাদের অজানা। আমরা আবার আমাদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম।
আমি আশিককে বললাম, তুই না বলেছিলি এ লোকটা একজন সাবেক মেজর জেনারেল!
আশিক বলল, বলেছিলাম।
আমি বললাম, কিন্তু তাকে তো মানুষের মতোই মনে হচ্ছে না। তুই কি সত্যি কথা বলেছিলি?
আশিক বলল, তুই কী ভাবিস? তুই একাই সত্য কথা বলিস? আর কেউ বলে না? আর কেউ বলতে পারে না?
চলবে…