দেখা, প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞার কথা
দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, দেখতে পারার মতো যোগ্যতা খুব কম কিছুতেই রয়েছে। যে দেখতে পায় না, তারও সে যোগ্যতা থাকতে পারে। আবার যে দেখতে পায়, সে কানা হয়েও থাকতে পারে। কিন্তু কথা হলো কী দেখবে মানুষ? মানুষকে সবকিছু দেখতে হবে, না কি কিছু কিছু বিষয় দেখলেই তার চলবে, কী বলো তোমরা? তোমাদের অভিমত শুনি।
আজ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা পথের ধারে একটি চা দোকানে বসে আলাপ করছিলেন সাধু। এখান থেকে দূরে নদী দেখা যায়, যা পর্বতের শিখর বেয়ে নেমেছে সমতলে। একটা পাহাড়ি ছেলে কয়েকদিন স্কুলে গিয়েছিল, নামসই করার ক্ষমতা অর্জন করার পরই দোকানটিতে বসালো তার বাবা, সেও বেশ কিছুদিন আগের কথা। এখন তার বয়স তেরো বা চৌদ্দ। আজ সাধু এসেছেন বহুদিন পর চা খেতে, জনাদশেক লোক সঙ্গে। ছোট ছোট জিপগাড়ি ও মোটরসাইকেল মাঝে মাঝে ছুটে যাচ্ছে সামনে দিয়ে। সাধু যখন সবার অভিমত ব্যক্ত করতে বললেন, তখনই ছেলেটি বলে উঠলো, আমি কিছু বলব?
বলো বলো, কেন বলবে না?
আমিও কিন্তু একটি বিষয় দেখি। তা হলো, আপনি কখন আমার এখানে চা খেতে আসেন আর কখন আসেন না।
হেসে উঠলো সবাই। সাধু আগ্রহের সঙ্গে বললেন, বলো বলো, তুমি এর ভেতর কী দেখতে পেয়েছ? তোমার দেখাটি আমিও দেখতে চাই।
ছেলেটি চায়ের কেৎলিতে জল ঢেলে দিতে দিতে বললো, আমি আপনাকে খুব ভালোভাবে লক্ষ করি, আপনি কখন এখানে আসেন এবং কী কথা বলেন। সেসব কথা প্রায় একই, যা আমি বুঝতে পারি না। তবু আপনার কথায় মনে হয় আপনি এখানে যেসব কথা বলেন, তা যাদের কাছে বলেন, তারা খুব সহজে বুঝতে পারে। আমি প্রায় দূর থেকে ওই আশ্রমে আপনার কথা বলার মুহূর্তে দেখেছি, ওখানে আপনি অনেক কথা বলেন কিন্তু বাকিরা খুব কম বলে, কিন্তু এখানেই দেখি আপনার সঙ্গে অন্যরাও অনেক কথা বলে, যা সবসময় ঘটে না। আমার মনে হয়, আপনি এখানে আসেন ওদের কথা শুনতে, আর হয়তো ওরা আশ্রমের পরিবেশে কেবল আপনার কথাই শুনতে চায়, তাই আপনি ওদের সুযোগ করে দেন, স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে ওদের নিজেদের কথাই বলতে।
সবাই তার কথা শুনে আশ্চর্য হলো। সাধু নিজেও তার কথায় তাকে অত্যন্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান বললেন।
তুমি যে কথাটি বললে, সেটি তোমার দেখা, যা হয়তো আমি দেখিনি কিংবা ভাবিনি। তোমার দেখা এখন আমার ভাবনাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে, কারণ তুমি একটা সত্যকে দেখেছ, যে সত্য আমার ভেতর লুকিয়ে ছিল কিন্তু আমি তা দেখতে পাইনি। কী চমৎকার ছিল তোমার বিশ্লেষণ! মনেই হলো না তুমি মাত্র কিছুদিন স্কুলে পড়েছ, মনে হলো তোমার উপলব্ধি অনেকদূর পর্যন্ত দেখার সক্ষমতা দিয়েছে তোমায়।
জ্বি, আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে আপনি কম করে হলেও আমার দোকানে এসেছেন একশতবার। প্রতিবারই আমি আপনাদের কথোপকথন থেকে যা শিক্ষালাভ করেছি, তাতে আমার এই কথাটি মনে হলো। আমি যদিও আপনাদের কথা বুঝি না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কিন্তু আপনাদের কথার ভেতর একটা আনন্দ আছে, মনে হয় আপনারা একসূত্রে গেঁথে দেওয়া একটি ফুলের মালা।
কী সুন্দর করে কথা বলছে ছেলেটি! একজন বলে উঠলো। আমরা কী কথা বলব? ওর কথাই শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের। সে বলছে যে, সে আমাদের কথা বুঝতে পারে না প্রায় কিন্তু যেসব কথা বলছে তা শুনে মনে হচ্ছে সে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তুমি দীর্ঘজীবী হও আর বড় মানুষ হয়ে ওঠো বাবা।
সাধু চুপ করে রইলেন। এতক্ষণ কথা শুনছিলেন সবার। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলছে। এই ছেলেটি ওদের কথা বলার একটা ভালো সূত্র ধরিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন, তোমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার কথা শুনতে চাও কিন্তু বলো কম। আমি নিজেও কথা কম বলতে পছন্দ করি, কিন্তু কিছু কথা থাকে যা বলতে হয়, হয়তো খুব বেশিদিন তা বলতে পারব না, হয়তো একসময় কথা বলার ইচ্ছাও রইবে না। তোমরাও হয়তো আমার সঙ্গ উপভোগ করতে পারবে না সে কারণে।
মানুষ যখন নিজের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে দেয় তখন সে চুপ হয়ে যায়। যখন মনে হয় তার কাছে কথাও একটি বিড়ম্বনা, একটি দূরত্ব, সত্তার সঙ্গে মূলসত্তার। আমরা এই যে এত কথা বলি, সে কিসের জন্য? নিরন্তর বোঝাপড়ার জন্য, কিন্তু যখন কেউ আর বুঝতে চাইবে না, হাঁপিয়ে উঠবে, দৃশ্যমান জগতের উপলব্ধি হতে চৈতন্যালোকে প্রবেশ ঘটবে, তখন সে কিন্তু ধীরে ধীরে লীন হয়ে যাবে, একটা শিশির যেমন ঝরে পড়ে বিরাট পুকুরে, একটা মোম যখন গলে যায় আলোর স্পর্শে।
সাধু উঠে দাঁড়ালেন। ছেলেটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালেন আশ্রমের পথে। সবাই এখন চুপ করে আছে। একসময় তিনি থামলেন, পেছনে ফিরে বললেন, আজ যেসব কথা এই ছেলেটি বললো, তা সে বলেছে স্বজ্ঞা হতে। আর আমরা প্রজ্ঞাবান হতে চাই। অথচ প্রজ্ঞা একটি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও আমিত্বপূর্ণ আরোপিত জ্ঞান। প্রজ্ঞাবান মাত্রই পরমজ্ঞানের ধারক নয়, যদি সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার স্বজ্ঞাময় অস্তিত্ব হতে। মানুষ স্বজ্ঞা হতে আসে ফের স্বজ্ঞায়ই ফিরে যায়, তাই স্বজ্ঞা হলো প্রথমত অন্তঃস্বভাব, এই অন্তঃস্বভাবকে মনের স্বেচ্ছাচার দ্বারা আমরা যখন হারিয়ে ফেলি তখন যতই প্রজ্ঞাবান হই না কেন অবশেষে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই অস্তিত্ব হতে; আর যদি কেউ ধীরে ধীরে সেই স্বজ্ঞার অকৃত্রিম বোধকে জ্ঞানমর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, তবেই সে প্রকৃত জ্ঞানী।
এই ছেলেটির ভেতর সেই অকৃত্রিম জ্ঞানের আলো রয়েছে, যাকে মহাসাধকরা অত্যন্ত যত্নের সাথে রক্ষা করে চলেন।
নেপালি বালক ও তার কিশোরী মায়ের গল্প
আজ সকালে যখন নেপালি বালকটি তার মায়ের হাত ধরে হাঁটছিল, সে কী করে জানবে তার বাবার পরিচয়? তাকে বলা হয়েছে সে ঈশ্বরের উপহার! যদি সে জানতো যে, তার জন্মদানে কিশোরী মা কতখানি প্রত্যাখ্যান ও বিপন্নতার শিকার হয়েছিল, তবে সে হয়তো একটা বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে বড় হবে। আমাদের সময় এখন অত্যন্ত সংকটপূর্ণ, আমরা যে সুদিনের কথা বলি, তাতো রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা বাস্তবতা, কিন্তু সুদিন এসেও ফের চলে যায়। আমরা ধরে রাখতে পারি না। কারণ কী?
সাধু আজকের সভায় কিছু সমাজকর্মী ও রাজনীতিঘনিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। সভাটি বসেছে সেই বাদামগাছটির নিচে, যেখানে দিনের বেলা তিনি কথা বলেন অভ্যাগতদের সঙ্গে। তিনি বললেন, আমি আপনাদের কী বলব? আমার সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে চিন্তা ও জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে।
না-না, আপনি বলুন, আমরা শুনেছি আপনার কথা। এই পাহাড়ি জনপদের সামান্য ছুতারও আপনার কথা জানে। ওদের ওপর আপনার একটা প্রভাব রয়েছে, ওরা আপনাকে সম্মান করে এবং আপনার আশ্রমকে পবিত্র জ্ঞান করে। আপনি অত্যন্ত দার্শনিকভাবে সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন, এটা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, একদিন আপনার সঙ্গে কথা বলব, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে।
সাধু স্মিত হেসে বললেন, আপনারা আমার সম্পর্কে যা জানেন, তা মানুষের কাছ থেকে শুনেছেন। আমি প্রথমত মানুষের সঙ্গে ভাব-বিনিময়ের চেষ্টা করি, কিন্তু তাদের প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে বিষয়টি এমন নয়। আমি ওদের প্রশ্নকে ওদের ভেতর দিয়েই পুনঃপ্রবাহিত ও পরিবর্ধিত করার চেষ্টা করি। ওরা হয়তো শুধু একটি প্রশ্নেই আটকে থাকে, আমি তা ওদের আত্মজিজ্ঞাসায় পরিণত করতে সাহায্য করি। ওরা যখন আমার সঙ্গে কথা বলে, আমি একটুও উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি না ততক্ষণ, যতক্ষণ না তারা নিজেরাই উত্তরের নিকটবর্তী হয়। এটা আসলে একটা পরম্পরা, ভাবনা ও সম্ভাবনার। এই পরম্পরাটি গড়ে ওঠে দ্বিপাক্ষিকভাবে এবং অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। আমি হয়তো কিছুই বলি না, কেবল সংযোগ স্থাপন করে দেই একটি সূত্র থেকে আরেকটির।
যে আশ্রমের কথা বললেন, এ আসলে আমার নয়। আমার আসলে কিছুই নেই সে অর্থে। আশ্রমটি সাধু-ফকিরদের জন্য আমারই এক বন্ধু দান করেছিলেন, যেন তাঁরা মাঝে মাঝে এখানে আসতে পারেন ও সেবা নিতে পারেন। আজ আমি আছি, কাল হয়তো থাকব না, পরশু এখানে আরেকজন আসবেন, তিনিও হয়তো থাকবেন না, আমার মতো প্রস্থান করবেন, ফের আরেকজন আসবেন। এটাই আসলে আশ্রমের প্রকৃত ধারা। এ জগৎ সংসারইতো বড় একটি আশ্রম, তার চাইতে বড় আশ্রম হলো আমাদের অন্তর। আমাদের অন্তরের আশ্রমটিকে আমরা রক্ষা করতে পারি না বলেই এই ধরনের প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের সৃষ্টি। মন্দির-মসজিদ-চার্চের সৃষ্টি। আমাদের অন্তরের প্রার্থনাগৃহ বা সাধনপীঠকে আমরা যদি প্রতিষ্ঠা না করতে পারি তবে এসব আশ্রম ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বৃথাই।
আপনাদের আমি কী বলব আমার কথা? আমাকে আপনারা সম্মানিত করছেন, হয়তো আমি আপনাদের সেই সম্মানটুকু রাখতেও পারব না।
কিন্তু, আপনি তো ইতোপূর্বে মানুষের জীবনধারায় যে পরিবর্তন সাধনের চেষ্টা করেছেন, তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেছে। আমরা দেখেছি এমন কিছু মানুষ যারা আপনার সঙ্গে কথা বলেছে, ইতোপূর্বে সে এমন করে ভাবেনি। অনেক সাধারণ মানের মানুষকে আপনার সংস্পর্শে আলোকিত হতে দেখেছি আমরা। তাই আমাদের মনেও এই ভাবনা এলো যে, আমরা যারা সমাজ নিয়ে কাজ করি, যারা পরিবর্তনের চিন্তা করি, পরিবর্তনের একটি বড় মাধ্যম হলো রাজনীতি, আপনার সঙ্গে আলাপে আমাদের এ ব্যাপারে উপকারই হতে পারে।
অনেকক্ষণ কথোপকথনের পর সাধু বললেন, সেই নেপালি বালকটির কথা দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম আলোচনা। আপনারা দেখেছেন, তাকে ও তার মাকে। ওরা এখানে এসেছে তিন বছর হবে। ছেলেটির মা বয়সে বড়জোর পনেরো। এই বয়সে একটি সন্তানের মা হওয়া, তাও আবার পিতৃপরিচয়হীন, সাংঘাতিক সমস্য। ওদের এখানে নিয়ে এসেছিল আমার এক বন্ধু। ওদের তখন দুরবস্থা। তবে মেয়েটির চোখে বেঁচে থাকার প্রত্যয় ও সন্তানকে বাঁচানোর সদিচ্ছা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। সে বলেছে যে, তার পরিবার তাকে সন্তান নষ্ট করতে প্ররোচিত করেছে, নইলে তাকে ওরা প্রত্যাখ্যান করবে। তাই হলো শেষে, মেয়েটি জন্ম দিল একটি শিশুর, তার পরিবার তাকে রেখেছিল গোয়ালঘরে। একটুও সেবা পায়নি সে, কেবল অপমান ও তীব্র উপেক্ষা ছাড়া।
আমার বন্ধু সুখবিন্দর, তার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। নিষ্ঠাবান শিখ। আমার গুরুভাইও বটে। আমার আশ্রমে নিয়ে আসে একদিন। বলে তুমি দেখো তাকে, যদি থাকতে চায়, ওরা স্বস্তি পাবে। সুখবিন্দর এরপর চলে গেলো টোকিওতে। সেখান থেকে ওর জন্য মাসোহারা পাঠায়। মেয়েটির সাথে তার কী পরিচয়, তা জেনেছি আরও পরে। কিন্তু আমি মেয়েটির জীবন নিয়েই আগে আপনাদের বলি।
যেদিন প্রথম এসেছিল, সেদিন তার ভেতর সন্দেহ ও অবিশ্বাসের ভারী পাথরচাপা দেখতে পেয়েছিলাম। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে বেশ কিছুদিন লাগলো। অনেকদিন পর, সেটা ছিল দোলপূর্ণিমা রাত। সবাই তখন ব্যস্ত অনুষ্ঠান নিয়ে। সেদিন আশ্রমে এসেছিলেন আমার পরমমিত্র ও গুরুস্থানীয় তবারক ফকির। বাংলার লালনশাহী ঘরানার সাধু তিনি। বহুবছর আসাম প্রদেশে থাকার পর দেশে ফেরার পথে সেদিন এসে উপস্থিত হলেন আশ্রমে। তাঁকে পেয়ে আমি অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলাম। এতটাই যে সেদিন মেয়েটির কথা ভুলেই গেছিলাম। আমার ভাবনা ছিল যে, দোলপূর্ণিমার চমৎকার দিনে তার সঙ্গে কথা বলব। চারিদিকে আলোকসজ্জায় ও ফুলের সমারোহে মেয়েটির মন ভালো হবে। কিন্তু আমরা কথা বলতে বলতে রাত যখন প্রায় তিনটা, যখন প্রায় সবাই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ মনে হলো তার কথা। মনে হতেই ইতস্তত করতে লাগলাম। এতরাতে মেয়েটি জেগে আছে না ঘুমিয়ে পড়েছে, জানি না। একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম।
তবারক ফকির অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমাকে বললো, কী হলো থেমে পড়লে যে? আমি তাকে বিস্তারিত বললাম সে কথা। শুনে তিনি বললেন, আচ্ছা, ওই যে একটি ৩ বছরের ছেলের মা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোথায় দেখলেন?
তুমি যখন ব্যস্ত ছিলে সন্ধ্যায় অন্যদের সঙ্গে, আমি তখন একটিবার পুরো আশ্রমটি ঘুরে দেখার চেষ্টা করছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে আশ্রমের যে পাশ দিয়ে ওই ভৈরবমণি পাহাড় উঠে গেছে, সেখানে দেখি কিছু দোকান বসেছে নানান পসরা নিয়ে। লোকজন ভিড় করেছে সেখানে। দেখলাম সে মেয়েটি সঙ্গে তার ছেলেকেও। ও হয়তো ছেলেটির জন্য কিছু কিনতে চাইছে। আমি দূর থেকে দেখতে চেষ্টা করলাম; দেখলাম, সে দাঁড়িয়ে আছে একটুও নড়ছে না, ছেলেটি তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, তবু সে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গেলাম, বললাম, কী হয়েছে মা? কিছু কিনতে চাইছো? মুখটি লজ্জায় যেন লাল হয়ে গেল। এই কিশোরী মেয়েটি গা থেকে কৈশোরের গন্ধ যায়নি এখনো, আবার তার সঙ্গে শৈশবকাল কাটাচ্ছে তারই সন্তান। আমি ছেলেটির জন্য একটি খেলনা কিনে মেয়েটির জন্য কী কিনব, তা বুঝে উঠতে পারলাম না। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে সে কী চায়? সে কেবল না না করলো।
একটি কিশোরী মেয়ের জন্য দেওয়ার মতো এই পসরা দোকানগুলোতে কতকিছু আছে কিন্তু একটি কিশোরী মা-কে দেওয়ার জন্য কিছু পেলাম না। তাকে কী দেব? যা দেওয়ার তা দিয়ে সে কী করবে? তার উপযুক্ত যা কিছু রয়েছে এর প্রত্যেকটির সঙ্গে সে সম্পর্ক ছিন্ন করে এসেছে তোমার এখানে। সে তার জীবনকেই ত্যাগ করেছে শিশুটির জন্য। আমি কিছু খুঁজে পেলাম না।
তবারক ফকিরের কথায় আমি কেমন যেন বিপর্যস্ত বোধ করলাম। ঘটনাটি খুব সামান্যই দেখতে, কিন্তু এর ভেতরের মর্ম যদি একবার আমরা বুঝতে পারি তবে এর ভেতরের সাংঘাতিক পীড়নটিকে অনুভব করতে পারব। আমি আপনাদের এতক্ষণ এই গল্পটি কেন বললাম? আপনারা যারা সমাজ ও রাজনৈতিককর্মী, তবারক ফকিরের জায়গায় যদি আপনাদের কেউ হতেন, তবে নিশ্চিতরূপে আপনারা মেয়েটির জন্য উপহারস্বরূপ কিনে দিতেন সেইসব বস্তু, যা মেয়েটিকে ভেতরে ভেতরে আরও পীড়িত ও মর্মাহত করে তুলতো।
কিন্তু হে মহান সাধু? তবে কি মেয়েটির প্রাপ্য অধিকার হতে তাকে বঞ্চিত করা হলো না? এটা তো কোনো সমাধান নয় যে, তার কিশোরী সত্তার সকল চাহিদাকে মাতৃত্বের কাছে বিলীন করে দেওয়া।
সাধু হেসে বললেন, না তা নয়। আপনারা যা ভাবছেন, তা আংশিক সত্য। একটি জলপূর্ণ চৌবাচ্চা যদি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়, তখন বুঝতে হবে তার ভেতর জমেছে মলিনতা। এই মলিনতাকে কী করে দূর করবেন?
সাফ করে।
হুম ঠিকই বলেছেন, কিন্তু তার আগে চৌবাচ্চাটি খালি করতে হবে। মলিনতাকে মন হতে বের করতে হলে আগে প্রয়োজন মনটিকেই খালি করা। যদি তা না করে তার ভেতরে প্রবেশ করাতে থাকি আগে সব উপকরণ, তবে সে হবে একই গল্পের পুনর্লিখন। আপনারা সমাজচিন্তকগণ এই দিকগুলো কখনো ভাবার সুযোগ পান না, কারণ এভাবে ভাবায় অভ্যস্ত নন আপনারা। আমাদের সমাজকাঠামো ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় সকল সময়ে একটা উপরিতলের অধিকারবোধ ও লড়াই কাজ করে, কিন্তু একের পর এক অধিকার অর্জনের দারুণ সফলতার পরও দেখতে পাই একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। আপনাদের আজ শুধু এটুকুই বলার ছিল আমার।
নীরবতা, পাগলের ঘণ্টা ও জেন সাধু
এক জাপানি জেন সাধু একবার আশ্রম থেকে বেরিয়ে বাজারের পথে হাঁটতে লাগলেন। পথে পরিচিত কেউ বলে উঠলো, হে সাধু আপনি বাজারে কী করছেন?
নীরবতাকে খুঁজছি।
বলেই তিনি হাঁটা শুরু করলেন। অন্য একজন একই প্রশ্ন করার পর এবার উত্তরটি দিলেন পূর্বজন, ‘তিনি নীরবতাকে খুঁজছেন।’ এভাবে তাঁর পেছনে একটি লাইন ধরে বহু মানুষ চলতে লাগলো, নতুন কেউ এসে প্রশ্নটি করলেই পেছন থেকে পূর্বের কেউ উত্তরে বলছেন, ‘তিনি নীরবতাকে খুঁজতে বের হয়েছেন।’
এভাবে বাজারময় ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে থামলেন এক কামারখানায়, সেখানে হাপর তুলে বিকট শব্দে আগুন ও লোহার আঘাতে যখন অন্য কোন শব্দ প্রায় শোনাই যাচ্ছিল না তখন সাধু পেছনে ফিরে প্রথমে যে ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে তার কানে কানে কী যেন বললেন? সে বললো তার পেছনের জনকে, এভাবে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পেছনে যে রয়েছে তার কানে একই কথা ফিসফিস করে বলতে লাগলো। কামার তার হাপর বন্ধ করে জ্বলন্ত লোহাখণ্ড জলে ডুবিয়ে বাইরে এসে দেখার চেষ্টা করলো ঘটনাটি আসলে কী!
সে দেখলো যে, ওরা একে অন্যের কানে কানে কী যেন ফিসফিস করে বলছে আর সাধু সবার অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ করছেন! কামার তার ঘামজর্জর শরীর মুছতে মুছতে তাঁকে প্রশ্ন করলো, আপনি এই বাজারে এত লোক নিয়ে কী করছেন?
সাধু চুপ করে রইলেন, সমস্বরে সবাই বলে উঠলো, ‘তিনি নীরবতাকে খুঁজছেন।’ সকলের কণ্ঠে কথাটি এমনভাবে উচ্চারিত হলো যে আশেপাশে প্রায় সব দোকানেই কাজ বন্ধ হয়ে গেল, সবাই ছুটে আসলো কী হচ্ছে ব্যাপারটি বোঝার জন্য। বাজারের এই দিকটা কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে জেন সাধু ও তাঁর পেছনে যুক্ত হওয়া মানুষদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এক পাগল, তার পরনে তেমন কিছুই নেই, হঠাৎ এসে দাঁড়ালো, এবং তার হাতে ছিল একটি ঘণ্টা, যা সে অদ্ভুতভাবে বাজাতে লাগলো; সেই ঘণ্টার সুর সবাইকে এমনভাবে বিদ্ধ করলো যে সকলেই কতক্ষণ ধরে সেই শব্দ শুনতে লাগলো তা মনে রইলো না।
অনেকক্ষণ পর যখন বাজারের সমস্ত লোক এসে এখানে জড়ো হলো, তখন পাগলটি তার ঘণ্টা বাজানো বন্ধ করলো। এক অনুপম নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলো বাজারটি। শেষে লোকজন খুব অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠলো, হে মহান সাধু, আপনি কেন এসেছেন আর কেনইবা আপনার পেছনে এতলোক হাঁটছিল ও কি ফিসফিস করছিল এবং বলছিল যে আপনি নীরবতাকে খুঁজতে এসেছেন, আমাদের একটু বুঝিয়ে বলবেন?
আমি প্রকৃতই নীরবতাকে খুঁজতে এসেছিলাম। আমি এমন একটি স্থানে নীরবতাকে খুঁজতে এসেছি, যেখানে শব্দ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমি বুঝতে চেয়েছি যে, নীরবতাকে ধারণ করা কতটা কঠিন! তাই এই বাজারে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে আমাকে এই নাটকীয়তার জন্ম দিতে হলো। আমি জানি আপনারা আমার কথা শুনে হয়তো আমাকে পাগল নয় বেকুব বলে গাল দেবেন কিন্তু তাতে আমি একটুও দুঃখ পাব না, বরং আমাকে আপনাদের কর্মব্যস্ততার ভেতর ব্যাঘাত সৃষ্টি করার জন্য ক্ষমা করবেন। আমি নীরবতাকে লোকালয়ের বাইরে খুঁজতে গিয়ে দেখেছি একরকম, আর লোকালয়ের ভেতর বাজারে এসে পেয়েছি আরেক রকম।
জনৈক বাজারি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বললো, কী পেয়েছেন, ঘোড়ার ডিম!
সাধু হেসে বললেন, জ্বি আসলেই আমি একটি ঘোড়ার ডিম পেয়েছি কিন্তু তা অনেক দামি!
লোকজন আরও বিরক্ত হলো, এমনকি অনেকে তাঁকে উন্মাদ বলেও গালাগাল করতে লাগলো, ধীরে ধীরে আগের মতো কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠলো বাজারটি। একে একে লোকজন চলে যেতে শুরু করলো এবং যাওয়ার আগে ওরা বলে গেল, এরপর আপনি এমন কিছু আবার করলে বাজারে আপনার প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হব আমরা।
লোকজন চলে যাবার পর সাধুর পেছন পেছন যারা লাইন ধরে এসেছিল কেবল তারাই রইলো, এরা বিষয়টি ভালো করে বুঝতে চাইলো। সাধু ওদের নিয়ে বাজার পার হয়ে পৌঁছুলেন নদীর ধারে। সেখানে একটি বসবার মতো স্থান খুঁজে সবাইকে নিয়ে বিশ্রাম নিলেন। একজন প্রশ্ন করলেন, হে সাধু, আপনি আমাদের খুলে বলুন বিষয়টি। আপনি আমাদের কানে কানে যে কথা প্রবাহিত করলেন সেটি ছিল:
‘আমরা সকলেই যা জানি তা এক’।
যখন আমরা একসঙ্গে কামারের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম, তখন সমস্বরে যেভাবে বলে উঠেছি, তার ভেতর দিয়ে কথাটি আরও স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু আপনি আমাদের এর বিশেষ রহস্যটি খুলে বলুন। সাধু অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলতে লাগলেন, আমি নীরবতার ভেতর ছিলাম দীর্ঘকাল, নীরবতা আমার কাছে সরবতার নামান্তর ছিল। আশ্রমে আমার সঙ্গে দেখা হতো না মানুষের সহজেই। তোমরা যারা আমার পিছু নিয়েছিলে তার প্রত্যেকেই হয়তো আমার সম্পর্কে উৎসাহবোধের কারণেই তা করেছ। আমি আসলে অন্যভাবে নীরবতাকে টের পেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমাদের পিছু নেওয়াটা একটা নাটকীয়তার জন্ম দিল। অত্যন্ত সফলভাবে তা অনুষ্ঠিতও হলো। তার জন্য আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
কিন্তু তোমরা যখন আমার পিছু নিলে, আমি তোমাদের পিছু নেওয়াটিকে আমার নয় নীরবতার পিছু নেওয়াতেই পরিণত করতে চেয়েছি। আমি চুপ থেকে তোমাদের সুযোগ দিয়েছি যে, তোমরা একে একে অন্য অনেককে এই নাটকীয়তার সুতোয় বেঁধে ফেল। আমি জানতাম যে যার ভেতরে নাটকীয়তার প্রতি আগ্রহ কিংবা দেখার উৎসুক মন রয়েছে সে ঠিকই এই ফাঁদে পা দেবে, অনেকটা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো।
তোমরা বাজারময় ঘুরে ঘুরে মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে এবং কামারের দোকানে তোমাদের সমস্বরে একই কথার বিকট উচ্চারণ সেই আমন্ত্রণকে নিমন্ত্রণে পরিণত করেছে। প্রায় সবাই ছুটে এসেছে কী ঘটছে দেখার জন্য। কিন্তু অবশেষে কিছুক্ষণের জন্যও হয়তো নীরবতাটিকে আমি ধরতে পারতাম না যদি ওই পাগলটি না আসতো। এটা খুব কাকতালীয় যে সে পাগল এবং তার ঘণ্টা অনেকটা সময় বাজারটিকে নীরব করে রেখেছিল।
আমি জানি না সে পাগল কোথা থেকে এসেছে? কিন্তু আমি জীবনে যত বাজারে গেছি সবখানেই একটি পাগলকে দেখেছি। বাজারে সবকিছুই পাওয়া যায়, কিন্তু নীরবতাকে নয়। আজ নীরবতাকে আমি কিছুক্ষণের জন্য খুঁজে পেলাম কেবল ওই পাগলটির জন্য যা আমার নাটকীয়তা ও তোমাদের অংশগ্রহণে চমৎকারভাবে অনুষ্ঠিত হলো। আমি যেটা দেখতে চাইলাম, যা তোমরা দেখেছো তার মুল উপলক্ষটি হলো নীরবতাকে ধাওয়া করা এবং উপসংহারটি হলো পাগলামি। যখন তুমি নীরব হতে চাইবে তখন তোমাকে হয় লোকালয় থেকে বাইরে ছুটতে হবে নয়তো এই পাগলটির মতো তাকে ধারণ করতে হবে। নীরবতাকে ধারণ করা তাই অত্যন্ত কঠিন কাজ। সরবতা সবচাইতে সহজ কাজ।
তোমার সরবতা তোমাকে অনেককিছু দেবে কিন্তু নীরবতা ছিনিয়ে নেবে অনেক অনেক কিছু। বাজারে সবচাইতে নীরব ব্যক্তিটি কিন্তু পাগল আর লোকালয় হতে দূরে নীরব ব্যক্তিটি হলাম আমি, যাকে বাজারের লোকেরা উন্মাদ বলে গেলো। নীরবতাকে আমরা ভয় পাই তাই যখন নীরবতা দেখতে পাই তখন তাকে ভাঙতে চাই। আমি এই বাজারের সরবতাকে ভেঙে দেখতে চেয়েছিলাম, এই পাগলটিকে পেয়েছি এখন আমার ভেতরের নীরবতাকে ভেঙে দেখলাম, সেখানেও একই পাগল ঘণ্টা বাজাচ্ছে!
এই গল্পটি বলছিলেন সাধু, কিছু অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সাধকদের জন্য। যারা নীরবতা বিষয়ক নানান প্রশ্ন করছিল। সাধু বলছেন, নীরবতাকে তোমরা ধরবার চেষ্টা করো না, জেন সাধু ধরতে গিয়ে যা দেখতে পেলেন, তা তাঁর গল্পের শেষে বলেছেন। নীরবতাকে ধরতে যাওয়া হলো পাগলের ঘণ্টা বাজানোর মতো। পাগল সব সময়েই এটা বাজায় কিন্তু মানুষ বিশেষ শুনতে পায় না। কিন্তু বিশেষ নাটকীয় মুহূর্ত ছাড়া এটি কাউকে মুগ্ধ করে না।
নীরব হওয়া আর নীরবতাকে ধরতে চাওয়া তাই এক নয়। আমাদের নীরবতা আমাদের ভেতরেই রয়েছে, আমরা কেবল অনুষঙ্গ ধরবার চেষ্টা করতে পারি, জলের ধারা, হাওয়ার শব্দ, মেঘের গতি, নিঃশ্বাসের আওয়াজ, দেহের ভারবহতা, মাটির স্পর্শ, পঞ্চভূতের প্রকৃতি ও তারতম্য। নীরবতা হলো একটা সংযোগ, নীরবতায় তুমি যা ধরতে চাইবে, তাই পারবে কিন্তু নীরবতাকেই ধরে বসলে ঝুলতে থাকবে তুমি তোমার ভেতরেই দিনের পর দিন।
চলবে…