শূন্যতা মানুষকে গ্রাস করলে তাঁর আত্মকণ্ঠের প্রতিধ্বনি বুঝি এমনি দূরাহত কোকিলের কান্না পর্ব হয়ে ওঠে। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াটাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় পাঠক হৃদয়ে, যেখানে পাঠকও সাক্ষী হয়ে ওঠেন সেই আহত পাখির। এমনই এক বিষণ্ন বিউগলের সংগীত হয়ে ওঠে এমরান কবিরের গল্পগ্রন্থ ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’র গল্পকথন, যেখানে সুরের একাকিত্বে মিশে থাকে জীবন-মৃত্যুর আক্ষেপে ক্রোধ আর ঘৃণায় মানবিকতার বিশ্লেষণ। এমরান কবিরের গল্প পড়তে পড়তে মনে হতে পারে দালির ছবির কথা। নিদ্রাভঙ্গে জেগে ওঠা রঙতুলির অতৃপ্ত অবসাদকে যে ক্যানভাসে তুলে ধরতেন, তেমনি কোনো ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে এমরান তুলে আনেন গল্পের অলৌকিক জাহাজ। লেখকের যন্ত্রণা ঝরে পড়ে ব্যক্তিগত বসন্তের অবসান, সমাজ-রাষ্ট্র-খুন।
সমসাময়িক ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি চলে যান কল্পনার পেন্ডুলাম দুলিয়ে। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের আগেই এমরান কবিরের লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। তাঁর ‘চিতাবাঘিনী’, ‘রুলীতত্ত্ব’, ‘নৌকা’ ও ‘ধানের শীষের গল্প’ নামের তিনটি গল্প ছোটকাগজ শূন্যপুরানের তিনটি সংখ্যায় প্রকাশের মাধ্যমে। ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’ লেখক এমরান কবিরের প্রথম গল্পগ্রন্থ। ৯টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থটি। ‘টুকরো টুকরো মৃত্যু অথবা প্রত্নপুত্রের কান্না’ বইটির প্রথম গল্প, যেখানে কাব্যিক ঢঙে উঠে আসে প্রেক্ষাপট। ‘চাঁদের এই অপার্থিব আলোকে এখন মনে হচ্ছে মৃত্যুগন্ধময়। সব মৃত্যু এখন চিকচিক করছে পরিত্যক্ত খড়ে। ধান কাটা হয়ে গেছে। খড়-নাড়া ঈষৎ সিক্ত। কারণ হালকা কুয়াশা ঝরছে। হাঁটলে পা ভিজে যায় একটু একটু। শিশিরসিক্ত ঘাস চিকচিক করে। দূরে, সামান্য দূরের ঝোপঝাড়কে মনে হয় মৃত্যুপুরী’ (টুকরো টুকরো মৃত্যু অথবা প্রত্নপুত্রের কান্না)। আর এভাবেই কোপনো সুনির্দিষ্ট কাহিনী নয়, বিচ্ছিন্ন ভাবনার অবকাশে বেড়িয়ে আসে গল্পের চরিত্ররা।
হাবিব, আবিদ, আশিকের সঙ্গে যেন সঙ্গী হয়ে যান লেখক। তাদের দ্বিধাগ্রস্ত জীবন কান পেতে থাকে কোনো সুখবরের আশায়, চাকরির ইন্টারভিউ স্বপ্নে পেন্ডুলাম হয়ে দোলাতে থাকে গিরিবালা, রুলী, লাবণ্য কিংবা চৈতীর মুখ, যাদের ভাষা অনুবাদের সুদিন আসে না। অপেক্ষায় চলে বিপাশা বসু, মলি্লকা শেরাওয়াতের বাণিজ্যিক নারীর মুখ চেয়ে মিথস্ক্রিয়া। এমনই টুকরো টুকরো হতাশার বাস্তব ছিন্ন চিত্রের মধ্যে বর্ণিত হয় এক মনস্তাত্তি্বক আখ্যান। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শহিদুল জহিরের লেখায় জাদুবাস্তবতার ব্যবহার আমরা দেখেছি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের দ্বারা আবেষ্টিত ছিল। তেমনি এমরান কবিরের কিছু গল্পে জাদুময়তা রয়েছে যেমন, তেমনি কাব্যময়তার আচ্ছাদনে নির্মিত কিছু গল্পকে পুরোপুরি জাদুবাস্তব বলা ঠিক হবে না। গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্পটি ‘নিদ্রাগহন মহাশূন্যে’। চমৎকার এই গল্পটিতে উঠে আসে দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দিশেহারা মানুষের কথা। সংলাপে নিয়ে এসেছেন উত্তরবঙ্গের ভাষা। অবচেতনে পাঠকের মনে পড়বে ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর মঙ্গার কথা। কিন্তু এসব বিষয়কে খোলাসা করে বলেন না গল্পকার। তিনি আমাদের বলেন হীরক রাজার দেশের গল্প।
অন্যদিকে ‘রুলীতত্ত্ব’ ও ‘যে গুহায় ঢুকেছিল মুফতি হান্নান’ গল্প দুটিতে জাদুবাস্ততার ছোঁয়া অনেক বেশি। ‘যে গুহায় ঢুকেছিল মুফতি হান্নান’ গল্পটিতে আমাদের সাম্প্রদায়িকতার ভিন্নরূপ উঠে আসে, যেখানে নায়ক আসিফের কণ্ঠে ভর করে সচেতন কণ্ঠস্বর। গল্পের শেষে তাই আত্মচিৎকারে সে সত্যই বেরিয়ে আসে_”আসিফ বলে, ‘আমরা ধর্ষক নই, আমরা পুরুষ। আমরা ভালোবাসতে জানি।’ ‘কিন্তু আমরা ধর্ষিতা হতে চাই।’ ‘আমরা ভালোবাসতে জানি।’ ‘আমরা ধর্ষিতা হতে চাই।’ ‘আমরা ভালোবাসতে জানি।’ ‘আমরা ধর্ষিতা হতে চাই।’ ‘আমরা ভালোবাসতে জানি। ‘আমরা …’আমরা…” (যে গুহায় ঢুকেছিল মুফতি হান্নান)। এমরান কবির বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে গল্প নির্মাণ করেছেন, যেখানে বিমূর্ত অভিব্যক্তির ভঙ্গিতে আখ্যান নির্মিত হয়। কিন্তু নির্মাণশৈলীতে বাস্তব সমাজ-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত স্পষ্ট।
আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুবসমাজের হতাশাগ্রস্ততা অনেক বেশি প্রকাশ পায়। শেষ গল্পটি হচ্ছে ‘নৌকা ও ধানের শীষের গল্প’, যেখানে গল্পকার সুন্দরভাবে গল্পের পেছনের গল্প তুলে আনেন। একটা জনপদের গল্প হয়ে ওঠে একটা দেশের আখ্যান। এমরান কবিরের গল্পে উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে, তিনি জীবনঘনিষ্ঠ ঘটনাকে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়ায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। মনোজগতের ও কথকতার খণ্ড খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো গল্পের সন্ধান দেন না। কিন্তু তার মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় গল্পের শুরু ও শেষ। তাঁর একটি গল্পে আমরা পাই হাজারো গল্পের সন্ধান। চিন্তার নানা গলিপথ। সব মিলিয়ে এ সময়ের তরুণ গল্পকার হিসেবে তাঁর দৃপ্ত পদচারণের আভাস স্পষ্ট।
নিদ্রাগহন মহাশূন্যে
এমরান কবির
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১০০ টাকা।