॥ তিন॥
ভাদ্র মাস বলে কারখানাগুলো এখন গ্রীষ্মের সময় মেপে চলে। তাই কাজ ফুরোয় বেলা পাঁচটা নাগাদ। এখন বাজে চারটা।
বাস মনময়পুরে সর্বশেষ স্টেশনে থামল। একে একে সবাই নেমে পড়লে ধীরে-সুস্থে সিট ছাড়ল সলিল। অবশ পা জোড়ায় রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হতে দিতে পারল, পেছনে তাড়া দেওয়ার কেউ নেই। ব্যাগ মোটে একটাই এবং একটু ভারী হলেও তা পিঠে দিব্যি তুলে নেওয়ার মতো।
লাগেজ বাক্সে রাখতে দেয়নি। তাই আগে নেমে পড়া মানুষগুলো যখন টোকেন নাম্বারের সঙ্গে লাগেজে বাঁধা নাম্বার মেলাতে ব্যস্ত, সলিল তখন বেরিয়ে এদিক ওদিক করার ফুরসৎ পেল। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিছুটা সময় হাঁটতেই পায়ে ‘শোথ’ ফিরে আসতে লাগলো। বাংলার কোল এখানেও জংলা সৃষ্টিতে তৎপর।
সূর্য ডুবতে যদিও আরও ঘণ্টা দুয়েক বাকি আছে, শাল পিয়াল আর অজানা সব আকাশছোঁয়া গাছের সবুজ অন্ধকারে বিকালের আলো তবু অনেকটাই ঢাকা পড়ার জোগাড়। বাসস্টেশনে ভ্রাম্যমাণ পানসিগারেট বিক্রেতারা আছেন অনেক। কিন্তু জলখাবার মেলাতে পারে এমন দোকান আছে কেবল একটি। সেটি ছাড়া ছোট টঙ দোকান রয়েছে অনিয়মিত বিরতিতে। দেখা গেল ক্ষিদে মেটানোর রসদ বলতে আছে বাসি পাউরুটি, কেক আর কাঁচাতেই হলুদ কলা—লোকে যাকে বলে কার্বাইডের কাজ। আর আছে স্থানীয় তেলে ভাজা পিঠা, ধুলো ভরা বাতাসে খোলা পড়ে আছে। একদিকে পুরি ভাজার জোগাড়যন্ত্র চলছে মাত্র। বিশাল কড়াইয়ের নিচে জ্বলছে চুলার নীল আগুন। আর বেলনের নিচে গোল হচ্ছে আটার ছোট বল। অনেকগুলো শিখা জ্বলকের ওপর বৃত্তাকারে আগুনের মুকুটের মতো তৈরি করেছে।
জলখাবারের দোকান এড়িয়ে সামনের একটি টঙে দাঁড়াল সলিল।সেখানে পলিথিনের প্যাকেটে ঝুলিয়ে রাখা স্ফীত কেক, নকশি বনরুটি আর হলুদ-সাদা সিঙাড়া। সিঙাড়ার প্যাকেটে আছে বোঁটা ছাড়ানো সবুজ কাঁচামরিচ আর এক টুকরো পেঁয়াজ। ভেতর থেকে বিজবিজে রকম শব্দ আসছে শুনতে পেয়ে কাছে এগিয়ে যায় সে।
একটি মাছি মাথা কুটছে প্যাকেটের ভেতর। কোনো একফাঁক গলে ঢুকতে পেরেছিল বটে, এখন বেরোতে আর পারছে না। এদিকে চেষ্টারও কমতি নেই। মধ্যবয়সী দোকানি একসঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে লোকের সঙ্গে আড্ডা আর ঘন দুধের চায়ে রুপালি চামচের ঝড়। একটা মিষ্টি টুংটাং শব্দ থেকে থেকেই কথার স্বর ছাপিয়ে উঠছে।
সলিল খাবারগুলো দেখল। তবে খেলো না। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে রাস্তা পেরিয়ে পুব দিকে চলে যাওয়া উঁচু নিচু পথ ধরে এগোতে থাকল। এগোনোর পথটি একসময় পাকা ছিল মাটির আস্তরের নিচে প্রমাণ চাপা পড়ে আছে।
পথজুড়ে রয়েছে অগনিত ছোট বড় গর্ত, বিষম রকম সব ঢেউ।ঢেউয়ের নিচ থেকে হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার ভাঙা অবশেষ বের হয়ে আছে। পথের দুপাশে নিয়মিত বিরতিতে বিদ্যুতের থাম। আর থামের সঙ্গে লাগোয়া সড়কবাতি। দণ্ডের সঙ্গে কৌশলে আকাশমুখী করে রাখা সৌরপ্যানেল। বিকেল পেরোনো প্রহরে বনজ অন্ধকারে কোনো কোনো সড়কবাতি বিভ্রান্ত হয়ে আলো বিলাতে লেগে গেছে। দুই/একটির বাতি ঢেকে রাখার সাদা অর্ধগোলাকার কাচটি হ্যালোইন-কুমড়োর দাঁতকাঁটার মতো ভাঙা।
বিকট হর্ন বাজিয়ে পাশটি কেটে বেরিয়ে গেল বিরাটবপু ট্রাক। মালে বোঝাই। পথের দু’পাশে সারিবাঁধা মনোহরি দোকানে এটা ওটা কিনবে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছিল। ভাঙা রাস্তায় ট্রাকের দোল দেখে ভয়ে নাকাল। এদিক ওদিক সরে গেল কেউ। কেউ আবার লাফ দিয়ে পড়ল দোকানের ভেতর। এ ব্যাপারে দোকানিকেও বেশ উদার দেখা গেল। উপাচার সব দাড়িপাল্লায় চড়িয়েছে। একটিবার তাকাল শুধু।
দোকানঘরগুলোর পেছনে মানুষের হাতে লাগানো গাছের জ্যামিতিক সারি। আকাশমনি সব। শেষ লোকটি আকাশমনির কুযশ গাইছিল। সলিলের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, আর একটামাত্র মোড় ঘুরে ডানে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই পড়বে শক্তিমতি কারখানা। কারখানার ঠিক বিপরীতেই দেখবেন এক বিঘার মতো জমি পড়ে আছে। আগাছা টাগাছা উঠেছে চারপাশে তবে মাঝখানটা ফাঁকা। ছেলেপিলে ক্রিকেট টিকেট খেলে। দেখলেই চিনবেন।
নির্দিষ্ট সেই গলি ধরে মিনিট দশেক হাঁটার পর পথের পশ্চিমপাশে শুরু হলো সীমানা দেয়াল, এরপর নীল রঙের বিরাট এক ফটক। আর পুবপাশে পড়ল পতিত জমি। হাতঘড়িতে সময় গড়িয়ে বেজেছে পৌনে পাঁচটা। ফটক বা দেয়ালে কোনো নামফলক না থাকলেও ভেতর থেকে আসতে থাকা শব্দের বিচ্ছিন্ন স্রোত জানান দিচ্ছিল এটা কারখানা বটে। উঁচু সীমানা দেয়ালের ওপর কাঁটাতারের বেড়া। প্লাস্টারের ওপর দুই পরত সাদা রং পরানো হয়েছিল। তার ওপর বাংলার পথের ধুলো এসে জমেছে, কোনো পানরসিক চুন মুছেছে, ছোট কিশোর কিশোরী কেউ লাল কাদায় হাত ডুবিয়ে দেয়ালে স্বাক্ষর রেখেছে। এবং আরো অনেক মানুষ তাদের অক্ষরজ্ঞান প্রকাশ করার সুযোগ ছাড়েনি।
ফটক পেরিয়ে কিছুটা এগোলে পথের অন্য পাশে টিনের দেয়ালের ছোট দোকান। ছাদ বলতে বাঁশের বেড়ার ওপর দুই পরতের প্লাস্টিকের ছাউনি, তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া পুরনো এক টিন। কাঠের ফ্রেমের সঙ্গে সে টিন মোটা রূপার তার দিয়ে বাঁধা। দোকানের বাইরে ছোট পরিসরে কাঠের পুরনো বেঞ্চ পেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভেতরে তাকালে শুরুতেই যে আসবাব চোখে পড়ে, তা সবুজাভ কাচের ঘের দেওয়া এক কাঠের শোকেস। এর আধো আলো আধো আঁধারের অর্ধস্বচ্ছ পেটে সিগারেট থেকে শুরু করে বিস্কুট, চানাচুর, ডাবলি, হরেক রকমের আচার সাজিয়ে রাখা। শোকেসের পাশেই উচ্চাতয় প্রায় অর্ধেক এক কাঠের টেবিল ভিজে কালো হয়ে উঠেছে। তার ওপর এক চৌকো রূপালি ট্রের ওপর ভেজা লাল কাপড়ে ঢাকা পানপাতার স্তূপ। ট্রের প্রায় অর্ধেকটা দখল হয়ে গেছে এতে।বাকিটুকুতে উপুড় করে রাখা কাচেরকিছু হাতলছাড়া কাপ।
টেবিলের পেছনে কালো নাদুসনুদুস মধ্যবয়েসী এক লোক একটা লাল বালতিতে কাচের ওই কাপগুলো জলনাড়া করে ট্রের ওপর সাজিয়ে রাখছে। সলিল তার কাছে পৌঁছুনোর অবসরে কাপগুলো সব ট্রেতে ওঠানো হয়ে গেল।টেবিল থেকে হাতনাগাল কোণে হাঁটুসমান উঁচু কাঠের ঘের। তার ভেতর বড় বার্নারে পাশাপাশিচাপানো দুটি কেতলি। হাতলে কাপড় জড়ানো, অতি ব্যবহারে কালো হয়ে উঠেছে। দুটোই ধোঁয়া উদ্গারী। ভেতরে বুগবুগ করে ফুটছে জল। একটি কেতলি তুলে লোকটি কাত করে ঢালতে শুরু করলো কাচপাত্রের ওপর। কাচের কাপ আর রূপালি ট্রে’র শরীর থেকে সাদাটে ধোঁয়া বেরিয়ে নেচে নেচে হাওয়ার সিঁড়ি বাইছে। একবার সেদিকে তাকাল লোকটি,এরপর সলিলের ওপর। এই ক্রমটি মেনে স্থানবদল করছে তার হলুদ একজোড়া চোখ।
দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কালো প্যান্টের কোমরে গোঁজা সাদা শার্টের এক যুবক। ত্রিকোণ মুখ, নাকের নিচে গোঁফ, চোখে চশমা। কোমরে গোঁজা শার্টটির পেছনের অংশ অনেকটাই বেরিয়ে আছে। দেখেচোখের দৃষ্টির আগের তুলনায় খানিকটা কোমল হয়ে উঠলো লোকটির। কাচের কাপের ওপর গরম জল ঢালা শেষ হয়েছে। আগুনে ফিরে গেছে কেতলি। সলিলকাছে এগিয়ে এলেঅবসন্ন চোখে লোকটি তার মুখে দিকে তাকিয়ে রইল। অল্প ঝাঁকুনি খেতে খেতে টুংটাং শব্দে পেছনে একটা কালো বাইসাইকেল পেরিয়ে গেল তখন। চালক মাথায় লাল গামছা বাঁধা এক কিশোর।
রঙ চা বানান?
লোকটা ওপরনিচ মাথা দুলিয়ে স্থির হয়ে রইল।
এক কাপ, প্লিজ!
কাচের শোকেসের এক কোণে মেলামাইনের পুরনো ছোট একটি পাত্র ছিল। সলিলের কথা শুনে ওই পাত্রমুখী হলো তার চোখ, এরপর হাত। অবসন্ন চোখ জোড়ার চেয়েও হলুদ রঙের থিকথিকে এক বস্তু সেখানে থেঁৎলানো পড়ে আছে। সেখান থেকে এক চিমটি তুলে নিয়ে কাচের কাপের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হলো। এর ওপর পড়ল দুই চামচ লালরঙা চিনি। চামচ দিয়ে চেপে চেপে এই মিশ্রণটিকে ঘনিষ্ঠ করা হলো। মণ্ড তৈরির পর গরম জল ঢেলে অর্ধেকটা পূরণ হলো।দুটো কেতলির একটির ভেতর চা পাতার দশা বারো সতেরো। ওটা কাত করে বাকি অর্ধেকটা ভরা হলো লিকারে।
রগ ওঠা বাহু লোকটির। কনুই অব্দি গোটানো কাপড়ের আড়ালে থাকা বাহুতেও সবল পেশীর অস্তিত্ব। শক্ত হলদেটে আঙুলের ডগা। নখগুলো পরিষ্কার এবং ছোট, হলুদাভ। লিকার ঢালার সময় জলের ধারার দিকে গভীর দৃষ্টি দিতে গিয়ে শরীরটাও খানিকটা নুয়ে এলো। এরপর চামচে চা তুমুল নেড়ে শোকেসের এক কোণে বেঁধে রাখা লাল তোয়ালে দিয়ে কাচের তলটা মুছে শেষমেষ তুলে দেওয়া হলো আগন্তুকের হাতে।
ধীরেসুস্থে দুই চুমুক। মুখটি তুলে সলিল নিচের ঠোঁট ওপরের পাটির দাঁতে বাঁধল। পরমুহূর্তে বলল, আপনার চা-টা দারুণ। আপনার ওই আদা রাখার বাটিটা আছে না? ওটা দেখে প্রথমেই আমার কেমন যেন লেগেছিল।ওটা যে আদা আমি চিনতে পারিনি। কিন্তু বলতেই হচ্ছে শেষ এমন চা খেয়েছি ঢাকায়, বেলিরোডে, এখন উঠে গেছে সে দোকান। চায়ের আরও একবার চুমুক দিয়ে বলল, রঙ চা কিন্তু সবাই বানাতে পারে না। আপনার এখানে হয়ত নিয়মিতই আসা পড়বে।
লোকটি লাল তোয়ালেটিতে হাত মুছতে মুছতে সলিলের কথা শুনছিল। কথা শেষ হতেই তার ঠোঁট দুটোয় হাসি ফুটল, চোখের কোণে পড়ল ভাঁজ। আন্তরিক কণ্ঠে মনময়পুরি টানে বলল, ঢাকা থেকে আসছেন?
হ্যাঁ।আমার নাম সলিল—কাপটা ডান হাতের তিন আঙুলে ধরে বৃত্তাকারে নাড়ছিল সলিল। জলীয় বাষ্পের ফিনফিনে ধারা বেরিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। নিজ পরিচয় দেওয়ার পর কাপটা বাম হাতে নিয়ে লোকটির দিকে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, আপনাকে কী বলে ডাকব?
হাজি—মুখ নিচু করে নামটি বলে মিটিমিটি হাসতে থাকল লোকটি। হাসার সময় তার ফোলা কালো গালদুটোয় আলো প্রতিফলিত হলো। একটা কাপে একটু লিকার, একটু পানি আর খানিকটা চিনি মিশিয়ে নিজেও চুমুক দিতে শুরু করল।
তো বেশ, হাজি ভাই। আপনার নাম দেখছি দারুণ!
আমার নাম জামাল—লোকটিও চায়ের কাপ কব্জির মোচড়ে ঘোরাতে থাকে।ওই সবাই হাজি-হাজি বলে, তাই বললাম।
বলেন কী। কেন, সবাই হাজি বলে কেন?
খুব হজে যাওয়ার কথা বলি তো আমি, প্রায়ই বলি। প্রতিবছরই বলি। কিন্তু যেতে কি আর পারি?কিন্তু ওই যে বলি বারবার? ওটা ধরেই লোকজন একটু মজা করে। ওই মজায় মজায় নামটা বসে গেছে। এখন এ নামেই ডাকে সবাই।
কথাগুলো বলার সময় মুখে হাসি থাকলেও বলা শেষে হঠাৎ করে আবার গম্ভীর হয়ে পড়ল হাজি। ফুটন্ত জলের কেতলিটা তুলে কাপগুলোর ওপর আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঢালতে শুরু করল। দেখে সলিল হেসে বলল, বড় ভাই, কাপগুলো তো ফেটে যাবে!বুঝলাম আপনি রসিক মানুষ। মনে হচ্ছে আপনার বন্ধুরাও তাই।
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ঝুঁকে রূপালি ট্রের ওপর কাপটা নিজেই নামিয়ে রাখল সলিল। ব্যাগের সামনের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দুই আঙুলে একটা শলাকা তুলে আনলো। শোকেসের কাঠামোর সঙ্গে সুতো দিয়ে বেঁধে রাখা লাইটারটা নিয়ে সিগারেটে আগুন ধরালো। শার্টের বেরিয়ে ফুলে থাকা অংশটা তুলে হাত রাখল প্যান্টের পেছনে পকেটে। টাকা বের করে আনার ফাঁকে প্রশ্নটা করল—আচ্ছা,এটাই কি শক্তিমতি কারখানা?
হাজি ঘন ঘন দুই বার মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, এটাই।
কোথাও তো কোনো সাইনবোর্ড দেখছি না।তাই চিন্তা পড়ে গেলাম।
সাইনবোর্ড দেয় না—নিরুত্তাপ কণ্ঠ হাজির।
হাজির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে না-ধূসর না-রূপালি ফটকটার সামনে এসে দাঁড়াল সলিল। কারখানার পেছনে পড়ে আছে সূর্য। সামনের জায়গাটা তাই অস্পষ্ট হয়ে আছে। আশপাশের গাছগুলোতেও দিব্যি অনেক পাখির বাস। অবিরত কিচিরমিচির আর পাতায় পাতায় খসখস। পাখির খুনসুটিতে ঝরে পড়ছে একটি দুটি পাতা। ফটকের এক কোণে প্রায় মিশে আছে একটি পকেট গেট।তার এক মানুষ চোখসমান উচ্চতায় ছোট চারকোনা একটি পাত, ভেতরের দিকে ঝুলছে।ওপাশে যে আছে সেই কেবল সরাতে পারে তা।উঁচু চার দেয়ালের ওপারে থেকে আসছে অবিরত ঝালাইয়ের শব্দ, লোহা কাটার জান্তব ধ্বনি, ভারী ধাতব কিছুর ওপর ভারী কোনো ধাতু খণ্ড পড়ার ছন্দিত শব্দ। আরও শতেক ধাতব শব্দ অবিরত আসছে,যেসবের সম্মিলিত একটি রূপ শুধু বাইরে শোনা যায়। উৎসের অস্তিত্ব আড়ালেই থাকে।
ফটকে দুবার টোকা দিতেই ওপাশ থেকে আলগা পাতটা উঠে গিয়ে দেখা দেওয়া চশমা আঁটা একজোড়া বয়েসী চোখ। চোখের কোণে জলের ফোয়ারার মতো ভাঁজ।
একই প্রশ্ন করে সলিল—এটা কি শক্তিমতি কারখানা?
আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন?—প্রহরী আলমগীরের কণ্ঠে দায়িত্ব ঝরে পড়ে।
ঢাকা থেকে আসছি। সলিল সরকার। ইঞ্জিনিয়ার। হেড অফিস থেকে পাঠিয়েছে আমাকে। আসার কথা ছিল আজ।।
হ্যাঁ, একজন ইঞ্জিনিয়ারের আসার কথা ছিল—লোকটির কণ্ঠে ঈষৎ সন্দেহের বাঁকা সুর। বাক্যের শুরুতে কণ্ঠ স্পষ্ট থাকলেও শেষটায় অস্পষ্ট হয়ে এলো, এরপর আবার স্পষ্ট। আপনার কাছে কোনো কাগজ আছে স্যার? একটু কড়াকড়ি চলছে তো!
নিশ্চয়ই! কাগজ একটা আছে।—সলিল ব্যাগ থেকে একটা হলুদ রঙের কাগজ বের করলো। তাতে কালো কালিতে বাংলা অক্ষরে বর্তমান ব্যবস্থাপকের কিছু কথা লেখা, নিচে স্বাক্ষর। কাগজটা ছোট ফাঁকা দিয়ে চালান করে দেওয়া গেল। আলমগীর তা হাতে নিয়ে চোখ বোলাতে সবে শুরু করেছে, এমন সময় তাকে চমকে দিয়ে বেজে উঠল কারখানার দিন শেষের বাঁশি। পেছনে তাকাল আলমগীর। আর দরজার বাইরে সলিল দিল দুই কানে হাত।
বাপরে, এত তীব্র!
পরমুহূর্তে ঘটাং শব্দে খুলে গেল পকেট গেট। এবার নিরাপত্তারক্ষীর পোশাকে প্রৌঢ় তার পুরো অবয়ব নিয়ে আবির্ভূত হলেন—তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ুন! এখনই বন্যার মতো বেরোতে শুরু করবে।
সলিল এক পা তুলে চৌকাঠ ডিঙিয়ে পা রাখলো কারখানার ভেতর। প্রশংসায় ঝিলমিলে হয়ে উঠলো তার চোখ, মৃদু হাসিতে প্রসারিত হলো ঠোঁটের দুটি কোণ। ভেতরে আলোর অভাব পুষিয়ে দিচ্ছিল বৈদ্যুতিক বাতি। সমান্তরাল দুটো টানা ছাউনির নিচেবিকট যন্ত্রপাতি সারিতে সাজিয়ে রাখা।
শ্রমিকেরা ওসব যন্ত্রকে তখনো ঘিরে আছে। গর্বিত মুখে তখনো কাজ করে চলেছে কেউ কেউ। সবার পোশাক দীন, অপরিষ্কার। বয়েসীদের বাহুর আন্দোলনে কিছুটা জড়সড়ো ভাব। চোখের আলোও অনেকটাই নিভে এসেছে।আধো ঝুলে পড়া চোয়াল। কেউ কেউ হাতের কাজটি সেরে নিচ্ছে, কেউ গুছিয়ে এনেছে যন্ত্রপাতি। বাঁশির শব্দ কমবয়েসীদের হাতগুলোকে চঞ্চল করে তুলেছে।
গার্ডের বসার জন্য কাচের জানালাওয়ালা ছোট্ট একটি ঘর আছে ফটকের পাশেই। ঘরের ভেতর তখনো কোনো বাতি জ্বলেনি।বিকেল শেষের আলোয়সে ঘরটির থাই গ্লাসের জানালার কাচে নিজ মুখ দেখতে পেল সলিল। মলিন, এলোমেলো চুল। ঘেমে কিছুটা নেমে এসেছে চশমা।
বাঁশি থামেনি। শ্রমিকরা বিভিন্ন ঘর থেকে দ্রুত বেরোতে শুরু করেছে।সলিল কাঁধের ব্যাগটা গার্ডরুমের ভেতরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে বাইরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকল শ্রমিকদের গতিবিধি।কলকল করতে করতে টানা টিনের ছাউনিসহ বিভিন্ন খোলা, বন্ধ, আধবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ওরা। ফটকের সামনের প্রশস্ত আঙিনাটি দেখতে দেখতে ভরে উঠল।আলমগীরের কাছেপিঠে এসে একটা সারি তৈরি করতে চাইল ওরা। কিন্তু কার পেছনে কে দাঁড়াবে–এ নিয়ে বাঁধল ছোটখাটো গোল।অবশেষে একটি সারি তৈরি হলো বটে, তবে তা ভাঙাপ্রায়। আর কেমন অর্ধচক্রাকার।শেষমেষ কয়েক সারি বক্ররেখা প্রায় সমান্তরালে দাঁড়াল।পকেট গেটটি ততক্ষণে খোলা হয়ে গেছে। প্রত্যেক সারিই পেছন ভাগের শ্রমিকরা বিচ্ছিন্ন, অনেকটাই ছড়ানো-ছিটানো, নিজেদের ভেতর আলাপে তখনো ডুবে।
মানুষের ভিড়ের ভেতর নিয়মিত বিরতিতে দাঁড়িয়ে আছে যন্ত্রগুলো। ওসবের কিছু কিছু প্রায় টিনের চাল অব্দি উঁচু। কিছু বুকসমান। আর কিছু প্রায় কোমরের কাছাকাছি। একেবারে বাঁয়ের ছাউনের বাইরে সার বেঁধে একটু পর পর দাঁড়িয়ে আছে পানির কল, তার সামনেই নর্দমা, সোজা ভেতরের দিকে চলে গেছে। একেকটি কল একেক রঙের।টিনের দ্বিতীয় টানা ছাউনিযেখানে শেষ সেখানে ট্রান্সফর্মারের তেলের বেশ অনেকগুলো রূপালি পিপে সমান্তরাল কয়েকটি সারিতে রাখা।
ফটকের কাছে যেখানে সলিল দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে গজ বিশেক দূরে তার মুখোমুখি কারখানার কয়েককটি টানা ঘর। সর্বডানের ঘরটি কারখানার সীমানা দেয়ালছোঁয়া প্রায়।সেখানে মাটিতে শেকড় ছড়িয়েছে মাঝারি আকারের এক পাতাবাহার। হলুদে সবুজে গল্প বলছে, বাতাসে পাতা নেড়ে নিজেই সায় দিচ্ছে নিজের কথার। সর্ববামের বড় ঘরটির পাশেসরু একটি রান্নাঘর।
টানা ঘরগুলোর শেষভাগের পেছন থেকে একটা লাল মোটা তার ওপরে উঠে গেছে। ওটাকে অনুসরণ করলে চোখে পড়ে কারখানার দেয়ালের বাইরে দুটো বৈদ্যুতিক থামের মধ্যখানে ধাতব দণ্ডের ওপর একটি বড় ট্রান্সফর্মার রাখা।তারটি তাতে গিয়ে মিশেছে।
শ্রমিকরা একটা কিছু নিয়ে হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিল। দুই জন মারপিটে লেগে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাঁশি বাজিয়ে এগিয়ে এলো আলমগীর। পকেট দরজার কাছটা ফাঁকা হয়ে পড়তেই দুই/একজন বেরোনোর উদ্যোগ করল। সেদিকেও চোখ ছিল প্রহরীর।চিৎকার শুনে থেমে গেল ওরা। মারপিট থামলে ফের নিজ স্থানে ফিরে গেল আলমগীর, ভুরু দুটি বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। প্রথম লোকটি রক্ষীর সামনে চলে এলো। তার সারাশরীরে পোশাকের ওপর দিয়ে একবার হাত বোলানো হলো। এরপর শার্টের পকেট, প্যান্টের দুপাশের পকেট, পেছনের পকেট হাতিয়ে দেখা হলো। শেষ হলে মুক্তি মিলল প্রথমজনের। ইশারা পেয়ে মুখে একটা আমুদে ভাব নিয়ে পকেট গেটের বাইরে আড়াল হয়ে গেল মধ্যবয়সী শ্রমিক। বেরোনোর সময় মাথার বারান্দা-টুপিটা পকেট গেটের ওপরের ধারে লেগে খসে পড়ল। মাটি থেকে ওটা কুড়িয়ে নিয়ে একটিবার ঝেড়ে আড়ালে গেল সে।
এরপর একে একে আসতে থাকল বিভিন্ন বয়েসের ও পদবির শ্রমিক। কারো ওপর তল্লাশি চালানো হলো নিয়মরক্ষার খাতিরে সংক্ষেপে। কারো ওপর বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে। মানুষগুলোর বেশিরভাগের চোখমুখ কঠিন হয়ে থাকল সারাটা সময়। কেউ একজন কৌতুক করতে চেষ্টা করলো এ নিয়ে, কিন্তু নিজেই হাসল শুধু, কেউ এতে অংশ নিলো না। সলিলের কাছাকাছি চলে আসা এক তরুণ তার সমবয়েসী সঙ্গীকে বলল,দেখিস একদিন সত্যিই মাল সরাব। প্রতিদিন এই অপমান! সয় না। জবাবে তার সঙ্গী হেসে প্রত্যুত্তর দিলো। কোনো বাক্যব্যয় নয়। তবে সঙ্গীর হাসির ভাষায় বুঝি সদুত্তর পেল না তরুণ।
শ্রমিকদের মধ্যে কেউ সলিলকে লক্ষ করল, কেউ তাকালও না। একের পর এক শ্রমিকের বেরিয়ে যাওয়ার সনদ মেলাতে মেলাতে এক পর্যায়ে হাঁপিয়ে উঠল আলমগীর।অবসন্ন দেহটা সোজা করে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে শ্রমিকদের সারি তার সামনে এসে বেকার দাঁড়িয়ে। উসখুস করছে, পা বদল করছে ঘন ঘন। এক পর্যায়ে প্রহরীর সহ্যের শেষ সীমাটি বুঝি পেরোল। সরোষে ডেকে উঠল—নজরুল! কী হলো? কতক্ষণ আর, শুনি? এ অবস্থা দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের ভেতর টেকো মাথা আর বোঁচা নাকের মাঝবয়েসী কালো এক লোক একরকম দৌড়ানোর মতো করে হেঁটে এলো ফটকের কাছে।পরনে আলমগীরের মতোই রক্ষীর নীল পোশাক। বয়েসী গার্ড তার দিকে একবার তাকিয়ে নাকের পাটা চুলকোলো, কিছু বললো না। দৃষ্টিতে জিঘাংসা। তাতে মধ্যবয়েসীকে খানিক বিব্রত দেখাল। টাকটা একবার চুলকে বলল—তুমি কিছুক্ষণ বসো যাও, যাও!
না! নিজের কাজ করো।
ঠিকাছে ঠিকাছে। ভালোর জন্য বললাম, ক্ষেপলে ক্ষেপো! আমারই আরাম। কই, আসো তোমরা! এই এই পাশের দুই সারি এক হও বললাম! এরপর আসো।
সারি মোট চারটি। পকেট গেটের কাছে আসতে আসতে দুটো হয়ে যাচ্ছে এক। আর তখনই বাঁধছে গোল। নজরুল বলল, এক সারি আমার কাছে আসবে আরেক সারি চাচামিয়ার কাছে যাবে, সোজা হিসাব। তাতেও গণ্ডগোল!তোরা মানুষ হবি নারে! পকেটে নিজের হাত ঢোকানোর দরকার নে-ই! ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও! সেয়ানা!
পুনরুক্তি চলতে থাকল বিবিধ বাক্যের। এভাবে মিনিট দশেক চলার পর ধীরে থিতিয়ে আসতে থাকল শব্দজল।এরইমধ্যে চারটি ফ্লাড লাইট জ্বলে উঠেছে কারখানার চার কোণে। তখনো উঠোনে দাঁড়িয়ে যারা, স্বচ্ছ-অস্বচ্ছ মিলিয়ে তাদের চারটি করে ছায়া দেখা যেতে থাকল।
তখনো বাতাসে উড়ে সরে যাচ্ছে ধুলো। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কিছু প্যাকেট ঢাকার ভাসমান টোকাইয়ের মতো কখনো কারও ভয়ে, কখনো নিজ মনের খেয়ালে, উড়ে দূরে সরে যাচ্ছে, কাছে আসছে। গজ বিশেক দূরের মুখোমুখি ওইবড় ঘরের ভেতর থেকেবেরিয়ে এলো এক কিশোর ছেলে, হাতে জলভরা বালতি। একটা নীলরঙা মগ তাতে ভাসছে আর দুলছে। চলে গেল পাশের আলো না-জ্বলা ছোট রান্নাঘরে।রান্নাঘরের ভেতরে শেষপ্রান্তে বালতি টানিয়ে রাখল। শব্দ পাওয়া গেল, তাকে দেখা গেল না। জায়গাটা দেয়ালের আড়াল। ওদিক থেকেও প্রাকৃতিক আলো আসছে, ম্রিয়মান। একটু পর আবার দেখা গেল ছেলেটাকে। দরজার কাছে রাখা শাকসবজির একটা ঝাঁকা তুলে ভালুকের মতো থপথপে পায়ে ভেতরে নিয়ে গেল। আর এলো না। শেষ শ্রমিকটিও তখন বেরিয়ে গেছে।
আলমগীর বলল, আপনি এবার অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করুন। আমি ফোন করে দিচ্ছি।
অফিসটা কোনদিকে?
ওই দিকে সোজা গেলেই,আলমগীর টেস্টিং রুমটা দেখিয়ে দিলো।
টেস্টিং থেকে মলিন শার্ট আর রং ওঠা প্যান্ট পরা আরো এক কিশোর ঝাড়ু হাতে এগিয়ে আসছিল। ট্রান্সফর্মারের তেলের পিপেগুলো যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছন দিককার আরেকটি ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বেরোলে এক তরুণ। বয়েসে ঝাড়ু হাতে কিশোরের চেয়ে কিছুটা বড়। তার হাতেও ঝাঁটা। দুজনে কারখানার দুই কোণ ধরে খ্যাশ খ্যাশ শব্দ তুলে ঝাঁড় দিতে লেগে গেল। একে একে ঝুড়িতে উঠলো সব ক’টা প্লাস্টিকের প্যাকেট, প্রচুর কপার তারের ছিন্নাংশ, বাঁকাচোরা ধাতব পাতসহ হরেক বস্তু।
সলিল বলল, ঠিকাছে, আমি তাহলে এগোচ্ছি।
একটু দাঁড়ান স্যার—আলমগীর তার ঘরের দরজার কাছে রাখা ছোট এক টেবিলের ওপর ঝুঁকে শক্ত সবুজ মলাটের এক টালি খাতায় স্বাক্ষর করছিল। সেখান থেকে মুখ না তুলেই বলল, আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।
গার্ডরুমের পর খানিকটা ফাঁকা জায়গা। এরপর অপরিসর দোতলা দালান, তার ওপর পানির বিশাল বর্গাকার আধার। দোতলা দালানের প্রায় পরপরই অভিন্ন ছাদের নিচে টানা কিছু একতলা ঘর। ঘরগুলোরই একটি থেকে তখনো ঠং ঠং শব্দ আসছে। সবাই বেরোয়নি?—সলিলের প্রশ্ন। আলমগীর তখন টালি খাতা থেকে সবে মুখ তুলেছে। চোখজোড়া নিচের দিকে রেখে ক’মুহূর্ত সময় নিলো। ওই অবসরে নিঃসঙ্গ ঠং ঠং ঠং শব্দটা নীরবতায় ঘা মারতে থাকল। না—কিছুটা যেন আনমনা।একজন রয়ে গেছে।
ওভারটাইম?
না। তার ব্যাপার ভিন্ন। টার্গেট-কাজ শেষ না করে যায় না। বলে লাভ হয় না।
টার্গেট কাজ মানে?
আলমগীর আর কোনো কথা না বলে হাজিরা খাতার পাতা ওল্টাতে থাকল। ওদিকে ঝাঁট দেওয়া শেষ করেছে ওই কিশোর আর তরুণ। আবর্জনার বালতি এক হাতে হাতে, অপরহাতে ঝাঁটা।ইটপাথরের ঢালাই দেওয়ারাস্তায় তাদের পায়ের শব্দবুকে হেঁটে ক্রমে ফটকের দিকে এগোতে থাকল। আলমগীরের সহায়তার আসা অন্য রক্ষীটি যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনই হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে।
কলমের খাপ নিবের মাথায় এঁটে কলমদানিতে তুলে রেখে টেবিলের এক কোণে একটা টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল বয়েসী রক্ষী। রিসিভার তুলে একটা নম্বর চাপতেই দূরে টেস্টিং রুমের ওপরতলার ঘরে ঝনঝন করে আরেকটা ফোন বেজে উঠতে শোনা গেল। টেস্টিং রুমের দেয়াল হলুদ, আর ওপরের ঘরটার দেয়াল সাদা রং করা। টেলিফোনটা সাদা রঙের ঘরে।
আলমগীর বলে চলল, জি স্যার, তিনি এসেছেন। আমি নিয়ে আসছি। অসুবিধা নেই। আমিই নিয়ে আসছি স্যার। দেরি একটু হয়েছে। রক্ষী তাকাল সলিলের দিকে, চোখে সহায়হীনের পরোক্ষ দৃষ্টি।কিন্তু কী আর করা স্যার উপায়ও ছিল না যে। তখন বেরোতে শুরু করল। আমারই ভুল হয়েছে।স্যরি স্যার, মাথায় কাজ করেনি। শব্দে। হ্যাঁ স্যার। ওই শব্দেই তো সব এলোমেলো হয়ে যায়।জ্বি? রবি রান্নাঘরে।
রিসিভার নামানো হলো।চলুন।
ঢালাই দেওয়া রাস্তাটা ধরে ওরা টেস্টিং রুমের দিকে এগোতে থাকল। এসময় যে ঘর থেকে শব্দ আসছিল ওটা পড়ল হাতের বাঁয়ে। ঘরের দরজায় বাংলায় লাল অক্ষরে লেখা ‘পিএফআই রুম’।
টিউববাতির সাদা আলোয় ভেতরে ছোট করে ছাঁটা চুল আর পরিপাটি সিঁথির এক তরুণকে দেখা গেল। পরনের ধূসর টিশার্ট, কালো প্যান্ট। পায়ে পুরনো কেডস। একটা রেঞ্চ হাতে যন্ত্রে বোঝাই এক আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খোলাদরজার সামনে দিয়ে ওরা যাওয়ার সময় মুহূর্তের জন্যে বাইরে তাকাল। প্রশস্ত কালো একজোড়া ভুরু, চোখজোড়া ওপরনিচ কিছুটা চাপা।দৃঢ় চোয়াল। জুতোর ফিতে না আটকে ভেতরে গুঁজে রেখেছে।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-২ ॥ হামিম কামাল
কারখানার বাঁশি: পর্ব-১ ॥ হামিম কামাল