।দুই।
সিটটা যেন উটের পিঠে বাঁধা। ভিড় ঠেলেই বাস টানছে, অমনি সামনে পেছনে দোল। জানালাটার কাচও সুবিধার না। ওটা খোলা সাধ্য কার। যেমন গোঁয়ারের মতো অটল, তেমনই হৃদয়ের মতো ভঙ্গুর। বজ্রের রেখা যেমন আকাশ চিরে যায়, তেমনই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত এঁকেবেঁকে ফেটে আছে কাচ। প্রতিবার ব্রেক কষার সঙ্গে লটপট করে উঠছে।
আরোহীর ভোগান্তির এখানেই শেষ নয়। সামনের সিটের কথায় আসা যাক। সিটটার যে হেলান, তার গোড়ায় কোথাও ভেঙে গেছে। সামনের আয়েশী যাত্রী পিঠটা এলিয়ে দিতেই সিটসহ কোলের ওপর এসে পড়ছিল বলা যায়। বেচারারও বা কী দোষ, বিব্রত সেও। পিঠটা টান করে সোজা হয়ে বসে আছে। সিট বদলানোর উপায় কারও নেই, সব দখল। সিটই শুধু নয়। বাসের টানা হাতলে মুঠো করে ধরার জায়গা নেই। এ অবস্থায় বাস বদলের চিন্তা যে করবে, ঢাকায় সে নতুন ঘুঘু। সব মানুষ অফিসমুখো এখন। যে যেভাবে আছে অনড় হয়ে সেভাবেই রইল। তটস্থ সহযাত্রী, পড়নোন্মুখ জানালা নিয়ে উটের পিঠে পাথর হয়ে বসে রইল তরুণ সলিল। পরনে পরিচ্ছন্ন পোশাক, পরিপাটি চুল। ঢাকা থেকে মনময়পুর প্রায় দু’শো কিলোমিটারের পথ।
হেলদোলের ভেতর কথাটি হুট করে তার মনে পড়ে থাকবে। মুখে তাই যাতনার ছাপ পড়ল। এমন সময় সারি সারি দালানোর আড়াল থেকে বেরিয়ে বাস পড়ল মূল রাস্তায়। তখন শেষ স্বপ্নটাও শব্দ করে ভাঙল। এতক্ষণ দালানগুলো সূর্য ঠেকিয়ে রেখেছিল। আর সিট দখলের মহাসংগ্রামে রোদের হিসাব নিকাশের ওঠার অবকাশ মেলেনি। এখন ছায়াটা সরে গিয়ে জানালার কাচে রোদ ভাঙল, সেই সঙ্গে ভোগান্তির ষোলোতম কলাটিও হলো পূর্ণ। ন’টার রোদ আঁচে কড়া। নিরুপায় চোখ দুটো হাতে ঢাকলো সলিল। মুখটা যথাসম্ভব বাসের দরজামুখো করে রইল।
বাসের হেল্পার ছেলেটা সদ্য কৈশোরের বেড়া ডিঙিয়েছে। এই অহমে পা তার রাস্তা ছোঁয়া না, তবে ছুঁইছুঁই করে। বছর বিশেকের বিষ্ণুকোকিল। কর্কশ কণ্ঠে এখনও ঝুলে ঝুলে তার লক্ষ্মীদের ডেকে চলেছে। আরও যাত্রী উঠলে কোথায় জায়গা হবে—যাত্রীদের এমন প্রশ্নের বিপরীতে সে রুষ্ট শিক্ষক। বেয়াড়া ছাত্রদের সেও চোখে মুখে শাসিয়ে চলেছে।
চারপাশে যন্ত্রের, মানুষের চিৎকার। কানে হাত তুলতে ভদ্রতায় ঠেকছে। পাশের মানুষটি স্ফীতকায় একজন মৌলবি। সাদা ঢলঢলে জোব্বা পরনে। দাড়িতে মেহেদির আগুন। পরিষ্কার করে কামানো গোঁফ। মাথায় একটা সাদা কাপড়ের টুপি, সেই টুপিতে গোল গোল ছিদ্রের নকশা। টুপির নিচ থেকে মোটা চুলের গোছা বেরিয়ে এসে ঘাড়ের একটু ওপরে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে। সেই চুলে আবার সাদাকালোর মিশেল। লোকটার ঠোঁটের এক কোণে পানের রস শুকিয়ে আছে। সেও চুপ করে নেই। বাস যখন গুলিস্তানের চত্বরে তখন থেকেই সে ফোনে কথা বলে চলেছে। ফোনের বিপরীতের হতভাগ্য লোকটি এর ফরমাশ মেনে হয়রান। এ মুহূর্তে ওপারে মৌলবির কোনও মহামূল্য ট্রাঙ্ক হাতড়ানো হচ্ছে বৃথাই। নেকি আমলের মহামূল্য একটি বইয়ের চলছে খোঁজ। মিলছে না। লোকটা আড়চোখে সলিলকে লক্ষ্যও করে চলেছিল থেকে থেকে।
সলিল হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। চোখে মুখে ‘এভাবে আর নয়’—এমন একটা ভাব। লোকটাকে মৃদু কণ্ঠে জায়গা করে দিতে বলল, নেমে পড়বে। ঢলঢলে অবয়বে একটা নড়নচড়ন দেখা গেল বটে, বেরোনোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া গেল না। সলিল কণ্ঠটা চড়ালে এবার যেন শোথ ফিরল লোকটির। বাসের ভেতরটা গুমোট হয়ে ছিল। বেরোতেই মিলল স্বস্তি। শিশু পার্কের দোরগোড়ায় একটা তরুণ বট। এখনই বুড়োর ভাব ধরে জটা নামাতে চাইছে। তার নীচে দাঁড়িয়ে গভীর করে শ্বাস টানলো সলিল। ঢাকার বাতাস নানা বিষবাষ্পে ভারি। তবু তার বুক হালকা হওয়া মুখ কারো কারো মায়া জাগালো। তাকে ডাকল রমনা পার্ক। বলল, মনময়পুর পরে যাস বাছা, এখন আমার কাছে আয়। আগে জীবনটা তো বাঁচা। পরে নাহয় জীবিকা খুঁজিস?
প্রহর গড়ালে হুড়োতাড়া থিতিয়ে এলো। পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই বড় নীলরঙা এক বাস এসে দাঁড়াল শাহবাগ সিগনালের কিছু আগে। গন্তব্য মনময়পুর, তবে যাবার পথ ভিন্ন। চিৎকার করতে থাকা কোনও কিশোর বা তরুণকে এ বাসে দেখা গেল না। বরং এক গম্ভীরমুখো মাঝবয়েসী লোক বেরিয়ে একটা ছাউনির নিচে চলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে একটা টুলের সামনে বসে থাকা দুটো লোকের হাতে কাগজ সাঁটা এক ক্লিপবোর্ড তুলে দিলো। পাশের দোকান থেকে একটা পান বেছে নিয়ে দিল দোকানির হাতে। তৈরি হয়ে ফের হাতে এলে কৌশল করে মুখে পুরলো। পানের ডাঁটার মাথায় চুন নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে ছাউনির বাইরে তাকিয়ে চোখ পড়লো সলিলের ওপর। যেন তার গন্তব্য জানে, এমনভাবে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলো টেবিল। যাত্রীদের ছোট একটা সারি সেখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করছে।
বাসের আসনগুলো ভালো। কাচের ওপর লেখা ‘বিরতিহীন, কম স্টপেজ’। সলিল একটা টিকিটে নির্দিষ্ট কোনো আসনের নম্বর দেওয়া নেই। সুতরাং যেখানে খুশি সে বসতে পারে। দু’ভাগ করা লম্বা সারির মাঝখানে একটায় রোদের হিসাব করে বসে পড়া গেল। ব্যাগ থেকে একটা সবুজ কৃষকায় বই বের করে পাতা ওল্টাতে শুরু করল। বইটির নাম ‘অব্যক্ত’। লেখক জগদীশচন্দ্র বসু। পরিচিত শহরের, পরিচিত দৃশ্যের প্রতি ঝোঁক বুঝি বাড়তি মেদ। ঝরে যাওয়াই ভালো। অন্তত এখন। বইয়ের পাতাতেই চোখ থাকলো নিবদ্ধ। যতোক্ষণ স্থির হয়ে আছে বাস, পড়ে নেওয়া যাক।
যাত্রীরা আরো উঠলেও অনেক আসন খালিই রইল। তবু শহর ছাড়তে নড়ার উপক্রম করল বাস। বাহির থেকে জোড়া থুতনির স্থুলকায় চালক উঠে পায়ের বিস্তারে এঞ্জিন এড়াল। এরপর কালো নরম আসনে বাতাস ঠেরে সশব্দে বসে পড়ল। জানালার বাইরে পেছন দেখানো কাচটা ঠিক করে নিলো। পেছনের গাড়িগুলো দেখতে দেখতে কী এক গোপন হিসাব বুঝি কষল। হেল্পার লোকটি মোড় থেকে একটা বিদেশি সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালে হাত নিচু করে তা নিয়ে ঠোঁটে তুলল চালক। হেল্পার ঘুরে এসে উঠে পড়ল দরজায়। জানালা পথে একবুক ধোঁয়া চালান করে যাত্রীমুখো আয়নায় নিজেকে দেখল সিগারেটঠুঁটো তৃপ্ত ওই মুখ। স্টিয়ারিং যেদিকে ঘুরল, নিজস্ব ভঙ্গিমতোন তার বিপরীত দিকে ঘুরল চালকের শরীর। স্টপেজ ছেড়ে গম্ভীর চাপা শব্দে গতি বাড়তে থাকল।
যাত্রাপথের ঢাকা শোকে কাঁদতে ভোলামানুষের মতো। শহরে ঢোকা কঠিন, বেরোনো কঠিনতর। প্রমাণ মিলতে থাকল পদে পদে। বাণিজ্যিক এলাকার মোড়ে মোড়ে জট। একের পর এক পেরিয়ে যেতে থাকা শহরের আবাসিক অংশের বেশিরভাগই ঘিঞ্জি, নর্দমাসংকুল, অনন্ত প্রতিযোগিতার অপরাধপ্রবণ শহর। থিকথিকে শিশুরারাস্তায় চরে খুঁটে খেতে লেগেছে, পথকুকুর সঙ্গী। কিশোররা রেলগেটে বিড়ি ফুঁকছে। যানজটে থামলেই জানালায় জমছে ভিক্ষুক, দোলনচাঁপা হাতে নাছোড় কিশোরী। দুই বাসের সরু ফাঁক গলে ফসকে বেরোচ্ছে প্যান্টে শার্ট গুঁজে পরা মধ্যবিত্ত, ভিড় ঠেলে পালিয়ে যাচ্ছে লম্পট। পা ফেলবার আগেই হেল্পারের তাড়া—ফলত রাস্তায় গড়াচ্ছে বৃদ্ধ। রিকশা ভেঙে পড়ে আছে হতভম্ব তরুণী, ব্যাগ পিঠে রাস্তা পেরোচ্ছে ভয়ার্ত শিশু। রাজপথে সবজির বাজার, চাঁদা নিয়ে হাতাহাতি। ডাস্টবিন, রেলগেট, রাস্তা সংস্কার, নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার, আবার ডাস্টবিন, ময়লাভরা পলিথিন মুখে কুকুর- দম্পতির মধুর খুনসুটি। বাবার সঙ্গে হাসিমুখে বাজারে চলেছে কিশোর, সড়কদ্বীপে উঠে গেছে বাস। পেট্রলবোমা হাতে ধরা পড়েছে এক টোকাই বালক, এক পকেটমারকে ধরে পেটাচ্ছে মানুষ। মিছিল। এর ভেতর একজোড়া তরুণ তরুণী রিকশা নিয়ে আটকা পড়েছে। রাস্তা বন্ধ করে মন্ত্রী পেরিয়ে গেলেন।
দক্ষিণ থেকে উত্তরের বিস্তৃত এলাকা পেরোনোর একটি বিশেষ মুহূর্তে ক্ষণিকের জন্য পুব দিকে চলে যাওয়া শহরের প্রশস্ত পথগুলো চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ মায়ার মতো ঝুলে থেকে আবার মিলিয়েও গেল। সুরম্য প্রাসাদগুলোয় হয় পশ্চিম দেশীয় আদল নয় প্রাচ্যের আদি নকশার বাহার। আবাসিক ভবন আর দাপ্তরিক কার্যালয়গুলোর ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বিরতিতে সুশোভিত উদ্যান। পথে উঁচু স্তরের পেশাজীবীর আনাগোনা, নিঃশব্দে চলছে আনকোরা ব্যক্তিগত সব গাড়ি, হাসছে সুবেশি তরুণ-তরুণী, নধর শিশুকিশোর। পথের মোড়, ফুটপাথ ভিক্ষুকবিহীন। অতিগুরুত্বপূর্ণ ঘোষিত এলাকা শুরুর আগেই উত্তরমুখো পশ্চিমমুখো হয়ে একাধিক বাইপাস যানবাহনের মোটা মোটা সারি টেনে নিয়ে গেছে বলে এদিকটায় বড়বাহনের চলাচল কম, জটও শিথিল। ‘অব্যক্ত’ অব্যক্ত হয়ে কোলের ওপর পড়ে রইলবাকি সারাপথ।
শহর ছাড়ার চূড়ান্ত ক্ষণ উপস্থিত হলে স্বস্তিতে ভাঙন ধরল। অভ্যাসের ব্যতিক্রম ঘটার অস্বস্তি আর ওই অস্বস্তি থেকে ধোঁয়ার মতো এঁকেবেঁকে জেগে ওঠা বিষণ্নতা সলিলের চোখেমুখে। মনটা আর্দ্র হলো, স্মৃতিকাতর হলো, চোখে তার ছায়াও পড়ল। বইটা বাঁ হাতে রেখে ডান হাতের কোন জানালার কাঠামোয় ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল সলিল। ঢাকার শেষ সীমা ছেড়ে নতুন আরেক ভুবনের রাস্তায় বাস উঠে এলো। মাটির রং এখানে লাল।
শহর শেষ, কিন্তু বাতাসে শহরের অবশেষ তখনও বর্তমান। মহাসড়কের পাশে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে বাস দেশের সবচেয়ে বড় আবর্জনাগার পেরোলো। বর্জ্যরে এই বিপুল স্তূপ ঘিরে টকে যাওয়া বাতাস সাপ হয়ে আস্ত গিলছে আগমণকারীদের। এরপর সরীসৃপের পায়ুপথ হয়ে যখন বেরোনো হলো, বাতাসের অভাবে ফুসফুস তখন ফেটে যায় যায়। জানালার বাইরে তখন অন্য জগৎ। শহরের অবশেষ থেকেও মুক্ত প্রকৃতি দিব্যি বেড়ে ওঠার অবকাশ ওখানে পেয়েছে।
মনময়নগরে প্রবেশের কিছু পথ আগেই অরণ্য শুরু হলো। শাল-পিয়ালের বিস্তৃত বনভূমি।
শালের গুঁড়ি সোজা ওপরে উঠে যাওয়ায়, আর খুব বেশি শাখায়িত না হওয়ায়, এমন বন ঘন হয়েও বেশ আলোকিত। তবে আলো যতই থাক, দু’পাশে তাকালে দৃষ্টি বার বার বাধা পড়ছে অরণ্যে, ভেদ করার উপায় নেই। মোটা থামের মতো গাছগুলো দর্পে আকাশ ছুঁতে সোজা উঠে গিয়ে বুঝি হেলায় নিচে তাকিয়ে আছে। এদিকে দিন ফুরোতে আর বেশি সময় বাকি নেই। পাখিরা ধীরে ধীরে নিজ নিজ ঘরে ফিরে আসছে। চারপাশ মুখর করা কাকলী তারই জানান দিয়ে চলেছে। একেকটা গাছের দিকে তাকালে প্রথমে কিছুই চোখে পড়ে না। শব্দ আছে, কিন্তু অস্তিত্ব নেই—এমন জগৎ। একেকটি গাছে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বোঝা যেতে থাকে, পাতাগুলো জ্যান্ত হয়ে যেন বাতাসের অনুপাতে নড়ছে। নড়েই চলেছে। শালের পাতা তো এত ছোট নয়। ওগুলো কী তবে? সর্বনেশে। একেকটা গাছে কত শত পাখি তার হিসেব প্রকৃতির। ঘন বনের নিচটা ঘাসে আর ঝোপঝাড়ে ঢাকা। সেখানেও অবিরত প্রাণের স্পন্দন।
স্থানে স্থানে বনে পড়েছে ছেদ। কিছু প্রশস্ত পথ এঁকে বেঁকে ক্রমশ বনের গভীরে চলে গেছে। দেখ মনে হয় যেন অদৃশ্য জলের নদী ওসব। ক্রমে যখন দিন আরো আলো হারালো, পাখিদের ডাক তীব্রতা পেল আরো। কিন্তু বনের ঘনত্ব কমতে শুরু করল। বন শেষ হলে শুরু হলো মনময়পুরের সীমানা। ঢাকার শেষ সীমা থেকে এখানে এসে পৌঁছুতে ঘণ্টা তিনের বেশি লাগেনি। ঢাকায় পদে পদে অবরোধ। এখানে তার নামগন্ধও নেই। বাসের গতি আর কাঁপুনিতে পানি খেতে গিয়ে ছলকে পড়লো গায়। বন শেষ হওয়ার পর আরও বহুপথ মনময়পুরের নিবিঢ় গ্রামদশা কাটল না। মূল সড়কের পাশে পাশে বহুদিকগামী মাটির রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার এখানে ওখানে একটি দু’টি ঝোপঝাড়ে কাঁচি চলেছে বোঝা যায়। তবে কেমন পরিকল্পনার অংশ এটি তা আঁচ করার আগেই স্থান হাওয়া। চালকের মর্জি।
গ্রাম দশা শেষ হয়ে মফস্বল দশা শুরু হলো। মফস্বল দশা শেষ হলে আবার শুরু হলো গ্রাম দশা। তবে এবার ও দশা শিগগিরই ঘুচে গেল।
শল্প এলাকা শুরু হলো। সারি সারি কারখানা। বিকট, বিরাট। দু’দিক বিস্তারি। নানা আকারের, নানা রঙের, নানা পদের। ধরনটা পাশ কাটানোর সময় চোখে পড়ে। তাতে কখনো বোঝা যায়, কখনও বোঝার আগে বাহন তাদের পেরিয়ে যায়। ঘটে গন্ধবদল। হয়ত এই বিস্কুটের মণ্ডের গন্ধ পাওয়া গেল, তো আরও খানিকটা এগোলে মিলল কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবানের সুবাস। কোথাও পরিচ্ছন্ন প্রাঙ্গণ, ওষুধের সশব্দ কারখানা। কোথাও ঝালাইয়ের শব্দ বলে দিলো বদলে যাচ্ছে কারখানার ধরন। এভাবে কিছু পথ পেরোনোর পর দেখা গেল—কোনও কোনও কারখানা বহুতল, মূল কাঠামোর বাইরে সাপের মতো একটা সরু সিঁড়ি এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। নিয়মিত বিরতিতে ওপর থেকে নীচ অনেকগুলো বেরিয়ে থাকা প্লাস্টিক নল থেকে বেরিয়ে আসছে ধূসর রঙা ধোঁয়া। বোঝা গেল, পোশাক কারখানা ওগুলো। একটি কারখানা স্রেফ একটা কারাগারের মতো নীরব গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও শব্দও এলো না, ধোঁয়াও না। কিছু বোঝা গেল না। কিছু কারখানার ভবনের দশা দীন। বিবর্ণ দেয়ালে কালিঝুলির এমনই বিস্তার যে মনে হয়, প্রতিদিন একবার করে পোড়ে। দীনতা ঢেকে রাখার ঢাকাই প্রবণতা এখানে নেই বলে দারিদ্র্যের সগৌরব প্রদর্শনী হয়ে অনেক কারখানা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁপছে। ভেঙচি কাটছে।
ধসে যাওয়া কারখানাও পড়ল চোখে। তিন-চার তলা বিপুলা দালান মাঝ বরাবর ধসে পড়েছে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে দেয়ালগুলো। ভেতরটা জনহীন। কোথাও শূন্য কাঠামোর ভেতর আবর্জনার বিষণ্ন স্তূপে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি যন্ত্রদানব। মৃত।
চলবে…