চিকা চিকা বোম চিকা
ভুলে যাওয়ার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে মনে রাখাকে এক প্রকার প্রতিবাদ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা। তবে আমার মনে রাখাকে প্রতিবাদ হিসেবে চিনিয়ে দিতে চাই না। জীবনের মধ্য পর্বে এসে যখন পেছনের দিকে ফিরিয়ে তাকাই, তখন এত-এত অপমান, অসম্মানের মাঝেও আমি দেখতে পাই আমার প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার অংশও নেহায়ত কম নয়। বরং ঘুরেফিরে মানুষের সেই ভালোবাসার কথাগুলোই আমার মনে পড়ে। একে স্মৃতিরোমন্থন বা সুখস্মৃতি হিসেবেও দেখতে চাই না। বরং এই মনে পড়া, আমার প্রতি মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা, যা কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, কোনো যোগ্যতা ছাড়াই আমি পেয়েছি, তা প্রকাশের মধ্যেও রয়েছে কৃতজ্ঞতা। এখানে প্রতিবাদের ছায়াকে আমি স্থান দিতে চাই না। প্রতিবাদের সেই ভাষাকেও রপ্ত করতে চাইনি। কত শত ঘটনা, কত শত কথা প্রতিদিন ঘটছে, ব্যয় করতে হচ্ছে, তার কতটুকুই আমরা মনে রাখি? রাখতে পারি?
মস্তিষ্ক যা প্রয়োজন মনে করে না, তার কিছুই সে জমা রাখে না হয়তো। অথবা রাখে, কিন্তু এক জীবনে তার হদিস পাওয়া ভার। আর যেটুকু বা যা যা সে মনে করিয়ে দিতে চায়, সেটুকুই আমরা মনে রাখতে পারি। ঘুরেফিরে সেটুকুই স্মৃতির দরজায় টোকা দেয়। অসংখ্য ঘটনার মাঝে—তেমনি আমারও অনেক স্মৃতি জমা করে রেখেছে মস্তিষ্ক। তার কিছু কিছু মনে করিয়ে দেয়। আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় সেইসব দিনগুলোতে। যার জন্য জীবন আমার কাছে রঙিন এবং সুন্দর সবসময়। এ জীবনকে আমি ভালোবাসি। জীবনের কাছে আমি পেয়েছি অনেক। সেই পাওয়া যেমন কখনো কষ্টের, তেমনি আনন্দের। তবে ফেলে আসা দিনের অনেক কষ্টকে এখন আর কষ্ট মনে হয় না। বরং সেইটুকু পাওয়ার বিনিময়ে আজ রঙিন হয়ে উঠতে পেরেছি আমি।
তখনো স্কুলের গণ্ডি পার হইনি। তবে পার হব-হব করছি। মানে স্কুল ফাইনাল নাকের ডগায়। ছেলেবেলা থেকেই আমি নানা-নানীর কাছে থাকতাম বেশি। আমার ছোট বোন তখন অসুস্থ। আমাদের মফস্বল শহর থেকে প্রায়ই আব্বা-মাকে ঢাকায় যেতে হয়। ফলে স্কুল ফাইনালের সময়ে যেন কোন ব্যাঘাত না হয়, তাই আগের বছরেই আমি নানা-নানীর কাছে চলে যাই। নানার চাকরি তখন দিনাজপুরে। আমিও এখানে এসে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হই। দিনাজপুরে আমার এত এত স্মৃতি, এত প্রিয় একটি শহর—এত নিরিবিল, মায়ায় ঘেরা—কাঞ্চন নদী, আর ঘাঘড়ার খালের জলের হাতছানি—আজও আমাকে টানে। বালুবাড়ি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আবাসিক এলাকায় আমরা থাকতাম। আমার ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বাংলা স্কুলের (পৌরসভা উচ্চ বিদ্যালয়) দেয়াল। যেদিন স্কুল ফাঁকি দিতাম, ওদিন আমার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ক্লাসে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি। আগামী দিনের বাড়ির কাজও শুনে নিয়েছি। শান্ত সেই শহরে কেটেছে আমার স্কুল পর্বের শেষ দুই বছর।
আবাসিক এলাকা হওয়ায়, ক্যাম্পাসেই প্রচুর ছেলেমেয়ে। নানান বয়সী। সবার সঙ্গেই আমার কথাবার্তা। সমবয়সী মোটে দুইজন। কাজল, একই স্কুলে—একই ক্লাসে। কাকলীও আমার সঙ্গেই পড়তো, তবে সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। বিকেলে ক্যাম্পাসের মাঠে সবাই মিলে আড্ডা তো ছিলই, আর ছিল আমার প্রিয় বাইসাকইকেল। সেই সাইকেল নিয়ে বালুবাড়ি থেকে চলে যেতাম নিমতলা, ঘাসিপাড়া, পুনর্ভবা নদীর কাঞ্চন ব্রিজ, কখনো বড়মাঠ পেরিয়ে বড়পুল, কখনো নিউটাউনের সাজানো রাস্তায়, কখনো সেইসব রাস্তা পেরিয়ে রামসাগর, অথবা পুরো উল্টোপথে মহারাজা স্কুল পেরিয়ে রাজবাড়ি, রাজবাড়ির দিঘির পাড়ে চুপচাপ বসে থাকা। আবার কোনদিন বালুবাড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে যেতে মহিলা কলেজ পেরিয়ে পলিটেকনিক্যাল ছাড়িয়ে ফুলবাড়ির দিকের রাস্তায়। আবার কখনো স্টেশন রোড ধরে এলোমেলো এপথ-সেপথ ধরে উঁচু প্রাচীরের জেলখানার পাশের ফাঁকা জায়গায় বসে থাকতাম। সেই এক দিন ছিল। সে এক সময় ছিল। হু হু করে উড়ে যেতে থাকে। গড়িয়ে যেতে থাকে। আর একটু একটু করে ক্যালেন্ডারের পাতাকে এগিয়ে নিতে থাকে।
কাকলীর বান্ধবীরা মাঝে মাঝেই আসতো ক্যাম্পাসে। তাদেরই একজন—সিমকি। ওদের বাড়িতে ছিল গোলাপের ঝাড়। প্রায়ই নিয়ে আসতো সেখানে ফুটে থাকা ফুল। একদিন ক্যাম্পাসে এসে, কাকলীদের বাড়িতে ঢোকার মুখে, মাঠে আমাকে বসে থাকতে দেখে, হাতের ফুল থেকে আমার হাতে একটি ধরিয়ে দেয়। কোন উদ্দেশ্য ছিল না ওর। আমারও না। মাঠে আমার সঙ্গে অনেকেই বসে ছিল, কাকলী-কাজলও ছিল। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন বাড়ির মহিলারাও ছিলেন। কাকলীরা ওদের বাড়িতে ঢুকে গেলে আমিও বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু এই একটি ফুলই কাল হয়ে গেল। আলোচনার বিষয় হয়ে গেল ক্যাম্পাসে। পরের দিন বিকেলে মাঠে যাবার পর, ক্যাম্পাসের কোন ছেলেমেয়েই দেখি আমার সঙ্গে কথা বলে না। খেলা তো দূরের। কাজলও এড়িয়ে চলছে। অনেক ছোট রিংকু, আমাকে বলে—তুমি নাকি মেয়েদের কাছ থেকে ফুল নিয়েছো, বাড়িতে বলে দিয়েছে—তুমি খারাপ হয়ে গেছো। তোমার সঙ্গে কথা বলতে মানা করে দিয়েছে।
ফুল নেওয়ার মধ্যে খারাপের কী আছে, বুঝতেই পারিনি তখন। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা আর আমার সঙ্গে কথা বলে না। ফলে বাইসাইকেল আমার আরো প্রিয় হয়ে উঠলো। সময় পেলেই বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার সঙ্গী রনি এবং শাওন। তিন বন্ধু শহরের প্রতিটি অলি-গলি চষে ফেলি। কত কতো পথ—কত গলি, আজ সব নামও মনে নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করলে সেই মায়াবী শান্ত শহরের পথগুলো আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এদিকে ক্যাম্পাসে আমাকে নিয়ে বাড়তে থাকে কথার ডালপালা। আমাদের বাড়িতেও আসে কথা। নানা-নানী আমাকে কিছুই বলেন না। কিন্তু প্রতিবেশিদের কথা থামে না। আমার দিকে কড়া নজর সবার। সিমকিরও ক্যাম্পাসে আসা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ সিমকির সঙ্গে আমার দেখা তো দূরের, পরে আর কথাই হয়নি কোনদিন। ক্যাম্পাসের ভেতরে আমাকে দেখলেই সবার ফিসফাস, বাঁকা চোখে তাকানোর সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগ হয়—নতুন উপসর্গ। আমাকে দেখলেই ছোটবড় সবাই ছড়া কাটে—‘চিকা চিকা বোম চিকা। চিকার দাম পাঁচসিকা।’ ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে চক দিয়ে চিকা মারা হতে থাকে। আমাদের দেয়ালে, আমাদের জানালায় লেখা হতে থাকে এই স্লোগান। আমি যখন বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাই, সবাই চেঁচেয়ি ছড়া কাটতে থাকে। আমার হাসি পায়। আমি হেসে ফেলি। এতে করে ছড়ায় যোগ হয় নতুন লাইন—‘চিকা চিকা বলি যখন, চিকার মুখে হাসি তখন।’ আমার বিরক্তি বোধ না হলেও, আমার নানা-নানী খুব বিরক্ত হন। তারা প্রতিবাদও করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সব অভিভাবকরাই যেন একজোট। এর মাঝে একদিন সন্ধ্যায় বাইসাইকেল নিয়ে ফেরার পথে, মোড়ের ওপর দাঁড়িয়ে। বন্ধুরা বিদায় নিচ্ছে যে যার মতো। তখনো আমরা কয়েকজন দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ কাজল, ওর এক আত্মীয় সঙ্গে আরো একজন কেউ—আমাকে দেখেই মোড়ের ওপর চিৎকার করে ওঠে চিকা, চিকা। আর যায় কোথায়—আমি খেয়াল করার আগেই—রনি, শাওন, জিয়া আরও কয়েকজন দৌড়ে ধরে ফেলে কাজলের সেই আত্মীয়কে। টানতে টানতে নিয়ে আসে আমার কাছে। রাস্তায় লোক জমে যায়। আমাকে কেন চিকা বলা হচ্ছে, জানতে চায় ওরা। তবে মাইরধর দেয়ার আগেই আমাদেরই ক্যাম্পাসের সেখানে আগে থেকে থাকা কেউ কেউ এসে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। ওরা শাসিয়ে দেয়, আর একদিন এমন বললে— দেখে নেবে।
সবাই চলে যাবার পর, আমাদের বন্ধুদের আর কোন কথাই হয়না। আমরা কিছু সময় চুপচাপ থেকে চলে আসি যে যার বাড়ি। পরদিন অফিসে আমার নানার কাছে—বিচার যায়। রাস্তায় লোকজন নিয়ে আমি ওদের আটকে ভয় দেখিয়েছি বলে। যারা বিচার নিয়ে গিয়েছিলেন— নানা তাদের বলে দেন, ও ওরা তো প্রায় বছর খানেক ধরে এমন করছে, কই আমরা তো বিচার নিয়ে যাইনি। আর মামুন তো মাত্র একদিন আটকেছে। তাতেই আপনারা চলে এলেন? (এটা অনেক বছর পরে আমি নানার কাছে শুনেছি।)
যারা বিচার চাইতে এসেছিলেন, তারা চলে যায়। নানা দুপুরে বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে বলেন, এরপরও যদি ওরা এমন বলে বা লেখে তো তিনি নিজেই যা করার করবেন। আমি যেন আর কাউকে পথে না আটকাই। এরপর থেকে সত্যিই কমে আসে এই শ্লোগান ও দেয়াল লিখনের প্রকোপ। আস্তে ধীরে ওরাও আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। কিন্তু কথা বলা পুরোপুরি শুরুর আগেই এসে যায় স্কুল ফাইনাল। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষের সঙ্গে সঙ্গে দিনাজপুরের মায়া কাটিয়ে আমি চলে আসি। বগুড়া থেকে অনেক বারই বেড়াতে যেতে চেয়েছি স্মৃতির ওই শহরে। কিন্তু সময় আমাকে সেখানে যেতে দেয়নি। ফেলে আসা ওই পথ, পথের দুধারের গাছগুলো, ঘাঘড়ার খাল, খালের পাড় ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভুত সেই গাছেরা, খালের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট কালর্ভাট, যার শরীর বহুদিন আমাদের আসন দিয়েছে। বহু বিকেল—আমরা তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। কাঞ্চন ব্রিজের ওপর নদীর ভেতরে হারিয়ে যাওয়া সূর্য, রামসাগরের দিঘির সেই টলমলে জল—চেহেলগাজীর মাজার,মহারাজা স্কুলের মাঠ, বড়মাঠের কোলে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুপার্ক,সার্কিট হাউস রোড,পথের শেষে বিডিআরের সেই অডিটোরিয়াম—আজও হাতছানি দেয়। রনি, শাওন, রিঙকু, মাসুদ, জিয়াসহ হারিয়ে যাওয়া, নাম ভুলে যাওয়া বন্ধুরা এখনো আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে।
চলবে…