পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার ছোঁয়ায় ঋজু উত্তরাধুনিক কথাসাহিত্যে উজ্জ্বল এক নাম জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি। কয়েক বছর ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হলেও এখন পর্যন্ত সেই সৌভাগ্যের তিলকটি তিনি পরতে পারেন নি। দেখা যাক ভবিষ্যতে এই সুযোগটি পান কিনা। তাঁর লেখা পরিমাণে খুব বেশি না হলেও ওজনে কিন্তু কম নয়। এই লেখকের লেখা দ্য উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল, আফটার দ্য কুয়েক, স্পুটনিক সুইটহার্ট অনেক আলোচিত গ্রন্থ হলেও সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও পঠিত প্রেমের উপন্যাস, নরওয়েজিয়ান উড।
হারুকি মুরাকামির অধিকাংশ সাহিত্যকর্মই উত্তম পুরুষে লেখা। নরওয়েজিয়ান উড ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়ে সারাবিশ্বে সাড়া জাগায়। বিশটি ভাষায় অনূদিত হয়। এই উপন্যাস সম্পর্কে ইংরেজি ভাষার অনুবাদক জে রুবিন বলেছেন, ‘জাপানের প্রায় প্রত্যেকেই এটি পড়েছেন। প্রকাশকের হিসাবে এই বইয়ের কাটতি তিন বিলিয়ন পার।’
ফিরে আসা যাক উপন্যাসের মূল বিষয়ে। উপন্যাসের নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্র সাঁইত্রিশ বছরের ওয়াটানেবা তোরোর জার্মানিতে যাওয়ার সময় বিটল্স সঙ্গীত দলের নরওয়েজিয়ান উড গান শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে ফিরে যান আঠারো বছর জীবনের স্মৃতি রোমন্থনে। ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে বিষাদের আবহে ৩৮৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি এগারোটি অধ্যায়ের বিন্যাসে বিস্তার লাভ করে। তোরোর বন্ধু কিজুকির আত্মহত্যার পরেই সে কোবে থেকে টকিওর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে থেকে লেখাপড়ার শুরু করে। শান্ত শিষ্ট, সাধারণ ধাঁচের আটপৌরে এই তরুণের ছাত্রজীবনে স্বাভাবিক সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আরও কিছু বন্ধু জুটে যায়। যাদের মধ্যে নাওকো, রিকো, মিরুদি, স্ট্রম ট্রুপার, নাগাসাওয়া এবং নাগাসাওয়ার বান্ধবী হাটসুমির নাম উল্লেখযোগ্য। রিকো ছাড়া অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের প্রেম-ভালোবাসা, শারীরিক সম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন এই উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। হারুকির অন্যান্য লেখায় পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতা লক্ষ করা গেলেও নরওয়েজিয়ান উড উপন্যাসটিতে সমাজবাস্তবতা মূর্ত। ‘শীতঋতু’ মেটাফর হিসেবে মানুষের জরা, থেমে থাকা এবং শেষাবধি জীবনাবসানের করুণগাথা অনুরণিত, বিষাদের ছায়ায় কষ্টের সুর বাজতে থাকে শ্লথ পাঠের পুরো উপন্যাসটিতে।
নাগাসাওয়া যদিও খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে উপন্যাসে আবির্ভূত হয়নি তবু দুতিনটি অধ্যায়ের বিস্তারে লক্ষ করা যায়, সে তার বড় পুরুষাঙ্গের জন্য কিংবদন্তী হিসেবে পরিচিত এবং আবেগকাতরতাহীন বাস্তব ও যুক্তিবাদী, মেয়েদের সঙ্গে রাত্রিযাপন ও মদ্যপান করায় সিদ্ধহস্ত। এই চরিত্রের একটি ছায়ারূপ যদিও দেবদাস উপন্যাসের চুনিলালের সঙ্গে মিলে, তবু নাগাসাওয়া বাস্তববাদী, মেধাবি ও পড়ুয়া, বিদে ভাষা শিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি পাওয়া চুনিলাল চরিত্রের বৈপরীত্য ইঙ্গিত করে। নাগাসাওয়া তোরোকে নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে রাত্রিযাপন করে, মাঝরাতে আবার বান্ধবী বদল করে—এসব মামুলি ঘটনা উপন্যাসে যথেষ্ট স্থানজুড়ে রয়েছে।
___________________________________________________________________________________
দেবদাসের জীবন শুধু পার্বতীর ভালোবাসায় সিক্ত ছিল কিন্তু তোরোর জীবনে মিরুদি, নাওকো, বৃদ্ধা রিকো থেকে শুরু করে অনেক তরুণীর সঙ্গে রাত্রিবাস করার মধ্য দিয়ে প্রেমের সত্যটি রহস্যময়ই থেকে যায়।
______________________________________________________________________________
উপন্যাসটিতে নাওকোর জীবনে তীব্র মনস্তাত্ত্বিক সংকট লক্ষ করা যায়। শুধু নাওকোর নয়, অন্যান্য চরিত্রেও এমন সংকট চিত্রিত হয়েছে। নাওকো কিজুকির বান্ধবী ছিল। যার সঙ্গে তার তিন বছর বয়স থেকে বেড়ে ওঠা; দুজনের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা ছিল। নাওকোর ভাষায়, ‘কিজুকি যখন তখন আমার স্তন ও যোনি নিয়ে খেলত তাতে আমি কিছু মনে করতাম না।’ তবে নাওকোর মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও তীব্র দহনের কারণ হলো কিজুকি যৌনাবেগতাড়িত হতো, তখন নাওকো কখনো কামসিক্ত হতো না; তার উত্তাপহীন যৌনগ্রন্থি নিষ্ক্রিয়তার কারণে যৌনাঙ্গ শুষ্ক থাকত। নাওকোর এমন নিষ্ক্রিয়তা ও উত্তাপহীন অক্ষমতার কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে কিজুকি আত্মহত্যা করে উপন্যাসে স্পষ্ট হয়নি এবং পরবর্তী সময় নাওকোর মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের কারণও কী ছিল, তাও স্পষ্ট হয়নি। তবে কিজুকির আত্মহত্যা ও নাওকোর যৌন অক্ষমতা দুটি কারণেই হয়তো নাওকোর মনোবৈকল্য দেখা দেয়, যার প্রচ্ছন্ন ছায়া উপন্যাসে পাওয়া যায়। কিজুকি একবার তোরোর সঙ্গে দৈহিক মিলনের সময় বলেছিল, কিজুকির সঙ্গে আমি কখনো কামসিক্ত হতে পারতাম না। আমার যোনি সিক্ত হতো না। সে জীবনে একবারই তোরোর সঙ্গে কামসিক্ত হয়েছে এবং সঙ্গম করতে সমর্থ হয়। কিজুকিকে সে শান্ত করত হস্তমৈথুন করে। টোরোর সঙ্গে দ্বিতীয়বার যৌনমিলনে প্রবৃক্ত হলেও প্রথম বারই সে কামরসে সিক্ত হয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় বার আর নয়। তখন হস্তমৈথুন করে তোরোকে প্রশমিত করেছিল। আত্মহত্যা, যৌনতা, মদ্যপান, ছাত্র-আন্দোলন ইত্যাদি যেন জাপানের এক বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি, যা উপন্যাসটির ভাঁজে ভাঁজে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে।
পুরো উপন্যাসটিতে তোরো নাওকো, ১৯ বছরের বড় রিকো, মিরুদিসহ আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে সঙ্গমের চিত্র চিত্রিত হয়েছে অত্যন্ত খোলামেলা ও সাবলীল ভাষায়; বাংলাভাষায় এ-ধরনের উপন্যাস খুব বেশি চোখে পড়ে না। রিকোর সঙ্গে তার কন্যাতুল্য তের বছরের এক লেজবিয়ান ছাত্রীর অস্বাভাবিক যৌনাচারও খোলামেলা বর্ণনায় চিত্রিত হয়েছে। এ-রকম খোলামেলা জলো আলোচনা তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ এবং এই আলোচকের ‘কুহেলীকুহকে’ কিছুটা সন্ধান মেলে। তবে এত বিস্তারিত নয়। আলোচ্য উপন্যাসে দৈহিক মিলনের খোলামেলা বর্ণনা যেভাবে করা হয়েছে, সেভাবে খোলামেলা বর্ণনা মনি হায়দারের ‘সুবর্ণ সর্বনাশ’, হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু ভেঙে পড়ে’ (যদিও এই উপন্যাসে অনেক রাখঢাক আছে), সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’ ইত্যাদি উপন্যাসে লক্ষ করা যায়।
নাওকো ও রিকো দুজনই মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। তারা দূরের এক মানসিক আরোগ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসা নেয়। তবে দুজনের মানসিক সংকট দুরকম। নাওকো শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে পরিত্রাণ পেলেও রিকো বরং জীবনকে উপভোগ করার জন্য গিটার নিয়েই একাএকা জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। তোরোর সঙ্গে রাত্রিযাপন করে, রান্না করে খাওয়া-দাওয়া করে, নাওকোর প্রতি শোক প্রকাশ করে মধ্যরাত পর্যন্ত গিটার বাজিয়ে এবং সর্বশেষ তোরোর সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোতে যাওয়ার সময় ১৯ বছর বয়সের ব্যবধান কমিয়ে এনে রিকোর বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে তরুণীর ঘ্রাণ খোঁজে এবং উভয়েই জীবনকে উপভোগ করে। এভাবে তালাকপ্রাপ্তা রিকো (রিকোর মানসিক অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছায় স্বামীকে বলে-কয়ে রাজি করিয়ে সে তালাক দেয়) একই রাতে চারবার শারীরিক মিলনের পর ভোরে রিকো তার গিটার নিয়ে অজানা পথে পা বাড়ায়, তোরো ফিরে আসে নিজের ঘরে।
তোরো একাধারে নাওকো এবং মিরুদির সঙ্গে প্রেম করলেও উভয়ের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে দৈহিক মিলনে প্রবৃত্ত হয়। অবাক ব্যাপার হলেও অন্য মেয়েদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের কথা অবলীলায় নাওকো ও মিরুদিকে সে বলে, যা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা মনে হয় না।
মিরুদি একটি বিস্ময়কর চরিত্র। তোরোর সঙ্গে পর্নো ছবি দেখা, পর্নো দৃশ্য সম্পর্কে নানা রকম রসাত্মক মন্তব্য করা তার স্বাভাবিক চালচলন হলেও তোরোর সঙ্গে দৈহিক মিলনে কিঞ্চিত সংযমের আভাস পাওয়া যায়। কথাবার্তায় সে রোমান্টিক হলেও তার স্বভাবে যথেষ্ট পাগলামি রয়েছে এবং মানুষের সঙ্গে মজা করা তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মৃত্যুশয্যায় শায়িত বাবাকে নিয়ে সে মজাই করেছে তোরোর সঙ্গে। বলে উরুগুয়ে গিয়েছি অথচ বাবা হাসপাতালে শয্যায়শায়ী। একদিন তরোকে নিয়ে যায় বাবাকে দেখতে এবং সেদিন খুব খাটো স্কার্ট পরে এবং পুরুষরা তার খাটো স্কার্ট দেখে কী ধরনের মন্তব্য করে তা আবার তোরোকে ব্যাখ্যা করে বেশ মজা করে। তবে তার চরিত্রের একটি অনন্য কতর্ব্যনিষ্ঠার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। সে বাবাকে কখনোই অবহেলা করেনি, বাবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যাবতীয় কাজ সে অকপটে করে। আবার অন্যদিকে বাবার মৃত্যুর পর সে বাবার ছবির সামনে নগ্ন হয়ে নিজের বক্ষ এবং যোনি দেখিয়ে আত্মকথনে মগ্ন হয়, পাশের বিল্ডিংয়ে আগুন লাগার পর গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে মজা করে, যা ঘটনা পাঠককে বিস্মিত করে।
মিরুদি স্বাভাবিক, প্র্যাকটিক্যাল এবং তার সঙ্গে দোলায়িত তোরো প্রেমে ও বিয়ের প্রস্তুতি নিলেও শেষ পর্যন্ত নাওকোর জন্যওয়াটানেবা তোরোর মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয় এবং ছাত্রাবাস ছেড়ে সে ভবঘুরের মতো এখানে-সেখানে দিন কাটাতে থাকে ঠিক যেন দেবদাস। দেবদাস যেমন ইডেন পার্কের বেঞ্চে রাত কাটাত, ঠিক তেমনি তোরোকেও দেখা যায় কখনো সৈকতে, কখনো স্টেশনের প্ল্যাটফরমে রাত কাটাচ্ছে—ছন্নছাড়া জীবন। যদিও দেবদাসের জীবন শুধু পার্বতীর ভালোবাসায় সিক্ত ছিল কিন্তু তোরোর জীবনে মিরুদি, নাওকো, বৃদ্ধা রিকো থেকে শুরু করে অনেক তরুণীর সঙ্গে রাত্রিবাস করার মধ্য দিয়ে প্রেমের সত্যটি রহস্যময়ই থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯ বছর পর তোরো জার্মানিতে কেন গেল— এমন একটি প্রশ্নও পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবে দেখা দিতে পারে।
তবে যাই হোক, নরওয়েজিয়ান উড পাঠ শেষে মন বিষাদে ছেয়ে গেলেও ওয়াটানাবো তোরোর একটি উক্তি যেন জীবনকে স্বপ্নময় করে তোলে, It’s because of you when I’m in bed in the morning that I can wind my spring and tell myself I have to live another good day.
তোরো, নাগাসাওয়া, রিকো ও মিরুদির জীবনের শেষ পরিণতি সম্পর্কে পাঠক হিসেবে জানার ব্যাকুলতা থাকলেও পরিণতি সম্পর্কে জানা যায়নি— লেখক পরিপক্ক কুশীলবের মতো মঞ্চের পর্দা ফেলে পাঠককে ভাবনার অতলে রেখে উপন্যাসটি শেষ করেছেন। হয়তো এখানেই উপন্যাসটির সার্থকতা।