তৃতীয় কিস্তি
এই কাহিনি বর্ণনা করেছেন সুধী সমাজে পরিচিত এবং আলোচিত বিখ্যাত লালন জীবনীকার তৎকালীন নদীয়ার অবিধাসী শ্রী বসন্ত কুমার পাল। এ জীবনী পাঠে আমার মনে হয়েছে এটি জনশ্রুতির ওপর নির্ভর করেও রচিত নয়। কারণ এখানে সে আভাসও খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমনটি পাওয়া যায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায়। বসন্ত পালের লেখায় যে বিষয়টি প্রকটভাবে মাথা চাড়া দেয় সেটি হলো-তিনি কল্পনার আশ্রয় নিয়ে এ জীবনী গ্রন্থটি রচনা করেছেন, তবে লালনের বাস্তব কিছু চরিত্রের সঙ্গে তিনি তার কল্পনার রূপ এবং রংয়ের মিশেল ঘটিয়েছেন, যা লালনের জীবনী গ্রন্থ বললে আমাদের ভুল হবে। একটি বাস্তব সত্য চিরদিনের জন্য, আমাদের সবার অজান্তেই মিলিয়ে যাবে এবং তা ডুকরে কাঁদবে নীরবে নিভৃতে। বসন্ত বাবুর লিখিত গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলা যায়-যে সময় এ গ্রন্থটির প্রকাশ, সে সময় লালন সুধী সমাজে পরিচিত, এ সম্পর্কে আবু তালিব তাঁর ‘লালন পরিচিতি’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-”লালন জীবনী প্রকাশে সর্বপ্রথম আগ্রহ প্রকাশ করেন কবি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২২ সালের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশ করে সমকালীন সুধী সমাজে লালনকে পরিচিত করে তোলেন এবং তারই অভিপ্রায়ানুসারে পরবর্তীকালে বসন্ত কুমার বাবু প্রমুখ মনীষীরা লালন গীতি তথা লালন জীবনী প্রকাশে উদ্যোগী হন এবং যথা সময় তা প্রকাশিতও হয়।” বসন্ত পালের (১৮৯০-১৯৭৫) ‘লালন শাহ’ নামক রচনা ছাপা হয়েছিল কলকাতার ‘প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩৩২-(১৯২৫) সালের শ্রাবণ সংখ্যায়। বসন্ত কুমার ফকির লালন সাহ এবং ‘প্রবাসী’র বৈশাখী ১৩৩৫ (১৯২৮) সংখ্যায় তাঁর মুদ্রিত আরও একটি রচনা ‘লালন সাহ’ সংযোজন- সমৃদ্ধি করে ১৩৬২ (১৯৫৫) সালে। তিনি রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের (১৮৮৮-১৯৬১) অর্থানুকুল্যে বের করেন লালন বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ ‘মহাত্ম লালন ফকির’। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ যে- ‘হিতকরী’ উপসম্পাদকীয়তে যে লেখা ছাপা হয়েছিল সেখান থেকেই বসন্ত কুমার এই গ্রন্থেও নাম নির্বাচন করেছেন। কেননা সে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ‘হিতকরী’ পত্রিকার বদলতে লালন সাহ সুধী সমাজে পরিচিত আর পরবর্তীকালে বনন্ত কুমার পাল যেসব কাজ করেছেন তা এই ‘হিতকরী’পত্রিকাকেই আশ্রয় করে এবং তিনি লালনের জীবনী হিসেবে ‘মহাত্ম লালন ফকির’ প্রণয়ন করেছেন তা লোকশ্রুতি এবং কিছু বাস্তবতার ওপর নির্ভর করে। বাংলা ভাষার খ্যাতিমান কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যার অসাধারণ লেখনী হাজার হাজার মানুষকে বিমুগ্ধ করে রাখতে পারে। তিনি ‘মনের মানুষ’ শিরোনামে একটি উপন্যাস লিখেছেন যার মূল চরিত্র লালন। এটি সর্ব প্রথম প্রকাশিত হয় পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সাময়িকী ‘দেশ’ শারদীয় ১৪১৫ সংখ্যায় । লালন নিজে জাতপাতের মুখে আগুন দিতে চেয়েছেন কিন্তু এই উপন্যাসে জাতপাতকে অনেক জায়গায় প্রকটভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসে আমরা প্রথমে দেখতে পাই-লালন কর কায়স্থ জাতের সন্তান। তাঁর নাম লালন কর হলেও সবাই তাকে লালু বলেই ডাকে। সে বসবাস করে দাস পাড়াতে। প্রথমেই তাকে দেখানো হয় একজন ঘোড়া চোর হিসেবে তবে সে অন্য চোরদের মতো চোর নয়, সে একজন শখের চোর। জমিদার কৃষ্ণ প্রসন্ন বাবু যখন লালনকে জিজ্ঞাসা করে তোমার নাম কী? সে জবাব দেয়, কর্তা এই অধমের নাম লালমোহর কর। পিতার নাম-ঈশ্বর রাধামাধব কর। তবে সবাই আমাকে লালু বলে ডাকে।
কবিরাজ কৃষ্ণ প্রসন্ন সেনের ‘বড় গিন্নির শখ হয়েছে গঙ্গা স্নানে যাবে। কবিরাজ মহাশয় এই যাত্রা পথের তল্পিবাহক হিসেবে সঙ্গে নিয়েছে লালুকে অর্থাৎ লালনকে। চারিদিকে ঘেরা পালকীতে বড় গৃহিনী, গ্রামের আরও তিনজন মাতব্বর পদব্রজে কবিরাজ মশাই ঘোড়ায় আর পেছনে পেছনে পাহারারত পাহারদার যাদু ও তল্পিবাহক লালু। পথের বহু বিপদ-আপদ কাটিয়ে বহরমপুর গঙ্গার ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।…পরদিন সকালে দেখা গেল লালুর সারা শরীরে লাল লাল গোটা বের হয়েছে অর্থাৎ জলবসন্ত হয়েছে। কবিরাজের দলটা দুদিন অপেক্ষা করলো বহরামপুর ঘাটে। তৃতীয় দিনে লালনের অবস্থার মারাত্মক অবনতি হলো। কবিরাজ বললেন ছেলেটা এত দূর এলো তবু গঙ্গা স্নানও ওর ভাগ্যে জুটলো না। যদি একবার অন্তত ডুব দিতে পারতো। যদু বললো কর্তা ওকে না পুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দিলে হয় না? কবিরাজ বললো-তাইদে, লালুর শরীর কলার ভেলায় তোলার পর কবিরাজ বললেন, ও যে হিন্দুর ছেলে ওর মুখাগ্নি হবে না? না হলে ওর আত্মার মুক্তি হবে না, তখন একটা চ্যালা কাঠে আগুন ধরিয়ে রাঘব দত্ত সেটা লালুর মুখে ঠেসে ধরে একটু মন্ত্রও পড়ে দিল।
মৃত্যুর পথযাত্রী লালনের বহনকারী কলার ভেলাটি নদীর স্রোতে অজানা পথে চলতে শুরু করল। শেষে মুসলমানদের একটি ঘাটে এসে এটি থামলো। দয়াপরবশ হয়ে রাবেয়া নাম্নী দুঃসাহসী মহিলা এই মুমূর্ষু রুগীকে নিয়ে যান এবং আন্তরিক সেবা শুশ্রূষায় লালন সুস্থ হয়ে ওঠেন। নিজের গ্রামের যাত্রাদলের লোকজন লালনকে একদিন চিনতে পারে কিন্তু গোলটা বাধে অন্য দিকে, যখন কবিরাজের লোকজন গ্রামে গিয়ে প্রচার করেছে লালনের মৃত্যু সংবাদ। লালন যাত্রাদলের নৌকায় চেপে নিজ গ্রামে পৌঁছায়। লালন ফিরে এলে দাস পাড়ায় হৈ চৈ পড়ে যায়; একজন মরা মানুষ ফিরে এসেছে। শেষ পর্যন্ত আর লালনকে দাস পাড়ায় থাকা হয় না ধর্মীয় কুসংস্কারের কারণে। সে আশ্রয় খোঁজে নির্জন জঙ্গলে। এই জঙ্গলে লালন বাস করতে থাকলে কয়েক মাসের মধ্যে আরো লোকজন আসা শুরু করল। যারা এখানে আশ্রয় নিয়েছে তারা সবাই ছিল সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত আর সমাজের সবচেয়ে দীন দুঃখী মানুষগুলো যাদের ওপর সব সময় চলেছে নির্যাতন আর নিপীড়ন।
সুনীর গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসের শেষে লেখকের বক্তব্য শিরোনামে একটা নিজের কৈফিয়ৎ দাঁড় করিয়েছেন এবং সেখানে উল্লেখ করেছেন-‘আমার এই উপন্যাসের প্রকৃত তথ্যের স্বল্পতায় অনেক কাল্পনিক চরিত্র আনতে হয়েছে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র যেমন হরিণাথ মজুমদার (কাঙ্গাল হরিনাথ নামে সমধিক পরিচিত), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগন হরকরা প্রমুখের কথা থাকলেও ঠিক ঠিক সময়সীমা মানা যায়নি। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ও উৎসাহেই লালনের গান বাংলায় শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে অনেকখানি পরিচিত হয়। কিন্তু লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কখনো প্রত্যক্ষ আলাপ পরিচয় হয়নি, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে তা প্রমাণিত। তা চরিত্র হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে আনা যায়নি। লালনের গানের একটি লিখিত সংগ্রহ রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি এমন- একটা কথা প্রচারিত আছে। এসব কথা পরস্পর বিরোধী মতামতে ভরা এবং গুজব, তা আর যোগ্যই নয় । রবীন্দ্রনাথ বাউল গানে মুগ্ধছিলেন, তার রচনায় কিছু কিছু বাউল গানের প্রভাবও পড়েছে। নিজেকেও তিনি বাউল মনে করতেন, এসব তো আমরা জানিই লালনের মূলভাব ও আদর্শ ফুটিয়ে তোলাই আমার এই রচনায় উদ্দেশ্য, কাহিনিটি আধার মাত্র।’
যে লালন সর্বদা জাত-পাতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং সচেতন থেকেছেন । কিন্তু সুনীল বাবু ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসে এই জাত-পাত বা ধর্মীয় কুসংস্কারকেই যেন বিকশিত করতে চেয়েছেন। তাইতো বললেন, ‘হিন্দুর ছেলে, তার মুখাগ্নি হবে না? না হলে যে ওর আত্মার মুক্তি হবে না।’ জাতরে হাতে পেলে লালন তাকে আগুন দিয়ে পুড়াতো। যারা জাত নিয়ে অহংকার করে তিনি নিজেও তাদের সেই জাতের বিরুদ্ধাচারণ করে বলেছেন:
১। আমি জানি না আমার সন্ধান
২। যাওয়া কিম্বা আসার বেলায় জেতের চিহ্ন রয় কাররে
৩। লালন জেতের ফাতা বিকিয়েছে সাধ-বাজারে।
সুনীল তার ‘কৈফিয়তে’ বলেছেন- এই উপন্যাসে প্রকৃত তথ্যের স্বল্পতায় অনেক কাল্পনিক চরিত্র আনতে হয়েছে। ঐতিহাসিক কিছু চরিত্র থাকলেও কোন সময় সীমা মানা হয়নি। এ গ্রন্থকে আমরা বলছি ‘উপন্যাস’ কিন্তু জীবনী বলতে পারি না। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রও লালন বা লালু, যাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের ঘটনা প্রবাহ আবর্তিত হয়েছে। একইভাবে বসন্তকুমার পালের গ্রন্থে সুনীলের মতো এভাবে ঘটনাগুলো প্রবাহিত না হলেও সুনীল বাবু এবং বসন্ত বাবুর ঘটনা প্রবাহের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তা বলা যায় না। বসন্ত বাবুও তার ‘মহাত্ম লালন শাহ’ গ্রন্থে যাকে আমরা আজ জীবনী বলছি সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনাদি ঠিক রেখে নানা কল্পনার আনয়ন করেছেন যা আজ নানাভাবেই প্রমাণ করা যায়। তিনি নানাভাবে কাহিনিতে নানারকম বিকৃতি করে ব্যবহার করেছেন। লালন গবেষক আবু তালিব তার ‘লালন পরিচিতি’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘লালন সম্পর্কিত বসন্ত বাবুর কাহিনিতে সম্ভাব্য সকল রকমের বিকৃতিই ঘছেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার জীবন -কাহিনির কাঠামোটি ঠিকই আছে। পার্থক্যের মধ্যে কাহিনি টি শুধু মাত্র ধর্মান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ মুসলিম সন্তান লালনকে হিন্দু সন্তানরূপে ধরে নিয়ে তার কাহিনির উপর হিন্দুয়ানী রং চড়ানো হয়েছে আরকি। ফলে মুসলিম সন্তান হয়েছে লালন চন্দ্র রায়, মাতা আমিনা খাতুন হয়েছে ‘পদ্মাবতী’ কায়স্থ -রমণী। বলাবাহুল্য জন্মস্থান সম্পর্কে সুম্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে এবং বহুস্থানে আখড়া ও আস্থানা থাকায় ‘হরিশপুর’ ভাড়ারায় রূপান্তরিত হয়েছে। বলাবাহুল্য এভাবে মধ্যযুগীয় বহু মুসলিম সাধক যেমন- কবীর, দাদু (ওরফে দাউদ) প্রকৃতিও হিন্দু ভক্তদের কল্যাণে হিন্দু বলে পরিচিত হয়েছে।’
এভাবেই শৈল্পিক কৌশলকে আশ্রয় করে যে গ্রন্থ রচনা করেছেন বসন্ত বাবু তা আজ লালন জীবনী হিসেবে সমধিক পরিচিত। আমার বিষয় বসন্ত বাবু এ ভাড়ারার লালনকে উপস্থাপন করার জন্য একজন মহিলাকে বেঁছে নিলেন সেখানে কি কোন পুরুষ পক্ষ ছিল না। নাকি মহিলাদের বরাত দিলে সূত্র অনেক শক্তিশালী হয়! তিনি বলেছেন- ‘তার পিতৃকুলের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেননি তবে মাতৃকুলের দিক দিয়া তাহার পরিচয় প্রদান করা হয়েছে।’ কেন তিনি পিতৃকুলের তথা সংগ্রহ করলেন না বা কেনইবা তিনি সংগ্রহ করতে পারলেন না। তা আজ সবার কাছে জানা কথা। তাও যে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন তা কোন এক বৃদ্ধা মহিলার কাছ থেকে সংগ্রহ করা!. তিনি অনেক ঘটনাকে সত্য মিথ্যা বিচার বিবেচনা না করেই নির্বিবাদে রচনা করে গেছেন যা আজ মিথ্যা কাহিনী বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তিনি তথ্যদাতার বরাত দিয়ে যেসব কথা বলেছেন তাও অনেক লোকশ্রুত বলে প্রমাণিত। তবে তার রচনার একমাত্র কাঠামো যে ‘হিতকরী’ পত্রিকা এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘হিতকরী’ পত্রিকায় যা প্রকাশিত হয়েছে তা নানা জায়গায়- বোধ হয়, থাকা অসম্ভব নয়, ছিলেন বলিয়া বোধ হয়, ইনি নাকি, হয়তো ইত্যাদি সংশয় প্রকাশ করেছেন যা আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। যদি প্রবন্ধকার নিজেই প্রত্যক্ষ দর্শনকারী হয়ে থাকেন তবে কেন এত সংশয়াতছন্ন কথার প্রকাশ, আর সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি জোরালোভাবে বলার দাবি রাখেন যে ‘হিতকরী’তে প্রবন্ধটি রচনা করেন। তিনি যদি তার সর্ম্পকে সব তথ্য বা বিস্তারিত জ্ঞান রেখেই থাকেন তবে কেন তিনি লালন গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নাম এখানে উল্লেখ করলেন না। যে লালন প্রায় প্রত্যেকটি গানেই তার গুরুর নাম তুলে ধরেছেন তবে কেন প্রবন্ধকার এড়িয়ে গেলেন নাকি লেখাটি তৈরি করার সময় সিরাজ সাঁইয়ের কথা বলতে তাঁর স্মরণ ছিল না। নাকি যার কাছ থেকে ঘটনাগুলো জানতে পেরেছেন তিনিও সিরাজ নামে যে লালনের একজন গুরু ছিলেন তাঁর নামের সাথে পরিচিত ছিলেন না? সর্ব প্রথম লালন সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেন আব্দুল ওয়ালী সাহেব। তিনিই লালনের গুরু সিরাজ সাঁইজির কথা প্রথম উল্লেখ করেন যা এর আগে কেউ উল্লেখ করেননি।
ফকীরি গান আখড়া নির্ভর গান এ গানগুলো আখড়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এসব বাউল ফকীরদের সেজন্য বিভিন্ন জায়গার গড়ে ওঠে আখড়া বা গান বাজনার আড্ডাখানা। লালন পন্থের সাধকরা কেবল যে ছেউড়িয়ার ভান্ডারা উপলক্ষে জমায়েত হয় তা নয়। আশে পাশের যতগুলো জেলা-রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুর, যশোর, নদীয়া, মুর্শিদিবাদ-সর্বত্র তাদের আখড়া ছিল। সর্বত্র ভান্ডারা বা মহোৎসব হতো। সর্বত্র সাঁইজিকে দর্শন দিতে হতো, গান শোনাতে হতো।লালন সাঁইয়ের অনেকগুলো আখড়া বাড়ি থাকলেও উল্লেযোগ্য আখড়ার একটি ছিল ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানাধীন আলমডাঙ্গা বাজারের নিকট চড়িয়া গ্রামে। আখড়াটি আলমডাঙ্গার আখড়া নামে সমধিক পরিচিত। ১৮৮১-১৮৮২ সালে মোট তিনটি কবুলিয়ৎ ও তিনটি পাট্টা সম্পাদিত হয়। তার প্রত্যেকটিতে ‘শ্রী লালন সাঁই’র সই বিদ্যমান।
লালন শাহ এই আখড়াই বসে নানা তত্ত্বগান করেছেন এবং এখানে তাঁর শিষ্যদের তথ্য বিশ্লেষণ করে শিক্ষা দিয়েছেন তত্ত্বের কঠিন তথ্য। মওলানাদের সঙ্গে একবার এখানেই বাহাস হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি আখড়ায় দায়িত্ব দেন তার ঘনিষ্ঠ শিষ্য শাকের সাঁই ওরফে শুকুর শাহকে। শুকুর শাহের কৌলিক উপাধি মোল্লা (পরেশাহ) তার পিতার নাম নযীবুল্লাহ মোল্লা। প্রথম জীবনে শুকুর শাহ হরিশ পুরের দক্ষিণ দিকসংলগ্ন কুলবাড়িয়া গ্রামের শাবান আলী নামক এক পীরের মুরিদ হন। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ইনি সমকালীন প্রবেশিকা পাশ করে কলকাতায় একটি মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি দেশে ফিরে এসে লালন শাহের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর কাছে বায়াত গ্রহণ করেন।
চলবে…